#নোনাজল
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
আসিফের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,” ওর এই ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ওর মা। আর দ্বিতীয় হচ্ছি আমি। আমাদের ভুলের কারণেই ও এমন করে।”
” মানে কি বাবা? কি বলছেন এইসব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সুনয়না।
“হ্যাঁ রে মা, আসিফের এইরকম ব্যবহারের জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের দেখেই তো ও শিখেছে।”
” বাবা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলবেন, প্লিজ?”
“হুমম, আজকে তোকে সব বলবো। অনেক আগেই তোকে এইসব জানানো উচিত ছিল। না হলে, আজকে এই দিনটা দেখতে হতো না। ”
“বাবা, একটু খোলাসা করে বলবেন প্লিজ? ”
“তোর শাশুড়ী আর আমার সম্পর্কে তোর কেমন মনে হয়?”
“মানে?”
“মানে আমাদের দাম্পত্য জীবন কেমন মনে হয় তোর?”
“ভালোই তো। আম্মা তো আপনার ভালোই খেয়াল রাখে। আপনিও তো রাখেন। কখনোই তার পছন্দের জিনিস আনতে ভুল করেন না। সেও তো আপনার পছন্দ অনুযায়ী সবই করে।”
সুনয়নার কথা শুনে আসিফের বাবা হাহা করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই বলে,” চোখের দেখাই কি সবসময় ঠিক হয় মা?”
সুনয়না থতমত খেয়ে চুপ করে থাকে৷ তাকে এইভাবে থাকতে দেখে আসিফের বাবা শান্ত গলায় বলতে শুরু করে, ” আসিফের মা আমার চাচাতো বোন। ছোট বেলা থেকেই ওর প্রতি আমার একটা সফট কর্নার ছিল। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসাও সে৷ কিন্তু, কখনোই ওকে সেভাবে বলা হয় নি। আমি ভেবেছিলাম ও আমাকে বুঝে। চাকরি পাওয়ার পর ভাবলাম আমি ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানাবো কিন্তু ওর বাবা মানে আমার কাকাই ওর আর আমার বিয়ের কথা আগেই উঠালো। আমি তো আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। ওর সাথে যখন আলাদা করে কথা বলতে গেলাম, ও জানালো ও নাকি ওর মামাতো ভাইকে ভালোবাসে। আমার যেমন খারাপ লাগছিল, তেমনি রাগও লাগছিল। ওর মামাতো ভাই ও এসে আমার হাত পা ধরেছিল যেন ওকে বিয়ে না করি। কিন্তু আমি এতো উদার ছিলাম না। আমি মানতে পারিনি ওদের ভালোবাসাকে। ওর মামাতো ভাইয়ের জব ও ছিল না যে ওকে বিয়ের কথা বলবে। ও আমাকে বলেছিল, একটা নামের সংসার হবে আমাদের। সবাই দেখবে আমরা কতো ভালো জুটি। কিন্তু আদতে ভিতরে কিছুই থাকবে না। আমিও বলেছিলাম, আমার ভালোবাসা দিয়ে তোকে আমার করে নিব।”
“তারপর কি হলো বাবা?”
” আমাদের বিয়ে হলো ধুমধাম করে। কিন্তু ওর মুখে প্লাস্টিকের হাসি। আমিতো ওকে চিনতাম। ও যে কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, আমি বুঝছিলাম। কিন্তু আমিও যে ওকে ভালোবাসি বড্ড। বিয়ের পর সবার সামনে আমরা ছিলাম রাজজোটক,কিন্তু বন্ধ দরজার আড়ালে আমাদের মানসিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারমানে এই না যে ও আমাকে অমান্য করতো। একদিন শুনলাম বাবা হবো। ভেবেছিলাম হয়তো আমাকে এইবার ভালোবাসবে একটু। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পরে আরো দূরে সরে গেল। আসিফকে নিয়েই ওর জগৎ গড়ে তুললো। ছেলেকে ছোট বেলা থেকেই বোঝালো, কোনো জিনিস বা কোনো মানুষ, যেটাকে বা যাকে, ভালোলাগবে না বা যার প্রতি ভালোবাসা আসবে না, তাকে কখনোই নিজের জীবনে জায়গা দিবে না। আসিফের মনে তখন থেকেই এই ধারণা জন্মেছে। তোমার আগেও ওর অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিল। প্রত্যেককেই ও প্রথম প্রথম অনেক মূল্য দিত। কিন্তু, একসাথে অনেকদিন থাকলে ভালো খারাপ সব সম্পর্কই হয়৷ প্রিয় গান টাও বারবার শুনলে খারাপ লাগে। সেখানে কারো প্রতি একটু বিরক্তিকর সময়ে যখন অন্য কাউকে ওর মনে ধরতো একটু, ও আগের জনের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিতো। আল্লাহই জানে, কিভাবে যে তোমার সাথে ওর বিয়ে হলো? বুঝলে তো, ওর এইরকম ব্যবহার করার পিছনে কে কতটা দায়ী? আমি আমার একটা করা ভুলের জন্য সারাজীবন কষ্ট করছি। আর আমার ছেলেটার এই ব্যবহারে সবসময়ই ওর মা সাপোর্ট করেছে। যার কারণে ওর মনে হয়, ও যা করছে, সব ঠিক৷ বাকি সব ভুল।”
সুনয়না চুপচাপ বসে আছে। আসিফকে এখন একটু হলেও ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু পরমুহুর্তে মনে হলো, আগে না হয় ছোট ছিল, এখন তো আর বাচ্চা না। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা যার নাই, তার সাথে আর যাই হোক, সম্পর্ক রাখা যায় না।
স্বর্না কোর্ট থেকে ফিরেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসিফকে ডিভোর্স দিবে। এতো অভিযোগ মাথায় করে সে বাঁচতে পারবে না। সুনয়নার বাচ্চাটার জন্য হলেও তাকে সংসারের মায়া ত্যাগ করতে হবে। সুনয়নার সংসার ভেঙেছে সে। বাচ্চাটাকে জন্মের আগেই বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করেছে সে। বাবা-মায়ের বিশ্বাস ভেঙেছে সে। তাদের কাছে দুনিয়ার যে চরিত্রটা সবচেয়ে বাজে,সেটাই সে। ছোট ভাই-বোন দুইটার স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করেছে সে। এখন তাদের অনেক কথা শুনতে হয় তার জন্য।বোনটার ও হয়তো একটা ভালো ঘরে বিয়ে হবে না।কিংবা ভাইটাও একটা ভালো পরিবারের মেয়েকে চাইলেও বিয়ে করতে পারবে না। বাবা হয়তো বাইরে গিয়ে আর মাথা উচু করে সবার সাথে কথা বলতে পারবে না। মা কে পাড়ার মহিলারা খারাপ কথা শুনাবে। মানুষের গীবত চর্চার প্রধান বিষয় হবে সে। ঘরে প্রবেশ করে একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিল সে। কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে তার। আসিফ কি সব ভুলে যাবে? তাকেও কি ভুলে যাবে? সে ভাবতে পারছে না। এই ঘরে তো সুনয়নার ও স্মৃতি ছিল। তাকে ভুলে থাকতে পারলে নিশ্চয়ই স্বর্নাকেও ভুলে যাবে।
হটাৎ ড্রয়িং রুম থেকে আসিফের চিৎকার শুনতে পেল সে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো, আসিফ ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলছে,” মা, আমি বাবা, হয়েছি। তুমি দাদি হয়েছো। তোমার নাতী হয়েছে মা। সুনয়নার ছেলে হয়েছে মা। আমাদের ছেলে হয়েছে।”
আসিফের মা প্রথমে বিষয়টা না বুঝলেও পরে বুঝতে পারে। সে গম্ভীর স্বরে বলে, “সুনয়না কি তোকে আবার সুযোগ দিবে? তোর সাথে একসাথে থাকবে?”
” থাকলে তো ভালোই। না থাকলে স্বর্নাকে নিয়ে আমি ছেলের সাথে থাকবো।”
” ও তো ছেলেকে দিবে না তোকে।”
” আমি কোর্টে ছেলের কাস্টাডি পেতে মামলা করবো মা।”
“পাগল হয়েছিস? দুধের শিশুকে দিবে তোকে?”
“তাহলে কি হবে মা?”
” কিছু বছর পরে দিবে। ছেলের কাস্টাডি বাবাকেই দেয় আর মেয়েরটা মাকে। তুই পাবি কিন্তু সময় লাগবে।”
” আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব না মা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চাই। দরকার হলে, আমি সবাইকে টাকা দিয়ে কিনে নিব তবুও…”
আসিফ কথা শেষ করার আগে তার ফোন বেজে উঠলো। নীহারিকা কল করেছে। মাকে অপেক্ষা করতে বলে সে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করে কিছু বলতেই যাবে, তার আগে অপরপাশ থেকে নীহারিকা বলে, ” আমি কোথায় বলো তো বেবি? ওহহ,স্যরি, তুমি কিভাবে জানবে? আমিই বলছি। আমি হাসপাতালে এসেছি। কেন বলোতো? তোমার ছেলেকে দেখতে। কি যে সুন্দর হয়েছে মাশাল্লাহ। একদম তোমার মতোই হয়েছে।”
আসিফ কি বলবে বুঝে পেলো না। সে আমতাআমতা করতে লাগলো। নীহারিকা হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো, ” জা/নো/য়া/র, তুই তো বলেছিলি তোর একটা বউ। ৭ মাস আগে বিয়ে করছিস।তাহলে সুনয়না কই থেকে আসলো? বাচ্চা কই থেকে আসলো? তোর চাকরি আমি যদি শেষ না করছি, তাহলে আমার নাম ও নীহারিকা না। ফোন রাখ হা/রা/মী।”
আসিফ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে এখন সে? তাহলে কি তার সব পরিকল্পনা শেষ হয়ে যাবে? তার চাকরি না থাকলে সে না সুনয়না বা ছেলেকে পাবে, না স্বর্নাকে নিয়ে হ্যাপি থাকবে? কি করবে এখন সে?
চলবে…..
অসুস্থতার জন্য কালকে গল্প দিতে পারিনি। আজকেও শব্দ কিছু কম আছে। তার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।