ডোর বেল বাজছে। একবার, দুবার, তিনবার। ইচ্ছে করেই তিনবারের মাথায় দরজা খুলে দিল সে। দরজা খুলতেই আসিফ হাসিমুখে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। স্বর্না কিছু জিজ্ঞেস করবে, তার আগেই বলে,” এতো দেরি হলো যে বেবি? ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”
“নাহ, মাথা টা ব্যথা করছিল। তাই একটু শুয়েছিলাম। ” কথাটা বলেই সে ভাবতে থাকে, একটা মানুষ কি করে এতোটা নিখুঁত অভিনয় করতে পারে? কিন্তু মুখে বললো,” ফ্রেশ হয়ে এসো। খেতে দিই।”
” নাহ, আজকে আর খাবো না। আজকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছিল, জান। তাই ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়েছি। তুমি খেয়ে শুয়ে পড়।” স্বর্নার ইচ্ছে করছিল তাকে বলতে সে এইরকম কেন করলো তার সাথে? কিন্তু সে বললো না। তাকে শান্ত মাথায় কাজ করতে হবে। এতো উত্তেজিত হলে চলবে না। খাবার টেবিলে সে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করলো শুধু। কিছুই খেতে পারলো না। কেন যেন খাবার গুলো তার গলা দিয়ে নামতে চাইছিল না। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। শ্বশুর-শাশুড়ী সবাই ঘুমুচ্ছে। আসিফ মোবাইল নিয়ে বিজি। স্বর্না ভাত নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ কারও ফোনে কল আসলো। সে হকচকিয়ে উঠলো। এটা তার বা আসিফের ফোনের রিংটোন না৷ একটু পর তার শ্বশুর রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমের পাশের বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করলো। কার সাথে কি কথা বললো, স্বর্না জানে না। তবে, যখন বের হলো বারান্দা থেকে, মনে হচ্ছিল সে যেন দুনিয়ার সবচেয়ে খুশি মানুষ। এই প্রথমবার স্বর্না তার শ্বশুরকে হাসতে দেখলো। তবে, স্বর্নার সাথে চোখাচোখি হতেই সে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল নিজের রুমে। স্বর্নাও নিজের খাবার শেষ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লো। আসিফ এখন ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। সে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, অফিসের কাজ করছে। স্বর্নার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে কি আর জানে না, অফিসে কেমন কাজ থাকে? সেও তো একই অফিসে কাজ করতো। বিয়ের পর আসিফের অনুরোধে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কারণ, অফিসে অনেকেই তারা বিবাহিত দম্পতি শুনলে বাঁকা চোখে তাকায়। আসিফ তাই তাকে বলেছিল চাকরি যেন সে ছেড়ে দেয়। আসিফের যুক্তি ঠিক ছিল, তাই সেও আর দ্বিমত করেনি। সে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দিতে লাগলো। আচ্ছা, ৭ মাস আগেও যখন সে আর আসিফ এইভাবে রাতের পর রাত জেগে গল্প করতো, তখন কি সেও এইভাবে চোখের পানি ফেলতো? সে কি স্বর্নাকে অভিশাপ দিয়েছে? তার অভিশাপেই কি তার সুখের সংসারে আগুন লেগেছে?
স্বর্না রেডি হচ্ছে বাইরে যাওয়ার জন্য। সে জানে, এই মুহূর্তে এখন যে মানুষটা তাকে শুধু বুঝবে, তার কাছে গেলেই তার শান্তি লাগবে কিছুটা। সকালে শাশুড়ীর ফোন দিয়ে মা কে কল করেছিল। মা তার কোনো কথা না শুনেই তার আওয়াজ শুনেই মুখের উপর কল কেটে দিয়েছে। ছোট বোনকেও দিয়েছিল। সে যা তা বলে অপমান করেছে। ভাইকে আর বাবাকে কল দেওয়ার সাহস হয়নি তার। মা-বোন ই যখন তাকে বুঝেনি, বাপ-ভাই কিভাবে বুঝবে?
সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে স্বর্না এগিয়ে গেল একটা প্রাইমারি স্কুল এর দিকে৷ দারোয়ান কে বললো , “আমার পরিচিত একজন এই স্কুলের টিচার। তার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
কিন্তু দারোয়ান বললো,” আমি যতদূর জানি, উনি তো ছুটিতে আছেন।”
“কেন?”
“সে তো আমি ভালোমতো জানি না। একটু অপেক্ষা করুন।” বলেই লোকটা চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এলো। তবে, একা নন। সাথে করে একজন মহিলাকে নিয়ে। মহিলাটিকে দেখে মনে হলো সে স্বর্নাকে চিনে। দেখেই চোয়াল কেমন শক্ত করে ফেললো মহিলা। অনেকটা ধমকের গলায়ই বললো,” নয়নাকে কি চাই আপনার আবার? ওর স্বামীকে ছিনিয়ে নিয়ে তার গলায় ঝুলে পড়েও কি শান্তি হয়নি? আবার কি চাই?”
দারোয়ানের সামনে এইভাবে বলায় বেশ লজ্জা পেল সে। দারোয়ান ও এদের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো। মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করলো, ” কি হলো? শং এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন যে? বলেন কি চাই?”
” সুনয়নার সাথে একটু দেখা করতে চাই। উনার ঠিকানা টা আমাকে একটু দিবেন প্লিজ? ”
” কেন? ওকে কি প্রয়োজন আপনার?”
” আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর আছে উনার কাছে। প্লিজ, বলুন না উনি কোথায়?” স্বর্না ঐ মহিলার কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করতে থাকে যেন তাকে ঠিকানা বলে৷ কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হয় না। স্বর্না বাধ্য হয়ে উনার অয়া ধরতে যায়। তখন উনার মন কিছুটা গলে আর উনি বলে যে নয়না হাসপাতালে আছে। তাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে মহিলাটি হেসে বলে,” নিজের পায়ে কুড়োল মারতে যাচ্ছো মেয়ে। যাও, যাও, সেখানে তোমার জন্য বিরাট এক সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।” বলেই সে চলে যায়। তবে, স্বর্না দমবার পাত্রী নয়৷ আজ যে করেই হোক, সুনয়নার সাথে দেখা করতেই হবে। সিএনজি ডেকে আবার উঠে পড়ে সে৷ হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে সিএনজি ওয়ালাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলে। তবে, তার মনে বেশ খটকা লাগে৷ কি এমন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেখানে তার জন্য? তবে কি সে জানতো, স্বর্না আজ আসবে এখানে।এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে এসে পড়ে হাসপাতালের সামনে। হাসপাতালের গেইট এর ভিতরে ঢুকেই সে বুঝলো, আবার একটা বোকামো করে ফেলেছে সে। এতো বড় হাসপাতালের কোথায় খুঁজে পাবে সুনয়না কে? কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ খুঁজেও যখন পেল না কোথাও, স্বর্না হতাশ হয়ে বসে পড়লো ওয়েটিং রুমের এক চেয়ারে। হঠাৎই লক্ষ্য করলো তার শ্বশুর এক মহিলার সাথে হাসতে হাসতে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। স্বর্নার যতদুর মনে পড়ে, এই মহিলাকে সে চিনে না। কোথাও দেখেও নি জীবনে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো তার কাছে। সে তাদের অনুসরণ করলো নিজেকে আড়াল করে। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মা ও শিশু ওয়ার্ডের দিকে। স্বর্নার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল। একটা কেবিনে হুট করেই তাড়া দুজন ঢুকে পড়লো। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না সে। কোনো কিছু না ভেবেই সেও কেবিনের দরজায় টোকা দিল। এরপরই সে বুঝতে পারলো, সে ভুল করেছে। এইভাবে এইখানে শ্বশুর এর পিছু নেওয়া তার উচিত হয়নি। এখন তাকে বাইরে দেখলে, ব্যাপারটা বেশ বাজে দেখাবে। সে দ্রুতই চাইলো কেবিনের সামনে থেকে সরে যেতে কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। স্বয়ং তার শ্বশুরই দরজা খুলে দিয়েছে। তাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে, সেটা তার চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সে স্বর্নাকে জিজ্ঞেস করলো, ” এইখানে কি চাই?”
” না মানে বাবা, আমি, আমি….”
” কি আমি আমি করছো? কি চাই এইখানে? হাসপাতালে কেন এসেছো?”
” আমি সুনয়নাকে দেখতে এসেছি বাবা। উনি কি এইখানে আছেন বাবা?”
“ওর কাছে কি চাই তোমার? ওর থেকে ওর সবই তো কেড়ে নিয়েছো৷ আর কি চাই?”
“বাবা, আসতে দিন ওকে। ওর কোনো দোষ নেই। ও যে শুধু একজনের মোহে পড়ে এইসব করেছে। আসতে দিন ওকে।” ভিতর থেকে কেউ একজন রিনরিনে গলায় বলে উঠলো।
উনি দরজার সামনে থেকে সরে গেলে স্বর্না ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সুনয়নার বেড এর কাছে। তবে, সে যা দেখলো, সেটা দেখার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার কোনোদিনই ছিল না। কারণ, বেডে সুনয়না একা নয়, তার পাশে একটা সদ্যজাত বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। স্বর্না যা বুঝার বুঝে নিল। এই সন্তান তার স্বামীর আর তার সতীন সুনয়নার৷ তাদের ডিভোর্স হয়েছে ৭ মাস হয়েছে। হয়তো আসিফকে জানায়নি সুনয়না। কিংবা নিজেই হয়তো বুঝে নি সে প্রেগন্যান্ট। দুয়ে দুয়ে সহজেই চার মিলিয়ে ফেললো সে৷ আচ্ছা, তার সংসার টিকবে তো? গর্ভাবস্থায় কোনো মেয়ের ডিভোর্স হয় না। হয়তো সুনয়না এখন ও পেপার এ সাইন ই করেনি। এখন কি করবে স্বর্না? আসিফ কি ফিরে যাবে সুনয়নার জীবনে? নাকি সেই নতুন মেয়ের কাছে? যেখানেই যাক, তার কাছে যে ফিরবে না, সেটা সে ভালো করেই বুঝে গেছে। কি হবে এখন? কোন দিকে মোড় নিবে পাঁচ পাঁচটা জীবন?
চলবে?….
#নোনাজল
#পর্ব_২
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা