#নীল_বুনোলতা ( ৫ )
#লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
আজ আকাশের মন ভালো নেই। গুমোট ভাব নিয়ে তার বক্ষ জুড়ে থরে থরে মেঘপুঞ্জ জমাট বেঁধে আছে। নিকষ কালো আঁধারে সকালটাকে সন্ধ্যা বানিয়ে দিল। এই বুঝি হুড়মুড়িয়ে ধরায় নামবে শ্রাবণ ঢল।
লতা ও তার বোন রুমকি তাদের ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা এক পশলা বৃষ্টির জন্য। তারপর দুইবোন মিলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে দাঁড়কাক হয়ে যাবে। লতার মুঠোফোন
বিরক্তিকরভাবে বেজে উঠল। রিসিভ করতেই দেখল সুজানার ফোন।
বৌমা তুমি বাড়ি আসছনা কেন?
আমাদের কত বড় বাড়ি খালি পড়ে আছে। আর তুমি কিনা পড়ে আছ সৎ মায়ের উপরে। নাকি সজীব নেই বলে আসতে চাচ্ছনা?
না মা। লজ্জা দিবেন না। একদম এমন কিছুনা। চলে আসবো অতি শীঘ্রই।
এত দূর। একা আসবে কিভাবে। আমি কাউকে পাঠিয়ে দিব?
না মা। লাগবেনা। আমার ভাই সবুজকে নিয়ে আসব।
আচ্ছা চলে এসো।
মোবাইল রেখে দিয়ে তড়িতেই লতা সজীবকে ফোন দিল।
মা আমাকে যেতে বলছে। কিন্তু আমার ভয় লাগে। আপনি না বললেন উনি খুনী?
আরেহ পাগলী। সেটা ঘটনা ক্রমে ঘটেছে। তাই বলে কি তোমাকেও খু’ন করবে নাকি। তোমার ইচ্ছে না হলে কয়দিন পর যেতে পারো।
নাহ। কেমন অশোভনীয় দেখায় বিষয়টা। কালই সবুজকে নিয়ে চলে যাব।
সেদিন দুপুরে বাবার বাড়ি কাজ আছে বলে মাসুদা বেরিয়ে গেল একা। আসল সন্ধ্যার দিকে। এরকম মাঝে মাঝেই মাসুদা বাবার বাড়ি কাজ আছে বলে হুটহাট বেরিয়ে যায়।
তার দুইদিন পরে সকালের দিকেই লতা চলে গেল অলকনগর গ্রামে সজীবদের বাড়ি। সাথে এলো সবুজ। লতাকে দেখে সুজানা খুশী খুশী চোখে বলল,
এই অভাগী মাকে ভুলে গেলে বৌমা?
ভুলব কেন মা। আসলে নিজের প্রিয়জনদের কাছে গেলে আর আসতে ইচ্ছে করেনা। আপনি অভাগী হবেন কেন? স্বামী নেই কেবল। তাছাড়া সবই ত আছে।
সুজানা কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলোনা। ধীর পায়ে অন্যদিকে চলে গেল।
রাতে সুজানা লতার লতার রুমে গিয়ে বলল,
বৌমা একা ঘুমাতে না পারলে চুমকিকে বলতে পার। সে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমাবে।
আচ্ছা মা। আমি চুমকিকে ডেকে নিচ্ছি।
চুমকি তার কাঁথা বালিশ নিয়ে লতার বেডরুমের নিচে বিছানা পেতে নিল।
এক দুই কথায় প্রসঙ্গ তুলল লতা।
আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
চুমকি তুমি যে সেদিন বললে এই বাড়িতে জ্বীন ভূত আসা যাওয়া করে। আমি যেন সাবধানে থাকি। কই আমারতো এমন কিছুই মনে হলনা।
লতার মোলায়েম কন্ঠে চুমকি প্রচন্ড ভরসা খুঁজে পেল। সে ইতিউতি চায়। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
ভাবি জানেন। এদের বাড়িতে আসার একমাস পর হতেই মাঝে মাঝেই কে যেন আমি রাইতে ঘুমায়া গ্যালে আমার গায়ে হাত দেয়। বাজে ভাবে সারা অঙ্গে হাতাইতে থাকে। সেটা পুরুষের হাত। এটা আমি সিউর। কে এই খাচ্চরের বাচ্চা খাচ্চর। তা আজো বুঝতে পারলাম না। এখন মনে হয় সেটা পুরুষ জ্বিন হইব। আমার দাদী বলছে জ্বীনদের স্পর্শ ঠিক মানুষের মতই। সেটা পুরুষ হোক আর মহিলা জ্বীন হোক।
লতার চোখ কপালে উঠে গেল শুনে। বিষ্পোরিত চাহনিতে চেয়ে,
কি বলছ এসব তুমি? হয়তো স্বপ্নে ভয় পাও তোমার এমন কোন অতীতের ঘটনার জন্য?
না ভাবিজান। এমুন কিছুইনা। আমি স্পষ্টই টের পাই। আমার রুমতো পুরাই আন্ধার থাকে। আমি যখন কে কে বলি। তখন চলে যায় সে। আবার লাইট জ্বালালেও কাউকেই দেখিনা।
কি বিশ্রী বিষয়। তুমি মাকে জানাওনি?
খালাম্মার কথা বলতাছেন? হ কইছি একবার। লাভ হয়নাই। উনি তুলার মতন আমার কথারে ফুঁ মাইরা উড়ায়া দিছে জ্বীন ভূতের আছর বইলা।
আচ্ছা মোট কয়বার হয়েছে এমন চুমকি?
উমমম প্রতি মাসে দুই বার করে হয়।
দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে পারনা তাহলে?
আমি ডরাই ভাবিজান। তাই চাপায়া রাখি। আমাদের বাড়িতে কোনদিন দুয়ারে খিল দিয়ে ঘুমাই নাইতো। খালাম্মা কইল কোন সমস্যা হইবনা দুয়ার না আটকাইলে। আবার আমার রুমের দুয়ারের ছিটকিনিটা ভালোমতন লাগেওনা। ঢিলা হইয়া গ্যাছে। আর সারা ঘরেতো জোয়ান কোন ছেলেও নাই। ভাইজান ত গ্রামে তেমন আসেওনা৷
লতা চিন্তিত মুখে বলল,
আচ্ছা! লাস্ট কবে ধরেছে মনে আছে?
আপনার বিয়ার চারদিন আগেও এমন হইছে।
তুমি এজন্য চলে যাবে?
হুম ভাবিজান। নইলে এখানে খাওয়া পরার অভাব নাই। বলেই আক্ষেপের সুরে চুমকি। জ্বীনের বাচ্চা জ্বীন আমার রিযিক কেড়ে নিতাছে।
তাহলে তোমারতো আরো আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিলো চুমকি?
অপার কৌতুহল নিয়ে বলল লতা।
খালাম্মা যাইতে দেয়না যে। খালি ভুলায়া ভালায়া রাখে আমারে।
তাহলে এখন যাবে কিভাবে?
অনেক আকুতি মিনতি কইরা বলছি। হেরবাদে রাজী হইলো।
আচ্ছা ঘুমাও চুমকি। তোমার ভোরে উঠতে হয়।
তার পরেরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পর লতাকে সবুজ বলল,
বুবু এখন কি তোমার কোন কাজ আছে? না থাকলে চলো এদের বাড়ির আনাচে-কানাচে থেকে বেড়িয়ে আসি।
নাহ। কাজ নেই। চল বলে দুই ভাইবোন বেরিয়ে পড়ল। তারা ঘরের দক্ষিন পাশ ধরে হাঁটতে লাগল দুই ভাইবোন। দৃষ্টিতে আটকে আসা গাছপালা দেখতে লাগল মোহাচ্ছন্ন হয়ে। পাখির কলকাকলীতে উৎসব মুখরিত বাড়ির চারপাশটা। শেষ মাথায় এসে লতা বলল,
এদিকে আয় সবুজ। তোর দুলাভাই বলল,
রইস নামে একজনের ঘর আছে ওদিকটায়। তাদের পাহারাদার।
লতা ও সবুজ এগিয়ে গেল। ছোট্ট একচালা বিশিষ্ট একটি টিনের ঘর দেখতে পেল বাগানের ধার ঘেঁষেই।
গলায় গামছা পেঁচানো রইস তাদের দেখতে পেয়েই এগিয়ে এলো। বয়স চল্লিশের মত হবে। চোখে মুখে সুখী সুখী ভাবের উজ্জ্বল প্রলেপ লেপ্টে আছে। হঠাৎ আগুন্তকের মতো তাদের দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল রইস।
বিব্রত কন্ঠে বলল,
ভাবিসাব হঠাৎ আ..আপনি এখানে? উনি কে?
ও আমার ছোট ভাই। তার সৌজন্যেই এদিকটায় আসা। আপনি রইস ভাই না?
হুম আমিই রইস।
অবাক হলেন মনে হয় আমাকে দেখে?
রইস তোতলাতে তোতলাতে বলল,
নাহ মানে। আপনার শাশুড়ী বা অন্য কেউই এদিকে কালে ভদ্রেও আসেনা তো। এর মধ্যে আপনি হলেন নতুন বউ। তাই একটু খটকা লাগল। আসেন না ভাবি ঘরের ভিতরে।
কেউ আসেনা কেন?
বাড়ির এত সুন্দর অন্দরমহল রাইখা লতায় পাতায় ঘেরা বাগিচায় কে আইব বলেন? কি দরকার হুদাই আসার। এসব সামলানোর দায়িত্ব আমার একলারই।
ওহ বুঝতে পেরেছি বলে লতা তার ঘরের ভিতরে ঢুকল। সবুজ লতাকে বলল,
বুবু আমি ওদিকটায় ঘুরে আসি। তুমি থাক।
আচ্ছা যা ভাই।
সবুজ চলে গেল পুকুরের পাড় ধরে অন্য ফলের বাগানের দিকে।
রইস ভাই আপনি একাই থাকেন এখানে?
স্মিত হেসে জানতে চাইল লতা।
আমি একলাই থাকি ভাবিসাব। তবে মাঝে সাঝে বউও আইসা থাকে দুচারদিন বেড়ানোর উদ্দেশ্য। বা যখন বাড়িতে কোন বড় ফাংশন হয়।
এই দুই রুমই না? ভালই গুছিয়ে রাখেন দেখছি। আপনি খাওয়া দাওয়া করেন কোথায়?
হ্যাঁ। দুই রুমই যথেষ্ট আমার লাইগা। ওই যে মাটির চুলা আছে। আমিই রান্না করি। বা অনেক সময় আপনাদের ঘরেও খাই। খালাম্মা আগেই বইলা দেয় খাওনের জন্য।
ভয় পাননা রইস ভাই?
নাহ। কিসের ভয়। রাইতে ঘরের চাইরপাশেই হাই ভোল্টেজের বাত্তি জ্বলে। বাগিচার ভিতরেও বাত্তি জ্বলে। সারা বাড়িতেই বহু বাত্তি সেট করা আছে।
আইচ্ছা থাকেন রইস ভাই। বলে লতা রইসের ঘরের পিছন দিকটায় গেল।
রইস ভীতসন্ত্রস্ত চোখে লতার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। বাধা দিতে গিয়েও পারলনা।
লতা দেখল আরেকটা একচালা টিনের ঘর। মূল বাড়ির পাশ থেকে এই ঘর দুটো কারোই চোখে পড়েনা। চতুর্দিকে বড় বড় ঝোপালো গাছ দ্বারা আবেষ্টিত। আচম্বিতে লতার কানে একাধিক মেয়েলী কন্ঠের গোঙানির আওয়াজ এলো। লতা বিস্মিত হলো গোপনে। তার মাথা ভনভন করে উঠল। অনুধাবন করার চেষ্টায় একটু কান পেতে ধরল টিনের সাথে। কম বয়েসী মেয়েগুলোর কন্ঠ থেকে বিশ্রী রকমের অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে কোন পুরুষ কন্ঠের টু শব্দটিও লতা শুনতে পেলনা।
সে পা ঘুরিয়ে রইসের ঘরের সামনে এলো। চমকিত কন্ঠে জানতে চাইলো।
পিছনের ওটা কিসের ঘর রইস ভাই?
রইসের ঝটপট উত্তর। ওটা গোলাঘর ভাবি। অনেক ধান হয় উনাদের।শতমন ধান এখানে মজুদ আছে। এই ধানের নিরাপত্তার জন্যইতো আমার ঘর এইখানে।
ওহ বুঝলাম বলে লতা চলে গেল। গলার গামছা দিয়ে ঢলে কপাল থেকে চিকন ঘামগুলো মুছে নিল রইস।
সবুজ এগিয়ে আসছে। লতা পা বাড়িয়ে সবুজের কাছে চলে গেল। সবুজের কাছে বিষয়টা গোপন রাখল।
লতা ঘরে গিয়ে আলতাফ মিয়ার রুমের ভিতরে উঁকি দিল দরজার ফাঁক দিয়ে। দেখল সে কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে খাটের উপরে।
লতা মনে করতে লাগল,
বহুদিন আগে দাদী তাকে একটা শোনা ঘটনা বলেছে। সেই ঘটনার কিছু অংশ যেন আজকের বিষয়টার সাথে মিলে গেল।
#চলবে — ৫