নীলাম্বরে জোছনা পর্ব ৮

0
387

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-৮

প্রফেসার আদিল চৌধুরী নিউইয়র্কের একটা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রফেসার।আটত্রিশ বছর বয়সি ইয়াং ব্যাচলার প্রফেসার। আজ দীর্ঘ তিন বছর পর দেশে ফিরছে।গাড়ীর সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো এক রমনীর মুখশ্রী।

মনে মনে আদি বলছে সফলতা খুঁজতে যেয়ে তোমাকে হারিয়ে ফেললাম! সফলতা পেলাম তবুও শান্তি অর্জন করতে পারলাম না।
একটা সময় মনে হয় সফলতা ছাড়া জীবন অর্থহীন। ভালো তো চাইলেই বাসা যায়। কিন্তু পরবর্তীতে সব পেয়ে যাওয়ার পরেও সেই হারানোর ভালোবাসা ফিরে পাওয়া যায় না। সব থেকেও কি যেনো নেই, কি যেনো এক অদৃশ্য শূন্যতা আমাদের ঘীরে রাখে। ‘ঠিক তখন আমরা বুঝতে পারি ভালোবাসা ছাড়া জীবন মূল্যহীন।

ততদিনে সব কিছু হারিয়ে যায়! চাইলেও আর ফেরাতে পারিনা সে-সব।


আজকে স্কুলে হাফ ক্লাস হয়েছে। ক্লাস শেষ করে আদুরী। টিউশন পড়াতে আসলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে। নাজিয়াদের বাসায় আসলো। নাজিয়া ক্লাস এইটে পড়ে,নাজিয়ার বাবা এডভোকেট। অহনা আদুরী দেখে বললো, তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে! অসুস্থ নাকি?

– না আপা তেমন কিছু না একটু টায়ার্ড লাগছে এই আরকি। নাজু কই?

– তুমি বসো আমি নাজুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর হ্যা শুনো পড়া শেষ করে একানেই ফ্রেশ হবে। আজকে দুপুর আমার বাসায় খেয়ে তবেই যাবে।

– আপা আমার যে একটু তাড়া ছিলো!

– ওসব বাহানা দিলে চলবে না। খেয়ে তবেই যাবে। একদম কোন অজুহাত চলবে না।

-আদুরী আর কিছু বললোনা। ইদানীং কারো সাথে তর্ক করতে ভালো লাগে না। কেউ যদি ভর দুপুরেও বলে এখন গভীর রাত তাও মেনে নিয়ে চুপ থাকতে ইচ্ছে করে।

মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন নিজের মধ্যে কোন ফিলিংস কাজ করে না। কোন কিছু নিয়ে উচ্ছাস থাকে না। কোন আশা থাকে না। বেঁচে থাকতে হবে এ নিয়মে বেঁচে থাকে। তাদের জীবনে মৃত্যু ছাড়া আর কোন কিছুর অপেক্ষা থাকে না।


মিফতাজ এসে পৌঁছালো আয়াতের রুমে,হুট করেই মিফতাজের কেমন হাসফাস লাগতে শুরু করলো।কেমন দম বন্ধ কর পরিবেশ।মিফতাজের ইচ্ছে করছে এক ছুটে পালাতে।
রুনা বেগম মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো আয়াত।
আয়াত তখন আনমনে ফ্লোরে আঁকাআঁকি করছিলো আর কি যেন গুনগুন করছিলো। একটু কাচে আসতেই মিফতাজের কানে আসলো আয়াতের গুনগুন শব্দ। কেমন পরিচিতি কন্ঠ।

রুনা বেগম নম্র স্বরে আবার ডাকলো আয়াত। এবার আয়াত ফিরে তাকালো।

গত রাতেই রুনা বেগম আয়াতের চুলে বিনুনি গেঁথে দিয়েছিল। আয়াতের পরনে একটা মেরুন রঙের কুর্তি, সব সময় আয়াত পাগলামো করে না। তবে কারো সাথে কথা বলে না। নিজেই মনে মনে কি যেন বিরবির করতে থাকে।

মিফতাজ চোখ তুলে এক পলক তাকালো আয়াতের দিকে। হুট করে চোখের সামনো নিজের ঘৃণ্য অতীত থেকে। পা টলে গেলো। হাত দিয়ে দরজার ধরলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জড়ো হতে লাগলো। এতো দিনের সব সত্যি এক মূহুর্তে কেমন মিথ্যে মনে হয়ে গেলো।

রুনা বেগম পিছু ফিরে কিছু বলার আগেই মিফতাজ কোন মতে বের হয়ে গেলো। পেছন থেকে রুনা বেগমের ডাকছেন কিন্তু এই মূহুর্তে সে ডাক মিফতাজের কানে পৌঁছালো না।
বেখেয়ালি হয়ে রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। বৈশাখ মাসের শেষের দিক ভরা দুপুর কেমন অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে শহর। কালো মেঘ ডেকে রেখেছে সব আলো। হয়তো কিছু সময়ের মধ্যে ধরনী কাঁপিয়ে ঝুম বৃষ্টি নামবে। তীব্র বাতাসে শহরের ময়লা আর ধুলোবালি উড়োউড়ি করছে। সেদিকে কোন খেয়াল নেই মিফতাজের। এই মূহুর্তে যেন জ্ঞান শূন্য মিফতাজ। যেই অতীত থেকে পিছু ছাড়াতে নিজের চোখে লেন্স ব্যাবহার করা শুরু করলো নিজের কপালের বা পাশে তিল লাগালো। নিজেকে পরিবর্তন করলো। সেই অতীত তিন বছর পর তার সামনে! ঝুম বৃষ্টিতে মাঝরাস্তা বসে চিৎকার করে বলতে লাগলো ভুল করেছিলাম। কিন্তু তোমাকে ভালোবাসায় কোন ভুল ছিলো না!মানহা আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিয়ো না। আচ্ছা এই আত্মচিৎকার কি মানহার কানে পৌঁছাবে!
দিশেহারা হয়ে একা একা চিৎকার করেই যাচ্ছে। গাড়ির দিকেও কোন খেয়াল নেই, তীব্র গতিতে একটা বাস মিফতাজের দিকে ছুটে আসছে……


মিফতাজের রুম, মিফতাজের স্টাডি রুম তন্ন তন্ন করে চিঠি খুঁজতে ব্যাস্ত আরহাম। যেনো চিঠি পেয়ে গেলেই পেয়ে যাবে তার ভিনদেশীকে। আরহাম নিজের মোবাইল থেকে বার কয়েক বার কল করেছে মিফতাজকে কিন্তু কোন রেসপন্স নেই।
হতাশ হয়ে নিজের রুমে বসে পরলো। এই একটা ক্লু আছে তার ভিনদেশীকে খুঁজে পাওয়ার। সেটা যদি না পায় তাহলে!

আরহাম নিজের রুমের ড্রয়ারগুলো চেক করতে লাগলো।
খুঁজতে খুঁজতে হুট চোখ পরলো পুরো একটা খাম। হাত বাড়িয়ে সেটা উঠিয়ে নিলো আরহাম। উপরের প্রেরকের জায়গায় লেখা,,,,,, রহস্যময়ী ভিনদেশী। আরহামের হার্ট মনে হয় এক্ষুনি লাফিয়ে বের হয়ে আসবে। এতো জোড়ে বিট করছে। খাম থেকে চিঠিঠা বের করছে। মনে হচ্ছে এখানে হয়তো শুরু নয়তো শেষ। এই চিঠি তার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি। চিঠিঠা খুলবে ঠিক এমন সময় আরহামের ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠলো। হুট করে রিংটোন আওয়াজ যেনো আরহামের হৃদয়ে আতংক সৃষ্টি করলো। এমনটা হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলো না আরহাম। কলটা রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশের মানুষটার কথা শুনে হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো। দৌড়ে বের হয়ে গেলো যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়।

দিশা বেগম আরহামকে হন্তদন্ত হয়ে বেড় হতে দেখে ঘাবড়ে গেলেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন কিন্তু নাগাল পেলেন৷ না। মিফতাজের বাবাও বাড়িতে নেই ডাক্তার দেখাতে চেন্নাই গিয়েছেন।

দিশা বেগমের মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছে। তিনি মনে মনে মানহাকে গা’লী দিতে লাগলেন। যেদিন থেকে এই বিয়ের কথা হচ্ছে সেদিন থেকেই তার ছেলের জীবন থেকে মনে হয় শান্তি চলে গেছে। তার ছেলের মুখে সেদিন থেকে কোন আনন্দ নেই উল্লাস নেই। সব সময় মুখটা মেঘে ডেকে থাকে।


আদুরী নাজিয়া কে পড়ানো শেষ করে ফ্রেশ হয়ে অহনার দেয়া একটা পেয়াজ কালার শাড়ী পরেছে। ভেজা চুলগুলো মেলে দিয়ে নাজিয়ার রুমে শুয়ে আছে। এমন সময় অহনার পাশের ফ্লাটের ভাবি আসলেন তার তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে। বাচ্চা মেয়েটার নাম ইতুমনি। ইতুর সাথে আদুরীর ভাব অগে থেকেই। ভাবি আদুরীকে দেখে বলে, তুমি একটু ইতুকে রাখো আমি অল্প সময়ের জন্য বাহিরে যাবো।

আদুরী খুশি হয়ে বলে এটা তো বেশ আনন্দের কথা আচ্ছা ভাবি ওকে রেখে যান। আমার সময়টাও ভালো কাটবে। বাচ্চা দেখলেই আদুরীর হৃদয়টা হাহাকার করে উঠে। এমন একটা বেবি সুন্দর একটা পরিবার তারও থাকার কথা। কিন্তু সে কেনো শূন্য! তার জীবনে ভালোবাসাই কি তবে কাল হলো তার জন্য?

ইতু আদুরীকে বললো, মামুনি ও মামুনি। ইতুর কথা শুনে ভাবনা থেকে বের হলো আদুরী। ইতুর মা আর আদুরী একি ভার্সিটিতে পড়তো।
আদুরী ইতুকে কোলে নিয়ে বসার রুমে আসলো।
অহনা তখন টেবিলে খাবার সাজাতে ব্যাস্ত। অহনা আড় চোখে ইতুর দিকে তাকিয়ে বলে,বাহহহ শাড়ীতে তোমাকে বেশ মানিয়েছে তো।

আদুরী নিশ্চুপ। অহনা আবার বললো জানো আজ তিন বছর পর আমার ভাই দেশে ফিরেছে। বাবা, মা তো গ্রামে থাকে। তাই এখানে উঠবে ওর সাথে আমরা কাল গ্রামে যাবো এক সপ্তাহ তোমার আসতে হবে না।

এবারও আদুরী চুপ। অহনা বললো, আদুরী কি হয়েছে তোমার? কিছু নিয়ে টেনশনে আছো?

‘আদুরী বেখেয়ালি ভাবে বললো কই নাতো।

– তাহলে এমন মন মরা হয়ে আছো যে?

আদুরী উত্তর দেবে তার আগেই কারো কন্ঠ শুনতে পেলো, কেমন আছিস আপা। এভাবে কেউ দরজা খুলে রাখে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here