নীলাম্বরে জোছনা পর্ব ১৪

0
365

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব-১৪

মানহা অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো সে সবটা খুলে বলবেই। আমি এখন যা বলবো সবটা শুনবেন, তারপর বুঝার৷ চেষ্টা করে ডিসিশন নিবেন।

‘আমি হুট করেই সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ না।

-আমি আর আয়াত আপু। তার এক ফ্রেন্ডের বার্থডে তে যাই। বার্থডে হচ্ছিল একটা পার্টি সেন্টারে। বার্থডে অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় একটা বেজে যায় ।মামি মা আগেই বলেছিল মামাকে পাঠাবে। কিন্তু আমরা মানা করে দিয়েছিলাম। পার্টি সেন্টার ছিলো পঞ্চম তলায়। আমরা দু’জন আগে বের হয়েছি।ষষ্ঠ তলায় ছিলো বার।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাওয়ার পর আয়াত আপু বলে,ইশশ পার্স তো ফেলে এসেছি!

‘আমরা দু’জন আবার গেলাম। লিফটে উঠতেই আমাদের সাথে আর একটা ছেলে উঠলো। ভয় ভয় লাগলেও আমরা দু’জনে সেটা প্রকাশ করছিলাম না। আমরা লিফটে উঠে বাটন প্রেস করতে ভুলে যাওয়াতে। ষষ্ঠ ফ্লোরে এসে নামি।

আমি সাথে সাথে আবার লিফটে উঠতে চাইলে। লোকটা ততক্ষণে আয়াত আপুর সাথে বাজে বিহেভ করা শুরু করে। আমি লোকটাকে একটা থাপ্পড় মারি। লোকটা রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে। চিৎকার করে বলে,রাজু তোরা এদিকে আয় তো।

‘আয়াত আপু লোকটার হাতে কামড় বসিয়ে দেয় আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করতে থাকি। পেছন থেকে একজন ছেলে আমাকে ধরে ফেলে।ওরা ছিলো চার পাঁচজন। আমরা অসহায় দু’জন মেয়ে মানুষ। আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে আট তলায় মানে ছাদে নিয়ে আসে।

তারপর শুরু হয় ধ্বস্তাধস্তি। এরমধ্যে আরো একজন ছেলে সেখানে আসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই ওভার ড্রাংক। কেউ হুসে নেই। এদের সাথে লড়াই করতে করতে আমাদের ড্রেসের বিভিন্ন অংশ ছিড়ে যায়।

সবার শেষ যে ছেলেটা আসে। সে প্রথমে বলে,তোরা এসব কি করছিস?

তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে,উঠে মধ্য রাতে তেজী মেয়ে পেয়েছি। এতো সহজে ছেড়ে দেবো।

আমি আর আয়াত আপু ভয়ে আতংকে আর নিজেদের মধ্যে নেই।

ছেলেগুলোর বিশ্রী হাসি আমাদের ঘা জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো।

অসহায় অবস্থা আমরা কেঁদে কেঁদে বললাম দয়া করে আমাদের যেতে দাও আমাদের এমন সর্বনাশ করবেন না প্লিজ। আপনাদের পায়ে পরি।
কিন্তু আমার এই অসহায় বাণী শোনার মত অবস্থায় তারা ছিলো না।

দু’জন ছেলে আমার উপর ঝাপিয়ে পরে। আসি নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে থাকি। এক পর্যায়ে ছাদের দেয়ালের সাথে স্বজোড়ে বাড়ি খেয়ে ফ্লোরে পরে যাই। আমার মাথা থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। চোখ বন্ধ করার আগে আমি শুধু আয়াত আপুর আত্মচিৎকার শুনেছিলাম৷

এতোটুকু বলে মানহা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়।
আরহাম মানহার সামনে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে রিলাক্স হও। আস্তে ধিরে বলো।

মানহা কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করে,
যখন আমার জ্ঞান ফিরেছে তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি। আর আয়াত আপু তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে আইসিইউতে। তার অবস্থা শোচনীয়। পরে জানতে পারি আপুকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে।

-কিন্তু এসবের সাথে মিফতাজের যোগসূত্র কি? তুমি আয়াতকে কেন নিয়ে আসতে চাইছিলে?
‘কারণ ওই শেশ ছেলেটা মিফতাজ ছিলো।

আরহাম নিজের রাগ সংযাত করছে। ঠান্ডা মাথায় কাজ করার মানুষ আরহাম হুটহাট রেগে যাওয়ার মানুষ না।

আরহাম বললো,আমি আরো সত্যি জানতে চাই সেদিন তোমার জ্ঞান হারানোর পর কি হয়েছিল! আর বাকিটুকু বলতে পারবে মিফতাজ।

‘হুম মিফতাজ আমকে পরশু রাতেই বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু ওর শারীরিক অবস্থার জন্য আমি শুনিনি।

‘তুমি মিফতাজকে মেনে নিতে পারবে?

‘হয়তো কখনো না। তবে আমি তাকে ভালোবাসি, তার সব অপরাধ তার সব খারাপ কাজ তার সকাল কিছুর ঊর্ধ্বে যেয়ে আমি তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা আর ক্ষমা করা এক জিনিস না।তবে ভালোবাসলে তার সকল খারাপ ভালো মেনে নিয়েই তাকে ভালোবাসতে হয়!

আরহাম বললো,তুমি চলে যাও ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে।

‘আপনি যাবেন না?

‘হুম যাবো নিজেকে একটু সময় দিয়ে। আচ্ছা এটা বলো, তোমার সাথে মিফতাজের পরিচয় কি ভাবে?
‘আপনার চিঠি পৌঁছে দিতে এসে। তারপর কাকতালীয় ভাবে দেখা হতে থাকে।

‘তখন তুমি চিনতে পারোনি?

‘নাহহহ সে নিজের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এনেছিলো।তারপর একদিন রাজুর সাথে তাকে দেখি। সেদিনের পর সব জানতে পারির।

‘কি করবে এখন?

‘আয়াত আপুকে সুস্থ করবো। তারপর এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো। আমি স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডা চলে যাবো।আপনি এই কথাটা এখনি কাউকে বলবেন না।

‘কার কাছ থেকে পালাতে চাইছো!
‘জানিনা, শুধু জানি আমি এই নিজের দেশ আর নিজের মানুষদের থেকে দূরে যেতে চাই।
‘শুনো অন্যদের থেকে আমরা পালাতে পারি,নিজের দুঃখ আড়াল করতে পারি,কিন্তু দিনশেষে নিজের থেকে পালাতে পারিনা!
‘আমার জীবন এইটুকু হলেও এ জীবনের বিষাদ কয়েক যুগের সমান, তাই নিজেকে নিজের সামলে নিয়ে চলতে শিখে গেছি।’দিনশেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে, মুখে হাসি টেনে ভালো আছি বলতে, অনেক আগেই অভস্ত হয়ে গেছি। একটা মানুষ যার কাঁদার জন্য কোন কাঁধ নেই, একটা মানুষ যার আবদার করার মত কোন মানুষ নেই,একটা মানুষ যার আপন বলতে, কেউ নেই! সে আর কার কাছ থেকে পালাবে!
আমার কেউ নেই, কেউ নেই। যাকে নিজের ভেবেছি, সেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দিনশেষে আমার আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেলো মানহা।

আরহাম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মানহার যাওয়ার পথে, মনে, মনে,ভাবছে কতই আর বয়েস হবে, মেয়েটার তেইশ সর্বোচ্চ! কিন্তু এতোটুকু জীবন তার বিষাদময়।সামনে থেকে দেখলে কে বলবে, ‘এই মেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসির আড়ালে এক আকাশ দুঃখ লুকিয়ে রেখেছে!


মানহা হসপিটাল আসতেই আদুরী তাকে জিজ্ঞেস করে, এতোক্ষণ কোথায় ছিলি? কোন উত্তর দেয়ার আগে এটাও মনে রাখিস আমি দেখেছি তোকে আরহামের সাথে যেতে।
‘তাহলে তো জানোই কোথায় ছিলাম।
‘না জানিনা। আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই।
‘আমি আরহামের সাথেই ছিলাম।
‘এতোদিন মা ঠিক বলতো। দেখ মিফতাজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, তুই তার ভাইয়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে আসলি!

‘আপাই!

‘একদম আওয়াজ নিচে, লজ্জা করে না তোর! আর কত নিচে নামবি?

‘আপাই তুমি ভুল ভাবছো। তুমি জানো আমি কেমন মেয়ে?

‘ভুল আগে ভাবতাম এখন একদম ঠিক ভাবছি।

‘আপাই আরহাম আয়াত আপুর ভালোবাসা। আমারা সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।আর আরহাম মানসিক রোগের ডাক্তার, তাই আরহাম ভাইয়াকে আমি সবটা বলে এসেছি।

‘মিথ্যে বললেও তার ভিত্তি থাকে। তুই গল্প বানিয়ে বলবি আর আমি বিশ্বাস করবো!

‘এটাই সত্যি, তুমি মানো আর না মানো।
‘তা তিন বছর ধরে একটা শেকল বন্দি পাগল কিভাবে প্রেম করলো!
‘আরহামের সাথে তার আগেই পরিচয় হয় আয়াত আপুর।

‘ওহহ তাই নাকি? তা আমি যতদুর জানি আরহাম দেশে ছিলোই না তাহলে?

‘তাহলে এটাই যে তারা ভার্চুয়ালি পরিচিত ছিলো।আর একদিন আমি আয়াত আপুর ফোন থেকে এসব জানতে পারি। তারপর আয়াত আপুকে না বলে আরহাম ভাইয়ার সাথে এড হই।আরহাম ভাইয়া আজকের আগে আয়াত আপুকে দেখেনি।কিন্তু ভাইয়ার সাথে দু’বার আমি ভিডিও কলে কথা বলেছিলাম।

‘তুই সত্যি বলছিস তার কি প্রামান আছে?

‘এখন যদিও কোন প্রমান নেই। সেদিন রাতে আমাদের দু’জনের ফোন ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘ দিন ফোন থেকে দূরে থাকার কারণে। পরে আইডি পাসওয়ার্ড ভুলে যাই। আ৷ কখনো আইডিতে ঢোকা হয়নি।
আমি আমার কথা বললাম বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here