নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ১৯

0
170

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

রাতের খাবারটা নিজ হাতে খাওয়ার মতো অবস্থা রইল না সেতুর হাতের।কাঁটা হাতের যন্ত্রনাই ক্ষিধে নেই বলেই কোনভাবে বেঁচে গেল।নীরু খাবার টেবিলে থাকলে হয়তো জেদ দেখিয়ে খাবার খাওয়ানোর জন্য রাজি করাত।কিন্তু নীরুও জ্বরের কবলে ঘুমিয়ে আছে।শ্বাশুড়ি বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই আর কিছু বলল না।নিষাদও বিশেষ আগ্রহ দেখাল না।সেতু যেন বিনা কৈফিয়তেই বেঁচে গেল।খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সবাই ঘরে গেল।সেতু বিছানার পাশে বসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই নিষাদ গমগমে সুরে বলে উঠল,

” তুমি না নিজের যত্ন নিতে পারো সেতু?তবে?”

সেতু চোখ তুলে চাইল।বলল,

” মানে?”

নিষাদ গম্ভীরভাবেই বলল,

” খাবার না খেয়ে নিজের যত্ন নিলে কিভাবে?”

” ক্ষিধে না থাকলে কি জোর করে খাব?জোর করে খেলেই বুঝি যত্ন নেওয়া হতো?কি আশ্চর্য!”

নিষাদ মুখ টানটান করল।ভরাট কন্ঠে শীতল রাগ মিশিয়ে বলল,

” চুপচাপ উঠে চেয়ার টেনে বসো। ”

সেতু বুঝল না।বলল,

” কেন?”

” বলছি তাই।”

কথাটা বলেই নিষাদ আর দাঁড়াল না।পা ফেলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।সেতু চুপচাপ তা দেখল।কিয়ৎক্ষন পরই নিষাদ ফিরে আসল আবারও।হাতে থালাভর্তি খাবার।সেতু কপাল কুঁচকাল।আগের মতোই বসে থেকে শুধাল,

” এসব কি?বললাম তো ক্ষিধে নেই।শুনেননি আপনি?”

নিষাদ সেতুর কথার জবাব দিল না।চাপস্বরে রাগ সমেত বলে উঠল,

” বললাম না চেয়ার টেনে বসতে?কথা কি শুনতে পাওনি তুমি?”

সেতু দমে গেল।নিষাদের কথার বিনিময়ে কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।পাশ থেকে চেয়ার টেনে বসে নিষাদের দিকে তাকাতেই নিষাদ বলল,

” এইবার ঠিক আছে।”

কথাটা বলে সেও বসল পাশে চেয়ার টেনে। নিজের হাতে সেতুর মুখে খাবার এগিয় দিয়েই বলল,

” চুপচাপ খেয়ে নিবে সেতু।”

সেতু চুপচাপ হা করল।নিষাদ আবারও বলল,

” তুমি মানে আমি,আমি মানে তুমি এমন একটা সম্পর্ক চেয়েছিলাম আমি সেতু।যেখানে তোমার সব কথা আমি জানব, আমার সব কথা তুমি জানবে।স্বামী -স্ত্রী হবে একে অপরের পরিপূরক, একে অপরের বন্ধু।এমনটাই কি নয়?”

সেতু স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে রইল।খাবার চিবুতে চিবুতেই বলল,

“হঠাৎ এসব কথা বলছেন কেন?”

” আমি কি সত্যিই তোমার মনে জায়গা করে উঠতে পেরেছি সেতু?”

সেতু চমকে তাকাল।নিষাদ মৃদু হেসে আবারও বলতে লাগল,

” আমি চেয়েছিলাম আমাদের সম্পর্কে কোন আড়াল থাকবে না সেতু।তোমার সবটা যেমন আমি জানব, তেমনই আমার সবটাও জানার অধিকার তোমার থাকবে।আমি চেয়েছিলাম আমাদের মাঝে কারোরই কোন সংকোচ না থাকুক এই সম্পর্কে।আমার সমস্যায় তুমি যেমন ঢাল হয়ে থাকবে তেমনই তোমার সমস্যায় আমি থাকব।তবে এত সংকোচ কেন সেতু?এত আড়াল কেন?এত সংকোচ, এত আড়াল নিয়ে কি একটা পুরো জীবন সংসার করা যায় সেতু?”

সেতু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। বলার মতো খুঁজে পেল ও না কিছু।চুপচাপ নিষাদের হাতে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।তারপর বলল,

” আপনি আমার সকল সংকোচ বুঝে নিতে পারেন নিষাদ, সকল আড়াল ভেদ করতে পারেন।আপনি আমায় অনেকটুকুই বুঝেন।তাই নিজেকে আর খোলা বইয়ের মতো মেলে ধরে আপনার সামনে বুঝিয়ে উঠতে পারি না নিষাদ।”

নিষাদ মানল না এই উত্তর। ত্যাড়া চাহনীতে তাকাল সেতুর দিকে।বলল,

” হ্যাঁ, আমি তো সবজান্তা! আমি তো মাল্টিট্যালেন্ট যে কোন বই না মেলেই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তু বুঝে যাব।তাই না?শোন মেয়ে, আমি কোনকালেই অতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলাম না যে বই না খুলেই সব বুঝে ফেলব।”

সেতু হালকা হেসে জবাব দিল,

” কিন্তু আপনি তো ভালোবাসার ক্ষেত্রে শুধু ব্রিলিয়ান্ট না সুপার ট্যালেন্ট ছাত্র!”

” তবে তো আমার উচিত ভালোবাসার একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।যেখানে আমি হবো ভালোবাসা সাবজেক্টের শিক্ষক।ছাত্রছাত্রীদের বসে বসে ভালোবাসা কাহাকে বলে, ভালোবাসা কি,ভালোবাসায় কি কি হতে পারে সব বুঝাব।তাই না?”

সেতু নিঃশব্দেই চমৎকার হাসল।মুখ চেপে বলল,

“সুন্দর হবে নিষাদ।আমি অপেক্ষায় রইলাম।”

নিষাদ গম্ভীরভাবে বলল,

” সত্যিই বলছি সেতু।এসব আড়াল, সংকোচ আমার কাছে ভালো লাগে না।তোমাকে সর্বপ্রথম আমাকে আপন ভাবতে হবে, ভালোবাসতে হবে, সব আড়াল আর সংকোচের অবসান ঘটাতে হবে।তোমার সব সমস্যার কথা আমায় জানাতে হবে।দুঃসময়ে পাশে থাকতে দিতে হবে।যত্ন করার সুযোগ দিতে হবে।নাহলে সত্যি সত্যিই আঁছাড় মেরে তোমায় রাস্তায় ফেলে চলে আসব। বলে রাখলাম।”

সেতু শেষের কথায় অবাক না হয়ে হেসে দিল। নিষাদ তাকাল গহীন চাহনীতে।কি সুন্দর মিষ্টি হাসি!ঠোঁট চওড়া করে বলল,

” ওভাবে হাসবে না সেতু।”

” হাসলে?”

নিষাদের ঠোঁটের হাসি গাঢ় হলো। জবাবে সাংঘাতিক ভঙ্গিতে বলল,

” মে’রে দিব একদম!”

” সত্যি?”

” না, মিথ্যে।”

কথাটা বলে আর ফিরে চাইল না নিষাদ।আলো নিভিয়ে দ্রুত বিছানায় অন্যপাশ ফিরে শুঁয়ে পড়ল।

.

হঠাৎ ঐ মধ্যরাতে মোবাইলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীরুর।জ্বরে জুবুথুবু শরীর নিয়ে তখনই ঘুম দিয়েছিল।এতক্ষনের শান্তির ঘুমটার বারোটা বাঁজানোর জন্য মোবাইলের অন্য পাশের ব্যাক্তিটাকে মনে মনে কয়েকটা কথা শোনাল।মেজাজ খারাপ করে কপাল কুঁচকাল।তারপরই মোবাইল হাতে তুলল।ততক্ষনে কল কেঁটে গিয়েছে।নীরু তাকিয়ে রইল মোবাইলের স্ক্রিনে।পুনরায় কল আসতেই থমকে তাকাল।রঙ্গনের নাম্বারটা মুঁছে দিলেও এখনও প্রত্যেকটা সংখ্যাই মনে আছে তার।কাঁপা হাতে কলটা রিসিভড করেই কানের সামনে ধরল।ঘুমুঘুমু স্বরে নিজের খারাপ গলা নিয়ে সেই প্রথম বলে উঠল,

” নমস্কার গাঁধা, কেমন আছো?”

রঙ্গন খুশি হলো না নীরুর কথায়।প্রথম দিয়ে নমস্কার বলে সম্মান দেখিয়ে পরে দিয়ে গাঁধা বলে আবারও অপমান করে দিল।রঙ্গন গলা ঝাড়ল।ব্যস্ততা নিয়ে বলে উঠল,

” যাক তোকে অন্তত পাওয়া গেল।তোর ভাই তো লাপাত্তা সে কবে থেকে!”

নীরু ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

” লাপাত্তা?লাপাত্তা হবে কেন?ও তো ওর রুমেই ছিল দেখেছিলাম।”

” তাহলে কল তুলছে না কেন তোর ভাই?তোর ভাইয়ের বোনকে কি চুরি করে তুলে এনেছি?হঠাৎ এমন রেগে যাওয়ার কারণ কি কিছুই তো বুঝলাম না।”

” গরুর বরাবরই অভিমান বেশি।হয়তো তুমি ও কিছু করেছো, যার কারণে কল তুলছে না। আই ডোন্ট শিউর,তবে মেবি তুমি বিয়ের বিষয়টা জানাওনি বলেই ও কষ্ট পেয়েছে।”

” কষ্ট পেয়েছে?ও কি তবে আশীর্বাদের অনুষ্ঠানে আসবে না?কি আশ্চর্য!মা বারবার বলছে ও যাতে আসে।”

নীরুর হঠাৎ মন খারাপ হলো।কিয়ৎক্ষন চুপ রইল।তারপর বলল,

” আমি সকালে ওর সাথে তোমার কথা বলিয়ে দিব।হবে না?”

রঙ্গন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

” তোর গলা এমন ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো শোনাচ্ছে কেন নীরু?”

নীরুর মন খারাপ ভাব কেঁটে গেল মুহুর্তেই। তেঁতে উঠে বলল,

” কি বললে আমার গলাকে?ভাঙ্গা রেকর্ড?এই এক মিনিট,তুমি এত রাত পর্যন্ত জেঁগে আছো কেন?”

রঙ্গন খুশীমনে উত্তর দিল,

” তিয়াশার সাথে কথা বলেছি এতক্ষন।তারপর তোর ভাইকে কল দিলাম। কল তুলল না, তাই তোকে কল দিলাম।”

নীরু ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে বলল,

” তিয়াশা কে?”

” যেই হোক তোর তাতে কি?”

নীরু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।অন্য সময় হলে হয়তো ঝগড়া করত।কিন্তু আজ মন চাইল না।মৃদু হেসে বলল,

“আমার কিছুই না।তিয়াশা যদি অন্য কোন মেয়ে হয় তবে এই যে রাত ধরে প্রেমালাপ করার বিষয়টা তোমার বউকে জানাতে হবে না?তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

রঙ্গন আগের মতোই খুশি গলায় শুধাল,

” তিয়াশা আমার বউয়ের নামই!উল্টো ভাবে ধরলে তুই হলি অন্য মেয়ে।তোর সাথে এত রাতে কথা বলাটা বেমানান।ইশশ, আমার বউ জানলে কি ভাববে? ”

নীরু চঞ্চল গলায় বলল,

” হু, তো আমি কি বলেছিলাম আমায় কল করতে?কল রাখো দ্রুত।আর কখনো যোগাযোগ করবে না, আর এতরাতে তো একদমই নয়।মনে থাকবে?”

” থাকবে না।তুই যে এতদিন আমায় কল করে করে আমার ঘুমের বারোটা বাঁজিয়েছিস তার প্রতিশোধ নিতে হবে না?”

নীরু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দিল,

” তখন বিষয়টা একরকম ছিল।এখনকার বিষয়টা আরেকরকম।তোমার বউ যদি জানতে পারে অন্য একটা মেয়ের সাথে তুমি কথা বিষয়টা বিচ্ছিরি দেখাবে।তোমাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।তাই না?আর তাছাড়া আমি তো তোমার মতো স্বার্থপর নই যে নিজের স্বার্থের কারণে কারো কথায় মজা লুটব বলে কল তুলব। আমি নিজেই তোমার কল দেখলে কল তুলব না।কাল থেকে কন্ট্যাক্ট নাম্বার চেঞ্জ করব।ভালো থেকো।”

” তুই এমন ভাব করছিস যেন তোর সাথে প্রেমালাপ করতে কল দিয়েছি?আশ্চর্য!নিষাদের কারণেই তো কল দিয়েছি।”

নীরু এবার রাগের চূড়ায় পৌঁছে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” তো এই বিষয়টা সারাদিন মনে ছিল না?আশ্চর্য!তুমি যোগাযোগ করবে না আর।রাখলাম।”

কথাটা বলে মুখের ওপরই কল রাখল নীরু।চুপচাপ মোবাইলটা বন্ধ করে ছুড়ে মারল রুমের ফ্লোরে।

.

নিষাদদের বাড়িতে নিলিরা আসল দুপুরের দিকেই।সাথে ছোট নিলু।পরনের লাল টকটকে জামা।নীরু একনজর তাকিয়েই চোখ উঁচিয়ে বলল,

” কিরে নিলুপাখি, তোর দাঁত নাকি তোর সাথে আর নেই?”

নিলু মুখ ফুলাল।চুপচাপ পাশে এসে বসে বলল,

” তাতে তোমার কি?তোমার নাকি বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে?একদম ভালো হয়েছে।”

নীরু মুখ কুঁচকাল।উঠে গিয়ে পা বাড়িয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতেই বলল,

” তোর যে দাঁত পড়ে গিয়েছে, এটাও ভালো হয়েছে। এবার তোর দাঁত আর উঠবে না।জীবনেও না।”

কথাটা বলেই রুমে গিয়ে সটান শুঁয়ে পড়ল।জ্বরে মাথা ব্যাথাটা বেড়েছে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল এখন দুপুর।এতক্ষনে নিশ্চয় রঙ্গনের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান শেষ বা শেষের দিকে।আচ্ছা, তার ভাই কি যাবে সে অনুষ্ঠানে?কে জানে!এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কানে আসল সেতুর কন্ঠ,

” মোবাইলটা এভাবে নিচে ফেলে রেখেছো কেন নীরু?”

নীরু সচেতন চোখে তাকাল।কাল রাতেই ফেলে রেখেছিল।আর খেয়ালই ছিল না।চোখ বন্ধ করে চঞ্চল গলায় রাগ মিশিয়ে উত্তর দিল,

” ঐ গাঁধা কল করেছিল তাই।নিজে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করে ফেলছে।আমায় কল দিবে কেন?আমার অনুভূতি সম্পর্কে জানে না সে?”

সেতু নীরুর পাশে বসল।মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” কষ্ট হচ্ছে নীরু?”

নীরু আগের মতোই চঞ্চল গলায় বলল,

” কষ্ট হবে কেন?তার সাথে কি আমার প্রেম ছিল?নাকি সে আমার স্বামী ছিল?”

” ভালোবাসতে তো।”

নীরু পাত্তা দিল না।বলল,

” উহ!আবেগ!আরো অনেকেই আসবে এমন।”

সেতু মলিন হাসল। বলল,

“আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে।কেঁদে নাও নীরু।এত হাসিখুশি থেকে নিজেকে এতোটা কঠোর প্রমাণ কেন করছো?”

নীরু চোখ বুঝে নিল।বলল,

” হাসিখুশি থাকলে কঠোর হয় কিভাবে?”

সেতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” যেভাবে তুমি হয়েছো।”

কথাটা বলে সেতু চলে হেল।নীরু চোখ মেলে চুপচাপ চেয়ে চেয়ে সেতুর যাওয়াটা দেখল।সত্যিই কি সে কঠোর হয়েছে?হাসিখুশি থাকলেই কি কঠোর হওয়া যায়?কিসব বলে গেল সেতু?

#চলবে…

[ কেমন হয়েছে?তাড়াহুড়োয় লিখেছি।ভুলত্রুটি থাকতে পারে।ক্ষমাস্বরূপ দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here