নিষ্প্রভ প্রণয় পর্ব ১৭

0
146

#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

নিষাদ আজ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল।কাল বাদে পরশু রঙ্গনের আশির্বাদের অনুষ্ঠান।তাড়াতাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যটা মূলত বোনের মন ভালো রাখা।উঁকি দিয়ে একবার নীরুর ঘরে তাকিয়েই নিজের ঘরে গেল।ঘর্মাক্ত শার্ট বিছানার উপর ছুড়ে রেখেই জামাকাপড় নিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে গেল।টানা আধঘন্টা স্নান সেরে বের হলো সতেজ মনে।রুমে সেতুকে দেখল না অবশ্য। পা বাড়িয়ে বেলকনিতে যেতেই দেখা মিলল সেতু আর নীরের।নীর হাত পা মেলে ফ্লোরে বসে আছে। সামনে তার খেলনা গাড়ি।হাত দিয়ে বারবার সেই খেলনা গাড়িটাকে ঠেলে দিচ্ছিল।একটু দূর যেতেই আবারও হাত দিয়ে তার কাছে টেনে আনছে গাড়িটাকে।নিষাদ মৃদু হাসল।হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়েই নীরের গালে হাত রাখল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” চলো ব্রো, তুমি আর আমি আজ গাড়ি চালাব একসাথে।”

নীর খুশি হলো। হাত দিয়ে ঝাপটে নিষাদের কোলে উঠল।আড়চোখে তা পর্যবেক্ষন করে হালকা হাসল সেতু।নিষাদ ব্যস্ততা দেখিয়ে নীরকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।সেতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” বাইরে যাব।যাবে তুমি?”

সেতু চোখ ঘুরিয়ে তাকাল এবার।বলল,

” সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন বাইরে গিয়ে কি হবে?”

নিষাদ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।বলে উঠল,

” আমার মাথা হবে।”

” এভাবে বলছেন কেন?”

নিষাদ ক্লান্ত চাহনীতে চাইল।গলা ঝেড়ে আবারও বলল,

” নীরু সহ বাইরে ঘুরতে যাব।ওর মন ভালো হবে ঘুরলে।সন্ধ্যা তো মাত্রই নেমেছে।যেতে চাইলে যেতে পারো।আর নীর গেলে নীরুর ও মন বেশ ভালো থাকবে।কিন্তু হঠাৎ মা মা করে কান্না জুড়ে দিলে?”

সেতু মাথা নাড়াল।নরম গলায় শুধাল,

” আচ্ছা।নীরুকে বলে আসি?”

নিষাদ বলল,

” আমি যাচ্ছি বলতে।”

সেতু আবারও হালকা মাথা নাড়াল।আর কিছু বলল না।নিষাদ নীরকে কোলে নিয়েই পা বাড়াল নীরুর ঘরে।দরজা থেকে দেখে মনে হলো নীরু বেশ মন দিয়ে পড়ছে।তবে মুখে আওয়াজ নেই।সেই ছোটবেলা থেকে হাজার বকাঝকা করেও তাকে আওয়াজ করে পড়ানো হয়ে উঠল না।নিষাদ পা বাড়িয়ে গিয়ে নীরুর পেঁছনে দাঁড়াল।এতক্ষনকার ভাবনা মুহুর্তেই ভুল প্রমাণ হলো।নীরু মন দিয়ে পড়ছে না।হাতের কলমটা দিয়ে বইয়ের উপর আঁকাআঁকি করছি।নিষাদ ভ্রু কুঁচকাল।কিসব বিচ্ছিরি অঙ্কন! মুহুর্তেই হাত দিয়ে নীরুর মাথায় চাটি মারল।নীরু সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল।নিষাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেই ঝাঝালো গলায় বলল,

” তুমি আমার পড়ার টাইমে পারমিশন না নিয়ে এসেছো কেন?আমার পড়ার ডিস্ট্রার্ব হবে না?আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি দেখতে পাচ্ছো না তুমি?”

নিষাদ আওয়াজ তুলে হেসে উঠল।নীরকে পাশে চেয়ারে বসিয়ে হাত দিয়ে নীরুর সামনে থেকে বইটা ছিনিয়ে নিল।বইয়ের পাতায় কলমের কালিতে আঁকা বিচ্ছিরি অঙ্কন গুলো দেখতে দেখতে বলল,

” এইসব?এইসব তোর পড়ালেখা?ছিঃ ছিঃ নীরু!নিলুর বইও তোর থেকে সুন্দর থাকে।তোর বই দেখে তো মনে হচ্ছে কোন এক বিখ্যাত পেইন্টারের হাতে পরে বইটার জীবন ত্যানাত্যানা হয়ে গেছে।পারমিশন নিয়ে আসলে তোর এসব বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখার সুযোগ হতো আমার?”

নীরু ভ্রু উঁচু করে তাকাল।বলল,

” অপমান করবে না একদম।আমার মতো বিখ্যাত পেইন্টার কোথাও খুঁজে পাবে না।আমি মা’রা গেলে আমার মতো আর্টিস্টের অভাবে পৃথিবী খা খা করবে দেখে নিও।সবাই তখন এই বিখ্যাত চিত্রকর্মের জন্য আপসোস করতে করতেই মরে যাবে।”

নিষাদ এবার আবারও হেসে উঠল।নীরের দিকে তাকিয়েই শুধাল,

” নীর?এই বিখ্যাত পেইন্টারের থেকে ভুলেও কিন্তু আঁকাআঁকি শিখতে যাবে না।তাহলে কিন্তু বিখ্যাত হওয়ার আগেই কুখ্যাত হয়ে যাবে!শত হোক সে খুব বিখ্যাত পেইন্টার বলে কথা!”

নীরু নাক ফুলাল।রাগে দুঃখে ফোঁসফাঁস করে শ্বাস ছাড়ল।নিষাদের হাত থেকে তার বইটা এক মুহুর্তেই ছিনিয়ে নিয়ে বলল,

” সরো এখান থেকে।কি মনে করছো?সুনাম করছো নাকি বদনাম করছো বুঝতে পারছি না আমি? এতটাই নির্বোধ আমি?”

” তুই নির্বোধ হবি কেন নীরু।তুই হলি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা।”

” মহিলা বলবে না একদম।না করলাম বিয়ে, না করলাম সংসার, না গেলাম শ্বশুড়বাড়ি তার আগেই মহিলা বলবে কেন?”

নিষাদ হাসল। বলল,

” আচ্ছা বলব না।তোকে বিয়ে দেওয়ার পর মহিলা বলব।ঠিকাছে?”

নীরু গাল ফুলিয়ে রাখল।মুখ ভার করে জবাব দিল,

” না, ঠিক নেই।আমি এসব বিয়ে টিয়ে করব না। তাই মহিলা ফহিলা ডাকার চিন্তাভাবনা বাদ দাও।”

” আচ্ছা বাদ দিলাম।”

নীরু সরু চোখে তাকাল। কিছু বলল না আর।নীরের নরম হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছিল। নীরও তা উপভোগ করছিল।নিষাদ আবারও বলল,

” নীরু?ফুসকা খাবি?”

নীরুর চোখ চকচক করল।ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সন্দেহী কন্ঠে বলল,

” হঠাৎ নিজ থেকে এই কথা বলছো?সূর্য কোনদিকে উঠল গরু?ঝেড়ে কাশো, কাহিনী কি বলো।”

নিষাদ হালকা হেসে বলল,

” কাহিনী কিছুই না।খাবি কিনা বল।ফুসকা, চটপটি সব খাওয়াব।শপিংও করতে পারিস চাইলে। বল, যাবি?”

নীরুর দৃষ্টি আরো সন্দেহভরা হলো।বলল,

” কি ব্যাপার?আজ বেতন পেয়েছো নাকি?পকেট কি আজ চকচক করছে টাকার গরমে?”

নিষাদ মুখ কালো করল।কপাল চাপডে বলল,

” এইজন্য বলে কারো উপকার করতে নেই। ভালো একটা অফার দিচ্ছি।চুপচাপ লুফে নিবি তা না তুই আমায় সন্দেহ করছিস?এই তুই আমার বোন?সবথেকে বড় কথা হলো নীরও যাবে। এবার বল, যাবি?”

নীরু কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।নিষাদকে হতাশ করে দিয়ে উত্তর দিল,

” না, আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।”

” কেন?”

” সামনে পরীক্ষা।পড়তে হবে আমায়।”

নিষাদ এবার ক্ষেপে গেল।বলল,

” দেখলাম তো তোর পড়ার নমুনা। ভালো করে ভেবে দেখ, ফ্রিতে শপিং, ফুসকা, যা ইচ্ছে তাই নিতে পারবি।লাভটা কার হবে? তোর।তাই দেরি না করে তৈরি হয়ে নে নীরু।”

নীরু ভাবল।কিয়ৎক্ষন ভেবেই ঝংকার তুলে হেসে উঠল।বলল,

” তবে আজ তোমার পকেট ফাঁকা গরু!”

.

তখন রাত দশটা।নীরুর ঘোরাঘুরির শেষ হলো না৷নিষাদ ক্লান্ত হলো।অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

” আর কত?শপিং করতে করতে তো পকেট খালি করে দিলি। ”

সেতু হাসল। নীরুর দিকে তাকিয়ে হাসির রেখা আরো চওড়া হলো।নীরু ও দাঁত কেলানো হাসি উপহার দিল।চাহনী সরু করে বলল,

” তো?আমি বলেছিলাম আসতে? তুমিই তো ঠেলেঠুলে নিয়ে আসলে।সে বেলায় কিছু হলো না?”

” ভুল হয়েছে!তোকে আর জীবনেও এভাবে বলে বলে আনা যাবে না।”

নীরুর হাসি চওড়া হলো।কোলে থাকা নীরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

” এনো না।আমি কি আসার জন্য কান্না করব নাকি?”

নিষাদ ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

” তবে এবার চল বাড়ি।”

নীরু মাথা নাড়াল কেবল।পায়ের গতি একই রাখল।মাঝেমাঝে কোলে থাকা নীরের সাথে এক আধটা কথা বলল।হেঁটে শপিং মল থেকে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসেই শ্বাস টানল।সেতু আর নিষাদও উঠল।মুহুর্তেই ঝুম বৃষ্টি নামল। নীরুর চোখ চকচক করে উঠল।বৃষ্টিতে ভেজার লোভ সামলাতে না পেরেই কোলের নীরকে পাশে বসাল।নিষাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

” আর দশ মিনিট গরু।আমি বৃষ্টিতে একটু ভিজেই চলে আসছি। কেমন?”

নীরু জিজ্ঞেস করল ঠিক।কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করল না।দ্রুত নেমে গেল গাড়ি ছেড়ে।বাইরে বর্ষার ঝুম বৃষ্টির সাথে জড়ো হাওয়া।নীরু উপভোগ করল তা।গাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূর হেঁটে হেঁটে গিয়েই হাতজোড়া দুইদিকে মেলে দিল।পরনের ওড়না সমেত গোল জামাটা ততক্ষনে ভিজে চুপসে মিলে গেল শরীরের সাথে।নীরু চোখজোড়া বন্ধ করল।বৃষ্টির দাপটে ঠান্ডা অনুভব হলো।মিহি পাতলা ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠল।মিনিট পাঁচ এভাবে কাঁটতেই কানে এল কারো চাপা কন্ঠ,

” কি আশ্চর্য!তুই এই রাতের বেলায় এখানে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে আছিস কেন নীরু?”

নীরু সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকাল।পরিচিত কন্ঠের কথা শুনে সন্দেহ হলো।তবুও চোখের সামনে যে ঐ মানুষটাই তা বিশ্বাস করল। রঙ্গনের এক হাতে বেশ অনেকগুলো শপিংব্যাগ।অন্য হাতে ছাতা।নীরু চমৎকার হাসল।শুধাল,

” বিয়ের শপিং করতে আসলে বুঝি?তোমার হবু বউও এসেছে?দেখা করিয়ে দাও তো।”

রঙ্গনের চাহনী মলিন হলো মুহুর্তে।মনে মনে নীরুর হাসিটা সহ্য হলো না।মলিন চাহনী ফেলে নীরুকে আপাদমস্তক খেয়াল করল। নীরুর ভেজা মুখে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে রইল।চিকন মিহি ঠোঁটের কম্পন করে উঠা চোখে পড়তেই দৃষ্টি সরাল দ্রুত।বলল,

” না, ও আসে নি।পরিবারের সাথে এসেছি।বিয়ের শপিং এখনও হয়নি,আশীর্বাদের জন্যই।”

নীরু মাথা নাড়াল।ডাগর চোখজোড়া দিয়ে রঙ্গনের পিঁছন দিকে তাকিয়ে বলল,

” আশীর্বাদ পরশু,আজ শপিং?যায় হোক,তোমার পরিবারের কাউকে তো দেখছি না গাঁধা।কোথায় তারা?”

রঙ্গন চাপা রাগ রেখে বলল,

” গাঁধা বললে ঠা’স করে চ’ড় দেব।তোর বড় হই আমি।”

নীরু ভ্রু জোড়া কুঁচকাল।চোখের দৃষ্টিতে সন্দেহ এঁকে বলল,

” তুমি? এইটুকু একটা ছেলে।দেখলেই তো লাগে দুইদিন আগে দুনিয়াতে এসেছো।তুমি আমার থেকে বড়?হাসালে বাচ্চা ছেলে।”

” বয়সে তোর থেকে গুণে গুণে সাড়ে আটবছরের বড় আমি।”

নীরু খিলিখিলিয়ে হেসে চঞ্চলতা সমেত বলল,

” বয়স ডাজন্ট ম্যাটার।তোমাকে দেখলে বাচ্চা বাচ্চা লাগে এটাই ম্যাটার।যাকগে,তোমার বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়নি এখনো?”

রঙ্গন হতাশ হলো।চেয়েছিল নীরু হাসিখুশি থাকুক।সুখী হোক।কিন্তু তাকে ছাড়াও এতটা সুখী? এতটা হাসিখুশি থাকবে?কেন থাকবে? উহ!বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথা হলো।ঠোঁট গোল করে শ্বাস টেনে বলল,

” হয়েছে।আশীর্বাদের সপ্তাহখানেক পর।”

নীরু হাসল।চঞ্চল গলায় শুধাল,

” ইনভাইট করবে কিন্তু বিয়ের কার্ড দিয়ে। আমি কিন্তু বেশ আরাম করে তোমার বিয়ে খাব।বুঝলে? ”

” হু,তোদের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের কার্ড দিয়ে আসব।”

” মনে রেখো কিন্তু।ভুলে গেলে কিন্তু মে’রে তোমার হাত পা ভে’ঙ্গে দিব।”

এই কথার বিনিময়ে রঙ্গনের হয়তো রাগ করা উচিত ছিল।নয়তো আওয়াজ তুলে হেসে উঠা উচিত ছিল।কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে রঙ্গন রাগল না।রঙ্গন হাসলও না।গম্ভীর স্বরে বলল,

“দেখা যাবে তা।এখানে এইরাতে? বৃষ্টিতে ওভাবে ভিজে চুপসে আছিস যে?”

নীরু আওয়াজ তুলে হাসল আবারও।হাত নেড়ে বৃষ্টির পানি ছুঁতে ছুঁতেই বলে উঠল,

” উহ!বৃষ্টি মানে ভালোবাসা গাঁধা।ভালোবাসারা যতোটা সংস্পর্শে থাকে ততোই ভালোবাসা বাড়ে।আমি তোমাদের মতো অতোটা যান্ত্রিক নই।যান্ত্রিক মনে ভালোবাসারা খুব বেশি সংস্পর্ষে থাকলেও ছুঁয়ে যেতে পারে না।আমার মন হলো সহজ, সরল, উদার।এমন মনে খুব অল্প ভালোবাসারাও জায়গা করে নেয়।বুঝলে?”

” বুঝলাম,ছাতা আনিস নি?”

নীরু রসিকতা করে বলল,

” কেন না আনলে বুঝি তোমার ছাতাখানা দিয়ে দিবে আমায়? নাকি সিনেমার হিরোর মাথার উপর ছাতা ধরবে?”

” তুই যে ইচ্ছে করেই ভিজছিস জানি আমি।তাই এই দুটোর কোনটাই করব না।বাড়ি যাবি না নাকি এখানেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকবি?”

” কি আশ্চর্য!তোমার কি মনে হচ্ছে আমি সারারাত রাস্তায় পড়ে থেকে গড়াগড়ি খাব?আমার বাড়িঘর নেই? ”

রঙ্গন হতাশ হয়ে বলল,

” তা কখন বললাম?”

” বলেছো বলেছো।যায় হোক, গেলাম আমি।”

কথাটা বলে আবারও পিঁছু ঘুরে পা বাড়াল নীরু।বৃষ্টিতে ভেজার শখটা পুরোপুরি পূরণ হলো না ঠিক।অনিচ্ছাস্বত্তেও ভেজা শরীরে গিয়ে উঠে বসল গাড়ির কোণে।গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিষাদকে বলল,

” চলো। বাড়ি যাব। ”

.

তখন বেশ রাত।নিষাদের চোখে ঘুম ধরা দিল না।তার পাশেই নীর আর সেতু ঘুমের সাগরে ডুবে আছে।নিষাদ গহীন চাহনীতে তাকাল সেতুর মুখে।রুমের হালকা আলোয় বেশ ক্লান্ত দেখাল ঘুমন্ত সেতুকে।মুখচ্ছবিতে কি ভীষণ ভয়ংকর মায়া।যে মায়ায় একবার ডুব দিলেই নিশ্চিত মৃ’ত্যু!নিষাদ আর দৃষ্টি সরাতে পারল না।অপলক ভাবে তাকিয়ে থেকে হাত এগিয়ে সেতুর কপালে আসা ছোট ছোট চুলগুলো কানে গুঁজে দিল।সঙ্গে সঙ্গে সেতু নড়চড় করল।চোখ মেলে ঘুমুঘুমু দৃষ্টিতে তাকাতেই জেগে থাকা নিষাদকে চোখে পড়ল।নিজের দিকে তাকিয়ে আছে দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমুঘুমু ভাব ছুটে গেল।অস্বস্তিতে লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হলো।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

” ঘুমাননি? ”

নিষাদ নির্বিকার তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল,

” না।”

সেতু আরো জড়োসড়ো হলো।বলল,

” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

নিষাদ হালকা হাসল।উত্তর দিল,

” ভালো লাগছে তাকিয়ে থাকতে।তাই।”

সেতু কিছু বলতে পারল না।দ্রুত উঠে বসল।বেলকনির দিকে পা বাড়িয়ে চলে গেল।কিয়ৎক্ষন পর বেলকনিকে নিষাদও পা রাখল।আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আজ আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ।চন্দ্রবিলাস করবে সেতু?”

সেতু তাকাল।অস্ফুট স্বরে বলল,

” হ্ হু?”

নিষাদ কিছু না বলে ফ্লোরে লেপ্টে বসে গেল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বলল,

” আমার পাশে একটু বসবে সেতু?”

সেতু এবার চোখ নামিয়ে ফ্লোরে বসে থাকা নিষাদের দিকে তাকাল।মাথা নাড়িয়ে হাঁটু গেড়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে পাশেই বসল।নিষাদ কিঞ্চিৎ রাগ দেখাল।চাপাস্বরে অল্প রাগ ঝেড়ে বলল,

” উহ,এটা পাশে বসা হলো?”

” তো?”

নিষাদ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,

” পাশাপাশি বসলে শরীরে শরীর ছুঁয়ে যায়। তোমার বাহু আমার বাহুতে স্পর্শ হতো।হয়েছে?”

সেতু না বুঝার ভান করে বলল,

” ক্ কি?”

” আমার শরীর ঘেষে পাশে বসো। বসে কাঁধে মাথা রাখো।”

সেতু শুনল না সেই কথা।দূরত্বও কমাল না।নিষাদ বাধ্য হয়েই সেতুর পাশে এগিয়ে বসল।সেতুর আর তার বসার মাঝে এইটুকুও দূরত্ব না রেখে হঠাৎই সেতুর মাথাটা চেপে তার কাঁধে রাখল।সেতু অবাক হলো।আর নিষাদ বিজয়ী হাসি হাসল।ঝুঁকে সেতুর কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

” এই বার ঠিক আছে।এভাবে বসে থেকে চাঁদ দেখো,আকাশ দেখো, পারলে আমাকেও দেখো। আমি কিছু মনে করব না।”

সেতুর কপোল জোড় রক্তিম বর্ণ ধারণ করল।শীতল রক্তরা উষ্ণ অনুভব হলো।চুপচাপ সেভাবেই কাঁধে মাথা রেখে স্থির রইল।নিষাদ মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,

” ভালোবাসি মেয়ে।”

সেতু মৃদু হাসল। বলল,

” এই পরিবারের মানুষগুলো এত ভালোবাসতে পারে কেন নিষাদ?আপনারা সবাই মানুষকে এতটা ভালোবাসা কি করে দিতে পারেন?”

নিষাদ উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” কে কে?”

সেতু উত্তর দিল,

” নীরু, মা আর..”

নিষাদের উৎসাহ দ্বিগুণ হলো।বলল,

” আর?”

” আপনি।”

নিষাদ খুশি হলো।মনে মনে হাসল।বলল,

” ভালোবেসে কি লাভ?তুমি যে ভালোবাসলে না। ”

” ভালোবাসা পেলেই যে ভালোবাসতে হবে নিয়ম আছে নাকি?নেই তো।”

নিষাদের কন্ঠ হঠাৎ ই উদাস হলো।বলল,

” মানে?তুমি ভালোবাসো না আমায় সেতু?সংসারটা শুধু দায়িত্বের দায়ে পড়ে করছো?”

সেতু ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলতে লাগল,

” এই পৃথিবীতে সবথেকে সহজ বোধ হয় মেয়েদের মনে জায়গা করে নেওয়া নিষাদ।মেয়েরা মায়ার প্রেমে পড়ে, যত্নের প্রেমে পড়ে, ভালোবাসার প্রেমে পড়ে।মেয়ে মন বড্ড স্বচ্ছ। আবার বড্ড জটিলও।একটা মেয়ে মন যতোই কঠিন থাকুক না কেন, মায়া-ভালোবাসায় তার মন সর্বদা আটকাবে।নরম হবে।সেই মায়া ভালোবাসাকে মাধ্যম করে আপনি বেশ দাপট নিয়েই তার মনে জায়গা করে নিতে পারবেন। কোনদিন প্রেম করবে না বলা মেয়েটাকেও আপনি ধীরে ধীরে মায়া, মমতা, যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে প্রেমের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করতে পারবেন।যেমনটা, আমিও ঝুঁকে গিয়েছি।”

নিষাদ সবটাই বুঝল। তবুও না বুঝার ভান করে বলল,

” তুমিও ঝুঁকে গিয়েছো মানে?কিসে ঝুঁকে গিয়েছো?”

সেতু অস্ফুট স্বর তুলে বলল,

” আপনাতে। ”

” ভালোবাসো আমায়?”

সেতু চুপ রইল।উত্তর দিতে পারল না।নিষাদ হাসল ঠোঁট চওড়া করে।সেতুর ফর্সা কপালে পুরু ঠোঁট ছুঁয়ে দিল মুহুর্তেই।ফিসফিসিয়ে বলল,

” চাঁদটা সুন্দর।আকাশটা সুন্দর।তুমিও সুন্দর।সবকিছুই আজ বড্ড সুন্দর লাগছে সেতু। ”

#চলবে….

[ কেমন হয়েছে?কোথাও ভুলত্রুটি থাকলে জানাবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here