নিশুতি তিথি পর্ব ২১

0
345

#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ২১
___________

৫১.
সেই কোন সকাল থেকে আঞ্জুমান মুখ তালাবদ্ধ করে রেখেছে। স্বাভাবিকও সেটা। মানসিক বিপর্যস্ত কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই শরীরী মিলনের ঝক্কি সামলানো কঠিন থেকেও কঠিনতম। কিন্তু উৎকণ্ঠা হয়ে থাকা আলী সেটা মেনে নিতে পারছে না। এতে আঞ্জুমানের মানসিক সমস্যা আরে বৃদ্ধির প্রবাণতা বেশি। ডাক্তার তো না-ই বলেছিলেন মিলনের সম্পর্কে যেতে। কোন এক সম্মোহনে দু’জনই সম্মোহিত হয়ে একত্রিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যা হওয়ার হয়েছে বলতে গেলে ভালোই হয়েছে। মনের পাশাপাশি শরীরী টানে তো আলীর সাথে স্বাভাবিক হবে, আশা করেছিল। কিন্তু পরিবেশ দেখা গেল আরো প্রকটভাবে গুমোট বেঁধেছে। আলী হাল ছাড়বে না। আবারো প্রচেষ্টা চালানোর বাহানায় বিছানায় শুয়ে থাকা আঞ্জুমানের কাছে গেল। মেয়েটা জেগেই আছে। অহেতুক ঘুমের ভান কেবল। আলী আলগোছে আঞ্জুমানের কাঁধে হাত রাখল। নিস্তরঙ্গ, স্থির হওয়ার আঞ্জুমানের গা খানিকটা কেঁপে উঠল। ঘুরিয়ে আলী নিজের দিকে ফেরালো তাকে। স্থিত হওয়া মুখটা নিজের দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে আলী শোধাল,

‘এমন চুপ করে আছিস কেন? আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? আমি তোর আগের চঞ্চলা, ছটফটে, উজ্জীবিত হওয়া ভাবটা দেখতে চাই। এমন চুপচাপ, শান্ত নদীর ঢেউ না। আগের মতো হয়ে যা না লক্ষ্মীটি। আমাকেও একটু ভালোবেসে মেনে নে।’

আঞ্জুমান এতক্ষণ যাবৎ চুপটি করে আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুনল তার যত কথা। শেষে আলীর চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হতেও দেখল। অবাক হলো খানিক, এত শক্ত, গাম্ভীর্যের মানুষটাকে তার জন্য কাঁদতে দেখে। কিন্তু প্রকাশ করল না। তবে সে সেই সকাল থেকে অবুঝ মাথায় ভেবে চলেছে তার আর আলীর সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়ে। মেনে নেওয়ার সিধান্ত তার কাছে ভালো লেগেছে। সে-ও এতিম, আলী-ও। দু’জন মানুষ দু’জনকে আগলে রাখবে। প্রত্যাশাই এটা। ভাবতে ভাবতে দেখল আলী তার মুখের ওপর ঝুঁকে আসছে। সজ্ঞানে চোখ বন্ধ করে সায় দিলো। হয়তো এটাই সম্পর্ক মেনে নেওয়ার সম্মতি।

৫২.
রিমার সাথে প্রায়ই কথা বলার চেষ্টায় জড়িত সমীর এবার আগের বারের মতো ভুলের পরিকল্পনায় মত্ত হলো। গতবার যখন বেড়াতে এলো রিমা। তার শ্যামাঙ্গী সৌন্দর্যে মোহিত সমীর ভালোবেসে ফেলল তাকে, বিবাহিত জানার পরও। নিজের ভলোবাসা কেয়ার করার সহিত বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিতে জাহির করত। মেয়েদের এসব বুঝতে পারার ক্ষমা যথেষ্ট। তাই রিমা-ও সেটা বুঝতে পেরে দূরে দূরে সরে থাকত। কিন্তু সমীর সেটা ধরতে পেরে লুকিয়ে-চুরিয়ে বোঝার প্রয়াস ছেড়ে সরাসরিভাবে বলার পরিকল্পনা করল। কিন্তু কোনকিছুতেই রিমাকে বাগে আনতে পারল না আর না একা তাকে পাওয়া গেল। সেইবার রিমাকে গেস্টরুমে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। রাগ-ক্ষোভ মিলেমিশে যখন জেদ ঘাড়ে চাপল, তখন পা গিয়ে পৌঁছাল কাঙ্ক্ষিত রুমে। যখনই পৌরুষ সত্তাটা আকস্মিকভাবে আক্রমণ করবে ঘুমন্ত রিমাকে, তখনই খেয়াল হলো আঁধারে আধো আলোয় নিজের বোন সামিয়া ওপাশে শুয়ে। কিছু করার বা সরে যাওয়ার পূর্বেই রিমা তাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দেয়। সেই চিৎকার কাল হয়ে দাঁড়ায় সমীরের জন্য। সেদিনই রাতে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা রিমা নিজের বাড়ি ফিরে আসে। সবশুনে পুলিশে দিতে চেয়েছিলেন আফজাল সাহেব। কিন্তু সামিয়া ও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রিমা পর দুঃখ মোচনের প্রবৃত্তিতা দেখায়। অতঃপর সমীরকে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে হুমকিধামকি কম দেওয়া হয়নি। সেই ঘটনা আলী শোনে অবাক, হতবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গিয়েছিল পর্যন্ত। তার স্ত্রীর জন্য কেউ এমনতরও করতে পারে ভাবনার বাহিরে ছিল। সেই ভুল পুনরায় করার ভূত চেপেছে সমীরের মাথায়। কিন্তু সেটা শেষমেশ পণ্ড হলো তার মা’য়ের কারণে। গতবার পুনরাবৃত্তি না হওয়ার পণে চোখে চোখে রাখতেন ছেলেকে, ছেলের স্বভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বিধায় বড়সড় ঝড় মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, নাহলে যে কী হতো!

৫৩.
বিকেলের নরম সোনা ঝরা রোদের স্পর্শের চেয়ে মধুতর স্পর্শে মোহিত আঞ্জুমান। ভালোবাসা এমনও হয়? প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তরও মেলে, হয়তো। নাহলে সে কেন কয়েকদিনের মাথায় আলীর ভালোবাসার নামক প্রেমের সাগরে ডুবে মরছে প্রতিনিয়ত? এত ভালোবাসা, যত্ন-আত্তিও কি তার ভাগ্যে লেখা ছিল? ছিল বলেই তাে পেল, নিজের করে একান্তে। আলীর বুকে মুখ গুঁজে প্রিয়তমর শরীরের মিষ্টি সুবাস নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতেই হাসির শব্দ মুখ তুলে তাকায়।

‘কী হইল হাসতাছেন ক্যান?’

‘ভালোবাসা পাচ্ছে দেখে।’

চোখ-মুখ কুঁচকে কপট রাগের ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ রাঙায় আঞ্জুমান। বিন্দুমাত্র না ভড়কে আলী বলল,

‘কেন তোর পায়নি?’

ঘাড় ছুঁয়ে আলীর তপ্ত নিশ্বাসে আঞ্জুমান নিজের সত্তাকে হারানো অবস্থা। কেমন কেমন অনুভূতিতে ছেয়ে শরীর জুড়ে। আঞ্জুমানের নেশা নেশা চোখের ঘোলা হাল দেখে আলী ফের শোধায়,

‘পাচ্ছে বলেই এত আদুরে বুকে স্পর্শ করছিস তুই।’

আলী তখনকার অবস্থা বুঝেই জব্দ করল তাকে এভাবে! ভেবে দুয়েক কিল বসালো আলীর প্রসস্থ বুকে। আঞ্জুমানের দু’হাতে পিছমোড়া করে কাছে টেনে নিলো আলী। খুব গভীরে নিজের স্পর্শে উন্মাতাল করে তুলল আঞ্জুমানকে। দোলনায় দোল খাওয়া কপোত-কপোতীর মজে থাকা লীলাখেলায় বাগানের পাখিরাও লজ্জায় মুখ লুকায় পাতার ফাঁকে।

‘রাতে কী খাইবেন?’

‘তুই যা খাওয়াবি।’

আলীর কথায় আঞ্জুমান ঘুরে পিছনে তাকালে আলী তাকে চোখ টিপ মারলো। সে এবার ধরতে পারল আলীর দুষ্টুমির ইঙ্গিত। শাড়ি পরা, কোমরে গুঁজা আঁচল, হাতে খুন্তি নিয়ে পাক্কা গৃহিণী ভঙ্গিমায় বেশ আদুরে লাগছে আঞ্জুমানকে। ভাবতেই অবাক লাগে আলীর, কদিন আগেও মেয়েটা তার ভয়ে কতই না তটস্থ ছিল। এখন তার ভালোবাসার চাদরে আঞ্জুমান নিজেকে আগলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। উচ্ছলতা, চঞ্চলতা ভাব উজ্জীবিত হচ্ছে ধীরেধীরে। তার এই উন্নতিতে আলীর অনেক সুবিধাও হচ্ছে, সাথে ভালোলাগাও কাজ করছে।

‘এমন চোখ রাঙাচ্ছিস কেন? ভয় পাই নাকি?’

হাতের খুন্তি নিয়ে আলীর অনেকটা কাছে এগিয়ে এলো আঞ্জুমান। আলীর ঘাড়ে দু-হাত রেখে গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে নেশাক্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘সত্যিই ভয় পান না?’

‘এভাবে চিপকে আছিস কেন?’

আমতাআমতা জবাব আলীর। অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে আসছে আঞ্জুমানের কাছে আসায়। নিশ্বাস নিতে বাঁধ সাধছে শ্বাসনালী।

‘কী করলাম আমি আবার? একটু কাছেই তো এসেছি। আর তাতেই আপনি এভাবে ঘামাইতাছেন! আহারে!’

এবার বোঝা গেল, সেরের ওপর সোয়া সেরের- চাল দিয়েছে মেয়েটা। ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আলীর। ভয়ের জায়গায় অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করল।

‘গরম লাগছে বেশ। সেজন্য ঘাম হচ্ছে। বুঝতেই তো পাচ্ছিস, গরম জিনিস তো….’

শেষের বাক্য নিচু ও চাপা স্বরে আঞ্জুমানের কোমর আঁকড়ে বলল আলী। তাতেই খেই হারিয়ে ফেলল আঞ্জুমান। প্রেমানন্দে মশগুল নতুন কপোত-কপোতী।

৫৪.
সমীর বদ্ধ উন্মাদনায় নতুন করে আগুন জ্বলাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আগুনে না জানি কে পুড়ে, ভস্মীভূত হয়। আলীর ওপর নজর রাখার জন্য মানুষ রেখেছে। সুযোগ পেলে মৃত্যু দেওয়ার আদেশ দিবে, এমন সময় নতুন তথ্য পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনে সে। ভাবতেই অবাকের চূড়ান্ত পৌঁছে গেল সমীর। যাকে পাওয়ার জন্য এতএত জল্পনা-কল্পনা, তাকে পাওয়ার পথ আলী-ই করে দিলো দ্বিতীয় বিয়ে করে। এবার খেলা জমবে বেশ, মজা অত্যাধিক।

‘রিমা, জানি কষ্ট পাবে তুমি। তবে মন খারাপ করো না। তোমাকে আগলে নিতে আমার এই বুক রয়েছে। তুমি মাথা পেতে সকল কষ্টের অবসান করো এখানটাই।’

নিজের বুকের বাঁপাশে হাত রেখে স্বগোতক্তি করল সমীর। অতঃপর উচ্চস্বরে হাসির শব্দে রুমের চার দেয়াল ভারী করে তুলল। বদ্ধ উন্মাদ, ক্ষিপ্ত দেখালো সমীরকে সেই অবস্থাতে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here