#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_০৮ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ফিহা। মাথাটা একেবারেই কাজ করছে না। খাইয়ে দেওয়ার কথা শুনে কতক্ষণ বোবার মতো বসেছিল। রক্ত মাখা তুলোটা বিনে ফেলে হাত ধুয়ে বেরোল। হাতটা যেহেতু রাতে কেটেছে, তাহলে উনি রাতেও খাননি। কালরাত থেকে না-খাওয়া মানুষটা এত শান্তভাবে চলাফেরা করছে, তা দেখে বুঝে উঠা সম্ভব না। ক্ষুধা পেট নিয়ে ভোরের জগিংটা পযর্ন্ত করে এসেছে, অথচ কাউকে কিছু বুঝতে দেননি। রান্নাঘরে ঢুকে একটা প্লেট নিয়ে দুটো পরোটা, একটু ভাজি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফিহা। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিল সাঈদ। ফিহা তার সামনে দাঁড়ালে পা-দুটো টি-টেবিল থেকে নামিয়ে ফেলল সে। ফিহা মুখোমুখি বসার জন্য কাঠের টি-টেবিলটায় প্লেট নিয়ে বসে। পরোটার ছোট্ট টুকরো নিয়ে তার ঠোঁটের কাছে ধরতেই হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। সাঈদ খাবারটা নেওয়ার জন্য সবে ঠোঁট ফাঁক করেছিল, কিন্তু ফিহার দৃষ্টি তখন দরজার দিকে থাকায় হাতটা নীচে নেমে গেছে। সাঈদ আর খেতে পারেনি। সুফিয়া দরজাটা খুলে প্রশ্ন শুরু করলে ফিহা সদ্য আগন্তকের দিকে প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্যার এখন এসেছে কেন? উনার না এগারোটায় আসার কথা? ফিহা প্লেটটা ওখানেই রেখে সুফিয়ার পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে চাইল। সালাম দিয়ে কিছু বলার পূর্বেই আগন্তুক ব্যক্তি হাসিহাসি মুখ করে বললেন,
– কী অবস্থা ফিহা? খালামনির বাসায় কেমন আছ?
ফিহা অপ্রস্তুত ঠোঁটে হাসি তাকাল। কণ্ঠস্বর নম্র করে বলল,
– ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন? বাবা তো বলেছিল আপনি এগারোটার দিকে আসবেন, কিন্তু আপনি যে সোয়া ন’টার দিকে আসলেন?
– আমার বারোটার দিকে একটু কাজ আছে ফিহা। তাই চাচ্ছি তোমার পড়াটা আগেভাগে পড়িয়ে দিতে। তোমার কী এখন অসুবিধা হবে?
ফিহা নিঃসংকোচে জানাল,
– না স্যার, আসুন। আপনি ভেতরে বসুন।
পাঁচ ফুট আট ইন্ঞ্চির ব্যক্তিটা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে রহস্যময় হাসি দিলো বসল। এ হাসির অর্থটা বুঝতে পারলেন না সুফিয়া। তার কাছে ছেলেটার কথার ধরণ, চোখের চাহনি, মুখের চাপা হাসিটা সুবোধ বালকের মতো ঠেকল না। আকাশি রঙের শার্ট পড়নে, সঙ্গে পড়েছে জিন্স। নাম ইফতেখার ইয়াসিন। ফিহার বাবা নিয়াজ উদ্দিন কোনো এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সুপারিশ পেয়ে তাকে ফিমার জন্য রেখেছিলেন। পরবর্তীতে পড়ানোর ধাঁচে মুগ্ধ হয়ে তিনি ফিহার জন্যও বহাল করেন। সেই থেকেই ইয়াসিন মাহমুদ ওদের দু’বোনের সাথে সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করে আসছে। ইয়াসিনকে ডাইনিং টেবিলে বসতে বলে ফিহা এক দৌঁড়ে দোতলায় উঠে রুমের দিকে ছুটে যায়। দূর থেকে এইটুকু দৃশ্য দেখে সাঈদ কিছুই বলল না। চুপ করে সেখান থেকে উঠে বাইরে গেল সে। চটপট করে বইগুলো নিতেই হঠাৎ ফিহা কিছু মনের পড়ার ভঙ্গিতে থেমে যায়। ও যে একটু আগে কাউকে খাইয়ে দিতে গিয়েছিল, সেটা তো সম্ভব হয়নি। ওই লোক কী নিজের হাতে খেতে পারবে? কাজটা ভালো হলো না। মানুষটার প্রতি যতই রাগ উঠুক, আজ সে না থাকলে ফিহা এখন হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে শুয়ে থাকত। বইগুলো নিয়ে বিবর্ণ মুখে নেমে এলো ফিহা। স্যারের সামনে বসতেই মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে শূন্য ড্রয়িং রুমটার দিকে তাকাল। সোফাটা খালি, প্লেটটা ওভাবেই পড়ে আছে। মানুষটা খায়নি।
.
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে বসে আছেন আফসানা। কাঁচের টেবিলের উপর ল্যাপটপ রেখে ডিলারদের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো দেখছেন তিনি। এমন সময় ডানপাশ থেকে বিপ্ বিপ্ শব্দে ফোন কাঁপতে লাগল। কলটা রিসিভ করে রকিং চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে সম্রন্ত্র সুরে বললেন,
– হ্যাঁ, সুফিয়া। বলো,
সুফিয়া চুলার তরতারিটা নেড়েচেড়ে দিতেই ব্যস্তস্বরে বললেন,
– সাঈদের হাত কাটছে আপা। কালকা রাত থিকা এহনো কিছু মুখে দেয় নাই। সকালে দেখলাম ফিহা ওর লিগা নাস্তা নিয়া গেল, পরে ওর টিচার আইছে দেইখা ওয় আর যাইতে পারে নাই। কী করমু কন তো এহন। আমার মাথায় কিচ্চু আইতাছে না। এমনে তো পোলাডারে ছাড়ন যায় না।
আফসানা মলিন মুখে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললেন। তার একমাত্র ছেলেটা এখন যোজন যোজন দূরত্ব রেখে চলে। নিজের কিছু খামখেয়ালি ভুলের জন্য একমাত্র ছেলেকে তিনি কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন। যদি সময় থাকতে বুঝতেন যে, তার ছোটো-ছোটো ভুলের জন্য তার ছেলেটা এভাবে বিগড়ে যাবে, তাহলে অতীতেই সাবধান হতেন আফসানা। সুফিয়া তরতারির নুনটা চেখে নিয়ে আবার বলে উঠলেন,
– আপনেরে সবসময় কইতাম আপা, পোলার দিকে এহন ইট্টু নজর দেন। ওর উপরে চাচাগোর ঝামেলা নিয়া রাগ ঝাইড়েন না। এহন দেখলেন তো কী হইছে? আল্লায় আমার কোলে পোলাপাইন দেয় নাই। দেয় নাই তো কী হইছে? আমি সাঈদরে নিজের পেটে ধরা পোলার মতোই আদর করছি। কিন্তু আমার আদর দিয়া তো পোলায় আপনার মায়াটা বুঝব না। ওয় তো আপনেরেই খুঁজত। ওর কথা ভাবলে ভিতরটা ফাইট্টা যায় আপা। লগের বন্ধুগুলি কী সুন্দর হৈচৈ কইরা বেড়ায়, আর সাঈদ চুপচাপ হইয়া একলা বইয়া থাহে।
চোখের কোল ঘেঁষে গরম কিছু গড়িয়ে পড়ছে আফসানার। মরহুম শ্বশুর যদি দু’হাত ধরে শেষ ইচ্ছা প্রকাশ না করতো, তাহলে ব্যবসাটার দিকে কখনো তিনি ঝুঁকতেন না। তখন সংসারের অবস্থা আহামরি সচ্ছলও ছিল না। সাঈদের বাবা সেনাবাহিনিতে যোগদানের ফলে সারাটা বছর প্রায় সেখানেই থাকতে হতো। এদিকে শ্বশুরের পূর্বপুরুষের ব্যবসাটা দেখভালের জন্য যোগ্য, বিশ্বাসী ও সৎ মানুষের দরকার ছিল। সাঈদের দুই চাচা অর্থলোভী, মিথ্যাবাদী এবং নিকৃষ্ট হওয়ার ফলে শ্বশুর মশাইয়ের কাছ থেকে শেষ ভরসাটুকু পায়নি। ফলস্বরূপ, ব্যবসার একমাত্র দায়-দায়িত্ব তিনি বড়ো বৌয়ের হাতে বুঝিয়ে একদিন শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলেন। সেই থেকে আজ অবধি রক্তমাংস এক করে ব্যবসাটা তুঙ্গস্পর্শী জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন আফসানা। আজ শ্বশুর মশাই বেঁচে থাকলে ব্যবসার অগ্রগতিটা দেখে কী খুশি-ই না হতেন! কিন্তু ছেলেটা? ছেলেটা এরকম হলো কেন? আফসানা চোখের পানি মুছে প্রসন্ন মুখে বলেন,
– তুমি না থাকলে আমার উপায় হতো না সুফিয়া। যেই অবস্থার ভেতর আমি ছিলাম, সেখানে শক্ত হাত না পেলে এতদূর আসা সম্ভব হতো না। আমার ছেলেটাকে কোনোদিন আয়ার মতো বড়ো করোনি, সবসময় দেখেছি নিজের বুকে-পিঠে মানুষ করার মতো স্নেহ দিয়েছ। কিন্তু ও যে মুখ বুজে আমাকেই খুঁজত, আমাকেই চাইতো, আমি তো টের পাইনি। ওর চাচাগুলোর যন্ত্রণায় আমি আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিয়ে এসেছি। কী ভুলটাই না করলাম! আল্লাহ্ আমাকে একদিক দিয়ে সব দিলেও অন্যদিক দিয়ে কমিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটা বড়ো হয়ে গেল সুফিয়া। নিজে নিজে চাকরিও জুটাল। মুখটা ফুটে বলেনি, ‘ মা, আমার এটা লাগবে, ওটা লাগবে ‘। সবকিছু একা একা দেখতে গিয়ে আজ নিজের কাটাকুটি নিয়েও কিছু বলে না। আমি কী করব সুফিয়া? মাথা তো আগের মতো খেলে না।
সুফিয়া চুলার আঁচটা কমিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ডাইনিং রুমের ফ্যানটা ছেড়ে সুশীতল হাওয়ায় চেয়ারে বসলে অবসন্ন সুরে বলেন,
– বয়স তো কম হয় নাই। এইবার একটা মাইয়া খুঁইজা বিয়া দেন আপা। বিয়া করলে আস্তে ধীরে পোলা ঠিক হইয়া যাইব।
আফসানা বিরস মুখে বললেন,
– বিয়ে দেওয়াটা কঠিন কাজ না সুফিয়া। সমস্যা হচ্ছে মেয়ে পছন্দ নিয়ে। ও কেমন মেয়ে পছন্দ করে, কী ধরনের সঙ্গী চায়, এসব নিয়ে কখনোই আমার সাথে আলোচনা করেনি। পঁচিশ তো কবেই পেরিয়ে গেছে। আমি যে মেয়ে পছন্দ করব তা কী ওর পছন্দ হবে?
সুফিয়া ফিচেল হেসে ফোনটা এই কান থেকে ওই কানে চেপে নিলেন। কথাটা এবার লাইনে এসেছে। সুযোগের উপর সদ্ব্যবহার করে দারুণ ঘুঁটি চালিয়ে বললেন,
– এইগুলি নিয়া ভাবেন আপা? বাড়ির মাইয়া থুইয়া আপনে বাইরে তাকাইতে যান?
আফসানা হুট করে পিঠটা সোজা করে বসলেন। কথার ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে প্রশ্নসূচকে বলেন,
– তুমি ফিমার কথা বলছ? তাহলে শুনে রাখো সুফিয়া, আমার ওকে একদমই পছন্দ না। মুখে মুখে তর্ক করা বৌ আমি চাই না। আমার বাড়ির বৌ হবে আমার মতোন। পেটে এক, মুখে এক এই ধরণের কালসাপ আমি চাচ্ছি না।
– আহা, আপনে ফিমার দিকে নজর দেন ক্যান? ঘরে কী আর মাইয়া নাই? একটা কথা হুইনা রাখেন আপা, ফিমা যদি পৃথিবীর শেষ মাইয়াও হইয়া থাহে, তবু সাঈদরে আমি বিয়া করতে দিমু না। চাল্লু মাইয়া দেখলে আমার গা কিড়কিড় করে। আর ওই ছেড়িরে দ্যাখল মনডা চায় কানের নীচে ধুমায়া মারি।
– তাহলে কী তুমি ফিহার জন্য কথা বলছিলে?
– হ। মাইয়া তো মাশাল্লাহ দিলে হাতে-পায়ে লম্বা হইয়া গেছে। আবার দুইজনের মধ্যে লুতুপুতু ঘটনাও লক্ষ করি নাই। আপনে নিয়াজ সাবের লগে এহনই কথা কইয়া দ্যাহেন। দ্যাহেন হেয় কী কয়।
– দিবে না সুফিয়া। বোনজামাই কিছুদিন আগেও একটা ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিলো। মেয়েদুটোকে অর্নাস পাশ না করিয়ে বিয়ের কথা ভাববে না।
– ওমা! তাই বইলা মাইয়া বিয়া দিতো না? এহনকার যুগে বিয়া কইরাও মাইয়ারা বাপের বাড়ি থাইক্কা পড়াশুনা করতাছে। কাবিন কইরা রাখলে সমস্যা কী?
– না, সুফিয়া। কাবিনের কথা তুললে বোনজামাই অন্য কথা দিয়ে ভুলভাল বুঝাবে। আমি চাই না সম্পর্কটা নষ্ট হোক। ফিমার বিয়েটা না হওয়া পযর্ন্ত ফিহার ব্যাপারটা নিয়ে কথা তুলতে চাচ্ছি না। আপদটা আগে বিদায় হোক।
সুফিয়া আরো কিছুক্ষণ কথা সেরে কলটা কেটে দিলেন। এটুকু বুঝতে পারলেন আফসানার মনেও ফিহাকে নিয়ে কিছু-না-কিছু চিন্তাভাবনা আছে। সম্ভবত ফিহার বাবা এইমূহুর্তে ‘ না ‘ করবেন বিধায় আফসানা ভুল সময়ে বলার মতো সাহস করেননি। সুফিয়া অজপাড়া গাঁয়ের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে এসেছেন। সাঈদের বাবার এক দূর সম্পর্কীয় ভাইয়ের বৌ ছিলেন সুফিয়া। মাতৃধারণে বেশ কিছু সমস্যা থাকায় সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য পাননি। দুঃখের সংসারে যখন স্বামীও হৃদরোগে গত হলেন, তখন আফসানা ও সোয়াদের তত্ত্বাবধানে এ বাড়িতে আসার সুযোগ পান তিনি। আজ অবধি তিনি মূল্যবান সদস্যের মতোই যথাযথ সম্মান পেয়ে আসছেন। কাজের মহিলা, কাজের বুয়া, বাচ্চার আয়া এ ধরণের কথা দ্বারা কখনো সুফিয়াকে ছোটো করা হয়নি, বরন্ঞ্চ যে পরিমাণে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তার বদৌলতে নিজের প্রাণটা পযর্ন্ত উৎসর্গ করতে রাজি আছেন।
.
ঠিক বারোটার আগে ইয়াসিনের একটা কল এলো। ফিহা ডাইনিং টেবিলে বসে বসে রসায়ন প্রথম পত্র বইটার রিডিং পড়ছিল। ওর মনটা তখন পড়ার দিকে একেবারেই ছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল বড়ো একটা অপরাধ করে ফেলেছে। একটা অভুক্ত মানুষ তার কাছে সামান্য কিছুর আবদার হিসেবে খাইয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছিল, অথচ ফিহা মনের ভুলে ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে পড়তে বসেছে। আজ স্যারটাও জলদি জলদি যাচ্ছেন না। ফোনে কথা বলার সুযোগ দেখে ফিহা একটু চোরাদৃষ্টি চালিয়ে ড্রয়িংরুমটার আশেপাশে দেখে নিল। না, মানুষটা এখনো আসেনি। বোধহয় সে বাড়িতেই নেই।
– ওখানে কী দেখছ?
আকস্মিক এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল ফিহা। চুরি হাতেনাতে ধরা পড়লে যেরূপ মুখভঙ্গি হয়, ফিহার অবস্থাও ঠিক সেরকম হয়ে গেছে। অপ্রতিভ মুখে ঠেলেঠুলে হাসি আমতা আমতা করে বলল,
– কিছু না স্যার। দেখছিলাম সুফি খালা ওখানে আছেন কি না।
– কিন্তু তোমার খালা তো ওখানে নেই। সত্যি করে বলো তো কী দেখছিলে? আজ আমি অনেকক্ষণ যাবৎ ফলো করছি তুমি প্রত্যেকটা লাইনে লাইনে ভুল করছ। কোথায় ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে বসে আছ ফিহা? কী সমস্যা!
শেষের প্রশ্নটায় কেমন সুক্ষ্ম তেজের আভাস ছিল।যদিও স্যারের মুখটা দেখলে তেমন ভয়-ডর লাগে না, কিন্তু বলার সুরটা যেন কেমনতর। ফিহা হাঁসফাঁস ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– আমি সিরিয়াস আছি স্যার। হয়তো বাসা বদল করেছি বলে মনটা এদিকে বসছে না। আপনি আমাকে হোমওয়ার্কগুলো দিয়ে যান। আমি আজ ঠিকঠাকমতো সেগুলো করে রাখব।
প্রত্যুত্তরে নীরব রইল ইয়াসিন। কিছু পড়া দাগাতে নিলে সুক্ষ্ম কায়দায় বলল,
– তুমি কী বাড়িতে একা আছ?
ফিহা এমন ব্যক্তিগত প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বাড়িতে সে একা না দোকা তা জেনে তার লাভ কী? জড়তা মুখে নিশপিশ ভঙ্গিতে বলল,
– না স্যার, একা নেই। বাড়িতে এখন তিনজন আছেন।
ইয়াসিন সহসা কলম থামিয়ে কিছু একটা ভেবে আবার বই দাগাতে ব্যস্ত হলো। ঠোঁট গোল করে বলল,
– ও, আচ্ছা। তোমার বাবার কাছ থেকে যে ঘটনা শুনলাম তাতে তুমি একা থেকো না। বিশেষ করে এই বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ না থাকলে তোমার একা থাকাটা একটু রিস্কি।
ফিহা বুঝতে পারছে না, বাবা কেন ঘরোয়া সমস্যাগুলো স্যারের কাছে বলেছে। বাবা তো এরকম কিছু করে না। ফিহা প্রশ্নের ঝুলিটা মাথায় রেখে মৃদু স্বরে বলল,
– আমি তো এখানে একা নই স্যার। বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষ আছেন। তাছাড়া আমার সমস্যা হওয়ার কথা না। বাইরে দুটো গার্ড সবসময় পাহারা দিয়ে থাকে। উলটাপালটা কিছু দেখলে সুফি খালাও রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে আসবে।
হালকা একটু হেসে ব্যাপারটা রসাল করল ইয়াসিন। লাল কালিতে মার্ক টেনে বলল,
– যে পুরুষের কথা একটু আগে বললে সে কী তোমার ভাই? তোমার যে আরো একটা কাজিন আছে জানতাম না তো।
– দীপ ভাইয়ের সাথে আপু আর আমি যতটা ক্লোজ আচরণ করি, উনার সাথে কখনো সেটা করতাম না। তাই উনার বিষয়ে কথাবার্তা উঠত না
ফিহা অকপটে কথাগুলো বলে দিলেও ইয়াসিন যেন আরেকটু ধারণা পাবার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল। গলাটা খাঁকারি দিয়ে একটু চালাকি করে বলল,
– তোমার দীপ ভাইয়ের ছোটো তাই না? ওহো! এক মিনিট, সে কী ফিমার বয়সী নাকি?
ফিহা সাথে সাথে সেটা খারিজ করে কাঙ্ক্ষিত কথাটা বলল,
– না না, আপুর বয়সী কেন হবে? উনি তো সবার বড়োজন। দীপ ভাইয়াও উনার দুই বছরের ছোটো। উনার সাথে তেমন যোগাযোগ করি না বলে কখনো উনার বিষয়ে কিছু বলিনি।
ইয়াসিনের ধারণাই তাহলে ঠিক। বাইরে যে রোলস রয়েস ব্রান্ডের ক্যালিনান গাড়িটা দেখেছে, সেটা তাহলে ব্যক্তিরই হবে। কেননা, এতোটা দামী রাখার মতো শৌখিনতার রুচি মহিলাদের ক্ষেত্রে সচরাচর হয় না। ইয়াসিন সমস্ত পড়া দাগিয়ে দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিল। স্যারকে বিদায় জানিয়ে দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে আপন চিন্তায় মগ্ন হলো ফিহা। অন্ততপক্ষে খেয়েছে কিনা এটুকু জানতে পারলে টেনশন থাকবে না। পরক্ষণে আবারও চিন্তা করে তাঁর খোঁজ নিয়ে ওর দরকারটা কী? তার চেয়ে ভালো নিজের রুমে গিয়ে, গোসলটা সেরে, বাদবাকি পড়াগুলো রেডি করা। ফিহা সমস্ত চিন্তা বাতিল করে শেষ কথাটার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বসল। গোসল সেরে, কাপড় নেড়ে, দুপুরের খাবারটাও সুফিয়ার সাথে খেয়ে নিল। ঘড়িতে বেজে গেল দুইটা। সুফিয়া দুপুরের ভাতঘুমের জন্য রুমে চলে গেলে এদিকে ফিহা আচারের বয়াম নিয়ে ছাদে প্রবেশ করে। আজ জমিয়ে আচার খাবে! বিরাট মাঠের মতো খোলামেলা ছাদ। ধূ ধূ প্রান্তরের মতো সাদা মেঝেটা চকচকে টাইলসে ঢেকে আছে, ডানদিকে ছোট্ট একটা চিলেকোঠা দাঁড়িয়ে আছে, ছাদের বাঁদিকে শান্ত-সুনিবিড় জায়গাটুকু অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে। আজ চিলেকোঠার ঘরটায় বসার জন্য সেদিক বরাবর পা চালায় ফিহা। দু’হাতের নরম থাবায় মোটাসোটা কাঁচের বয়ামটা বুকের সাথে চেপে আছে, যেন ভুলবশত ঠাস করে বয়ামটা নীচে না পড়ে। চিলেকোঠার দরজাটা ঠেলে দিলে সেটা একটু একটু করে খুলে গেল। ভেতরের মিশমিশে অন্ধকারটা কেটে গিয়ে একফালি সোনা রঙ তিরতির করে প্রবেশ করল। সেই আলোতে দেখতে পেল, স্টাডি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে একজন। তাকে একপলক দেখেই চিনতে পেরেছে ফিহা। কিছুক্ষণ অবুঝ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলে শেষপর্যন্ত ভেতরে ঢুকার জন্য সাহস জুটিয়ে ঢুকল। তার পিঠ পেছনে দাঁড়ালে হঠাৎ টেবিলের উপর মাথার কাছটায় ছোটো ছোটো দুটো কেকের প্যাকেট দেখল। সেগুলো এখন ছেঁড়া অবস্থায় অবহেলার মতো শূন্য পড়ে আছে। ঘুমন্ত মাথার নীচে একটা ডায়েরি উঁকি দিচ্ছে। সম্ভবত কিছু লেখার পরিকল্পনায় ছিল সে, কিন্তু ডানহাতটা কাটা বলে কিছু লিখতে পারেনি। আরেকটু সাহস জুগিয়ে কাছে এগোল ফিহা। বয়ামটা টেবিলের কাছে রেখে সাঈদের বাঁয়ে এসে থামল। তাকে আলতো স্বরে ডাকল,
– এই যে?
নিজের কাছেই ডাকটা কেমন বিদঘুটে লাগল ফিহার। কাউকে ‘ এই যে ‘ বলে ডাকে? ফিহা কী এখন বলদের মতো আচরণ করছে? আচ্ছা, এত বড়ো জোয়ান লোককে এখন কী বলে ডাকা যাবে? ‘ মিস্টার ‘ বললে কেমন হয়? যাঃ! মিস্টার শব্দটা কেমন ঢঙি ঢঙি লাগে। মিস্টারের বাংলাটা যেন কী? চট করে মনে পড়তেই আবার ডাকল ও,
– এই যে জনাব? শুনছেন? আপনি কী খেয়েছেন?
যতটা আগ্রহ নিয়ে ডেকেছিল তার এক কোণাও সায় দিলো না সাঈদ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে শ্রান্তির চোখদুটো বুজে আছে সে। নিঃশ্বাসের উঁচুনিচু তালে সৌষ্ঠব পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। মাথার কাছে একটুখানি ফাঁক করা জানালা দিয়ে লুকোচুরি হাওয়া এসে তার পাতলা চুলগুলো উড়িয়ে দিলো। ইশ! এই লোকটার চুলগুলো যে অতিমাত্রায় সুন্দর! ঘুমন্ত মুখটার উপর যেটুকু মায়া ছেঁকে আছে, ওইটুকু মায়ার ঘোরটা যেন মখমলী রুমালে আঙুল ছোঁয়ার মতো আদুরে অনুভূতি! ফিহা একবুক জড়তা নিয়ে তার পিঠের উপর হাত রাখল, আবারও শেষ চেষ্টা চালিয়ে কণ্ঠস্বর লঘু করে বলল,
– জনাব?
পিঠে গরম স্পর্শ পেয়ে আস্তে আস্তে চোখের বন্ধ পাতাদুটো খুলল সাঈদ। ঘুম ঘুম চাহনির মাঝে আবছা একটি মুখ দেখে তন্দ্রার ঘোরে বলল,
– হুঁ,
পিঠে আবারও হাত ছোঁয়াল ফিহা। আলতো হাতে স্পর্শ চালিয়ে নরমভাবে শুধাল,
– আপনি খেয়েছেন?
চোখদুটো খিঁচিয়ে মাথাটা তুলে ফেলে সাঈদ। চারপাশটা দেখে নিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ তুলে ফিহার দিকে তাকায়। ঘোরটা পুরোপুরি কাটার জন্য কিছুটা সময় নিল। একটু ধাতস্থ হলে ডায়েরিটা নিয়ে চলে যেতে নিল, কিন্তু পেছন থেকে ছোট্ট একটি সম্বোধন ছুটে আসল কানে,
– জনাব,
কোনো এক অদ্ভুত শক্তি যেন স্নায়ুবিক তাড়নায় পাদুটো থামিয়ে দেয়। সাঈদ হাঁটতে পারে না। কর্ণকুহরে আরো একবার শুনতে পায়,
– আপনাকে কিছু প্রশ্ন করেছি। আপনি কী খেয়েছেন?
সেখানেই অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকল সাঈদ। দাম্ভিকতার সুরে জবাব দিলো,
– না। খাইনি।
আবারও যেতে উদ্যত হলে মেয়েলি সুরটা যেন জোর খাটিয়ে বলল,
– এ্যাই, দাঁড়ান একটু।
সাঈদ দাঁড়ায়। মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে কারণটা বুঝার জন্য তাকায়। ফিহা ততক্ষণে বয়াম তুলে তার পিছু পিছু এসে বলে,
– চলুন। দুপুরের খাওয়াটা স্কিপ দিতে হবে না। আপনি রুমে গিয়ে গোসলটা সেরে নিন, আমি ততক্ষণে খাবারটা গরম করে আনছি।
কথোপকথন শুধু এটুকুই ছিল। এটুকুই বলে ফিহা ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার কাছে তখনও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সাঈদ। এই যে ছোটো ছোটো আদেশগুলো, কথাগুলো, টুকটাক জোরগুলো দেখিয়ে যাচ্ছে, ও জানে না এর কোমল প্রভাব বুকটার ঠিক কোথায় যেয়ে লাগছে। ফিহা দশ মিনিটের ভেতর খাবার নিয়ে রুমের দোরগোড়ায় হাজির হয়। টুক টুক শব্দ করে বাইর থেকে শুধায়,
– আমি কী আসব?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসল,
– কাম ইনসাইড।
ভেতরে প্রবেশ করে ভড়কে যায় ফিহা। কী আশ্চর্য কাণ্ড! পুরো রুমটা দিনের বেলাতে এমন অন্ধকার করে রেখেছে কেন? সে কী আলো সহ্য করতে পারে না? বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সাঈদ। ফিহা রুমের অন্ধকারময় অবস্থা দেখে প্লেটটা রাখতে রাখতে বলল,
– আপনি কী অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না? রুমটা এমন ভূতুড়ে করে রেখেছেন কেন? আমি পর্দাগুলো সরিয়ে দিচ্ছি। আমার অন্ধকার ভালো লাগে না। আপনার জন্য যে কৈ মাছটা আনা হয়েছে সেটা এই অন্ধকারে বাছা অসম্ভব।
বলেই ফিহা একনিমিষের ভেতর পর্দাগুলো দু’হাতে সরিয়ে দিলো। রুমের সবটুকু অন্ধকার এক লহমায় উজ্জ্বল হয়ে দেয়ালে দেয়ালে আলো ছড়িয়ে পড়ল। থাইগ্লাসটা সজোরে ঠেলে গুরুত্বপূর্ণ কাজটায় ব্যস্ত হলো ফিহা। প্লেটটা নিয়ে চটপট ভাত মাখিয়ে মানুষটার ঠোঁটের কাছে এক লোকমা ধরল। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে বহু যুগ পর কারো হাত থেকে খাবাররটুকু খেয়ে নিল সাঈদ। স্মৃতিতে ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ল, ক্লাস ফোরে থাকতে শেষবার বোধহয় মায়ের হাতে খেয়েছিল। এরপর আর কখনো খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। দৃষ্টি নীচু করে কাটা হাতটার দিকে তাকায় সাঈদ, তখনই ফিহা মাছ বাছতে বাছতে বলে,
– পুচকি পুচকি দুটো কাপকেক খেলে পেট ভরে? আপনি খালাকে ডেকে খাবারটা খেয়ে নিতে পারলেন না? আর শুনুন, আপনার আচরণটার জন্য মোটেই আপনাকে ক্ষমা করা হয়নি। আপনি শুধু শুধুই আমাকে অতগুলো ভাইয়ার জন্য অপমান করে দিলেন। আপনাকে আমি মানবতার খাতিরে এইটুকু সাহায্য করছি। আরো একটা কথা, এভাবে অন্ধকার ঘরে থাকবেন না।
সাঈদ চুপচাপ কথাগুলো শোনার পর ধীরাজ গলায় বলল,
– লোকটা কী হয়?
একপলকের জন্য হাত থামল ফিহার। নির্ঘাত টিচারের কথা জিজ্ঞেস করেছে সে। দ্বিতীয় লোকমাটা শূন্য তুলে নিরুত্তাপ সুরে বলে,
– টিচার হন। ইয়াসিন স্যার।
ছোট্ট হাতের ছোট্ট লোকমাটা মুখে নিল সাঈদ। চিবোতে চিবোতে বলল,
– কীসের টিচার?
একটু দ্বিধায় পড়ল ফিহা। মানুষটার জেরা দেখে এখন ভয় পাচ্ছে ও। প্রাইভেট টিউটর শব্দটাকে বেশিরভাগ মানুষ ভবিতব্য জামাই গোছের কিছু ভেবে থাকে, এখানেও বোধহয় ভয়াবহ কিছুই ভাবা হচ্ছে। ফিহা একটু চিন্তা করে স্বাভাবিক গলায় বলল,
– আমি ফিজিক্স সাবজেক্টে একটু দুর্বল। বাবা আমাকে ব্যাচে পড়তে দেয় না। এজন্য বাবার আদেশে সবগুলো গ্রুপ সাবজেক্ট আমি ফিমা আপুর স্যারটার কাছে পড়ে নেই।
সুদক্ষ জবাবটার পর কিছুটা শান্ত দেখাল সাঈদকে। সে নম্রভাবে খাবারটা খেয়ে আরেক লোকমার জন্য অপেক্ষা করছে। ফিহাকে যখন দেখে স্যারের কাছে ত্রস্তপায়ে চলে যেতে, তখন হতাশায় আরো একবার ডুব দিয়ে সেখান থেকে চলে যায় সাঈদ। বাইরে থেকে দুটো মিনি সাইজের কাপকেক এনে চিলেকোঠার ঘরে চলে যায়। সবার আড়াল হয়ে ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুলে ঠিকই, কিন্তু ডানহাতে কলম চালানোর মতো অবস্থা তার ছিল না। এরপর সময়ের তালে তালে কখন যে মাথা নামিয়ে ঘুমের গভীরে ডুবে যায় তা এখন মনে পড়ছে না। হঠাৎ নীরবতার লক্ষ্যভেদ করে ফিহাই প্রথম বলল,
– আরেক প্লেট আনি?
পানির গ্লাসটা নিয়ে ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সাঈদ। বুঝিয়ে দিলো সে আর খাবে না। অতিরিক্ত ক্ষুধায় সময়মতো না খেলে পরে গোগ্রাসে খাওয়ার মতো অবস্থাটা মlরে যায়। ফিহা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ হাঁশফাঁশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখটা পিছু ফিরিয়ে পানি খাওয়া মানুষটার দিকে চোখ তুলে বলল,
– হাতটা একবার ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে আনবেন। ওটা আপনার ডানহাত আর আপনি ডানহাতি মানুষ। এরকম করে কাটা-ছেঁড়া বিষয়টা অবহেলা করবেন না। সামনে আপনার জন্য সমস্যা হবে। আমি সকালের জন্য দুঃখিত।
দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল ফিহা। চোখের সামনে শেষ বাক্যটুকু শুনে পানি খাওয়াটা স্থগিত করে আছে সাঈদ। বুকের বাঁদিকে আবারও ধক্ ধক্ হাতুড়ির মতো কঠিন করাঘাত হচ্ছে।
#FABIYAH_MOMO .