নির্মোচন পর্ব ২৯ (এর ১ম অংশ)

0
264

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৯ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

ঘড়ির কাঁটা, সময়ের পাতা নিষ্ঠুরভাবে চোখ ফাকি দিয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে দ্রুত সবকিছু শেষ হবে কিনা সন্দেহ। চিন্তার ছকে আর কিছু বাঁধা পরার আগেই রোকসানা কাদিরের আদিখ্যেতা ও বিয়ের সমস্ত আমেজ থেকে চূড়ান্ত বিদায় গ্রহণ করল। দুই পরিবার কাউকেই কিছু জানায়নি আসন্ন শুক্রবার ঠিক কি ঘটতে চলেছে। অনেকটা নিরিবিলি, ঠাণ্ডা, ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সম্পন্ন করার জন্য ভীষণ ব্যস্ত আছেন তারা। লোক সমাগম করে শুধু শুধু সমাজের একশ্রেণীর মানুষকে খাওয়ানোর মানে নেই। বরং এর বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সাঈদ কিছু একটা ভেবেছে। বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিয়েটা নিকটবর্তী একটি মসজিদ প্রাঙ্গণে সুন্নতি তরিকায় সম্পন্ন হবে। মানুষের আগমন হবে স্বল্প, হৈচৈ হবে না কোনো, কেবলমাত্র নিজেরা নিজেরা উপস্থিত থেকে হালাল, পবিত্র, সুন্দর কার্যক্রমটায় সাক্ষী হবে। লোহার জং ধরা গেটের বাইরে রওনা দেওয়ার জন্য দুটো গাড়ি এখন ত্রস্তভাবে প্রস্তুত। আফসানার গাড়িতে নিয়াজ উদ্দিন ও তার পরিবারকে নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বটা সাদরে গ্রহণ করেছে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার ইফতিখার ফাহাদ। লাবিব খুব ভোরেই গাজীপুর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। কারণ হিসেবে জানিয়েছে একটা জরুরী দরকার। গাড়িটা স্টার্ট দেওয়ার আগে দীপ ও দীপের পুরো পরিবারের সাথে শেষ বার্তাটুকু সমাপন করল নিয়াজ ও নাজনীন। মৃদু ঝাঁকুনির তালে জড়তা ছেড়ে দিয়েছে স্থির গাড়িটি। আনচান করা অসভ্য মন জানালার বাইরে কী যেন একটা দেখবার জন্য ছটফট করে উঠল ফিহার। কিন্তু দৃষ্টিসীমানার ধারে কাছে দেখতে পেল না নির্ভীক ওই কঠিন মুখ। গতকাল রাতে ওভাবে ওরকম সম্মোহন কণ্ঠে গান গাওয়ার পর আর একদণ্ড সামনে আসেনি। কেন আসেনি এ কথা জানা নেই ওর। প্যান্ডেলের ওখান থেকে দীপ ভাইকে উদ্দেশ্য করে সুন্দর কিছু কথা বলেছিল,

– হলুদ ছোঁয়ার দিন একটা চোরা রিকোয়েস্ট করেছিলি। এরকম একটা কনসার্ট ভাইবে চটক গান শুনতে চাস। শুনিয়ে দিলাম। আমার আগে বিয়েটা করেছিস, ভালো কথা। আমার চাইতেও বহুগুণ ভালোভাবে বিয়ের দায়িত্বটা পালন করে দেখাতে হবে। কণেবাড়ির লোকেরা যেন তর্জনীর ডগা দেখানোর সুযোগ না পায়। মনে রাখিস কথাগুলো।

কথাগুলোর নীচে স্বতঃস্ফূর্ত ইঙ্গিতটা কাকে এবং কী উদ্দেশ্যে দেওয়া সেটা যেন বুঝতে পেরেছিল সবাই। দীপের বড়ো চাচা আজগর আলী দেওয়ান এবং পোদ্দারি করা কিছু মহিলার চোখ ক্রুরতার আঁচে জ্বলজ্বল করছিল। নির্বিকার চিত্তে জায়গামতো কথার বারিটা পৌঁছে দিয়ে প্যান্ডেল থেকে নেমে গিয়েছিল সাঈদ। এরপর কোথায় কোনদিকে উধাও হয়ে গিয়েছে তা আর লক্ষ করা হয়নি। এবড়োথেবড়ো ভাঙা পথটা দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এসব কিছুই আনমনে ভেবে চলেছে ফিহা। মনে হচ্ছে জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় এই মফস্বল স্থানে, এই দেওয়ান বাড়ির প্রাঙ্গণে, এই গাজীপুর জায়গাটাতে নীরবে আচমকা ঘটে গেল। এখানে কাটানো তিনটে দিন তিনটে যুগের মতো অনুভূত হচ্ছে। যেন বহু বহু ঘটনা, অকথিত স্মৃতি, নানা অপ্রত্যাশিত মূহুর্তের সংবলিত একটা গ্রন্থগার রচিত। এ গ্রন্থগারে পাক খেয়ে খেয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘন কালো অন্ধকারে ঘনিয়ে আসছে দ্রুত।

.

ফাহাদের মসৃণ ড্রাইভের নিপুণ কৌশলে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার জার্নিটা সোয়া চার ঘণ্টায় সমাপ্ত হলো। ফতুল্লা রোড ধরে একটানে গাড়িটা ছুটিয়ে আনলো গন্তব্য এলাকায়। ধূলি ধূসরিত রোড মাড়িয়ে সশব্দে গাড়িটা থামিয়ে দিল কাঙ্ক্ষিত বাড়িটির সামনে। জার্নির গা ম্যাজম্যাজে ভাবটা ঝাড়া দিয়ে একে একে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল সবাই। ফাহাদ পকেট থেকে সেলফোনটা বের করতে করতেই চোখ ঘুরিয়ে পুরোটা বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে নিল। ছোট্ট জায়গার ভেতর দোতলা একটি বাড়ি, বাড়ির দেয়ালে থাকা সাদা রঙটা ময়লা হয়ে ফিকে দেখাচ্ছে। ছাদ থেকে সবুজ লতাপাতার লম্বা ডাঁটা বাড়ির গা বেয়ে নেমে এসেছে নীচে। বাতাসে কড়াভাবে অনুভব করা যাচ্ছে ছাদবাগানের মন জুড়োনো মধুর ঘ্রাণ। বড়ো অদ্ভুত ভাবে জায়গাটা ভালো লেগে গেল ফাহাদের। এখানে এতো নীরব নীরব, ঠাণ্ডা আবেশে ঘুম জড়ানো প্রশান্তি কেন? রক্তে যেন মন আচ্ছন্ন করা অদৃশ্য ভালো লাগার ঔষুধ মিশে যাচ্ছে। নিয়াজ সাহেব যে সেই কখন “ভেতরে আসো বাবা” বলে ভেতরে ঢুকে গেছেন, সেদিকে হলফ মাত্র খেয়াল নেই ফাহাদের। ডায়াল করা সেলফোনটা কানে চাপা অবস্থায় মুগ্ধ নয়নে বাড়িটার চর্তুদিক মাপতে মাপতে বলল,

– তোর শ্বশুরবাড়িটা খুব সুন্দর সাঈদ। এখানে আসলে একদমই পস্তাবি না। কী সুন্দর, শান্ত, নিরিবিলি একটা জায়গায় ওরা থাকে! আমি সিরিয়াসলি জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছি। তোদের খানদানী স্টাইলের মরা বাড়িটার চাইতে ওদের রঙচটা এই ছোট্ট বাড়িটাই মারাত্মক লাগল। পরে কল দিচ্ছি। আঙ্কেল মনে হয় ভেতরে আসার জন্য ডাকল। হ্যাঁ . . তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছি। রাস্তা একটু ফাঁকা ফাঁকা পেয়ে গেছিলাম। আচ্ছা তাহলে পরে কল দেই। ঠিকআছে রাখ।

কলটা কেটে দেওয়ার পর ভেতরে প্রবেশ করে ফাহাদ। একতলায় স্রেফ একটি মাত্র দরজা, কাঠের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে দুটো বড়ো বড়ো বেডরুম-সহ এক ইউনিটের একটি ফ্ল্যাট। ঘরের ভেতর দিয়ে উপরে উঠার একটি সিঁড়ি। নিয়াজ উদ্দীনের ইচ্ছে ছিল তিনি মারা যাবার পর এই বাড়ির দুটো তলা দুই মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন। বিয়ের পর যখন মনে হবে বাবার বাড়ি থেকে কিছুদিন স্মৃতি লালন করে আসা যাক, তখন স্বামী-সন্তান সহ ঘুরে যাবে এই ছোট্ট নীড়ে। ক্ষুদ্র সম্বলে যতটুকু পেরেছেন তাতেই মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু নিশ্চিত করেছেন নিয়াজ। চোখ ঘুরিয়ে সমস্ত আকর্ষণ দেখতে দেখতে সোফার নরম আসনে বসে পড়ল ফাহাদ। সামনের টি-টেবিলে ট্রে সাজিয়ে ছোটো ছোটো পিরিচে খেজুরের গুঁড় দিয়ে পায়েস, ঘন দুধে রান্না করা সেমাই, কেকের স্লাইস, দু’কাপ ধোঁয়া উঠতে থাকা গরম চা পরিবেশন করা হয়েছে। অতো তাড়াতাড়ি খাবারের বন্দোবস্ত দেখে মনে মনে একটু আশ্চর্য হলো ফাহাদ। খাবারের প্রতি তাগাদা বুঝিয়ে নিয়াজ উদ্দীন একগ্লাস পানি খেয়ে বললেন,

– এখনো বসে আছ কেন? তুলে নাও . . তুলে নাও। একদম লজ্জা কোরো না। তোমার আন্টির রান্না করা পায়েস কিন্তু খুব সুস্বাদু হয়। খাও। খাওয়া শেষ করে গোসলটা সেরে নিয়ো।

মুচকি হাসি দিয়ে পায়েসের বাটিটা নিঃশব্দে তুলে নেয় ফাহাদ। এমন উষ্ণ আন্তরিকতায় মনপ্রাণ যেন মোমের মতো গলে গলে আসে। খাবারের স্বাদের চাইতে আচারনিষ্ঠ ব্যবহারটাই যেন ভীষণভাবে প্রলুব্ধ করে মন। চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিতেই প্রশ্নটা না করে পারল না ফাহাদ,

– আঙ্কেল, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনি তো চাইলে দোতলার রুমদুটো ভাড়া দিয়ে থাকতে পারেন। একটা ছোটো ফ্যামিলি থাকলে আপনাদের আরো সুবিধে হতো।

জিরো সুগারের মিষ্টি মেশানো চায়ের কাপটা হাসিমুখে তুলে নেন নিয়াজ। ফাহাদের প্রসঙ্গটা বুঝতে পেরে তিনিও নিজের দিকটা পরিচ্ছন্ন করে বললেন,

– আমার আর্থিক দিকটা নিয়ে টানাটানি থাকলেও যেটা বলছ, ওটা করতে পারতাম না বাবা। বাসা ভাড়ার জন্য এ পর্যন্ত কম মানুষ আসেনি। গুদামঘরের জন্য পর্যন্ত বায়না করতে এসেছিল। সবগুলোকেই ফিরিয়ে দিয়েছি। বতর্মানে ভাড়াটিয়া আর ভাড়া দেওয়া লোকদের উপর বিশ্বাস করা শক্ত। তুমি তো সাঈদের কাছ থেকে জেনেছ, কেন মেয়েদুটোকে খালার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এটার পর মনে হয় না তোমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে।

হঠাৎ ফাহাদের মনে হলো নিয়াজ উদ্দীন বোধহয় কিছু একটা আড়াল করতে চাইছেন। বলতে গিয়েও কথাটা বলে উঠতে পারছেন না। ফাহাদও শান্তমনে চা পান করতে করতে নিজের নাছোড়বান্দা সূত্রটা প্রয়োগ করে বলল,

– আঙ্কেল, একটু প্র‍্যাক্টিক্যাল হই। মনে কিছু নিবেন না। এই টেকনোলজির যুগে এসেও যদি আপনি খারাপ ছায়া বা অশরীরীর ঘটনা বলে ব্যাখ্যা দেন, তাহলে তো ভুল হচ্ছে। সাঈদ আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই এখন পর্যন্ত জানায়নি। ও যদি এই ব্যাপারে একবার হাত ঢোকায়, তাহলে ধরে নেন, গাছের শিকড় সুদ্ধো একেবারে টেনে তুলে আনবে। যা যদ্দুর জেনেছি সব আফসানা আন্টি বলেছেন। আন্টির কথা শুনে সেদিনও মনে হয়েছে, আর আজও এখন মনে হচ্ছে . . আপনি কিছু একটা লুকাচ্ছেন। হয়ত এটাও জানেন আপনার দুই মেয়ের উপর কারা লেগেছে। জানেন দেখেই একসেকেন্ডও দেরি না করে নিরাপদ জায়গায় ওদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। একদম তাড়াহুড়ো করে।

এক মূহুর্ত্তের জন্য নিয়াজের মনে হলো, সামনে কোনো সাধারণ ছোকরা বসে নেই। বসে নেই গাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে আসা সেই সুশ্রী চেহারার ফাহাদ। এ যেন সাক্ষাৎ পুলিশি আচরণ দেখিয়ে পেটের নাড়ি ছিঁড়ে আনার মতো তথ্য বের করছে। নিয়াজ প্রশ্ন মাখানো দৃষ্টিতে দুই ভ্রুঁর মাঝে খাঁজ গেঁথে বললেন,

– তুমি কী বলতে চাইছ আমাকে? কি ব্যাপারে জানার প্রসঙ্গে কথাটা বললে বাবা?

চায়ের কাপে তখনও ধীরস্থির ভাবে চুমুক দিয়ে খাচ্ছে ইফতিখার ফাহাদ। নিয়াজের উদভ্রান্ত চাহনি দেখে চায়ের কাপটা সমুখ টেবিলে রাখতেই ভীষণ ঝরঝরে কণ্ঠে বলে উঠল,

– আমি একজন মেডিকেল অফিসার আঙ্কেল। সাইকোলজি কোর্সটা পড়াশোনার ফাঁকে ভালোভাবে আয়ত্ত করা লাগে। একজন পেশেন্টের চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কীরকম। প্রথমদিনের আলাপেই আমি বুঝেছি, আপনি কোনো জটিল টেনশনে ভুগছেন। ঠিকমতো রাতে ঘুমান না। চোখের নীচে গভীর কড়া ডার্কসার্কেল। বিয়েবাড়িতে পোলাও, কোরমা পেয়েও খাবারের প্রতি বিন্দুমাত্র রুচি নেই। আপনার সামনে এখন সাঈদের বন্ধু ফাহাদ নয়, একজন ডিগ্রিধারী ডাক্তার বসে আছে। সেই জায়গা থেকে চিন্তা করে বলুন, আপনি এখন কী নিয়ে টেনশন করছেন? টেনশনের আসল কারণটা কী এবং কোত্থেকে? নিশ্চিত থাকুন, আমি এ প্রসঙ্গে কারো সঙ্গে আলাপ করব না।

রীতিমতো ভিড়মি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গেল নিয়াজের। ফাহাদের মতো হাসিখুশি ছোকরাকে তিনি সাঈদের মতোই অফিস সেক্টরে জব করা ভেবেছিলেন। অথচ তার সমস্ত ভাবনাকে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে একজন ডাক্তার কিনা বসে আছে। নিজের হতভম্ব ভাবটা ওভাবেই ঝুলিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা ধরতে গিয়ে শুধালেন,

– তুমি . . তুমি একজন ডাক্তার?

– জ্বী, আঙ্কেল। কার্ডিও ডিপার্টমেন্ট। আপনি হয়ত বাকি সবার মতো ভেবেছিলেন আমি সাঈদের মতো কর্পোরেটের লোক। আসলে তা না; আমি মেডিক্যাল লাইনে আছি। আমি শুরু থেকেই আপনাকে লক্ষ করছিলাম আপনি কিছু একটা নিয়ে অন্যমনষ্ক। এইযে, এখনো পানির গ্লাসটা নার্ভাসনেসের জন্য কাঁপছে। আপনি পানিটা শেষ করুন আঙ্কেল। আমি রিল্যাক্সেই আপনার কথা শুনব।

কথাটা বলতেই সেমাইয়ের বাটিটা সাদরে তুলে নেয় ফাহাদ। কিছুটা সময় দেয় নিয়াজ উদ্দিনকে ধাতস্থ হওয়ার জন্যে। পানির গ্লাসটা ঢকঢক করে সাবাড় করতেই নিয়াজ উদ্দিন চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রী ও মেয়েদুটোর উপস্থিতি নিশ্চিত করে দেখেন। পরক্ষণে কিছুটা স্বস্তির সুরে বলতে শুরু করলেন,

– এই জায়গাটা নিয়ে একটা মাত্র কথা বলব— “উপরে ঠোঁট সুন্দর, ভেতরে দাঁত নেই।” তুমি এখানে আসার পর অবশ্যই এটা দেখেছ কী শান্তির একটা জায়গা। সদর এলাকা হলেও এখানটায় তেমন কোলাহল নেই। এখানে যারা থাকে তারাও বেশ বড়ো স্তরের মানুষ। আমি এ শহরে এসেছি ১৯৯২ সনে। সুপারভাইজার হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। পৈত্রিকভাবে কিছু টাকা পাওয়ায় এখানে একখণ্ড জায়গা কিনি। কম দামে সোনার হরিণ পেয়ে যাওয়ায় আমি অতোকিছু না ভেবেই কিনেছিলাম। অল্পকিছু পুঁজি নিয়ে বাড়িটাও একসময় তুলে ফেললাম। এখানে যতগুলো বিল্ডিং তুমি দেখছ বাবা, সবগুলো বিল্ডিংয়ের মালিক এখন আতঙ্কের ভেতর আছে। এখানে কোনো নিরাপত্তা নেই। কার, কখন সর্বনাশ ঘটে যায় কেউ বলতে পারে না। কেউ সাহস করে মুখও খুলতে চায় না। আমাদের পাশের এলাকায় শুনলাম, রাত তিনটের দিকে বাড়িঘর ভাঙচুর করে গেছে। বাড়ি থেকে হুট করে কেউ না কেউ নিখোঁজ হয়। আর ফিরে আসে না। লা° শও পাওয়া যায় না। পু° লি শে র কাছে মামলা দায়ের করলেও ক্ষতি। তোতাপাখির মতো ওই এক কথা বলে বেড়ায়, “আমরা ত দ ন্ত করছি। ত দ ন্ত করে দেখছি।” কিন্তু তদন্তের নামে কিচ্ছু না! সবাই দিনের পর দিন চুপ করে বসে আছে। কেমন সমাজে বাস করছি একবার ভাবো! আজ কোনো অঘটন ঘটলে পুলিশের কাছে নিরাপত্তা পাই না, সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা নেই, প্রতিবাদ করার মতো মানুষ থাকলে তাদেরও টু° টি চে পে ধরা হয়। কেউ এগোতে চায় না। আমরা সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনভাবে চলতে পারি না।

ভ্রুঁ কুঁচকে প্রচণ্ড কৌতুহলের সাগরে ডুবে আছে ফাহাদ। এতো সুন্দর একটা জায়গায় কিনা ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছে? বাগানে মিষ্টি ফুলের গন্ধ, কিন্তু বাতাসে ভয়ের শ্বাস? ফাহাদ ব্যাপারটা আরো তলিয়ে দেখার জন্য বলল,

– কারা আছে এসবের পেছনে, জানেন কিছু?

মুখ ফুটে বলি বলি করা কথাটা বলতে গিয়েও আরেকবার ভেবে নিচ্ছেন নিয়াজ। সাধারণ মানুষ তিনি, খেটেখুটে সংসারের পেছনে ক্ষয় যাওয়া অবদানটুকু রাখছেন। এমতাবস্থায় কথাটা বলে দিলে মেয়ের কাবিনে কোনো বাঁধা বিপত্তি হবে কিনা সেটাও এখন খোঁচাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া শ্রমিকের মতো নিস্তেজ সুরে বললেন,

– জানি না। জানলে হয়ত আমার জায়গা থেকে কিছু একটা করতে পারতাম। যা হোক, তুমি এখন গোসলটা সেরে নাও। আজ রাতে এই গরীবিখানায় দুটো ডাল-ভাত খাচ্ছ। তোমার আন্টিকে রান্না চাপাতে বলে তোমার জন্য রুম গুছাতে পাঠিয়েছি। রাতটুকু থেকে কাল সকালে যেয়ো বাবা। এখন যাও, চটপট শরীরটা চাঙা করে আসো।

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও নিয়াজ উদ্দিন তখনো জানতেন না, তার কথাগুলো ইতোমধ্যে রেকর্ড করা হয়েছে। আর সে রেকর্ডটুকু যত্ন করে নিজের সেলফোনে তুলে নিয়েছে ফাহাদ।

.

হাতের ফাঁক গলে ঝুরঝুরে বালির মতো বেরিয়ে গেল কটা দিন। কবোষ্ণ সকালের মিঠে মিঠে আলোয় দূর বিল্ডিংয়ে ঘন কুয়াশা চোখে পড়ে। ধোঁয়া ধোঁয়া আস্তরের মাঝে ফুটে উঠে সোনালী রোদ্দুর। গা ঝাড়া দেওয়া শীতালু পরশ রোমে রোমে ছড়িয়ে দেয় অবাধ্য কাঁপুনি। সেই কাঁপুনিটা অনুভব করেই ছাদবাগানে থাকা গোলাপ ফুলের পাপড়িতে মৃদু টোকা দিল ফিহা। লাল রক্তের মতো ফুটে থাকা গোলাপ পাপড়ি থেকে টুপটুপ ঝরে পড়ল শিশির। খিলখিলে এক টুকরো হাসি অপাপবিদ্ধ মুখটায় ফুটে উঠলে মায়ের দিকে আবেগ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,

– তোমার হাইব্রিড গাছে ইয়া বড়ো ফুল ফুটেছে মা! দেখো দেখো . . জলদি দেখে যাও। গোলাপফুলটা দেখে মনেই হয় না গাছটা সেদিন তুমি লাগিয়েছ! কী সুন্দর দেখতে হয়েছে, মা শা আল্লাহ!

ছোট্ট ছাদের অন্যপ্রান্তে মাদুর বিছিয়ে লেপ, কাঁথা, গরম কাপড়গুলো রোদে পোহাতে দিচ্ছেন নাজনীন মিলা। মেয়ের আপ্লুত কণ্ঠস্বর শুনে ওপ্রান্ত থেকেই সতর্ক সূচকে প্রত্যুত্তর করলেন,

– ফুল ছিঁড়বি না। বইখাতার ভেতরে শুকনো ফুল জমাতে জমাতে বিচ্ছিরি অবস্থা করে ফেলেছিস। এখনো যদি ছোটোবেলার মতো এই বদ বদ স্বভাবগুলো পুষে চলিস, তোর কানটা মো চ ড়ে একেবারে ছিঁ° ড়ে দিবে!

তপ্ত সুরে বলা মায়ের ওমন সতর্কবাণী শুনে সারল্য মুখে অন্ধকার নেমে আসে। মুখ ঘুরিয়ে দূরে কর্মরত মায়ের দিকে চিন্তিত সুরে শুধিয়ে উঠে,

– কান কে ছিঁড়বে? সকাল সকাল কীসব বকছ তুম . .

ছিঁটকে আসা কথার উচ্চগ্রাম যেন আস্তে আস্তে নিম্নগ্রামে পৌঁছে গেল হঠাৎ। চট করে মস্তিষ্কে চাপড় কষালো একটি জরুরি কথা। এ বাড়িতে যেমন হাইব্রিড গোলাপফুল আছে, তেমনি ও বাড়িতে আছে ঝাঁক বাঁধানো গোলাপফুলের রাজ্য। যদি ভুল করে একটি গোলাপফুল তখন ছিঁড়ে ফেলে, তাহলে কী গাছের মালিক এমনই করে মায়ের মতো কঠিন শাষণ করবে? হুট করে তাঁর রূঢ়মূর্তির কঠিন, গম্ভীর, বেরসিক আদলটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল। প্রথমদিন ছাদে ওই অপমানকর কথা আর কথার নীচে দাপটের সাথে ফুটে উঠা কাঠিন্যবোধ . . সবটুকুই কীভাবে যেন ফিকে ফিকে হয়ে এসেছে। বরং ফিকে হওয়া আস্তরের উপর রঙ চড়েছে পাগল করে দেওয়া মুচকি সেই হাসি, হাসির আবেশে জড়িয়ে নেওয়া শীতলী আচ্ছন্ন কণ্ঠস্বর। আজ ক্যালেন্ডারের পাতায় মোটাদাগে উঠেছে বৃহস্পতিবার। বুকের ভেতরে ধ্বক করে উঠল অনৈচ্ছিক পেশির হৃদপিণ্ড। শ্রান্ত হয়ে থাকা ধক্ধক্ নিঃশ্বাসের মৃদঙ্গ যেন আহুতি দিয়ে জানান দিচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকা মন আবারও তারস্বরে বুঝিয়ে দিল, হাতে আছে আর মাত্র একদিন। স্রেফ আজকের দিনটুকুই। এই চিরচেনা সকাল, এই পরিচিত নীড়, সকাল সকাল পবিত্র মায়াময় শান্তির মাঝে মার কর্কশকণ্ঠী চিৎকার— “ঘুম থেকে উঠবি? আমি আসলে কিন্তু চা° ব কা তে শুরু করব!” বাবার তখন নাস্তা খেতে খেতে দারুণ প্রতিবাদ করা স্বর, “তুমি সকাল সকাল চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছ কেন? আমার মেয়েদুটো শান্তিমতো ঘুমোচ্ছে ভালো লাগে না দেখতে? ওরা ঘুমোচ্ছে, ঘুমাক। তুমি তোমার খুন্তি ঘুরাও।” রান্নাঘরে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মা জননী তেলে বেগুনে ছ্যাঁত করে উঠে বাবার কথায়, বাবাও দমে যাবার পাত্র নয়। খটোমটো বাকবিতণ্ডায় ঘুম হালকা আসে দু’বোনের। দুজনই কান খাড়া করে শুনতে পায় বাবা-মার সাময়িক যুদ্ধ। এরপরই চায়ের কাপে ক্ষুদ্র ক্যাপসুল মেশাতে মেশাতে বাবার দিকে চা বাড়িয়ে দেয় মা। নিমিষের মধ্যেই ছুঁ মন্তর ছুঁ মন্ত্রের মতো গায়েব হয়ে যায় বাবা-মার সাময়িক তর্ক। মা সদর দরজা লাগাতে লাগাতে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া বাবার পানে বলে উঠেন, “আসার সময় মনে করে লবণ, চিনি, দুধের প্যাকেট নিয়ে ঢুকবেন। দুধের কৌটা ঝেড়ে মুছে আপনাকে দুধ চা করে দিলাম। আজকে দুধের প্যাকেট নিয়ে না ঢুকলে কাল চা খাওয়া বন্ধ।” কথাগুলো স্মরণ করতেই চোখ ছাপানো অশ্রুর মাঝে হাসি ছলকে উঠল। কী ভয়ংকর ভাবে মিস করবে এই আশৈশব দিনগুলি! শিশিরে ভেজা হাতের মুঠোটা চোখের সামনে মেলে ধরল ও। সকালের রৌদ্র ঝকঝকে আলোর মাঝে ধরা দিল মেহেদি রাঙা হাতদুটো। ডানহাতের ফর্সা তালুতে ছয় অক্ষরে দখলীস্বত্ত্ব করে আছে ছোট্ট নামটুকু, যেন তারই একমাত্র অনির্বাণ শিখাটুকু শোভা পায় হাতে। হঠাৎ বাঁপাশ দিয়ে আচমকা ছিঁটকে এলো ফিমার নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর,

– তোর কানের ব্যথা কমেছে?

মৃদু ঝটকায় চমকে উঠতেই বোনের দিকে ভাবনা-বিভোর মুখটা ঘুরিয়ে ফেলল ফিহা। অন্যমনষ্ক ভাবটা দ্রুত মুখ থেকে মুছে ফেলে গলা স্বচ্ছ করে জানাল,

– হ্যাঁ, একটু। একটু মানে হালকা হালকা ব্যথা এখনো রয়ে গেছে। জোরে চাপ দিলে ব্যথা পাই।

– তুই কী জুয়েলারি পরতে পারবি না?

– না, এখনো না। তাছাড়া ওগুলো খুব ভারি। আমি ভারি জিনিস এমনিতেও পরতে পারি না। মাকে বলেছ ব্লাউজটা যে দুই সাইড থেকে ঢিলা হয়?

অপরাধে মাখো মাখো চোখদুটো ছোটো বোনের দিকে স্থির রেখে পরক্ষণে তা মাটিতে নামিয়ে বলল,

– বলেছি। মা ওটা সুঁই সুতা দিয়ে ঠিক করে দিবে। ব্যাগ কোনটা নিয়ে যাবি? কিছু কিছু জিনিস এখনই গুছিয়ে নে।

ফিহা এখনো বুঝতে পারছে না হুট করে আপুর মাঝে এমন আকস্মিক পরিবর্তন কেন। মেজো খালামণির ওখান থেকে আসার পর কেমন যেন মুখ নীচু করে কথাবার্তা বলছে। আগের মতো কোনো বিষয়ে খোঁটা, উগ্রবাদী মন্তব্য, নিজের ইচ্ছা নিয়েও তেমন কোনো প্রসঙ্গ তুলছে না. . হঠাৎ কী হলো ঠাস ঠাস জবাবে কথা বলা আপুর? আকাশ ফুঁড়ে ভেবে চলা প্রশ্নগুলোর মাঝে হঠাৎ মায়ের ব্যস্ত সচকিত কণ্ঠ,

– ফিমা? কাজ না থাকলে একটু আয় দেখি।তাড়াতাড়ি একটু হাত লাগিয়ে টব তিনটা নামাতে সাহায্য কর। আজ এগুলো উপরে রাখা যাবে না।

স্থিরতা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিমা ছুটে গেল মায়ের কাজে হাত লাগাতে। ভীষণ ভারী দুটো টব। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে একটা আলগাতেই কপালে ঘাম ছুটে যাবে, সেখানে তিন তিনটে! কী যেন মনে করে ফিহাও মা আর বোনের মাঝে জানান দিয়ে উঠল,

– দেখি, ওটা আমাকে তুলতে দাও। আপু একটা তুলুক, আমি একটা তুলি আর পরেরবার এসে শেষের টবটা দুজন মিলে তুলব।

মেয়ের দিকে একপলক চমকানো চাহনি মেলে ফের কী যেন ভেবে বলে উঠেন মা,

– তুই ওটা পারবি উঠাতে?

মায়ের কণ্ঠে ‘না পারার’ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ফুটে উঠায় ফিহার আত্মগর্বিত মন হিংস্রভাবে তেঁতে উঠে,

– আশ্চর্য! এইটুকু একটা টব, এইটুকুনি জায়গা! আমি কী টবটা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারব না? তুমি আমাকে খাটো চোখে দেখছ কেন? তোমার সামনে পুরস্কারজয়ী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানো না? দেখি সরো, কথা বলতে বলতে যে সময় খরচ করছ, তাতে দুই চক্কর অনায়াসে ঘুরে আসতে পারি।

একপ্রকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া মাটিভর্তি টবটা দু’ঠোঁট টিপে, গায়ের জোরে দুহাতে উঠিয়ে, ফোঁস করে একটা দম ছেড়ে বলল,

– হুঁ, হাঁটা দাও মা। টবটা অতো ভারি না, যতটা তুমি বোঝাচ্ছ।

মেয়ের কথার ধরণে আশ্বস্ত হয়ে ফিমাকে আগে আগে নামতে বললেন নাজনীন। বুঝিয়ে দিলেন সোজা নীচতলার বারান্দায় গিয়ে থামতে। ফিমার পিছু পিছু নাজনীন যখন ভারী টবটা তুলে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামছে, তখন পেছন থেকে বাহাদুরি ভঙ্গিতে নামতে থাকা ফিহা বড়োবোনের আচরণটা নিয়ে ভাবছিল। গলায় থাকা লম্বা ওড়নাটা কখন যে একপাশে বেশি হয়ে মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে সেদিকে লক্ষ ছিল না ওর। মা বিকেলের কাবিনের ব্যাপারে কী যেন আলোচনা করতে ব্যস্ত। আর মাত্র চার সিঁড়ি কেবল বাকি! জর্জেটের ওড়নাটা নামার তালে হঠাৎ পায়ের নীচে আঁটকা পরতেই ডান-পাটা অকস্মাৎ হড়কে গেল ফিহার! দু’হাতের বাঁধন থেকে বিকট শব্দ করে ভেঙে গেল টবটা। তারপরই লোমহর্ষক গলা ফাটানো আর্তনাদে গমগম করে উঠল সিঁড়ির জায়গাটা! বুক মোচড়ে উঠা নিঃশ্বাসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাহনিতে তাকিয়ে আছেন নাজনীন ও ফিমা।

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা— ২৫০০+ শব্দসংখ্যা। চেষ্টা ছিল বড়ো করে দেবার। দিয়েছি। আপনাদের ইচ্ছেটুকু পূরণ করেছি। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here