নির্মোচন পর্ব ২৮

0
289

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৮ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

ঘরে ফিরে চুপচাপ গা থেকে শাড়ি খুলছিল ফিহা। আশ্চর্য রকম চুপটি হয়ে আছে। হাসি মাখা প্রাণোচ্ছল চোখদুটো শত শত প্রশ্নের কাছে জব্দ। অনভ্যস্ততার দরুন অসংখ্য সেফটিপিনের সূঁচালো মুখ একের পর এক ধৈর্য সহকারে খুলতে হচ্ছে, কিন্তু মন ও মনোযোগ সূদূর অট্টালিকায় ভাবনার আরশে পাড়ি জমিয়েছে। জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে চকচকে এক থালা চাঁদ। রূপোলি আলোয় কেমন থম ধরা এক আশ্চর্য সৌন্দর্য চর্তুদিকে ছড়িয়ে আছে। একটু আগে মা আর বাবা যে সমস্ত কথাগুলো বলল, তাতে প্রচণ্ড আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বিস্তর চিন্তাভাবনার মাঝেই বাঁ কাঁধের ছোট্ট সেফটিপিনটা চাপ দিয়ে খুলছিল, সঙ্গে সঙ্গে ‘উহঃ’ আর্তনাদে বৃদ্ধাঙুলটা সরিয়ে ফেলল ফিহা। আঙুলের ডগায় ছোট্ট একটা ছিদ্র হয়ে একবিন্দু রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চট করে আঙুলটা আঁচলের প্রান্তে চেপে ধরলে বাবার একটু আগের কথাগুলো ফের স্মরণ করে উঠল,

– তুমি আল ফিমা বাদে আমাদের কোনো চিন্তা নেই মা। তুমি জানো, তোমাদের দুজনকেই আমি বিশ্বাসের জায়গা থেকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি। কখনো কোনোদিন কোনোকিছুর জন্য তোমার মা বা আমি দুশ্চিন্তায় জড়াইনি। তোমরাও ওরকম কাজ করোনি, যার জন্য আমাদের মাথা নীচু করে থাকতে হবে। কিন্তু এবাবের ব্যাপার আলাদা। তোমার মতামত না শুনে কোনো ধরণের সিদ্ধান্ত আমি নিব না, তাই তোমার দীপ ভাইয়ার বাসাতেই কথাটা এখন তুলছি। তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে একটা। এ পর্যন্ত অনেক প্রস্তাব শুধু তোমাদের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে ফিরিয়ে দিয়েছি। আজও এটা ফিরিয়ে দিতাম, কিন্তু এবারের এই পাত্র আমার মনমতো। আমি কিছুটা হলেও নিশ্চিত যে এমন পরিবারে তুমি কখনো অসুখী থাকবে না। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক করার আগে এটাই জানতে চাইব, তোমার কী মনে হয় বিয়ের কথাটা এখন পাকা করা উচিত?

দোতলার যে ঘরটায় নিয়াজ ও তার স্ত্রী এখন মেহমান হিসেবে থাকছেন, সে ঘরটা এখন ভেতর থেকে ছিটকিনি মেরে প্রাইভেসির জন্য বন্ধ করা। বিছানায় বসে আছেন দুজন, একটু দূরে সোফায় বসে আছে ফিহা। সিল্কের কালো শাড়িটি ভীষণ যত্ন করে পরেছে তাদের ছোটো মেয়ে। বেশ বড়ো বড়ো লাগছে শাড়ির অনিন্দ্য সুন্দর বেশভূষাতে। মাথা নীচু করে কোলের ওপর রাখা কোমল হাতদুটো বারবার আঁচলের প্রান্তে খুঁট পাকিয়ে চলেছে ও। মুখ নীচু করে থাকায় তারা দেখতে পায়নি, শান্ত চোখদুটো অবাধ অশ্রুতে টলোমলো, যেন এখুনি ঘোর বর্ষার মতো টপটপ করে ঝরে পরবে অশ্রুকণা। মনের ভেতরে যে শঙ্কাগুলো সবসময় কুরে কুরে খেত ফিহার, তা যেন আজ স্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছে মনে। অপরিচিত লোক, অচেনা জগত, নিজের খোলসে মুড়োনো সত্তাটুকু ওই স্বামী নামক পুরুষটির হাতে তুলে দেওয়া, আদৌ ওই পুরুষটি কেমন হবে, ওকে আদর দেওয়ার জায়গায় অমানুষিক আঘাত করবে কিনা, এমন ভয়াবহ ধরণের দুশ্চিন্তায় ছোট্ট বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড ভীত হয়ে যাচ্ছে। অব্যক্ত অদ্ভুত ভয়ের কাছে সতেরো বছরের পবিত্র, অস্পৃশ্য তনুমন ভীষণভাবে শঙ্কিত, ত্রস্ত, কুণ্ঠায় জড়িয়ে কিছুই বলতে পারছে না। মেয়ের জবুথবু অবস্থা ঠাহর করতে পেরেই যেন মা প্রসন্ন সুরে আরেকটু সরল হয়ে জানালেন,

– বড়োবু তোকে ছোটো থেকেই পছন্দ করতো ফিহা। বুর পরিবারটা কতো ছোটো তুইও জানিস। আমরা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেব বলে এতোদিন ভুলেও বিয়ের কথা উঠায়নি। আজ দুলাভাই খুব আন্তরিকভাবে তোর বাবার কাছে প্রস্তাব রেখে দিয়েছে। সাঈদও অফিসের কাজে চট্টগ্রামে চলে যাবে। দুলাভাই চাচ্ছে সাঈদ এখন থাকতে থাকতে কিছু একটা পাকা হোক। তুই যদি মত রাখিস তাহলে তোর বাবা শুধু কথা পাকাপাকি করবে। তুলে দেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো কথা উঠাতে যাবে না।

কথার মাঝপথে একটু বিরতি দিয়ে মেয়ের মনে একটুখানি সময় দিলেন তিনি। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে আবারও কথার কপাট খুলে বললেন নাজনীন,

– সাঈদের মতো ছেলেকে নিয়ে যত প্রশংসা আমি তোদের কাছে করেছি, আমার মনে হয় না ওর ব্যাপারে কিছু জানতে তোর বাকি আছে। ও কেমন ছেলে এতোদিনে তুই একটু হলেও জেনেছিস। তাছাড়া, তোর যদি মনে হয় তুই এতে রাজি না, সরাসরি আমাদের এখন জানিস দে। আমরা চাই না এই ছোট্ট বিষয়টার জন্য দুই পরিবারে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।

মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে সহসা পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা কিছু বয়ে গেল ওর। অদ্ভুত একটা বরফি শীতল হাওয়া বুকের অন্দর কোণে মূহুর্মুহু কাঁপিয়ে দিতে লাগল। দু’কানে স্পষ্ট শুনেছে ওই নাম! হ্যাঁ . . ভুল শোনেনি! একটুও না। প্রস্তাবটা বাহিরের কোনো অজ্ঞাত, অচেনা, বেঢপ লোক পাঠায়নি, স্বয়ং পাঠিয়েছে ওই একটি মাত্র পুরুষ। চোখভরা দুশ্চিন্তার অশ্রুগুলো পরম নিশ্চয়তার আশ্বাস পেয়ে হাতের উপরই যেন টপটপ করে ঝরে পড়তে থাকে। শিথিল হয়ে গেল মনের সমস্ত ভয়, হাতের খুঁট পাকানো আঁচল, চোখের আঁটকে রাখা পানিটুকুও। সে কী জানতো ওর হৃদয়ের প্রতিটি কোণ যে তার অনুভূতিতে রেঙে উঠেছে? ও যে তার সান্নিধ্যের ভেতর ভীষণ রকম জড়িয়ে থাকতে চায় এটুকু অবস্থা কী সে বুঝে গেছে? ঝরঝর করে নীরব অশ্রুর অশ্রুপাত দেখে বড্ড বিচলিত হয়ে যান বাবা নিয়াজ। মেয়েকে এতটুকু পরিমাণ কষ্টের ভেতর না রেখে সঙ্গে সঙ্গে কোমল বুঝ দিয়ে বলে উঠেন,

– এ প্রস্তাবে মত না থাকলে কোনো জোরাজুরি নেই মা। আমি এক্ষুণি ভাইজানকে ফিরিয়ে দিব। দরকার নেই এই প্রস্তাব। আমি কখনো তোমার উপর সিদ্ধান্ত চাপাইনি, আজও চাপাব না। আজই আমি সবকিছু মিটমাট করে দিব। তুমি শান্ত হও।

নিয়াজের মুখ থেকে ওমন ভয়ংকর কথা শুনে চট করে মাথা তুলে তাকায় ফিহা। বাবার মুখের দিকে আসল ইচ্ছেটুকু কোনোভাবেই প্রচ্ছন্ন জড়তার জন্য বলতে পারছে না। দুটো প্রসন্ন আর্দ্র চোখ একপলক মায়ের দিকে ফেলে পরক্ষণে তা বাবার দিকে স্থির করে বলল,

– তোমরা যা ভালো বুঝো, তাই করলে ভালো হয় বাবা। আমার কখনো এ চিন্তা মাথায় আসেনি, তোমরা আমার উপর জোর অধিকার চাপাচ্ছ। আজও মনে হচ্ছে না এটা জুলুম। তোমাদের সিদ্ধান্তই আমার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। তোমরা ভালো বুঝে যা চিন্তা নিবে, নিশ্চয়ই সেটা আমার জন্য ভালো।

উল্লেখ্যযোগ্য মতামতটা চাপা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে নিজের কথা শেষ করল ফিহা। আবারও মাথা নীচু করে বাবা-মার সামনে নিজের শালীন শিষ্টাচারটুকু বজায় রাখল সে। মেয়ের মুখের দিকে যতক্ষণ নিয়াজ ও নাজনীন তাকিয়ে ছিলেন, তাতে যতটুকু যা বুঝে নেওয়ার তা তারা বুঝে গেলেন। ডানে মুখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর পানে তাকালে মৃদু হাসি দিয়ে নাজনীনও হালকা ভাবে মাথাটা উপর-নীচ নাড়িয়ে দিলেন। ভদ্রলোক মিশ্র অনুভূতির শিকার হয়ে মেয়ের দিকে নিরুদ্বেগ সুরে বললেন,

– রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে আমরা বাসায় ফিরে যাচ্ছি। ব্যাগ যা গোছগাছ করা দরকার, তা এখনই সেরে নাও। পরে হয়ত সময় পাবে না। যাও, হাতমুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

সম্মতি জানিয়ে বাবার কাছ থেকে ফেরার পর এখনো অবধি স্থির হয়নি ফিহা। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে পর্যন্ত আসার পেছনে অন্য কোনো কারণ কী আছে? দূরবর্তী শহর, দূরবর্তী বিভাগে চলে যাচ্ছে বলে-ই কী এমন তাড়াহুড়ো? কিন্তু তাতে তো এমন তাড়াহুড়ো করবার প্রয়োজন ছিল না। ও তো পালিয়ে যাচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছে না, তাহলে এমন আকস্মিক পন্থায় চড়াও কেন?

.

কালো শার্টটা গা থেকে খুলে চেয়ারের উপর মেলে রাখল সাঈদ। প্যান্টের পকেট থেকে গাড়ির রিমোর্ট, ওয়ালেট, ব্লুটুথ এবং দু দুটো স্মার্টফোন কাঁচের সেন্টার টেবিলের উপর রেখে দিল। বিছানার দিকে চাইতেই লাবিব ইশারা বুঝে সঙ্গে সঙ্গে হাতে রাখা টাওয়েলটা বন্ধুর দিকে নিক্ষেপ করে বলল,

– তোর পিঠে দাগ বসে গেছে। এই শরীর নিয়ে কীভাবে স্বাভাবিক থাকোস জানি না। যে কেউ তোর পিঠের অবস্থা দেখলে সন্দেহ করব। লেজার টিট্রমেন্ট নেওয়ার সিচুয়েশন থাকলে নিয়ে নিস।

দেয়ালে পিঠ ঠেকা দিয়ে বিছানায় বসে থাকা ফাহাদ সবই শুনতে পাচ্ছে। কোলে থাকা ল্যাপটপে তখন ব্যস্ত আঙুল চালাতেই পেশাদার ডাক্তার ভঙ্গিতে বলল,

– সম্ভব না লাবিব। লেজার ট্রিটমেন্টের পর আবারও যে ওর পিঠে ওরকম দাগ হবে না, এটার কোনো গ্যারান্টি নেই। আমার মনে হয় কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকাটাই ভালো হবে।

ফ্লোরে হাঁটু ভাঙা অবস্থায় কিন্ঞ্চিত ঝুঁকে খোলা লাগেজ থেকে পোশাক বের করছিল সাঈদ। সে নিজেও জানে তার শরীরের কিছু কিছু দাগ লেজার ট্রিটমেন্ট করানোর জন্য উপযুক্ত নয়। জানেও না তার এই অবস্থাকে কেমন চোখে দেখবে নাবিলা। সবাইকে পুরোদস্তুর শান্ত, স্বাভাবিক, সুস্থির দেখালেও প্রকৃতপক্ষে একদমই সুস্থির নয়। অস্বাভাবিক কিছু ইঙ্গিত পেয়েই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি সিদ্ধান্ত তাকে আজই নিতে হয়েছে। তার মধ্যে একটি ছিল বিয়ের প্রস্তাব। লাগেজের চেইনটা লাগাতে লাগাতেই লাবিবের প্রচণ্ড কৌতুহলী স্বরটা কর্ণকুহরে শুনতে পেল সাঈদ,

– আমি একটা ব্যাপারে প্রশ্ন না করে পারলাম না সাঈদ। তুই মেবি আমাদের বলেছিলি বিয়ের বিষয়ে এখনই কিছু কনফার্ম জানাতে পারছিস না। এমনকি এটাও জানিয়েছিস কিছু কিছু ব্যাপারে ক্লিয়ার না হলে তুই বিয়ের ম্যাটারে আগাবি না। তাহলে চট করে তোর সিদ্ধান্ত বদলানোর মতো অবস্থা কেন হলো? আমি যদি ভুল না হই, তাহলে তুই স্ট্রং পারপাজ থেকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হইছিস। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার অর নট?

বন্ধ লাগেজের কাছে তখনো ওভাবে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সাঈদ। কিছুক্ষণ কালো লাগেজটার দিকে একদৃষ্টিতে কিছু ভাবনা সেরে এবার লাবিবের দিকে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

– ক্লিয়ার। আমি স্ট্রং পারপাজ থেকেই এই ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছি। নাহলে আমি নিতাম না। বিয়েও করতাম না।

উত্তর শুনে চট করে কিবোর্ডে আঙুল চালানো হাতটা থমকে গেল ফাহাদের। কথার ভেতরে গভীর রহস্যের জাল বুনে আছে। ঠাস করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিয়ে ভ্রুঁ কোঁচকানো ফাহাদ আস্তে করে লাবিবের পাশে এসে বসলো। লাবিবও যেন অনুমান করতে পেরেছে এই নিঝুম রাত্রির নিস্তব্ধ সময়টাতে কিছু দুর্বোধ্য ব্যাপার খোলাসা হবে। কিন্তু সেটা যে কী এবং কতটুকু সত্য, তার জন্যই লাবিব ফের তাগাদা দিয়ে বলল,

– কিচ্ছু গোপন করবি না। এই মূহুর্তে গোপন করার মতো সিচুয়েশন রাখলে কঠিন বিপদে পড়বি। কোন ঘটনা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিস? আমি আগেই আইডিয়া করেছিলাম তুই কিছু একটা থেকে প্রেশারে পরে এই কাজ করলি। এখন বল, কোন ঘটনার সূত্র ধরে প্রস্তাব পাঠাতে গেলি?

শান্ত দূরদর্শি চোখদুটো ওদের উপর থেকে ঘুরে তৎক্ষণাৎ নিজের পেছনে থাকা বন্ধ দরজার দিকে ছুঁড়ল। প্রখর দৃষ্টিতে দরজার উপরে থাকা লম্বালম্বি ছিটকিনি, মধ্যখানের সিলভার ধাতব নব, শেষের আড়াআড়ি থাকা ছিটকিনিটা পর্যবেক্ষণ শেষে দরজার নীচে সরু ফাঁকটার মাঝেও দৃষ্টি রাখল। কেউ নেই দরজার ওপাশে, দরজায় কান পাতলেও শুনবে না কিছু, ঠাস করে দরজা খোলার চিন্তাটুকু মেকি। পিনপতন নীরবতার ভেতর ছেয়ে থাকা রুমটা দৃঢ় অবিচল কণ্ঠস্বরে গমগম করে উঠল,

– যা বলব, রিল্যাক্সে সব শুনে যাবি। কোনো অ্যাকশন নিবি না। ডাটাগুলো সব আদিব পাঠিয়েছে। নাম, ইয়াসিন মাহমুদ। সার্টিফিকেটে নাম মাহমুদ হাসান ফয়সাল। নিজেকে ইন্ট্রোডাকশনে ইয়াসিন মাহমুদই বলে, সেটা ভুয়া। বতর্মান বাড়ি, খিলগাঁওয়ের আশপাশে। পেশায়, প্যাকেট, মেশিন, বডি পরিবহনের লোক। উদ্দেশ্য, কম বয়সী যুবতীকে ভালো লাগলে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া। আনসার্টেন ট্রমা, পারিবারিক দারিদ্রতা, নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি পেতে ওরকম বাজে লাইনে ঢুকেছে। কিন্তু আজ থেকে ক’বছর ধরে ওই লাইনের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। ধারণা করলাম, কারো প্রতি উইক হয়ে নিজেকে ভদ্র বানানোর চেষ্টায় আছে।

শান্তভাবে পুরো কথাটা শোনার পর লাবিব আর ফাহাদ আশ্চর্য হয়ে একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারা ধারণা করতে পারেনি বাড়িতে এখন কেঁচোর খোলসে ভয়ংকর এক সাপ লুকিয়ে আছে। প্রচণ্ড ত্রস্তভঙ্গিতে ফাহাদ বিছানা থেকে নেমে সাঈদের মুখোমুখি বসে বলল,

– সত্য করে বল, ওই হা রা ম জাদা পা° ষা ণটা এখন কী চাচ্ছে? তোর বউয়ের উপর উইক নাকি অন্য মোটিভ নিয়ে বসে আছে?

ওমন অপেক্ষাকৃত নীচু কণ্ঠ এবং কণ্ঠের ভেতর বারবার ‘ তোর বউ’ শব্দটা শুনে সাঈদ না পারতে হেসেই দিল। ভুখা ইঁদুরের মতো তাকিয়ে থাকা ফাহাদ বন্ধুর এই দুর্লভ হাসিটাকে পাত্তাই দিল না। উলটো চরম খেঁকিয়ে বলল,

– ধুরো ব্যাটা, হাসি দিস না তো। তাড়াতাড়ি বল ওই হা রা ম জাদা তোর বউয়ের উপর হাবুডুবু খাচ্ছে?

ওমন জাঁদরেল ভঙ্গিতে জেরা করতে দেখে লাবিব দুই ভ্রুঁ কুঁচকে ঠাস করে এক ঘা ক ষি য়ে দিলো! আপন কণ্ঠে বিরক্তির ঝাঁজ মাখিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

– হুরো ছা° গ ল, তুই ডাক্তার হবি নরম মানুষ। তুই আমার চাকরি কাঁধে তুলতে যাস কেন? ক° সা ই য়ে র মতো কচকচ করে অ পা রে শন করবি, তা না, আসছে নিজেরে ফকিরের শার্লক হোমস বানাতে। সর।

মাথার পেছনে দস্তানার মতো এক দাবড় খেয়ে চোখমুখ তখন কুঁচকে ফেলেছে ফাহাদ। মুখ ভরে ভরে গালি এলেও “উহঃ” শব্দে আর্তনাদ করা ছাড়া তেমন কিছু বাগড়া দিল না। দুই বেয়াদবের কীর্তিকাণ্ডের মাঝে আবারও নিজের অসমাপ্ত কথাগুলো বলতে শুরু করল সাঈদ,

– ওর মানব দরদী আচরণের জন্যই প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য হয়েছি। ওই আচরণ শুধু আমার জন্য-ই লাগবে। আমি ওটা অন্য কারো সাথে ভাগ বসাব না, কাউকে দেব-ও না। ফার্দার যখন ওর সামনে যাব, তখন আমার সামনে আমার বউ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে। এটাই আমার স্ট্রং পারপাজ। আর কোনো জিজ্ঞাসা?

বিস্ময় ভরা চোখে দুই বন্ধু একসাথে ডায়ে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানায়। তাদের মুখে আর কোনো বাক্যের জোগান পড়ে না। তারা ভেবেছিল ভয়ংকর কোনো সত্যের মুখোমুখি হয়ে জানতে পারবে, ফিহাকে বিয়ে করাটা এমনিই কোনো ভাঁওতাবাজি বা নৈমিত্তিক ব্যাপার। যেখানে মনের কোনো আধিপত্য নেই। কিন্তু কথার শেষভাগে যে সমস্ত জবাব আর প্রবল আকাঙ্ক্ষায় ধিক ধিক করা চোখদুটো দেখতে পেল, তাতে ওদের পুরোপুরি বিশ্বাস জন্মে গেছে, এই সাঈদ আর ক’মাস আগের সাঈদ এ দুটোর ভেতর বিস্তর ফারাক। পরিবর্তিত এই জুনায়েদ সাঈদ কেমন হতে চলেছে ধারণা নেই . . .

.

সকালের সূর্য নিজেকে জানান দিয়ে বেশ উত্তপ্ত ভাবে উঠল। মিঠে রোদের পরিবর্তে কড়া মেজাজী তাপটা যেন গায়ে এসে পরছে। জানালার বাইরে উদাসী নয়নে তাকিয়ে থাকা পাণ্ডুর মুখটা বহুকিছুই যেন জানান দিয়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এই কড়া মেজাজী তাপটার মতো কড়া মেজাজী পুরুষটি কোটি কোটি আলোকবর্ষের মতো দূরে। যাকে ছুঁতে পারার সাধ্য ও চেতনা, ভাগ্য ও আকাঙ্ক্ষা কোনোটাই তার জীবনে অবশিষ্ট রইল না। কাপড় ভরা ব্যাগটার মোটা চেইনটা বন্ধ করতেই হঠাৎ একজোড়া পা-কে এমুখো এগিয়ে আসতে লাগল। ফ্লোরে বসে থাকা ফিমা অগ্রগামী পাদুটো চিনতে পেরেছে। হাঁটতে হাঁটতে পাদুটোর মালিক ব্যাগের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পরলে ফিমাও জড়সড় মুখে উঠে দাঁড়িয়ে তাকাল। সূর্যের তেরছা আলোয় মুখ উজ্জ্বল করা গৌরবদীপ্ত চোখদুটো ওর দিকেই বিনা শব্দে চেয়ে আছে। যেন আগাম কিছু কথা বলার পূর্বে প্রস্তুত হচ্ছে মানুষটা। সেই প্রস্তুতির আগেই ফিমা কিছুটা হেসে প্রসন্নকণ্ঠে বলল,

– সাঈদ ভাই কী কাউকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকটায় এসে পড়লে নাকি?

সপাটে সাঈদেরও একচোট প্রশ্ন,

– তোর বোনকে খোঁজার জন্য এদিকটায় আসতে হবে?

কথার মারমুখি প্যাঁচে ধরা না দিয়ে ফিমা কিছুটা নিভলো। ট্রাউজারের পকেটে দু’হাত গুঁজে রেখে অতি সন্তপর্ণে অর্থবহ কথাগুলো বলে উঠল সাঈদ,

– তোর একটা চরম সত্য গোপন করলাম। তুইও আমার ব্যাপারে চরম একটা সত্য গোপন রাখবি। কথার নড়চড় যেন না হয়। আজকের পর আর কখনো ওর জীবনে বাগড়া দিতে আসবি না। এতোদিন আড়ালে আড়ালে যা যখন করেছিস . . সবই আমার জানা, আমার নখদর্পণে। ভেবে নিস তোকে দয়া করে ছাড় দিলাম। এই দয়াটুকু সবসময় মনে রাখবি। ভুলবি না। আমি ভুলে যাওয়া ব্যক্তিদের পা শ বি ক ভাবে শা° স্তি দিয়ে ফেলি। ওই কাজ এখন বন্ধ। শুধু মাথায় রাখবি, বাসে যদি ওইদিন সর্বনাশ ঘটে যেত, আমি তোর জীবনে কু রু ক্ষে ত্র বাঁধিয়ে দিতাম। এখনো কানের ওই চোট আর কাঁধের কাছে ব্যথা দুটোই আছে। আমার ইশারায় কাউকে কিছু জানায়নি। খুব সাবধানে থাকিস। আজ যেভাবে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওভাবেই যেন চারদিন পর ফিরিয়ে আনতে পারি। ঠিকআছে?

শেষের ক্ষুদ্র প্রশ্নটা যেন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের কোনো খু° নির মতো শোনালো। ওভাবে কখনো বলতে দেখেনি সাঈদ ভাইকে। এই স্বর, এই দৃষ্টি, এই ঠাণ্ডা ক্রুরতার মেজাজ যেন আগের চাইতে আরো ভয়ংকর ঠেকল। ঢোক গিলে শুকনো চৌচিরে গলাটা সিক্ত করে বলল,

– ঠিক. . ঠিকআছে ভাইয়া।

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা— মাথাব্যথার জন্য মনোযোগ দিয়ে লিখতে সমর্থ্য হলাম না। আন্তরিকভাবে দুঃখিত। দুঃখ প্রকাশ করলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here