নির্মোচন পর্ব ২৬ পর শেষ অংশ

0
337

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৬ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[শেষ টুকরো] .

ডায়ালকৃত ফোনটা কানে চাপা অবস্থায় আকস্মিকভাবে মুখের কথা আঁটকে গেল তার। অখণ্ড আইসবার্গের মতো নিস্পন্দ হয়ে সামনেই দু’চোখ স্থির করে ফেলল সাঈদ! তার অপ্রত্যাশিত এমন অদ্ভুত আচরণে তৎক্ষণাৎ লাবিব আর ফাহাদ সেই দৃষ্টি লক্ষ করে সামনের পানে তাকাল। অবিশ্বাস্য চোখে চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল দুই বন্ধু! কী দেখছে তারা! তৎক্ষণাৎ একে অন্যের দিকে জুলজুল চাহনি বিনিময় করতেই আবারও তারা অবাক-বিস্ময়ে সামনের দিকে মিটিমিটি হাসিতে তাকিয়ে রইল। যা দেখছে, তা সত্যি দেখছে তো? এবার কি স্থির থাকতে পারবে তাদের বন্ধু? কানের কাছ থেকে স্লো মোশনে কখন যে হাতের ফোনটা নীচে নেমে গেছে সেদিকে হুঁশ নেই সাঈদের। লাইটের ফর্সা আলোয় দূর থেকে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে সিল্কের কালো অন্ধকার রঙা শাড়িটি। কালো আব্রুর পরতে পরতে ফুটে উঠেছে বিপজ্জনক সৌন্দর্যের আশ্চর্য কঠিন উদাহরণ। চিন্তাও করেনি সাদামাটা বেশে ঘুরঘুর করা মেয়েটি আজকের এই সন্ধ্যাসজ্জায় তার মন, তার মস্তিষ্ক, তার দু’চোখের দৃষ্টিটুকু হরণ করে ফেলবে। লাবিব আস্তে করে ফাহাদের ডান হাতে ধাক্কা মেরে বলল,

– চল এখান থেকে। বিরিয়ানীর ভেতর দুষ্টু এলাচি হওয়ার দরকার নেই। স্পেস দিতে হবে।

ফাহাদ মৃদু ইঙ্গিতটা বুঝেও কেন জানি সরতে ইচ্ছে দেখাল না। জুনায়েদ সাঈদের মতো পাষণ্ড গোছের রোবট বন্ধুটা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেয় সেটাই দেখার জন্য মন প্রচণ্ড আঁকুপাকুঁ করছিল। কিন্তু লাবিবের ওমন কঠিন তীব্র চাহনি দেখে ফাহাদ না পেরে অপ্রস্তুত হেসে বলল,

– আরে ব্যাটা যাচ্ছি তো। মশার মতো কানের কাছে ভনভনানি দিস না। চল, আস্তে আস্তে হাঁটা দে।

দুই বন্ধু নিঃশব্দে সেখান থেকে কেটে পড়ল ধীরেসুস্থে। বুঝতেও দিল না কখন, কোনদিক দিয়ে সটকে পরেছে তারা। প্রবাসী বাড়ির জনহীন প্রাঙ্গণে ওই একটিমাত্র নারীমূতির পদাঙ্ক, পদশব্দের তালে তালে হিলজুতোর ঠক্ ঠক্ করা দাম্ভিক শব্দতরঙ্গ হচ্ছে, সেই শব্দতরঙ্গের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মিষ্টি সুগন্ধি ফুলের সুভাষ। আজ বড়ো বড়ো হরিণী চক্ষুর চক্ষুপাতায় ব্ল্যাক স্মোকি আইশ্যাডের নিখুঁত আই মেকআপের সৌন্দর্য, রক্তে দামামা ছড়ানো মিষ্টি লোভী ঠোঁটদুটোতে লিপগ্লসের গোলাপী আভার জেল্লা, কোমল স্নিগ্ধ গালদুটোতে বুরুশের হালকা নিখুঁত গোলাপি পরশ। যেন গোলাপের নির্যাস থেকে নিংড়ে আনা রঙটুকু তুলতুলে গালদুটোতে হালকা করে ছুঁয়ে নিয়েছে। মাথার মধ্যখানে লম্বা সিঁথি তুলে কালো ঝরঝরে রেশম চুলটা অবলীলায় ছেড়ে দেওয়া। সেই রেশম কালো চুলগুলোতে মৃদু দোল লাগাচ্ছে শীত আগমনী বাতাস। উজ্জ্বল গলায় জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ঠিকরাচ্ছে সাদা পাথরের চিকন একটি ক্লাসি নেকলেস, বাঁ’হাতের সরু কবজিতে সেই নেকলেস ম্যাচিং ব্রেসলেট। আরো একবার সেই ব্রেসলেটের ঢিলে হুকটা চেক করতে করতে কালো পার্সটার ভেতর ভাইব্রেট ফোনটা চটপট ঢুকিয়ে নিল ফিহা। এখনো খেয়াল করেনি তার দিকে দৃষ্টি থমকে তারই পরম পুরুষটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড্ড দেরি করে ফেলেছে এই সিল্কের শাড়িটি পরতে পরতে। বড়ো কোনো ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া এই প্রথমবার নিজহাতে শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন লজ্জা মেশানো ফুরফুরে অনুভূতি দিচ্ছে, তেমনি দিচ্ছে ঝামেলায় কিছুটা বিরক্ত হওয়া তেঁতো মন। দ্রুত পা চালানোর জন্যে ডানহাতে শাড়ির কুচিটা একটুখানি উঁচু করে ধরলে সুন্দর পাদুটোতে দৃশ্যমান হলো বেল্ট লাগানো কালো ফ্ল্যাট হিলের জুতা। চোখদুটো হিল ও কুচির দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে দ্রুতবেগেই খোলা গেটটার বাইরে পা রাখল ফিহা। সঙ্গে সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার সপাটে এক চাবুক ওর নরম বুকে আছড়ে পড়ল! স্থির হয়ে গেল ওর দুটি নয়নও। চকচকে ঠোঁটদুটো সহসা মৃদু কেঁপেও উঠল কেন জানি। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদেহী মানুষটির চক্ষুতারা, তার নিঃশব্দ গাম্ভীর্যের মুখায়ব, ডানহাতে থাকা মোবাইল ফোনটা ফর্মাল প্যান্টের ডান পকেটে ঢুকিয়ে নেওয়া, সবই ফিহার কোমল বুকটায় তীব্র কাঁপুনি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এজন্যই কী ঝলমলে একটা রঙিন অনুষ্ঠানে এই কালো রঙটা নির্বাচন করেছে সে? এই কুৎসিত কালো রঙটা এতোটাই প্রিয় তাঁর? চওড়া প্রশস্ত কাঁধদুটো তাঁর কালো শার্টের আব্রুতে ঢাকা, হাতঘড়িটি কালো রঙের হলেও গোলাকার চাকতিটা সিলভার রঙা, কবজির কাফড্ বাটনটা খুলে কালো হাতাটা গোটাতে গোটাতে বেশ মোটা করেই কনুইয়ের একটু আগেই ভাঁজ করে রেখেছে। এই অন্ধকার কালো রঙটি ছাড়া তাকে এখনো কোনো ঝলমলে রঙে দেখেনি ফিহা। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের অভদ্র মনকে শেকল পরিয়ে দ্রুত দৃষ্টিজোড়া স্বাভাবিক করল ফিহা। মন্থরপায়ে হেঁটে হেঁটে আসলো মানুষটার কাছে। রাস্তা পার করে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতেই গলাটা একটু স্বচ্ছ করে বলল,

– দেরির জন্য অসম্ভব দুঃখিত। বড়ো কোনো ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া পরতে গিয়ে প্রচণ্ড বেশি দেরি করে ফেলেছি। আপনি এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবেন জানলে আমি হয়ত আগে থেকে আরেকটু সতর্ক হয়ে থাকতাম।

বলতে বলতে চোখদুটো সেই লোকটার চোখে নিবদ্ধ করে রাখল ফিহা। বুঁদ বুঁদ করে জমে উঠা রক্তিম অনুভূতিগুলো দু’ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরুতে দিল না। গায়ে শীত ধরানো মৃদু বাতাসটা এখনো কপালের চুলটা দুষ্টুভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর, কিন্তু আম্ভরিক ছাঁচের ঠোঁটদুটো এ যাত্রাতেও কিছু ব্যক্ত করল না। কেমন মানুষ ইনি? কেউ কিছু বললে কি তার সোজা উত্তর দেওয়া যায় না? কেন ঠোঁটদুটো অদৃশ্য টেপ দিয়ে আঁটকে রেখে এরকম নির‍্যুত্তর ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে? বিরক্তির আঁচটা চিকন চিকন ভ্রুঁদুটোতে কুন্ঞ্চন সৃষ্টি করলে ফিহার মুখটা নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে শুধিয়ে উঠে,

– আমাকে কী খারাপ দেখাচ্ছে? কোনোভাবে কী মানাচ্ছে না আমায়?

বুকের অন্তঃকোণে তীব্র আকাঙ্ক্ষী মনটা তাঁর মুখ থেকে প্রশংসনীয় বাক্যটুকু শুনতে চাইছে। মরুর বুকে খাঁ খাঁ করা জল পিপাসার মতোই বড্ড আনচান করছে ওর অবুঝ ছোট্ট মনটা। বুকের কাছাকাছি থাকা ওই প্রশ্নাতুর চোখদুটো জবাবের উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে থাকলে নিঃশব্দে মুচকি হাসিটা ঠোঁটে ফুটালো সাঈদ। মনের ভেতরটা দুলে উঠে ওই পাগল করা হাসিটা শেষমেশ বড্ড কাছ থেকে উপহার দিল প্রিয় মুখটিকে। কিচ্ছু বলল না সাঈদ। যেন শব্দালংকারের চাইতে নিঃশব্দ ওই অর্থপূর্ণ হৃদয় দোলানো হাসিটি বড্ড বেশি বাক্যময়। রাত ঘনানো আকাশে উঁকি দিয়ে উঠা চন্দ্রকিরণ এই অন্ধকার প্রিয় লোকটার জীবনে এভাবেই হয়ত জোৎস্নার আলো ফুটিয়ে দিবে। আর সেই মায়াময় আলোতে জীবনের টুকরো টুকরো সুখগুলো কুড়িয়ে নিবে এই স্বল্পভাষী লোকটি। ঠোঁটে সেই হাসিখানা জড়িয়ে রেখেই একটা হাত রাখল ফিহার ডান হাতে, ভীষণ আলতো এবং নরমভাবে। নির্দিষ্ট কথাটা স্রেফ ও-ই শুনতে পাক এমন একটা স্কেল বজায় রেখে মৃদুকণ্ঠে জানালো,

– আপনাকে লাগাম ছাড়া সুন্দর দেখাচ্ছে। এই লাগামহীন সৌন্দর্যের কাছে আমার ধৈর্যের বাঁধ মানছে না।

কিশোরী চন্ঞ্চল চোখের তারায় প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসটুকু ঝিলিক দিয়ে উঠল ফিহার। সারল্য হাসিতে ভরপুর ওই মেয়েলি নরম ঠোঁটজোড়া চওড়া হাসিতে প্রসন্ন হয়ে রইল। এতটুকু পরিমাণ জড়তার আঁচ বুকের কোনো কোণেই আজ টের পেল না ফিহা। এই যে পার্স ধরা ডানহাতের কবজিটা সে আলতো করে ছুঁয়ে ধরেছে, এতেও মন ও মস্তিষ্ক একটা সেকেন্ডের জন্যও সংকোচ অনুভব করল না। কিন্তু শরীরে ঠান্ডা ধরানো মৃদু মৃদু বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথেই চূড়ান্ত বাগড়া দিতে হাজির হলো ফোন। সশব্দে ভাইব্রেট হয়ে বড্ড বিশ্রীভাবে কাঁপিয়ে দিল ফিহার পার্স ধরা হাতটা। চটক ভেঙে স্বশরীরে ফিহা প্রচণ্ড কেঁপে উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা রিসিভের জন্য পার্স খুলে বের করতে লাগল। অন্যদিকে প্যান্টের পকেটে থাকা সাঈদের ফোনটাও ‘ ফাহাদ ইজ কলিং ‘ উঠে অনুষ্ঠানে দেরি করা নিয়ে মৃদু হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেলেছে। রেড আইকনে বৃদ্ধাঙুল বসিয়ে কলটা কাটতেই কথা বলতে থাকা ফিহার দিকে অনুষ্ঠানে পা বাড়ানোর জন্য চক্ষু ইশারা বোঝাল। ফিহা মাথাটা সম্মতির সুরে ‘হ্যাঁ’ বুঝিয়ে হাঁটা চালু করতেই আগে আগে ঢুকল ও। এরপর পাঁচ মিনিট অন্তর রেখে বেশ ধীরস্থিরভাবে প্রবেশ করল সাঈদ।

.

মাঝারি একটা প্যান্ডেল বাঁধিয়ে বেশ সুন্দর করে জায়গাটা সাজিয়ে রাখা। মানুষে মানুষে ভিড় হয়ে ভীষণ ভালোই লাগছে শেষ অনুষ্ঠানটা। আকাশের কালো ঝাঁপিতে দুষ্টু দুষ্টু নক্ষত্রের মাঝে গোল চাকতির মতো একখানা সুন্দর চাঁদ। চাঁদের মিঠে মিঠে আলোয় একীভূত হয়ে আছে ঝরঝরে গানের সুর-শব্দ-গলা। চোখ ঝলসে দেওয়া আলোকসজ্জার এই দারুণ সমাহার দেখে উপস্থিত সবার মনটাই কীরকম চনমনে হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলের অবস্থা দেখলে মনে হবে এ যেন ছোটোখাটো এক কন্সার্টের মতো ছোট্ট প্রয়াস। আর সেই প্রয়াসে প্রৌঢ় থেকে শুরু করে সবাই হাসি-ঠাট্টায় নব্বই দশক থেকে একেবারে হাল আমলের গান পর্যন্ত গেয়ে যাচ্ছে। কী উপচে পড়া হাসি, কী বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস! শরবতের গ্লাসে চুমুক দেওয়া ভদ্রলোক সোয়াদ পাশে থাকা স্ত্রীর দিকে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন,

– সানা, আমার মনে হয় তুমি একটা গান ধরতে পারো। তোমার দ্বিগুণ বয়সী মাজেদা আপা যদি গীত গেয়ে নিজের জন্য হাততালি নিতে পারে, আমার মনে হয় তুমি উনার চেয়ে ভালোই পারবে।

প্যান্ডেলে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকা আফসানা সেকেন্ডের ভেতর স্বামীর দিকে আগুনদৃষ্টিতে তাকালেন। বয়স বাড়তে বাড়তে এখন তলানির দিকে এসে পরেছে তাও ভদ্রলোকের রসবোধ যেন কমছেই না! তিনি কণ্ঠস্বর বেশ চৌকশ করে একটু আগের গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুধিয়ে উঠলেন,

– আপনি প্রস্তাবের বিষয় নিয়ে কি ভাবলেন? দেখুন মেজর সাহেব, একটা কথা আপনাকে পরিস্কার বলে রাখি। ছোটো বোনজামাই কিন্তু রোকসানার জামাইর মতো অর্থলোভী লোক না। খুবই সৎ আর ভালো মনের মানুষ। বিয়ের কথা মাথায় আসলেই কিন্তু পরিবারের উপর আর্থিক ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তার উপর বড়ো মেয়ে এখনো অবিবাহিতা। বড়ো মেয়ে রেখে ছোটো মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে নিশ্চিত প্রস্তাবটা ওরা ফিরিয়ে দিবে। কোনো বাবা-মাই চাইবে না সন্তানের মধ্যে এরকম একটা ভেদাভেদ হোক।

স্ত্রীর যুক্তি শুনে নিজেও একখণ্ড যুক্তি উপস্থাপন করলেন সোয়াদ,

– তোমার কথাবার্তার সাথে একমত হতে পারলাম না। তুমি সোসাইটির বানানো নিয়মকানুনের দিকে কেন ঝুঁকছো সাঈদের মা? বিয়েটা কী সোসাইটি নির্ধারণ করে দিবে, নাকি যার যার ব্যক্তিগত ধর্ম? ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করলে কখনো বড়ো মেয়ে, ছোটো মেয়ে এই ধরণের প্রসঙ্গ আসার কথা না। বরং ওদের মেয়ে সাবালিকা হয়েছে কিনা সেটা দেখো। কথাবার্তা আর বিচারবুদ্ধিতে যদি পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো ছাপ না থাকে তাহলে সেই মেয়েকে ‘সাবালিকা’ বলাই উচিত। কিন্তু আমার মনে হয় না তোমার বোনঝি নাবিলা অতোটা অবুঝ। সতেরো বছর বয়সী, জেলা শহরে বেড়ে উঠা বেশ নামীদামী একটা সরকারী কলেজ থেকে পড়ছে। সবদিক দিয়ে ওর বোন ফিমার সাথেও সমান তালে চলতে শিখেছে, তাহলে সেই মেয়ে অবশ্যই নাদান নয়।

– কিন্তু এখানেও একটা গুরুতর সমস্যা আছে মেজর সাহেব। আপনি সেটাতে কেন গুরুত্ব দিচ্ছেন না আমি একদম বুঝতে পারছি না। দেশের সরকারি আইন অনুসারে আঠারো বয়সের নীচে মেয়ে বিয়ে দেওয়া আইনগত অপরাধ। সেখানে আপনি আইনশৃঙ্খলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েও এই ধরণের ভুল বক্তব্য কেন রাখছেন জানি না।

– সবদিক বিবেচনা করে আমি আমার সঠিক অভিমত পোষণ করছি সানা। আরো একটা কথা মনে রাখবে, প্রস্তাব দেওয়া মানেই কোনো মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়া না। দু’পক্ষ ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে সবটা বুঝে তারপর একটা পারস্পরিক সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর তারা কন্যা তুলে দেয়। ছেলে কিন্তু কবজি ডুবিয়ে মেহমানদারী করা নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। সে মেহমান খাওয়াবে না। তুমি তোমার জায়গা থেকে কীভাবে সব দেখভাল করবে দেখে নাও।

– আশ্চর্যজনক কথাবার্তা, একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে মানুষ দাওয়াত দিব না? আয়োজন করব না আমি? এগুলো কী ধরণের অসামাজিক আচরণ?

– বললাম তো, বিয়ে যে করছে তার সঙ্গে এসব বুঝো। আমি শুধু আমার তরফ থেকে দায়িত্বের কাজটা পালন করব। তাছাড়া আমিও চাই, আমাদের বাড়িটা আলোকিত করে ওই মিষ্টি স্বভাবী পুতুল মেয়েটা চলে আসুক। তোমার অভদ্র, ভাব নিয়ে থাকা ছেলেকে যদি সভ্যতার লাইনে আনতে পারে, তাহলে আমি কোনো ক্ষতি দেখছি না।

এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না আফসানা কাদির। সাঈদের বাবা একপ্রকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছেন আজ রাতে তিনি খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটা রাখতে যাবেন। তারপর যা হয়, তা দেখা যাবে।

.

প্যান্ডেলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বেশ মন মাতানো গান ধরেছে তপন। সঙ্গে গিটারের তারে সুরেলা শব্দ যুক্ত করে পরিবেশটা অদ্ভুত ভাবে বদলে দিয়েছে। দীপ তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সাথে আগমনী অতিথিবৃন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত। আর বাকিরা যে যার যার কথায় এবং আড্ডায় নানাভাবে মগ্ন। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটার মতো বাজবে, কিন্তু ফিহার ইচ্ছে করছে শৈলীদের বাড়িতে গিয়ে পোশাক খুলে টানটান বিছানায় শুয়ে পরতে। অদ্ভুত একটা আলস্য ভাব সারা শরীর-মন জুড়ে ছেঁকে ধরেছে। মা আর খালামণিরা কী কী ব্যাপার নিয়ে আলোচনা আর হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠছে তা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। ফিমাও জর্জেটের একটা গোলাপি শাড়ি পরে বেশ চটকদার সাজ দিয়ে তার বয়সী মেয়েগুলোর সাথে কথাবার্তা বলছে। অন্যদিকে আরো একবার হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলাতেই লাবিব ইঙ্গিতপূর্ণ স্বরে বলল,

– আর দুই মিনিটের মতো বাকি। বেশিক্ষণ নেই। বিশ্বাস কর, আমি মারাত্মক এক্সাইটেড!

টানটান উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে ফাহাদের মধ্যেও একই অবস্থার সন্ঞ্চারণ ঘটেছে। ঠোঁটে বিশ্বজয়ীর মতো কাঙ্ক্ষিত হাসিটা ছুঁড়ে দিতেই প্রসন্ন কণ্ঠে বলে উঠল,

– এই ফার্স্ট টাইম মেবি আন্টির সামনে বো° মা ফা° টতে চলেছে তাই না? ওর মা কি ব্যাপারটা জানতো লাইব্বা?

– আরে না, লিটার্লি কেউই জানে না। আঙ্কেল জানে কিনা শিওর না। কিন্তু বাড়ির কোনো কাকপঙ্ক্ষি কিচ্ছু এখনো জানে না।

– আমার তো এখন মন চাইছে নিজেই একটা জোগাড় করে এই আনন্দে শামিল হই। ক-ত্ব-দিন এমন আনন্দের স্বাদ পাই না! লাস্ট সেই যে আমরা পাঁচজন মিলে ‘রাতারগুল’ ট্যুরের সময় আনন্দ করছিলাম, ওই দিনগুলো আর ক্যাচআপ করতেই পারলাম না।

ঘড়ি থেকে চোখ তুলে ফাহাদকে কিছু বলতে নিবে লাবিব, তার আগেই আকস্মিকভাবে লাইটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর খোলা আসমানের নক্ষত্ররা দুষ্টু হাসিতে যেন মজা লুটছে। যেন হৈ হৈ করা একদঙ্গল মানুষের উদ্দেশ্যে বলছে— “হে মনুষ্যদল! শান্ত হও। তোমরা এখন দেখবে এ রাতের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত। এমন এক অবর্ণিত মূহুর্ত, যে মূহুর্তের ব্যাপারে শুধু আমি জানি। তোমরা তো জানো না, এ পৃথিবীর বুকে কত কত গল্প লুকোনো থাকে। কত শত মর্মবেদনা তারা জানায় কালো আসমানের কাছে। কত কত হাহাকার, চিৎকার, নীরব ধ্বনি পৌঁছায় আমার নিকট। তোমরা কি জানো তারা আমার দিকে নীরবে কত অশ্রু ঝরায়? জানো কতটা দুঃখে থাকে তাদের ওই চোখ ঝরা বিন্দুতে? তোমরা যখন দু’চোখ বুজে শান্তির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ো, তখন তোমাদের আশেপাশে, তোমাদেরই কাছে, তোমাদের নিকটে থাকা কোনো মনুষ্য চোখ এই আমার খুঁজে পায়। কী হাহাকার, গ্লানি, বিষণ্ণতা। হে মনুষ্য! তোমরা ভীষণ নিষ্ঠুর। হাসির নীচে লুকিয়ে থাকা দুঃখ তোমরা বুঝো না। অথচ, এই আমার নীচে লুকিয়ে থাকা রহস্য তোমরা খুঁজতে আসো।” প্রকৃতির এমন অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শোঁ শোঁ বাতাসে মিলিয়ে যেতেই মনে মনে “এক, দুই, তিন . . .” গুণতে শুরু করেছে দুই বন্ধু। জিভের আগায় ‘দশ’ উচ্চারণ করতে দেরি, অকস্মাৎ দপ করে জ্বলে উঠল সবক’টা লাইট। উজ্জ্বল হয়ে উঠল প্যান্ডেলের সমস্ত আলো, ঝলমলিয়ে উঠল কাঙ্ক্ষিত সেই অভিভূত পরিবেশ! লাবিব, ফাহাদ, দীপ বাদে প্রত্যেকের চোখে আশ্চর্যের বিচ্ছুরণ, কৌতুহলে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না, এমনই এক ধাঁধাপূর্ণ অবস্থার ভেতর প্যান্ডেলের চেয়ারটায় বসে গিটারটা হাতে তুলল সাঈদ। যেন পেশাদার একজন গিটারিস্ট তার শখের বস্তুটা যত্ন করে বুঝে নিল। ঠোঁটের কাছাকাছি স্ট্যান্ড মাইক, চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে পজিশনটা ঠিক করে ফেলেছে। এবার গিটারের তারে আঙুল ছোঁয়াতেই মৃদু সুরটা তুলে দু’চোখ বন্ধ করল সাঈদ। ঘন সুন্দর লম্বা পাপড়ির চোখদুটো ওভাবেই বুজে রেখে গানের বাক্যগুলো গেয়ে উঠল ধীরে ধীরে। সেই সকালে দেখা প্রথম ওই মুখ, লাল টকটকে নাকে ফোলা ফোলা চোখ,

কোনো এক সকালে,
তোকে প্রথম দেখেছি।

মনের এই গভীরে
তোকে আমার করেছি।

গলার কাছে কাঁটা আঁটকানোর মতো ঢোকটা তখুনি আঁটকে গেল ফিহার। রক্তের শিরাগুলো তীব্র টনের্ডোর মতো উত্তাল হয়ে উঠল ওর। নিজের দু’চোখ, দু’কান, কোনো ইন্দ্রীয়কেই ও এক সেকেন্ডের জন্য বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটাই ঘটিয়ে যেন নিজের ভঙ্গিতে ঘটিয়ে দিয়েছে সাঈদ। দক্ষপূর্ণ সাবলীল সুন্দর কণ্ঠে সে যেন মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে সুর ছেড়ে ধরলো,

গোধূলির রং আলতো ছোঁয়ায়
ছুঁয়ে দে আমায়,

চোখ খুলে সরাসরি শান্ত, প্রসন্ন, নির্মল দৃষ্টিটা প্রিয় মুখটির পানে তাক করে গাইল,

একটুখানি সাঁঝ নেমে অন্ধকারে,

হাতে হাত রেখে উড়ে বেড়াই . .
উড়ে বেড়াই,

ছেলের মাঝে এমন সুনিঁখুত কণ্ঠের সুর, এমন স্বাভাবিকত্ব, এমন অসাধারণ দৃশ্যপট দেখে ধাক্কাটা সামলাতেই পারলেন না আফসানা। ডানহাত দিয়ে সোয়াদের বাঁহাতটা সজোড়ে খামচে ধরলেন তিনি। যেন বলতে চাইছিলেন, “সাঈদের বাবা, এ আপনার ছেলেই তো? ঠিক দেখছি গো আমি? গান কবে গাইতে শিখলো? কি দেখছি গো সাঈদের বাবা!” শত শত কৌতুহলের মাঝেই হঠাৎ করে প্রত্যেকের মাঝে আনন্দের স্ফুরণ বয়ে গেল। সাঈদের গিটারের তারে আঙুল চালানো প্রতিটি সুর, ছন্দ, মন মাতানো তালটা সকলের মুখ, চোখ, ঠোঁটে, হাসিতে, খুশিতে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। চোখ বুজে তীব্র আকণ্ঠ অনুভূতি থেকে নিখাদ অবস্থাটুকুই যেন ব্যক্ত করে উঠল গানে, দ্রুততার তালে গিটারের তারগুলোতে তীব্র অস্থির ঝংকার তুলে গেয়ে উঠল সুর-কথা,

আজ ঘুরে ঘুরে মন উড়ে উড়ে,
তোকে চাই কাছে বারে বার।

মন দেওয়ানা, করে ছলনা
তোকে খুঁজে ফিরি বারবার।

তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।

পঙকির সুর মাখানো কণ্ঠে প্রবল উৎকণ্ঠাটুকু দফায় দফায় বুঝিয়ে দিচ্ছে এই কট্টর পুরুষ। হৃদয়ের মণিকোঠায় জমে থাকা নরম অনুভূতির বাষ্পগুলো সে ছেড়ে দিচ্ছে অবলীলায়। তার সবচাইতে গোপনতম গুণ, তার গাওয়ার এই উৎসটুকু দিয়েই ব্যক্ত করছে সুকঠিন অবস্থা। দু’চোখ খুলে সামনের ওই মুখটির পানে চাইতেই কণ্ঠস্বর যেন আবারও দুষ্টু খোলসে ইঙ্গিত রেখে গাইলো,

দেখে লাগে জানি কেমন,
বোঝাতে পারিনি আমি তখন।

মায়াভরা চোখে চেয়ে,

আমাকে করেছে শেষ,

আমিও হয়েছি পাগল,

শেষ লাইনে যেন সত্যিকার অবস্থাই বলে উঠল সাঈদ। হুট করে এক পশলা বাতাসের ঢেউ তাঁর কপালে ছেয়ে থাকা জেলহীন চুলটাকে উড়িয়ে দিল। ভ্রুঁ ছুঁই ছুঁই করতে থাকা দুষ্টু চুলের কাণ্ড দেখে অজান্তেই হাসি ছলকে উঠল ফিহার। আকাশ সম মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকতে থাকতেই মাধূর্য ভরা কণ্ঠটার সাথে কখন যে এতোসংখ্যক কণ্ঠ মিলে একাকার হয়ে গেছে, তা খেয়াল করেনি ও। একসাথে অনেকগুলো কণ্ঠ একত্র হয়ে সমস্বরে সেই গানটার সাথে মন-প্রাণ-সুর মিলিয়ে গাইলো,

তোকে ছাড়া আমার কাটে না সময়
কীভাবে বোঝাই তোকে কত করে চাই

রাতদিন আমার কাটে নিরালায় ভেবে
কী জাদু চোখে, কী মায়া জড়ালে।

আজ উড়ে উড়ে মন ঘুরে ঘুরে
তোকে চাই কাছে বারে বার।
মন দেওয়ানা, করে ছলনা,
তোকে খুঁজে ফিরি বারবার।

এবার একটু থামল সাঈদ। থেমে গেল তার গিটারের তার, তার সুদক্ষ নিপুণ হাত, তার ঠান্ডা স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর। সমবেত কণ্ঠগুলো আচানক এমন কাণ্ডে কিছুই বুঝতে পারল না। মাঝপথে কী গানের লাইনটা ভুলে গেছে নাকি? এভাবে থামলো কেন? ফিহার মুখটা অন্যান্যদের মতো কৌতুহলে মাখো মাখো হলে এবার ঠোঁটে মুচকি হাসিটি জিইয়ে রেখে উচ্চ স্কেলে গেয়ে উঠল সাঈদ,

তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
আমি শুরু থেকে শেষ তোকে চাই।

তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।

‘আমি শুধু যে তোমাকেই চাই’।

স্থায়ীভাবে গানটার সমাপ্তি টানতেই প্রচণ্ড কান ফাটানো শব্দে মুখর হয়ে উঠল জায়গাটা। সবাই ‘ঠাস ঠাস’ কঠিন করতালিতে ফেটে পরেছে। থামছেই না, থামলই না! যেন এই সুন্দর রাত্রির সবচাইতে জমকালো ব্যাপারটা উপভোগ করেছে তারা। যাকে এই বাড়িতে সবচেয়ে কম মাতামাতি করতে দেখা যেত, যাকে দেখা যেত নিরিবিলি, শান্ত, নিজের মতো করে থাকতে, সেই নীরবে থাকা পুরুষটিই যেন জ্বলজ্বলে তারার মতো সবার কাছে ধরা দিয়েছে। কী অদ্ভুত এক ব্যাপার!

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা— মন্তব্য, মন্তব্য, মন্তব্য জানাবেন কিন্তু। শুভ মিষ্টি রাত্রী। 😁❤

[শব্দসংখ্যা: ২৬০০+]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here