নির্মোচন পর্ব ২৫ (শেষ টুকরো)

0
290

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[শেষ টুকরো] .

আফ্রিকার সবচাইতে ভয়ংকর বিপজ্জনক সা° প— “ব্ল্যাক মা° ম্বা”। পৃথিবীর প্রথম বৃহত্তম সা°প “কিং কো° ব° রা বা শঙ্খচূড়”-এর পর দ্বিতীয় বৃহত্তম হিসেবে ব্ল্যা° ক মা° ম্বা স্থান গেড়েছে। যার একটা ছোবলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু নিশ্চিত, যার দ্রুতগামী বেগ ঘণ্টায় ১৯.৫ কিলোমিটার। সেই বিপজ্জনক সা° পের নামানুসারে ক্যালিনান কালো গাড়িটি শোভা পেয়েছে। যেই গাড়ির ব্যাকসীটে এখন তিনটে ম° দা রু ব্যক্তি নেশায় ঢুলু। গা থেকে কড়া ম° দে° র গন্ধ ভুরভুর করে বের হচ্ছে, আর আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো প্রত্যেকের মুখ অক্ষত। তারা কেউ নাবিলা হক ফিহার ব্যাপারে কোনোভাবেই জড়িত না। থার্ড ব্যক্তি বা বাইরের কোনো ব্যক্তিদল এতে জড়িত থাকার সম্ভাবনা আছে। নাবিলাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে সুফিয়ার কাছে বুঝিয়ে সে তৎক্ষণাৎ দীপের তিনবন্ধুকে খুঁজতে যায়। বলা বাহুল্য, আমেরিকার স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট তৌকির আহমেদ শিহাব, শিল্পপতি বাবার বখে যাওয়া সদ্য পদপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যানেজার হাসিব ইকবাল, মোটা অংকের ঘুষ খাওয়া ব্যারিষ্টার আফিদ খন্দকার— সবকটা বিদেশি ম° দে° র ঢেঁকুর তুলে কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে বেহুঁশ ছিল। কমিউনিটি সেন্টারের দেখভালের জন্য একমাত্র যেই লোক, সেই ম্যানেজার লোকটাকে টাকার সুঘ্রাণে মুগ্ধ করে “কেউ যেন ছাদে না আসে!” কথাটার মতো ফলিয়ে ছাড়ে। আপাতত ম্যানেজার লোকটা চরম ভয়ে “আল্লাহ আল্লাহ” যিকির শুরু করে দিয়েছে, যেন উপর মালিকের কাছ থেকে চাকরি নটের খবর না-আসে। ফাহাদ, লাবিব ও ওখানকার দু’জন কেয়ারটেকারের সাহায্যে তিন মাতালকে গাড়িতে তুলেছে সাঈদ। এই অবস্থায় কেউ দেখে ফেলে বিশ্রী একটা বিপত্তি ঘটাক, তা সে চায় না। বর-কণে উভয়পক্ষের সম্মানের চাইতে কণের সম্মানটাই আগে যাবে এখানে। কারণ এলাকাটা কণেদের স্থানীয়। সবদিক বিবেচনা করেই সে নাবিলাকে নিজের গাড়িতে তুলেনি এখন। এখনো অবশ্য তুলার মতো অবস্থা ও সুযোগ দুটোই হাতে আছে, কিন্তু বাসের মধ্যে বরযাত্রী ছাড়া আরো যে-ক’জন মানুষ উপস্থিত আছে, তারা ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক নজরে দেখবে না। তাছাড়া মদের উৎকট একটা গন্ধের ভেতর ও নিজেও বেশিক্ষণ সুস্থভাবে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ, তার চেয়ে বরং বাসেই যাক।

.

বরযাত্রী-সহ এক এক করে সবাই নেমে যেতেই ফিহা ইচ্ছে করে সবার শেষে নামল। ওড়নাটা দিয়ে আরেকটু ভালো করে মাথা, কাঁধ, শরীরের উপর অংশটা ঢেকে নিয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, আপাতত মা, বাবা বা কেউ না-দেখুক! ওদিকে সবাই নতুন বউকে ঘরে তোলার জন্য কী কী সব লোকজ নিয়ম মেনে এরপর নির্দেশ দিল আমেনার স্বামীকে,

– জামাই? দূরে দাঁড়ায়া আছ কেন? এদিকে আসো এদিকে। নতুন বউকে কোলে তুইলা তাড়াতাড়ি মহিলা মানুষের গ্যান্ঞ্জামটা খতম করো। আর সহ্য হইতেছে না। কী যে নিয়ম নীতি শুরু করছে এরা!

দীপের বাবা বিরক্ত স্বরে কথাগুলো বলে উঠলে রোকসানা কাদির মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠেন,

– কী সমস্যা আপনার? এগুলো মহিলা মানুষের গ্যান্ঞ্জাম আপনারে কে বলছে? ও মা, আপনার ছেলেরে একটু বুঝান তো। এসব পালন না করলে অমঙ্গল হবে না বলেন? মাত্র নতুন নতুন কবুলটা পড়ালো।

দীপের থুত্থুড়ে বুড়ি দাদী লাঠিতে ভর দিয়ে কোমর কুঁজো করে বললেন,

– বৌমা, তুমি কামডা সাইরা লাওসাই। ওর কথাত কান দেও ক্যা?

বুড়ো দাদীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমেনার স্বামী ভুঁড়ি সামালে হেঃ হেঃ হাসিতে সামনে এসে দাঁড়াল। অন্যদিকে বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে সটান গাড়িতে হেলান দিয়ে বুজরুকি তামাশা দেখছে সাঈদ। সুদীর্ঘ উচ্চতার দরুন দূরের সমস্ত কাহিনি তার নখদর্পণে স্পষ্ট। বেচারি নববধূ কতটা অস্বস্তির ভেতর শাড়ির আঁচল খামচে আছে সেটুকু দৃশ্য যেন দেখতেই পাচ্ছে না কেউ। এদিকে আফসানা কোলে তোলার মতো জঘন্য নিয়মটা দেখে অতীতের একটুকরো ঘটনা অজান্তেই স্মরণ করছিলেন। এভাবেই এক উদ্ভট নিয়ম মানতে গিয়ে প্রবেশপথে ঝামেলা করেছিলেন তিনি। নিজের গায়ে স্বামী ছাড়া অন্য কারো স্পর্শে কোলে উঠার অবস্থা দেখে তাকে সেসময় শ্বাশুড়ি-সহ অন্যান্য বউরা “ছিঃ ছিঃ” নজরে টিটকারি দিয়েছিল। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে আবারও একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখে কিছু বলতে নিবেন, তার আগেই ছেলের এফোঁড়-ওফোঁড় করা কঠিন-দীপ্ত স্বরটা বিদ্ধ করে ছাড়ল,

– আলহামদুলিল্লাহ্ বলা বিয়েটার মধ্যে এক চিমটি নাউযুবিল্লাহ ঢুকাচ্ছেন। লজ্জা থাকলে অন্যের বউকে কোলে তোলার কথা না।

তীব্র দাপটে প্রতিটি কথা উচ্চ গলাতে শুনিয়ে ছাড়ল জুনায়েদ সাঈদ। যেন উপস্থিত প্রত্যেকের কানে যেন শূঁলের মতো কথাগুলো বিঁধে। সঙ্গে সঙ্গে সব কয়টা বিমূঢ়দৃষ্টি পেছনের দিকে ঘুরে যেতেই গাড়িতে হেলান দেওয়া অবস্থায় সুদেহী যুবকটির দিকে নজর পড়ল তাদের। সেই ভঙ্গিতেই যুবক আরো একবার উচ্চবাক্যে প্রতিবাদ করে উঠল,

– কবুল বলার কাজটা যে করতে পেরেছে, সে নিশ্চয়ই ফিজিক্যাল ডিসঅর্ডারের অ° টি স্টি° ক ব্যক্তি না। যার বউ তার কাছেই হিসাবটা বুঝিয়ে দেন। এসব নাটুকপনা ঢঙ ইসলামি শরিয়তের মধ্যে ঢুকাবেন না।

শেষের কথাটা আপাতদৃষ্টিতে রোকসানা ও দীপের বাবার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু রোকসানা বুজুর্গ মানুষের সামনে কী রেখে কী বলবে বুঝতে পারছে না। ইতোমধ্যে ভিড় করা প্রতিবেশী মহিলাদের মাঝে কানাঘুসো শুরু হয়ে গেছে। কুণ্ঠায় নত হয়ে থাকা নববধূ এরকম একটা ঝামেলা দেখে ঘোমটার নীচে প্রায় কেঁদেই দিবে এরকম একটা অবস্থা। এতোগুলো মানুষের সামনে আরো একবার নাক কাঁটা পরে আজগর আলী সমুখে ক্রুদ্ধ গলায় হুংকার দিয়ে উঠলেন,

– বয়স যত হয়নাই, বাড় তত বেড়ো না। তোমাকে কেউ বলেনাই নিজের আলগা জ্ঞানটা এখানে বিতরণ করতে আসো। যেইটা জানো না ওইটা নিয়া লাফালাফি দেখাও ক্যান, অ্যাঁ?

পালটা অপমান শুনেও কাঠিন্য মুখটি যেন আগের মতোই নির্লিপ্ত হয়ে আছে। আঁটসাঁট কালো শার্টের উপর তাঁর বলিষ্ঠ হাতদুটো তখনও ভাঁজ করা, তখনও তাঁর কৃষ্ণাভ চোখের স্থির মণিদুটো আজগর আলীকে পরিমাপ করে যাচ্ছে, কোথা থেকে অপমানটা করলে এই ভরা মজলিশে দর্পের খোলসটা খসে যাবে। আফসানা ছেলের ওই চাহনি, ওই নীরবতার নীচে ঠান্ডা মাথার দ্রুত চিন্তা করার কৌশল সম্বন্ধে জানে। তাই তিনি অভদ্র ছেলের চূড়ান্ত অভদ্রতা দেখার জন্য প্রসন্ন ঠোঁটে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আজগর আলী অসহ্য রাগে চিড়বিড়িয়ে প্রায় চ্যাঁচিয়ে উঠেন,

– কথা বলা না ক্যান! তোমার এখানে মুখ খোলার সাহস কে দিছে হ্যাঁ? নিজেরে খুব শেয়ানা ভাবো বাপু? আমার পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে . . .

কথা শেষ হবার আগেই টাস টাস তুড়ি বাজিয়ে নিজের ঠোঁটের উপর তর্জনী বসালো সাঈদ। সোজাসুজি অর্থ, “জবান একদম বন্ধ। কথা না।” যেই গাড়ির সাথে পিঠ হেলান দিয়ে এতোক্ষণ সে দাঁড়িয়েছিল, সেই গাড়ির ব্যাকসীটের দরজাটা আকস্মিকভাবে খুলে দেয় সে। খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ধপাস করে অচেতন হাসিব ইকবাল বেকায়দায় মাটিতে লুটিয়ে পরল। সেকেন্ডের ভেতর সেখানকার বাতাসে উৎকট গন্ধটা মিলেমিশে এমন অবস্থা হলো যে, পেটের নাড়িভুঁড়ি প্যাঁচিয়ে প্রচণ্ড বমি আসার মতো গা গোলাতে লাগল। একমাত্র সাঈদ বাদে উপস্থিত সবাই সেখানে দ্রুত নাক চাপলো, কেউ ওড়না বা শাড়ির আঁচলে নাক চেপে “ওয়াক ওয়াক” করতে লাগল, কেউ গন্ধটা নিতে না পেরে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পরেছে। বাসের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ফিহা ওড়নায় কষে নাক চেপে এতোক্ষণে যেন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল। কেন গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্যদিকে গিয়েছিল, কেন বাসটা থামানোর কথা বলেও থামায়নি, কেন মুখের উপর সুফিয়া খালাকে গাড়িতে কিছু মাল-সামান রাখার জন্য বাঁধা দিয়েছিল। এই লোক পেট গুলোনো গন্ধের ভেতর কী করে গাড়ি চালিয়ে আসলো? বমি পায়নি? ফিহা আর একসেকেন্ডও সহ্য করতে না পেরে তড়িঘড়ি করে ভিড় সামলে রুমের দিকে ছুটে যায়। এদিকে গাড়ি থেকে বাকি দু’জনকে টেনে বের করে একইভাবে মাটিতে ফেলে দেয় সাঈদ। দু’হাত ময়লা ঝাড়ার মতো ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ কঠিন, চোয়াল শক্ত করে বলল,

– আপনার ওই দুই নাম্বারী অহংকারের চাইতে আমার গাড়ির ভেল্যু আরো বেশি। তাহলে বুঝে নিন, আপনার উপর কতটুকু দয়া-মায়া দেখিয়ে আমার গাড়িটা নোংরা, পঁচা করলাম। মান-সম্মানটা আমার যেতো না আপনার যেতো, সেটা নিজের চানাচুর মেন্টালিটি দিয়ে হিসেব-নিকেশ করে নিবেন দেওয়ান মশাই।

মুখের উপর একেকটি বিষ মাখানো কথা ছুঁড়ে গাড়ির দরজাটা বন্ধ করল সাঈদ। এবার পাকড়াও করল আমেনার স্বামী বকর হোসেনকে। নাকে রুমাল চেপে ভদ্রলোক তখন চুটিয়ে ঘাম দিচ্ছিলেন। সেই ঘামে ভেজা তকতকে চাঁদির চুলহীন মাথাটা লক্ষ করে সাঈদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

– শ্বশুরের টাকার গরমে মাথার চুল উঠে গেছে বকর সাব? লক্ষণ ভালো না। নিজের বউ-বাচ্চার প্রতি স্যাটিসফেকশন না রেখে বাইরে মুখ দিলে সেটা আপনার শ্বশুরকে কাইন্ডলি জানাবেন। যত্ন করে আপনার চাঁদির গরমটা নামিয়ে দিবে।

কথাটা শুনে আজগর আলী মর্ম উদ্ধার করতে না পারলেও আশু ভয়ে মুখ চুপসে গেল বকরের। টপ করে একফোঁটা নোনাবিন্দু কপালের ডানপাশ বেয়ে কানের কাছে গড়িয়ে গড়িয়ে পরল। অন্যদিকে দীপ তাড়া দেখিয়ে নিজেই নিজের বউকে কোল নিয়ে বাড়ির ত্রিসীমানা পার করে ঢুকেছে। জমায়েত মানুষদের ভেতর সহসা ব্যাপারটার ঘোর কেটে গেলে সাঈদও নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে যায়। এদিকে বকর নাক চাপা রুমালটা দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছেই নিতেই হঠাৎ স্ত্রী আমেনার দিকে চোখ-মুখ স্থির হয়ে গেল। আমেনা স্বামীর দিকে সন্দিগ্ধ চোখে ঠোঁট ফাঁক করে তাকিয়ে আছে। যেন বুঝতে চেষ্টা করছে, তার স্বামী পরনারীতে আসক্ত নাকি।

.

পিলপিল করে গোটা রাতটুকু পেরিয়ে গেছে। দু’চোখে একফোঁটা ঘুমের জোগান পরেনি। কতটা উৎকণ্ঠার ভেতর একেকটি সেকেন্ড, একেকটি মিনিট, একেকটি হিংস্র ঘণ্টা পার করেছে ফিমা, তা দেয়ালে আঁটা চকচকে আয়নার ভেতর দেখতে পাচ্ছে। চোখের নীচে নির্ঘুম রাতের ডার্কসার্কেলের চিহ্ন, মুখে লাবণ্য বলতে ফুরফুরে উজ্জ্বল ভাবটা নেই, নীচের শুষ্ক ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে ফাঁটা রোগের মতো হয়ে আছে, চুলের অবস্থা বড়োই কঠিন। সবে শোয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে হাতমুখ ধুতে এসেছিল। কিন্তু ট্যাপের ছড়ছড় পানিতে দু’হাত মুঠো করে মুখ ধোয়ার নাম নেই। হঠাৎ ধপ ধপ করে দরজায় করাঘাত কষে তাড়া দেখাল ফিহা,

– এ্যাই আপু তোমার কতক্ষণ লাগবে? বের হবে না? আমি মুখ ধুবো তো।

সংবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো মৃদু চমকে উঠে দ্রুত ট্যাপের পানিতে ঝপাস ঝপাস মুখ ধুয়ে নেয়। ডানহাত মুঠো করে পানি নিতেই মাথার তালুতে ঘষে নেয় আলতোভাবে। সকালের ঠান্ডা ঠান্ডা পানিটা বড্ড আরামদায়ক, দু’চোখ বুজে রাত জাগা ক্লান্তিটা গভীর নিঃশ্বাসে ছেড়ে দেয় ও। ভেতরটা একটু স্বস্তির বাতাসে নরম হয়ে উঠলে অনেকক্ষণ পর প্রশান্তিময় উচ্ছ্বাসে শান্ত হলো মন। এবার কাজ করা যাক। ওয়াশরুমের দেয়ালে ছোটো তাকের মতো জায়গাটায় শ্যাম্পু, বডিওয়াশ অসংখ্য বোতলের কাছে মোবাইল ফোনটা রাখা। ভেজা হাতটা গেন্ঞ্জিতে মুছে মোবাইলটা তুলে গভীর দম ছাড়তে ছাড়তে সবকিছু লগইন করে ঢুকল। ম্যাসেজের হোমপেজটা ফুটে উঠতেই সেখানে অসংখ্য ‘ নিউ ম্যাসেজ ‘ এসে জমা হয়ে আছে। ঢোক গিলতে গিলতে বহুকষ্টে থরথর করে কাঁপতে থাকা আঙুলগুলো চট করে একটা জায়গায় ক্লিক করল ফিমা, বুকের ভেতরে দম আঁটকে রইল ততক্ষণ। ওমনেই সেকেন্ডের ভেতর ম্যাসেজের নীচে গোটা গোটা অক্ষরে ফুটে উঠল— “You blocked this account. Can’t message anymore .”

দুম করে আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দেয় ফিমা। হাঁপানি রোগীর মতো লম্বা লম্বা টানে দম ছাড়তেই ঠোঁটের উপর জমা ঘামটা হাতের উলটো পিঠে মুছে নেয়। সে আর কোনোদিন এই ভুল করবে না। কোনোদিনও না! বেঁচে থাকতে কক্ষনো এই কাজে ঝুঁকবে না সাবিলা হক ফিমা।

.

আকাশের গা জুড়ে নীল শামিয়ানার বুকে থোকা থোকা তুলোর মতো মেঘ। মেঘের আচ্ছাদনে আজকের আবহাওয়া ভীষণ নির্মল ও শান্তির। রৌদ্রকরোজ্জ্বল সূর্যের তাপ অনেকাংশে কমে এসে ছাদের বুকটা ঠান্ডা করে রেখেছে। সেই ছাদের উপর খালি পায়ে পা ফেলে রেলিংয়ের উপর মোটকু কাঁচের বয়ামটা রেখেছে ফিহা। বয়ামভর্তি টুকরো টুকরো বরইয়ের আচার, সেই টক-ঝাল আচারটা মুখে পুড়ে দু’গাল ফুলিয়ে খাচ্ছে ও। পাশ থেকে হঠাৎ খুকখুক কাশির শব্দ হলে শান্তভাবে ডানে তাকিয়েছিল ও, কিন্তু তৎক্ষণাৎ দু’হাত কেঁপে উঠে হাত থেকে বয়ামটা ছেড়েই দিল ফিহা! আকস্মিকভাবে পরতে যাওয়া বয়ামটা চট করে দক্ষপূর্ণ ক্যাচে ধরে ফেলল জুনায়েদ সাঈদ। বয়াম ধরা অবস্থায় ওই ভঙ্গিতেই মুখ তুলে জাঁদরেল মেজাজে গলা তুলল,

– এই দোষটা কার?

ফিহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমতা আমতা করে বলে,

– আ-আ-আপনার দোষ।

সাঈদ ইচ্ছে করে ওকে জ্বালানোর জন্য গলাটা আরো উঁচু করে বলল,

– আমার দোষ?

কণ্ঠের উদ্ধত অবস্থা দেখে আরো মিইয়ে গেল ফিহা। আহাম্মকের মতো ডানে-বামে মাথাটা দ্রুত নাড়িয়ে বলল,

– না না, আমার দোষ!

– এখন আবার তোর দোষ?

কী বলতে যেয়ে কী বলছে আল্লাহ মালুম! এভাবে ভূতের মতো পাশে এসে দাঁড়াতে ফিহা কথার খেঁইটাই হারিয়ে ফেলেছে। নিজের প্রতি নিজে বিরক্ত হয়ে বলল,

– এই বয়ামের দোষ!

– এখন আবার এই বয়ামের দোষ? আমাকে দেখে অমন চমকে উঠতে বলেছে কে? আচারের বয়াম বলেছে?

রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে একবার ওই অসভ্য বয়ামটার দিকে তাকাল, আরেকবার দুঃখী দুঃখী দৃষ্টিতে কথার মারপ্যাঁচে ফাঁসানো মহাধূর্ত লোকটার পানে তাকাল। এরপরই সরু সরু ভ্রুঁদুটো কঠিনভাবে কুঁচকে খেদোক্তি করে বলল,

– দোষটা আপনারই। আপনি এমন ভূতের মতো চলাফেরা করেন কেন? পায়ে শব্দ করে আসতে পারেন না আপনি? লাকড়ি ঘরে ওরকম করে আসার জন্য সেদিন আমি কাঠগুলোর নীচে চাপা পরতাম! সব আপনার দোষ।

কিশোরী স্বচ্ছমেদুর মুখটায় একমুঠো রাগ লেপে বড়ো স্নিগ্ধ, বড়ো আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে এখন। পবিত্র গোলাপফুলের হালকা গোলাপি রঙটুকু তার ওই নরম মিষ্টি ওষ্ঠযুগলের মায়ায় অপরূপ হয়ে আঁটকে আছে। তেলে মাখামাখি ওই ওষ্ঠ-সৌন্দর্য্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কালকের সেই বাঁ’কানটার দিকে নজর বুলাল সাঈদ। কানের নরম লতিটা ভীষণ ফুলে রক্তিম ছাঁচে টসটস করছে জায়গাটা। নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে আছে নরম লতিটুকু? ইচ্ছে করল ওই জায়গাটুকু একটু একটু করে আঙুলে ছুঁয়ে আলতো করে তার আদরটুকু চেপে দেয়। রুক্ষ আঙুলগুলো চুলে ডুবিয়ে ওই কান ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলতে,

– ব্যথাটা বেশি হচ্ছে? কোথায়, কতটুকু ছুঁয়ে দিলে এই ব্যথাটুকু আমার কাছে চলে আসবে? আমি চাই না সামান্যতম আঁচড়ও আমার সবচাইতে শুদ্ধ নারীটির গায়ে পড়ুক।

চোখের রুদ্রতেজি ছাঁচটা আস্তে আস্তে কমে গিয়ে গম্ভীর চোখদুটো কেমন নরম হয়ে গেছে। যেন মনের কিছু গোপনতম বাক্য সে বলতে চাইছে, কিন্তু অনভ্যাসের জন্য তার ঠোঁটদুটো নড়ছে না। ফিহা কোঁচকানো ভ্রুঁদুটো স্বাভাবিক করে এবার যেন একটু প্রসন্ন সুরে শুধায়,

– ওভাবে কি দেখছেন?

কানের অংশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে তাকাল সাঈদ। বয়ামটা নিরাপদ ভাবে রেলিংয়ের উপর রাখতেই দু’জনের মধ্যকার দুরত্ব কমিয়ে কাছাকাছি এসে বলল,

– যা দেখছি তা ছোঁয়ার হক কি এখনো হয়েছে? হয়নি। ব্যাপারটা আপনিও বুঝতে পারছেন, ব্যাপারটা আমাকেও বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু লুকোচুরি ব্যাপারটা দু’জনকেই অস্থির করে দিচ্ছে।

আবারও সেই অসহ্যকর “আপনি” বলা সম্বোধন, হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথার ভেতর যেটুকু অনুভূতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাতে আবারও দেহের শিরাগুলো প্রচণ্ড ব্যগ্র হয়ে উঠল ওর। তেলে মাখা ঠোঁটটায় দাঁত বসিয়ে শান্ত রইলে সাঈদ আজ একটুও থামলো না। চোখের চাহনি দিয়েই ওকে তিনগুণ কাঁপিয়ে ছেড়ে মৃদু অথচ দৃঢ় তেজে বলল,

– আমার মধ্যে প্রেম করার কোয়ালিটি নেই, যেটা আছে খুবই বাজে। হয়ত, এই বাজে অবস্থার জন্য আমি নরমাল কনভারসেশন চালাতে পারি না। স্বাভাবিক রসবোধ, হাসিয়ে চলা, টেনে টেনে খেজুরে আলাপ— আমার মধ্যে পাবেন না নাবিলা। যেটা পাবেন, সেটা একান্তই নিজের মনে, নিজের কাছে, নিজের ওই ছোট্ট বুকেই জমা রেখে দিবেন।

কথাটা বলেই মুখটা আরেকটু সন্নিকটে আনলো সাঈদ। মনের একদম গহিন পর্যন্ত ছুঁয়ে যাওয়া কণ্ঠে আস্তে করে বলল,

– একদম গোপনতম আবেগ, যেটা একমাত্র আমার নামেই রাখবেন। পারবেন তো? আরো কনফেস করা লাগবে? এনাফ না আপনার জন্য?

গলার কাছে কুণ্ডলী পাকানো নিঃশ্বাস আঁটকে স্থির হয়ে রইল ফিহা। দাঁত দংশন করা ঠোঁটটা আরো কঠিনভাবে চেপে হঠাৎ দুম করে সেখান থেকে পালিয়ে গেল ও। ধপধপ করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলার সেই রুমটার কাছে পৌঁছাতেই অকস্মাৎ পাদুটো দরজার বাইরেই থমকে গেল! হাসির ঝলকে উপচে পরা চোখদুটো বিষণ্ণ বিকেলের মতো ম্লান হয়ে গেছে। বাবার সামনে হাসিমুখে কথা বলা ব্যক্তিটি হঠাৎ দরজার দিকে তাকালে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল ফিহা! নিজেকে লুকোনোর মতো পরিস্থিতি বা পালানোর মতো সুযোগ কোনোটাই নেই! ওই বিষণ্ণ, ফ্যাকাশে মেয়েলি মুখটা দেখে কেমন রহস্য রহস্য হাসিতে বলল সেই ব্যক্তি,

— “কেমন আছ ফিহা? কি খবর তোমার? সব ঠিকঠাক চলছে?”

অশনি ঝড়ের পূর্ব সংকেত কিনা জানা নেই নাবিলা হক ফিহার। চরম বাকরুদ্ধ হয়ে রইল সে। মুখে কোনো কথাই বলতে পারল না সেই মূহুর্তে! সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় চরম অপমানিত হয়ে আর কখনো মুখ দেখায়নি! তবে আজ কেন এ তল্লাটে এসেছে এই ব্যক্তি?

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা : পরিবার, পড়াশোনা নিয়ে অত্যধিক ব্যস্ততায় আছি। আউট অফ রিচ। দুঃখিত, ক্ষমা, মাফপ্রার্থী। 💔

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here