#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[অংশ ০২]
টায়ারের তীব্র ঘর্ষণের শব্দে প্রবল হুঙ্কার ছড়িয়ে চলন্ত ইন্ঞ্চিনটা থমকে যায়! চোখ ঝলসানো দুটো হেডলাইটের আলোয় ভীতিগ্রস্ত পাখির ডাকগুলো চারধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিশাচরের মতো শান্ত স্তব্ধ পরিবেশে কতক্ষণ ওভাবে কান চেপে চোখ খিঁচে দমবন্ধ অবস্থায় ছিল, তা নিজেও জানে না ফিহা। বুকের ভেতরে অসহ্য কাঁপন, মাথার ভেতরে মাইগ্রেনের পীড়া, অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে। ভয়ে, যন্ত্রণায়, তুমুল আতঙ্কে চোখ খুলে সামনে তাকালে কয়েক সেকেন্ড ওকে হেডলাইটের আলোর সাথে যুঝতে হলো। হাতদুটো চোখের সামনে আড়াল হিসেবে রাখতেই আঙুলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে যেটুকু দৃশ্য দেখতে পেল, তাতে বুকের রক্ত যেন আরেকবার হিম হয়ে আসে! দু’হাতে স্টিয়ারিং ধরা তীব্র কাঠিন্য মুখটি চরম শান্ত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখের পলকও যেন একটা মূহুর্ত্তের জন্য পরছে না। দৃঢ়, অবিচল ওই মুখটির সামনে এভাবে এই অবস্থায় পরবে এ যেন কল্পনাও করতে পারেনি। বুকের ভেতরে উত্থাল করা ঝড়টা ঠোঁট মুচড়ে চোখের জলের সাথে টপটপ পরতে শুরু করেছে। মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজন বুঝি তাঁর সামনে হলো না ফিহার। সারাদিন অসহ্য পরিশ্রমের ধকল শেষে এভাবে চোখের সামনে কোমল মুখটা দেখতে পাবে এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারছে না সাঈদ। স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটোর উপর প্রবল আক্রোশ ঢেলে চোয়াল আরো শক্ত হয়ে উঠল। যদি আকস্মিকভাবে ব্রেকটা না কষাতো? কি হতো? চোখের সামনে থেকে মৃদু মৃদু কাঁপতে থাকা হাতদুটো আস্তে আস্তে নীচে নামাতেই লালবর্ণের চোখদুটো দেখতে পায় সাঈদ। স্টিয়ারিং খামচানো আঙুলগুলো হালকা হয়ে তার বুকের ভেতরেও অসহ্য রকমের শূঁল বিঁধিয়ে দিচ্ছে। হাসিতে খিলখিল করা মুখ তার সামনে কান্না গিলে গিলে তাকিয়ে আছে। কেন এরকম অবস্থা? এই.. এই অসহ্যকর অবস্থাটা কেন সহ্য করতে পারছে না সে! রোবটের মতো স্থির চাহনি অটল রেখে ‘টুট টুট’ শব্দে গাড়িটা আনলক করল। শব্দটা শুনেই দু’চোখ ভরা অশ্রুটা অবাধে ছেড়ে দিয়ে কাঁপতে থাকা হাতটা ডানদিকে ইঙ্গিত করল ফিহা। বোঝাল, রাস্তার ওপাশে থাকা একটু দূরেই স্থির বাসদুটোর দিকে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করলেও দৈবগুণে কিছু অশুভ আঁচ, আসল ইঙ্গিত বুঝতে পেরে যায় সাঈদ। কোনো টু শব্দটি না করে সরাসরি রাস্তার ওপারে থাকা প্রথম বাসটার মধ্যে তল্লাশি চালায় সে। পুরো বাস খালি। কেউ নেই, ফকফকা শূন্য। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় বিন্দু বিন্দু রক্ত আর এক জায়গায় রক্তের আলতো ঘেঁষাটে খাওয়া অবস্থাটুকু ছাড়া তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারল না। যে-ই ছিল নিশ্চয়ই পালিয়েছে। সীটের নীচে এদিক-ওদিক ছিটকে থাকা জুতাজোড়া নিয়ে সে ফিহার সামনে এসে দাঁড়াল। বাঁহাতে জুতা ধরা, অন্যহাতে ফিহার ডান কবজিটা খাবলে পিছু পিছু ওকে গাড়িতে এনে বসিয়ে দেয়। জুতার হিলে থাকা রক্তের আলামতটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য জুতাটা ওকে পরতে দিল না। প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে সেটা গাড়ির পেছনে রেখে আসে।
ড্রাইভিং সীটে ফিরে আসতেই হেডলাইটের আলো নিভিয়ে ভেতরকার আলোটা জ্বালিয়ে দেয় সাঈদ। আজ আর আপোস করে না ওর প্রতি। কোলের দিকে দৃষ্টি ফেলে রাখা রমণীর মুখটা দু’হাতে ধরে সরাসরি নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলে। অশ্রুতে টলমল করা চোখদুটোতে কোমলভাবে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর নীচু করে বলল,
– বাসে কে ছিল?
ছলছল অশ্রুতে চুপ করে তাকিয়ে ফিহা মানুষটার কণ্ঠে, নরম স্বভাবে, ওরকম ঠান্ডা চোখের ঠান্ডা ভাবটুকুতে নির্ভার হয়ে যায়। একটু আগের ভীতিকর পরিস্থিতিটা সামলে নিয়ে শুকনো গলাতে বলে উঠে,
– চিনি না। অন্ধকারে মুখ দেখিনি। কোন কাপুরুষ বাসে উঠেছিল আর কেন আমার উপর..
মাঝপথে কথাটা ‘ শশশ ‘ শব্দ করে থামিয়ে দিল সাঈদ। আতঙ্কের কোন সীমায় পৌঁছালে আদরের এই মুখটা এভাবেও ঘেমে উঠতে পারে, তা দৃষ্টি এড়াল না তার। মুখের উপর লেপ্টে থাকা দু’একগাছি চুল একটা একটা করে সরিয়ে ওর প্রতি নরম হয়ে বলল,
– মানব দরদী সেবাটা বন্ধ করতে হবে নাবিলা। সবাই সবকিছুর জন্য যোগ্য নয়। আমি এখানে কাউন্টার করব না কেন তুই রাতের বেলায় সুনশান বাসের ওখানে গিয়েছিস। কিন্তু একা, এই নির্জন দিকটাতে কেন আসার প্রয়োজন পরল সেটাই জানতে চাইব।
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে সামনের ড্যাশবোর্ড থেকে ডানহাত বাড়িয়ে চারকোণা টিস্যুবক্সটা ওর কোলের মধ্যে রাখল। খাবলে খাবলে একসঙ্গে চার-পাঁচটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলে ফিহা চোখ নীচু করে বলল,
– আমি সাউন্ডবক্সের আওয়াজ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। এখানে এমন একটা শব্দহীন জায়গা নেই, যেখানে একটু শান্তিমতো বসতে পারব। গান বাজানো লোকগুলোকে বারবার রিকোয়েস্ট করলাম সাউন্ডটা কমিয়ে দিতে। ওরা শুনল না। নির্লজ্জের মতো কথাগুলো কানে-ই নিল না। ওদিকে সবাই খেতে বসে পরেছে। এদিকে আমি মাথা নিয়ে স্থির থাকতে পারছিলাম না। বাবাকে বলতাম, কিন্তু সে তখন মার পাশে খাচ্ছিল। চর্তুদিকের শব্দে তখন মনে হচ্ছিল মাথার ভেতরটা যেন ছিঁড়ে আসছে! তাই বাধ্য হয়ে বাসে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এখানে একটু বিশ্রাম নিব, শান্ত হয়ে বসব। তাছাড়া, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বাসে চলে আসবে। এসব ভেবেই আমি বাসে উঠি।
ওর বুদ্ধি বা কর্মকাণ্ড দেখে কোনো প্রশ্ন তুলল না জুনায়েদ সাঈদ। বরং, তার রাগ হচ্ছিল লাবিব, ফাহাদ আর সুফিয়া খালার প্রতি। তাদের বারবার করে বলে যাওয়ার পরও যদি এমন একটা তামাশা ঘটে থাকে, তাহলে তাদের অবস্থা কোন পর্যায়ের জঘন্য করে ছাড়বে তারা বোধহয় নিজেরাও তা জানে না। খসখসে রুক্ষ পুরুষালী হাতে আবারও নীচু করে রাখা মুখটা তার দৃষ্টি সমুখে তুলে ধরে। অশ্রুতে ভেজা পাপড়িগুলো, চোখ ভর্তি করা ছলছলে জল, লাল টকটক করা নাকের ডগায় যেন তখনও ব্যথাতুর ছাপটা গেড়ে ছিল। কিন্তু কীসের ব্যথা? নাকের ওই লালচে ডগায় নরম আদর মাখিয়ে জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে,
– আমি বুঝতে পারছি না কোথায় কি হয়েছে। কিন্তু অনুমান করতে পারছি, কিছু একটা ঠিক নেই। বেজ° ন্মা°টা কোথাও আঘাত করেছে?
মনে মনে কথাগুলো আওড়ে গেলেও ফিহা তাঁর চুপটি দেখে একটুও ঘাবড়াল না। যে না-বলা ব্যথাটা মুখ বুজে শান্ত করে রেখেছে, সেটা বলে দিয়ে এই মানুষটার অস্থিরপ্রবণ মুখটা দেখতে চাইছে না। মন চাইছে না, এই মানুষটা সারাদিনের অমানুষিক ধকল শেষে ওর ব্যাপারটা নিয়ে মুখ ভার করে থাকুক। কালকের মতো মাদকে ভরা ঠান্ডা ঠান্ডা চোখদুটো দিয়ে অনিমেষ চোখে চেয়ে থাকুক। তার ভালোলাগা, মন্দলাগা নীরবেই বলুক, শুধু কালকের মতো হৃদয় ছোঁয়ানো দৃষ্টিতে থেমে যাক মন। কিন্তু সাঈদ ব্যগ্রভাবে ওর গালদুটো আরেকটু চেপে ধরলে তীক্ষ্ম আর্তনাদে কেঁপে উঠে ফিহা। চোখমুখ খিঁচিয়ে খপ করে ধরে ফেলে সাঈদের বাঁ’কবজি। না চাইতেও বুঝিয়ে ফেলে সমস্যাটা বাঁ’কানে। কানের কাছে আঙুলের স্পর্শ লেগে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। সাঈদ পলকের ভেতর দু’হাত নামিয়ে ওখানকার সমস্ত চুল পিঠের পেছনে সরিয়ে ফেলে। স্পষ্ট দেখতে পায় ঝুমকোটা রক্তাক্ত এবং কান থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে আইভরি গোল্ড রঙের জামাটা কাঁধের কাছে লাল হয়ে আছে। অদৃশ্য চোখে মনে মনে পণ করছিল, ওই অজ্ঞাত শ°য়°তানটার কান ছিঁড়ে এনে মুঠোর মধ্যে পুড়ে ফেলতে! টিস্যুবক্সের একগাদা টিস্যু নিয়ে মাঝের ক্ষুদ্র দূরত্বটুকু নিজেই ঘুচিয়ে মৃদু শঠতার সাথে বলল,
– নড়াচড়া করবি না। আমি এটা ঠিক করে দিচ্ছি। কয়েক মিনিট পুরোপুরি স্থির থাক্। সামান্য একটু পেইন হবে, ব্যস্।
সেই যে চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে বুজে ফেলেছে তা আর খুলেনি ফিহা। শুধু ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দ্বারা বুঝতে পারছে, কালরাতের চাইতেও বুঝি মানুষটার উপস্থিতি বড্ড সন্নিকটে। তর্জনী আঙুলের ডগা দিয়ে কানের কাছ থেকে সবটুকু চুল সে সরিয়ে দিচ্ছে। কানের ছিদ্রপথে ঝুলে থাকা ঝুমকা হালকা একটু নড়াচড়া করতেই প্রবল ব্যথায় ‘ উহঃ ‘ করে আঁতকে উঠল ফিহা। চোখদুটো আরো প্রবলভাবে কুঁকড়ে মৃদুস্বরে জানাল,
– ব্যথা পাচ্ছি, একটু আস্তে।
বিড়বিড় করা স্বরটা দু’কানে শুনতে পেয়ে আরো সতর্ক হলো সাঈদ। এরপরই ঝুমকাটা টান দিয়ে খুলতেই তৎক্ষণাৎ টিস্যুটা কানের লতিতে চেপে ধরে। নিজেও বাঁ’হাতের উপর নখের তীক্ষ্ম ব্যথাটা শান্তমুখে হজম করছে। বুঝতে দেয়নি একচুল, ফিহা যে ভুলবশত শক্ত হাতটাকে খামচে ধরেছে। কিছুক্ষণ পর কানে চাপা টিস্যুটা ছেড়ে দিলে ততক্ষণে রক্ত কিছুটা বন্ধ হয়ে আসে। এতোক্ষণ দম আঁটকে রাখা ফিহা একটু সুস্থির হলে সীটের সাথে গা এলিয়ে দুর্বলস্বরে বলল,
– পানি খাব..
টিস্যুর ভেতরে রক্ত মাখা ঝুমকোটা মুড়িয়ে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিল। একপলক নিজের বাঁহাতের উলটোপিঠে হাসি হাসি চোখে মেয়েলি নখের আঁচড়গুলো দেখতে পেল সাঈদ। আধ খাওয়া পানির বোতলটা ওর দিকে বাড়াতে গিয়েও অজানা এক কুণ্ঠায় তির্যকভাবে বলে উঠল,
– স্যরি, নট অ্যাভেইএব্যাল। অপেক্ষা করতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে বোতলটা জায়গামতো রেখে দেয় সাঈদ। মাথাটা সীটের হেডরেস্টে রেখেই নিভু নিভু চোখে ডানে তাকায় ফিহা। মাথার ব্যথাটা বড্ড ধিক ধিক করে বাড়ছে, আর অন্যদিকে গলাটা শুকনো। দু’চোখে ও দেখতে পাচ্ছে ড্যাশবোর্ডের ওদিকে একটা পানির বোতল। একপলক সেই বোতলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে এরপর চোখটা জাঁদরেল মুখের দিকে ফেলল,
– ওটা কি পানির বোতল না?
– ওটা দেওয়া যাবে না।
ভ্রুঁ কুঁচকে চকিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল ফিহা,
– কেন দেওয়া যাবে না?
শান্তমুখে কালো শার্টের স্লিভদুটো ফটাফট কনুইয়ে ভাঁজ করে ব্যস্তভাবে গাড়িটা স্টার্ট দিল সাঈদ। তবু ফিহার উত্তরটা সে এই ফাঁকে দিল না। পাশে বসা রমণীকে অবশ্যই এ কথা বলা যাবে না ওটা তার আধ খাওয়া পানির বোতল। বোতলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে খেয়েছে সে। সে চায় না ঘেন্না ঘেন্না একটা বিচ্ছিরি ভাব এই সুন্দর মূহুর্তটার ভেতর বাঁধা পড়ুক। বোতলটার আধ খাওয়া অবস্থা দেখে ফিহা নিগূঢ় ব্যাপারটা বুঝতে পারল যেন। কিন্তু ছোট্ট একটা বিষয় এভাবে চেপে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখে ভীষণ অস্বস্তির ভেতর পড়ল। এটা তো সরাসরি মুখ ফুটে বললেই হয়! দোনোমনা করবার তো প্রয়োজন নেই। সে কি ভাবছে ফিহা তার পানির বোতলটা দেখে ঘিনঘিনে ভাব দেখাবে? ওই খয়েরি রঙা ঠোঁটদুটো কী দেখতে কুৎসিত যে ফিহা তার নরম স্পর্শটুকুতে ওরকম ঘিনঘিন করবে?
.
বিদায়ের পালা চুকাতে চুকাতে রাত তখন নয়টা। ভিডিয়োম্যানদের ক্যামেরার দাপটে সবটুকু মূহুর্ত ধারণ করা হচ্ছে। কণেপক্ষের কান্নাকাটি এবং বিদায় দেবার চিত্রটুকু দেখে চোখ সরালেন নিয়াজ উদ্দীন। আল্লাহ্ ভাগ্য করে তার কপালে দুটি কন্যা সন্তান ভিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মের কাছে এই ভিক্ষাদুটো অন্যের কাছে একদিন তুলে দিতে হবে। যদি পাত্রদুটো তার কন্যাদের যথাযথ সম্মান না দেয়? যদি কোনোপ্রকার দুর্ব্যবহার করে তখন? টুকরো টুকরো হয়ে তার বাবাসুলভ মনটা মাথানত হয়ে যাবে। পান্ঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোটো বাটন ফোনটা বের করে সময়ের ছকটা দেখে নিলেন। নয়টা তেরো। পাশ থেকে আজগর দেওয়ান অমন কমদামী ফোনের মডেল দেখে কেমন যেন একটু তুচ্ছ নজরে তাকালেন। শেষমেশ ব্যাপারটা হজম করতে না পেরে ক্ষুদ্র একটা খোঁচা হো হো হাসিতে দিয়ে বসলেন,
– ভাইসাব দেখি খানদানী মডেলের ফোন ব্যবহার করতাছেন। তা, ফোনটার দাম কত গো ভাইসাব? কথা কানে টানে শোনা যায় না?
নিয়াজ উদ্দীন একমুখ লজ্জায় বড্ড বিব্রত হয়ে পড়েন। তবু ঠোঁটে স্বচ্ছ হাসি ফুটিয়ে সরল মনে বলেন,
– দাম বেশি না ভাই। কিন্তু তবু গরীবের দিনকাল শোক্করে শোক্করে চালানো যায়। আমি আবার স্মার্টফোন চালাতে পারি না। উলটাপালটা টিপ মেরে কই না কই কী হয়ে যায় . . . বাদ দিয়েছি।
নিয়াজ উদ্দীনের কথায় হো হো করে হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে কৌতুকের পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি। মনে মনে আজগর দেওয়ানের কথা ও ব্যবহারে বিব্রতবোধ করলেও নিয়াজ উদ্দীন তা সামাজিকতার খাতিরে প্রকাশ করতে পারলেন না। হাসি থামিয়ে আবারও আজগর দেওয়ান বলে উঠেন,
– তা কথাটা ঠিকই বলছেন ভাইসাব। বয়সের আগে যারা বুড়া হয় আর টাকার কাছে যারা পঙ্গু, তাদের জন্য এইসব বড়োলোকী মালসামান ঠিক না। কমদামী জিনিসই ভালো। কমদামী পাত্র, কমদামী সেট, কমদামী পোশাক . . . বুঝছেন না ব্যাপারটা? এই আমারেই আপনি দেখেন না ভাইসাব, গেল বছর ত্রিশ দিয়ে সেটটা কিনলাম। এখন শুনি সেটটা নাকি ভালো না, পুরানা। পরে আমার ড্রাইভার ব্যাটাকে দিয়ে দিছি। যাহ ব্যাটা, পুরান মাল দিয়ে ফূর্তি করগা। এর মধ্যে দীপের বিয়েতে নানারকম খরচ এসে পড়ল। পরে, এবার আপনার মতোই কমদামী সেট নিলাম . . . হে হে। দাম বেশি পরে নাই ভাইসাব, গরীব মানুষ বুঝেনই তো। আঁটত্রিশ দিয়ে আপাতত এটা কিনলাম, পরে আল্লাহ দিলে ভালো দেখে একটা নিব।
যেখানে নিয়াজ উদ্দীনের হাতের ফোন মাত্র দুই হাজার তিনশো টাকার, সেখানে তাঁর সামনে একজন আঁটত্রিশ হাজারের ফোনকে মাত্র বলে বুক ফুলিয়ে যাচ্ছে। ক’বছর আগেও তাঁর হাতে বারো হাজার টাকায় কেনা চমৎকার একটি স্মার্টফোন ছিল, কিন্তু সেটা তিনি স্ত্রীর হাতে হাসিমুখে তুলে দিয়েছেন। বাসায় যে টিভি সেটটি ছিল, সেটার মাদারবোর্ড প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। টিভি নষ্ট। শহরের বুকে টিভি ছাড়া মূহুর্ত কাটানো একপ্রকার বিষাদগ্রস্ত অবস্থা, তা বুঝতে পেরেই নিয়াজ উদ্দীন হাতের ফোনটা স্ত্রীর জন্য ওয়াইফাই সংযোগে ব্যবস্থা করে দেন। ফোন দেখে দেখে ফিমার মা নিজের সময় কাটান, সেলাই কাজ শেখেন, রান্নাবান্নার ভিডিয়ো দেখেন। নিয়াজ উদ্দীন মনে মনে সুখকর দৃশ্যগুলো স্মৃতিচারণ করতেই হঠাৎ সামনে বড়ো মেয়ে এসে হাজির হলো। কেমন একটা চোখ পাকানো দৃষ্টিতে সরাসরি আজগর দেওয়ানকে মুখ ভাঙা ক’টা জবাব ছুঁড়ে বলল,
– আপনার পেছনেই ছিলাম। এইজন্য কথাটা না বলে পারছি না। আপনার মুখটা পশ্চাদদেশের মতো এমন নোং°রা কেন? মুখ দিয়ে ভালো কথা বের করতে পারেন না? যত্তসব দুর্গন্ধযুক্ত কথা বের করা ছাড়া একটাও তো ভালো কাজ করতে দেখিনি। আমার বাবাকে আলগা ফতোয়া না দিয়ে নিজের মেয়েকে বলবেন আরেক সুপুরুষের দিকে চোখ না দিতে। তাছাড়া লজ্জা তো আপনার মেয়ের মধ্যে এমনিতেও নেই। লজ্জা লাগলে বলবেন, আমাদের বাসা থেকে এক কলসী আমদানী দিয়ে যাব। কোনো টাকা লাগবে না।
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চরম অপমান করে ছাড়ল ফিমা। ও যে এক কাঠি বেশি অভদ্র সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিল ও। এইটুকু মেয়ের আস্পর্ধা দেখে আজগর দেওয়ান ভয়ানক ভাষায় কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই পেছন থেকে ডাক পড়ল তার ও নিয়াজ উদ্দিনের। বাধ্য হয়ে সেমুখো যেতে হলেও গজরাতে থাকা চোখদুটো ফিমার দিকে নিক্ষেপ করে রইলেন আজগর। নিয়াজ উদ্দীন যদিও কখনো মেয়েদের গায়ে হাত তোলেননি, কিন্তু এরকম অশিষ্টতা দেখে চোখ গরম করে চরম কিছুই বলতে যাচ্ছিলেন, তবে বলার সুযোগ পেলেন না। ঘটনাক্রমে দু’হাত ময়লা ঝাড়ার মতো ঝাড়তে ঝাড়তে ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটালো ফিমা। ছোটোবোন ফিহার স্টাইলে পটাপট কথাগুলো শুনিয়ে দিয়ে পৈশাচিক একটা আনন্দ হচ্ছে! বুড়ো ভিমরুল, আরো শোনাবি কথা? শোনা!
.
মহাসড়কের ফাঁকা বুক দিয়ে সাঁই সাঁই গতিতে ছুটছে বাস। রাতের অন্ধকার মাখিয়ে গন্তব্যের পথে ছুটছে তারা। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দুটো বা তিনটে বেজে যেতে পারে, কারণ একটু আগে জ্যামে বসে ক’ঘণ্টা নষ্ট গিয়েছে। আকাশের বুকে ঝলসানো রুটির মতো গমরঙা গোল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মায়া ভরা আলোতে চারধার স্নান করে দুটো ডাগর আঁখির কোটরে দৃষ্টিবদ্ধ সেটা। যার বাঁ’কানের লতিটা ফুলে লাল হয়ে আছে, কাঁধের কাছে সেফটিপিনের আঁচড়, গলার ওড়নাটা দিয়ে মাথা-সহ সারা শরীর শীতের বাহানায় ঢেকে রেখেছে, ছোট্ট মনটার ভেতর ঘূর্ণিঝড়ের আসর। জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে চলন্ত গাড়ির চলন্ত চাঁদের সাথে সাথে রূপকথার মতো অলীক রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে ও। ভেতরে গুমরে গুমরে উঠছে কয়েক ঘণ্টা আগের বীভৎস স্মৃতি। যে বীভৎসতার কথা একজন ব্যক্তি ছাড়া এখনো পর্যন্ত কাউকে মুখ ফুটে বলেনি, হয়ত ওভাবে সহজস্বরে বলাও যাবে না। এরকম ঘটনার কথা অবশ্যই বাবা-মা বা নিকটাত্মীয় কাউকে জানানো উচিত, কিন্তু জানানোর মতো হিম্মত বা অতোখানি আস্পর্ধা কি একটা মেয়ের বুকে সবসময় থাকে? থাকলেও সেটা মূল্যায়ন হয়? গলা টিপে রাখার মতো জবান করে দেওয়া ছাড়া বড়োরা আর কী করতে পারে? এই ঘটনার কথা মাকে যদি সাহস করে বলতেও যায়, সেখানেও মা সরাসরি মুখের উপর তোপ দেখিয়ে বলবে,
– বাসের মধ্যে গেলি কেন? আর জায়গা পাসনি? মাথাব্যথা আমাদের হয় না? আর মানুষের হয় না? তোর বেলাতে এইসব নাটক কোথা থেকে আসে?
চোখ বুজে হতোদ্যম নিঃশ্বাসটা ফিহা নীরবেই ছাড়ে। যার বিষ, তারই ব্যথা। এটা হয়ত নিজের মাও বুঝবে না। খাবার টেবিলে বসার আগে মাকে একবার বলেছিল, ‘ মা? মাথাব্যথায় টিকতে পারছি না আমি। চলো না আমরা বাড়ি যাই? সবাই থাকুক, তারা আস্তেধীরে আসুক ‘। এরপরের উত্তরটুকু মুখ ঝামটা দেওয়া আর নাকোচ করার মতোই ছিল। সবাই যার যার সুযোগ, জায়গা, পরিস্থিতি, অবস্থা, বিবেক, বুদ্ধি অনুযায়ী স্ব স্ব স্থানে ঠিক। বিড়বিড় করে উদাসী মনে চাঁদের পানে নজরুলের বিখ্যাত লাইনটুকু বলে উঠল ফিহা,
“আমরা সবাই পাপী।
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।”
চোখ বুজে ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে দমটা ছাড়ল ফিহা। আগামীকাল বৌভাত অনুষ্ঠান যেমনি হোক, সে যাবে না, যুক্ত হবে না। কালদিন পর এখান থেকে আজন্মের জন্য চলে যাবে। শুধু কালকের দিন। আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। কোলের মধ্যে থাকা পার্স ব্যাগটা মৃদু মৃদু শব্দে কাঁপছে। দ্রুত চেইন খুলে ভেতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনলো; স্ক্রিনে উঠে আছে ছোট্ট নাম—Unknown . চুপচাপ সেটা দেখতে দেখতে কলটা কেটে যাওয়ার আগমূহুর্তে সেটা রিসিভ করে ডানকানে চাপল। ক’সেকেন্ড দু’পাশ থেকেই অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। কেউ যেন নিজের গুমোর ভেঙে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে রাজি নয়। শেষমেশ একই কলে একইসাথে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় দু’পাশ থেকে বলে উঠল,
— “বাসটা থামাতে বলি?।”
একজন বাসের সীটে বোকা বোকা কথায় লজ্জারুণ মুখটা নীচু করে রেখেছে। অন্যজন তখন প্রিয় ব্ল্যাক মাম্বা ছুটিয়ে বাসের পিছু পিছু সুদক্ষ হাতে ড্রাইভ করে আসছে। দু’জনের ভেতর তফাত শুধু এটুকুই, তুমুল লজ্জার আবিরে লাল হয়ে আছে একজনের পানপাতা কোমল মুখ, আর ওই মুখটা মনের দর্পণে কল্পনা করছে চরম নিষ্ঠুর এই পুরুষ।
.
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : কিছু প্রশ্নের জবাব আগামী পর্বে পাবেন ইনশাআল্লাহ। ❤