নির্মোচন পর্ব ২৫ (প্রথম অংশ)

0
296

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

চোখদুটো হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের আগায় জিহবার লেহন যথেষ্ট বিশ্রী ও কুৎসিত। কুটিল চাহনিতে কোমল দেহের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে কেমন অমানবিক আকাঙ্ক্ষার তীব্রদৃষ্টি চালাচ্ছে কেউ জানে না। হাত বাড়িয়ে পাতলা নির্মেদ কোমরটা জড়িয়ে ধরে ঠিক ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো গা শুঁকতে মন চাইছে, কিন্তু তা এখন সম্ভব নয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক বাসের ভেতর বাল্যবন্ধু সরফরাজ দীপের বাড়িশুদ্ধো আত্মীয় যাত্রা করছে। উচ্চশব্দে প্রায় কান ফাটিয়ে দুটো সাউন্ড বক্স বাসের ভেতরে উল্লাসপূর্ণ বরযাত্রীর মনে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিচ্ছে। গানের তালে তালে সুর মিলিয়ে, হাতে তালি ঠুকে ‘ এই যে বেয়াইন সাব ‘ গানে অঙ্গীভঙ্গি শুরু করেছে ক’জন বরযাত্রী সদস্য। উৎসবপূর্ণ আমেজ। এতোসবের মাঝেও গভীর ছাঁচের লালসাপূর্ণ চোখদুটো বাঁয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দু’সীট সামনের প্রাণোচ্ছল মেয়েটিকে আড়চোখে দেখছে। এশিয়ান মেয়েদের গায়ের চামড়ায় যেটুকু প্রবল আকর্ষণীয় ভাব লুক্কায়িত থাকে, তা যেন মার্কিন মুলুকে ফুটফুটে সাদা শেতাঙ্গিণীর দেহে তেমন খুঁজে পায় না। বড্ড অসহ্য লাগছে বাংলাদেশে এসে। অ্যালকোহলিক মন বারবার পিপাসার্ত হয়ে পরছে। কিন্তু দু’ঢোক গিলে তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগটুকু এখানে নেই। পিঠটা সীটের সাথে হেলিয়ে দিতেই অফ হোয়াইট রঙের পান্ঞ্জাবীর হাতাটা কনুইয়ে একটু গুটিয়ে নিল। পাশ থেকে ভিডিয়ো ক্যামেরা অন করা হাসিব সকলের আনন্দঘন মূহুর্ত ধারণ করতেই মৃদু গলায় বলল,

– বাংলাদেশী ওয়েডিং বোরিং লাগছে ডাক্তারসাব?

গলার দু’দিকে হাত বুলিয়ে সেই অল্প ব্যথার জায়গাটুকু নিশ্চিত করল তৌকির আহমেদ শিহাব। গলার ফর্সা চামড়ায় লাল থেকে খয়েরি বর্ণ হয়ে আছে ব্যথাতুর দাগটা। কালরাতে কোন জানোয়ারের বাচ্চা তার উপর অতর্কিত হামলা করল ধারণা নেই, তবে মন বলছে জানোয়ারটা বেশ শক্তিশালী এবং দৈহিকভাবে তার মতোই নিয়মিত শরীরচর্চা করা পুরুষ। নাহলে কয়েক সেকেন্ডের মাথায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। মাথাটা সীটের হেডসাইডে ঠেকিয়ে কিছুটা সামনে থাকা রমণীকে লোভাতুর নজরে খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকে। দুপুরের একফালি সোনা রোদ্দুর পর্দার ফাঁক গলে খিলখিলে হাসির মুখটাতে ছেঁকে আছে। পড়ণে আইভরি গোল্ড রঙের লম্বা ঘেরওয়ালা গোল জামা। দুর্দান্ত মানিয়েছে! ঠিক যেন পাকিস্তানি অপ্সরী মেয়েদের মতো সুন্দর শালীন দেখাচ্ছে। সোনালি সুঁতোর বর্ণিলময় কারুকাজের সাথে ছোটো ছোটো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে জামার সামনের অংশটা। ডানকাঁধ থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে লম্বা ওড়না এবং কোমল হাতদুটো কবজি পর্যন্ত ঢাকা বলে অন্য মেয়েদের মতো চুড়ি পরেনি হাতে। মাথার ডানদিকে সিঁথি তুলে সমস্ত চুল বুকের বাঁপাশটায় এনে ছেড়ে রেখেছে। সীটের সামনে থেকে পিছে ঘুরে পেছনের সীটের মানুষদের সাথে ফুরফুরে আনন্দে মেতে আছে। ক্যামেরায় সেটা দৃষ্টিবন্দি করতেই হাসিব একটু বাঁকা হেসে বলল,

– এতোগুলো পরিবারের মধ্য থেকে দীপের খালাদের পরিবারটা খুবই স্মার্ট মনে হলো। কথাবার্তা, পোশাক-আশাক, চলাফেরা সবদিক দিয়ে এই খালাদের পরিবার বেশ অন্যরকম। তুই কি এসবের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবি?

শিহাব নিজেও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। বড়ো খালা বেশ কাঠখোট্টা গোছের মানুষ, সেনার বউ। আর ছোটো খালাটা নির্ভেজাল মনের, স্বামী ছোটো একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাটিং সেকশনের ম্যানেজার। কিন্তু তবু এদের মধ্যে পারিবারিক যে দৃষ্টিকোণ, সেটা দীপের অন্যান্য প্রভাবশালী আত্মীয়ের মতো নীচু, খারাপ, গল্পবাজ লাগল না। হ্যাঁ চলবে! শিহাবকে চুপ থাকতে দেখে হাসিব আবারও প্রশ্ন একটা ছুঁড়ে দিল,

– আজরাতে এক্সিকিউজ করবি ওটা? আজকের মতো ব্যস্ততা আর পাবি না শিহাব। আমি সবকিছু বন্দোবস্ত করে রেখেছি। ওদেরকেও বলেছি রেডি থাকার জন্য। কেউ কোনো সন্দেহ করবে না গ্যারান্টি দিচ্ছি। আর বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে এসে সবাই একপ্রকার টায়ার্ড থাকবে, কি বলিস তুই?

হাসিবের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেও তার মনটা পড়ে আছে দু’সীট সামনে। সূঁচালো সুন্দর নাকটার নীচে দুটো তুলতুলে লোভী ঠোঁট। সেদিক পানে চেয়ে নীচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল,

– হুঁ, সময়মতো আমাকে ফোন দিবি। আমি আসব। সবাই ঘুমাক আর না-ঘুমাক আজ গলাটা না ভেজালে চলছে না। আই অ্যাম ফ্যামিশ্ড।

– চিন্তা করিস না। যত লাগে তত পাবি। মাল খসালে মামা, বাঘের দুধও এখানে পাওয়া যায়। আর এটা এমন আহামরি কি জিনিস! আচ্ছা রেডি থাক।

কেমন চতুর পরিকল্পনা এঁটেছে তিনবন্ধু সেটা ঘুণাক্ষরেও কেউ জানে না। তিনজনের অস্থির মন রাতটুকুর জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছে। যেন রাতের আঁধারে নিজেদের খোলস ছেড়ে ধরা দিবে তারা।

.
দুর্বার গতিতে চলতে থাকা বাস শেষ বিকেলের কমলা রোদ মাখিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছল। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা। ময়মনসিংহ শহরের চমৎকার একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে বাসদুটো একটু দূরে খালিস্থানে পার্ক করা হয়েছে। মরিচা বাতির আলোকসজ্জা এবং রমরমা শৌখিন বিত্তশালী আয়োজন দেখে ম্লান হাসেন নিয়াজ উদ্দীন। এতোটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করার সামর্থ বা সুযোগ তাঁর নেই। মেয়েদুটোকে নিয়ে বুকভরা স্বপ্ন তিনি দেখে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ। তাঁরও যে খুব ইচ্ছে করে মেয়েদুটোকে এভাবেই ধুমধাম করে বিয়ে দেবার! কিন্তু অর্থনৈতিক দিকটার কথা ভাবলে বুকের ভেতরে টনটন করে ব্যথা হয়। প্রচণ্ড দুঃখ লাগে। মনে হয় মেয়েদুটোর জন্য কিছুই তিনি করতে পারবেন না। চোখদুটো মাটির দিকে নামিয়ে সহজাত সরল ভঙ্গিতে হেঁটে চলেন নিয়াজ। পেছন থেকে আফসানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজনীন স্বামীর অসহায়ত্ব যেন হাড়ে হাড়ে টের পান। সংসারের পেছনে সর্বস্ব ঢেলে দেওয়া এই পুরুষটি আজও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। একাধারে শ্রম দিতে দিতে জীবনের দুই তৃতীয়াংশ বয়স শেষ। তবু যেন দায়িত্বের বোঝা কাঁধ থেকে নামলো না। স্বামীর মলিন মনটা অনুমান করেই নিজেদের আরো ছোটো ভাবতে শুরু করলেন নাজনীন। আজও বড়োবোনের পাশে নিজেকে বড়ো তুচ্ছ, বড়ো বেমানান বলে মনে হচ্ছে। চিকন চিকন দুটো সাধারণ চুড়ির দিকে দুঃখ ভরা চোখে চেয়ে থাকতেই ভাবলেন, এখানে সব মহিলার গায়ে ভুরি ভুরি অলংকার, আর তিনি কিনা সংসার চালানোর পেছনে সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রায় নিঃস্বই হয়ে আছেন। ফোনে কথা বলতে থাকা আফসানার চোখ এবারও ব্যাপারটা লক্ষ করতে পারল। অফিসের ম্যানেজারকে কল রাখতে বলে তিনি ছোটোবোনের দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চাইলেন,

– নাজু, তোকে না বলেছি এদিককার বড়লোকি হাবসাব দেখে ঘাবড়াবি না? তাহলে তুই হাতের চুড়ির দিকে কি দেখছিস? আমার চুড়ি খুলে দিলে পড়বি? এখনো সময় আছে বল। এই ফাঁকে পরে নে।

আফসানার অমন বলা দেখে হেসে ফেলেন নাজনীন। ফ্যাকাশে হাসিটা বুকের ভেতরে গোপন করে সরলহাস্যে বলে উঠেন,

– না বু, রাখো। ঘাবড়ানোর কিছু নাই। আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে শোকর গোজার করি। এই যে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি, কোনো ঋণের কর্জ নাই মাথায়, এটাই তো অনেক। অনেক না বু?

ছোটোবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে সুখ অনুভব করেন আফসানা। আজও তার ছোটোবোনের সাংসারিক মনোবল দেখে আশ্চর্য হন, খুশি হন, গর্বের নিঃশ্বাসে মাথা নুয়ে আসে তাঁর। তিনি হ্যাঁ সূচকে মাথা দুলিয়ে আফসোসের ব্যাপারটুকু বুঝতে পেরে বলেন,

– মেয়েদুটোকে নিয়ে চিন্তা করিস না নাজু। তোর মেয়েরা যথেষ্ট মেধাবী, বুদ্ধিমান। আমরাও তো একসময় তিন তিনটা মেয়ে আব্বার কাঁধে বোঝাস্বরূপ ছিলাম। ছিলাম না রে? আমাদের কি ব্যবস্থা হয়নি কোনো? আব্বার জন্য সবকিছু আসান হয়ে যায়নি? সব হয়েছে। ওসব নিয়ে দুর্ভাবনা করতে যাবি না। ওদের পড়াশোনা যখন করাচ্ছিস, কষ্ট করে সেটাই করা। যখন যেটার সময় হবে, সেটা সুযোগমতো হবেই। চল, ভেতর যাই। হাতের চুড়ির দিকে না তাকিয়ে জীবনের দিকে তাকা। ওই চুড়ি তো কবরের নীচে যাবে না। যাবে? আয়।

বড়োবুর কথায় নীরবে হেসে হাঁটা দেন নাজনীন মিলা। মাথার উপর ছাদটুকু ছাড়া ধন বলতে ঘরে কিছুই নেই, এ কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? স্বামীর স্বল্প বেতনের চাকুরিতে কি কি পন্থায় তিনি সংসার চালাচ্ছেন, কীভাবে একটু একটু করে চাহিদা চেপে মেয়েদের জন্য সর্বস্ব বিকিয়ে চলছেন, আর কীভাবেই একজন বীরাঙ্গণার মতো জীবনযুদ্ধে হাসিমুখে মাথা উঁচু করে হেঁটে চলছেন, তা কি প্রতিবেশির দল বা স্বজনরা কেউ জানবে? জানবে না। শহরে একখানা দোতলা বাড়ি, ভাড়া দিবে, মাস শেষে আয়েশী ভঙ্গিতে টাকা তুলবে, খরচ করবে— বাস্তবতা এতো সহজ নয়। পায়ের তলায় শত শত কাঁটা ফুটিয়ে রক্তাক্ত হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে চলার নামই জীবন-যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সেনাপতি সে নিজে, যোদ্ধা সে নিজে, অধিনায়কও একমাত্র সেই-ই! ফলাফল পাবে মৃত্যুর পর পরকালীন জীবনে। মানুষের কাছে নয়।

.
একজন হিংস্র মানুষ বলেই এতোদিন নিজেকে জানতেন ডেরেক ফার্নান্দেজ। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে আজ থেকে ক’বছর আগে। তিনি এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাঁর পেশাগত জীবনে এর চাইতে নির্মমতার পরিণতি সাড়ে তিন বছরেও তিনি দেখেননি। ব্যাপারটা মনে করলেই হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আসে। পাথর বনে যাওয়া মনটা ভয়ের কাতরে শিরশিরে অনুভূত হয়। তাঁর ডানপাশে থাকা ব্যক্তিটি দক্ষ চালে মহাসড়কের বুকে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। স্থির চোখদুটো যেন জলজ্যান্ত নিষ্ঠুরতায় ধক ধক করে উঠছে, আর রুক্ষ হাতের গ্রিপ যেন শক্ত করে ধরেছে গোলাকার কালো স্টিয়ারিংটা। ডানহাতে তীব্রগতিতে স্টিয়ারিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে ডানে গাড়িটা মোড় নিয়ে ফেলল একজন সুদক্ষ চালকের মতো। বহুক্ষণ যাবৎ নীরবতা শেষে আপাত কঠিন শঠতায় বলে উঠল সাঈদ,

– নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন ডেরেক সাহেব। সবসময় আপনাকে উদ্ধারের জন্য আমি হাজির হব না। আজ যদি আমি গাজীপুর অন সাইটে অ্যাভেইঅ্যাবেল না থাকতাম, আপনার পরিণতি কেমন করুণ হতো, নিজেই সেটা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন। চাকরি বাঁচাতে যা ইচ্ছা করুন, কিন্তু মেইন ট্র‍্যাক থেকে দূরে সরে গেলে আমি তা একদম বরদাস্ত করব না।

বয়সের কাঠগড়ায় নিজে বেশ বড়ো হলেও পাশের এই পুরুষটিকে চরম ভক্তির নজরে দেখেন ডেরেক। আজও তিনি গলাটা নরম সুরে মাখো মাখো করে বিগলিত সুরে বললেন,

– ঈশ্বরের দোহাই, আপনাকে আর কখনো এরকম পরিস্থিতির ভেতর ফেলব না। কথা দিচ্ছি। আমি নিজেও ব্যাপারটার জন্য খুব লজ্জিত। রাত আড়াইটার সময় ডাক . . . প্লিজ পারডন মি ফর দিস টাইম।

গলাটা চরম ক্রোধে ঝাঁঝিয়ে উঠতে চাইলেও নিজেকে বেশ কট্টরভাবে সামলে নেয় জুনায়েদ সাঈদ। কালো হাতঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাতটার কাছাকাছি। আজ সারাটাদিন বাইরে কাটালেও ওই কোমল মুখটা দেখবার জন্য প্রচণ্ড ব্যাকুল হয়ে উঠছে। রুক্ষ আঙুলের মাঝে একবার শুধু নরম আঙুলের স্পর্শ পড়ুক, গতরাতের মতো মায়া ভরা চোখদুটো দিয়ে চুপ করে তাকিয়েই থাকুক, আর কিচ্ছু চাই না তার। ডেরেক ফার্নান্দেজ মাথা ঘুরিয়ে গাড়ির ব্যাকসীটটার নীচে থম মারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গাড়ির ভেতরে জ্বলে উঠা হলুদ টিমটিমে আলোয় স্পষ্ট ওই নারী মুখ। মুখটি ভীষণ রকমের সুন্দর। হাত-পা শক্ত করে বেঁধে মুখটাও নির্দয়ের মতো গায়ের ওড়না দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেদনাদায়ক যন্ত্রণার প্রবল ছাপে ফুলে উঠা চোখদুটো থেমে থেমে ফেলছে অশ্রুকণা। আর সহ্য করতে না পেরে গোঙানির মতো অস্ফুটস্বরে কাতরাতে থাকে। দুর্বল, ভঙ্গুর শরীরে নড়াচড়াটুকু করতে না পেরে দরদর করে দু’চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ডেরেককে আড়চোখে পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ গম্ভীর স্বরটা অবিচল কণ্ঠে বলল,

– বাকি মেয়েগুলো তু° লে আনুন যেভাবেই হোক!এসব ছোটোখাটো কাজের জন্য আমাকে কল করতে যাবেন না। সাবধান করে দিচ্ছি আপনাকে এবং আপনার পুরো টিমকে। মেয়েটাকে ধানমন্ডির ভেতর কোথায় রাখবেন ইমিডিয়েটলি সেটা ফাইনাল করে জানাবেন দ্রুত। এই মেয়েকে আমার চাই ডেরেক সাহেব। বায় হুক অর বায় ক্রুক— ইট শ্যুড বি ডান।

ব্যাকসীট থেকে চোখ ঘুরিয়ে সতর্কভঙ্গিতে ‘ হ্যাঁ ‘ জানায় ডেরেক ফার্নান্দেজ। এ পর্যন্ত হিসাবের ছকে কতটা সংখ্যা পূরণ হলো সেটা মনে মনে যোগ করতেই ভারি ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। ডানে তাকাতেই কর্পোরেট অফিসের দুর্ধর্ষ এইচ ও ডি’র দিকে তাকিয়ে দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি বুঝিয়ে বললেন,

– আর মাত্র ক’জন বাকি, হেড। শেষ। আবদুল সোহাইল গ্রুপের কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টে আপনার এইচ. ও. ডি. পজিশনটার সময়সীমা ফুরিয়ে আসছে। রিজাইন দেওয়ার আগেই আমাদের সব কাজ হয়ে যাবে।

কানে পুরোটা কথা শ্রবণ করলেও দুম করে আদরের ব্ল্যাক মাম্বাটা নোয়াহ্ ব্রান্ডের গাড়ির কাছে থামিয়ে দিল সাঈদ। হাতঘড়িতে বিপ্ বিপ্ শব্দে অ্যাকুরেট রাত আটটার জানান দিচ্ছে। স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটো তখনো সেভাবে স্থির রেখে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

– আমার কি এখন ঢাকা বিভাগে কাজ শেষ?

– জ্বী। আপনারটা অন্য বিভাগে পরেছে। খুব সম্ভবত একমাসের মধ্যেই সবগুলো কাজ শেষ হয়ে আসবে। তাই বেশি দেরি নেই।

– সময় কতদিন বললেন?

– অলমোস্ট একমাস। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে আসবে আই হোপ। অন্য বিভাগের কোন জেলায় পরেছে সেটা আমি গতকাল রাতে আপনার ডিভাইসে জানিয়ে দিয়েছি। চেক করবেন।

– বেশ। এবার যেতে পারেন ডেরেক সাহেব। মেয়েটাকে আপনার গাড়িতে তুলে হাইওয়ে রোড দিয়ে চলে যান।

– আসি। সেফ জার্নি।

কুশলী কায়দায় সম্মতি বুঝিয়ে ডেরেককে বিদায় জানাল সাঈদ। রাস্তার এ পথে সুনশান একটু, বেশ জনমানবশূন্য ফসলি ক্ষেত। এই সুযোগে ব্যাকসীট থেকে ঝামেলার বোঝাটা কাঁধে তুলে নিজের গাড়িতে নিয়ে গেলেন ডেরেক। পুরো সাক্ষাৎ, আলাপ, সিদ্ধান্তের সময় চোয়াল শক্ত করে কথা বললেও এখন মনটা আর স্বাভাবিক নেই। ঝুরঝুরে বালির মতো তার রঙিন নরম প্রাসাদটায় কি ধস নেমে গেল? একমাস? স্রেফ একটা মাস? এই একমাস কি ঢাকার তল্পিতল্পা গুটাতে আর মায়ের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট? মা জননী কি ঢাকার বাইরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারবে? চাকরির এতোগুলো বছরেও মায়ের চোখ থেকে ওরকম দূরে থাকেনি সাঈদ। আফসানা কাদিরের গর্ভ থেকে প্রথম ও শেষ সন্তান যে সে নিজে, এরপর সেই গর্ভের জরায়ু টিউমারের গ্রাসে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এরপরও কি কাপুরুষের মতো চাকরির টানে যেতে চাইবে? স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটো আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে আসলে আজও অন্তর্মুখী মনটা বিড়বিড় করে উঠল,

– যার প্রথম ও শেষ সন্তান শুধু আমি। আর কোনোদিন কোনো সন্তান যার কোল জুড়ে আসেনি আর আসবেও না এতোসব কিছু জেনেও অমানুষের মতো দায়িত্বে ফাঁকি দেব? জানা নেই। জানিও না। বারবার আমাকে এমন কঠিন চ্যালেঞ্জের ভেতর ফেলা হচ্ছে। রক্ষা করুন ইয়া কারীম! আই অ্যাম টোটালি ব্ল্যাক আউট!

.

ডানহাতে কপাল টিপতে টিপতে পরিচিত কাউকে খুঁজতে লাগল ফিহা। সাউন্ড বক্সের শব্দদূষণে মাথার ভেতর অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। খাবারের সেকশনে সবাই খাবার খেতে বসেছে, কিন্তু মাথাব্যথার যন্ত্রণায় মুখে কিছু তুলার মতো রুচি নেই। কপালের দু’পাশ থেকে রগ খিঁচে দুর্বহ একটা ব্যথা হচ্ছে। একদমই সহ্য করা যাচ্ছে উহঃ! আর সেখানে দাঁড়াতে না পেরে হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় ফিহা। শব্দের ধুকধুক কাঁপুনিতে মাথাটা যেন বড্ড বেশি বিষিয়ে উঠছে। চোখ মেলে কোনোরকমে তাকিয়ে দেখল, আরামে বসার মতো আহামরি তেমন জায়গা নেই। থাকলেও মানুষজন এখানে-ওখানে ছবি তোলায় ভারি ব্যস্ত। ব্যথায় কপাল কুঁচকে থাকলে হঠাৎ যেন ওর মনে পড়ল, একটু দূরেই তো খালি বাসদুটো থেমে আছে। ওখানে নিশ্চয়ই বিরক্ত করার কেউ থাকবে না। এমনকি সবাই আসতে আসতে আর বেরোতে বেরোতে যতক্ষণই লাগুক, ততক্ষণে তো একচোট পাতলা করে ঘুমও দিতে পারবে! ইশ, দূর্দান্ত একটা বুদ্ধি খেলেছে! এমন পাকা খেলুড়ে বুদ্ধিগুলো পরীক্ষার হলে কেন আসে না? মীরজাফরের মতো ছোট্ট মাথায় শুধু শুধু ফাজিলটা ঘাপটি মেরে থাকে। পা চালিয়ে সেন্টার এরিয়া থেকে বেরোতেই আর কিছুমাত্র পথ হাঁটা দিতে হবে। বিশাল বিশাল বাসদুটো রাখার জন্যও তো বিশাল বিশাল জায়গা রাখতে হবে, তাই আজগর জেঠু দূরের দিকেই বাসদুটো রেখে আসতে বলেছেন ড্রাইভারকে। নিরিবিলি মেঠো প্রশস্ত পথ, দু’পাশ থেকে ঝিঁঝিপোকার একটানা ডাক, নিঝুম রাত্রির অন্ধকার ঘনানো স্তব্ধতা আর ময়মনসিংহের বুকে শান্তি ছড়ানো বাতাস এসব শুষে নিতে নিতে বাসের কাছে পৌঁছল ও।

যাক, বাসের ভেতরে ড্রাইভার মামাটা লাইট ধরিয়ে গেছে। একা একা, দুরন্ত, সাহসী কপট মেয়ের মতো বাসের ঠিক মধ্যখানের একটা সীট বেছে প্রায় ঘুমোনোর মতো বসে পড়ল ফিহা। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর-মন জুড়িয়ে এসে মাথাটাও যেন স্বস্তি অনুভব করছে। ফোমের তুলতুলে নরম সীটে ফুরফুরে আরামে মন ঠান্ডা হলে দু’চোখ জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি এসে জুটলো। মিঠে মিঠে তন্দ্রায় তলিয়ে যেতেই সারাদিনের শূন্যতাটুকুর মাঝে কালরাতের ওই মুখ, ওই ঠান্ডা ঘন স্বর, ওই স্বরের নীচে ভারিক্কি চালের কথাগুলো, সবটুকুই বদ্ধ চোখের ক্যানভাসে ভেসে উঠল। অবচেতন মন যেন ছন্দে ছন্দে শুধিয়ে উঠে,

“এ কেমন ভালোলাগা?
কাছে থাকলে বড্ড জ্বালায়,
দূরে থাকলে যন্ত্রণা।

না পেলে কষ্ট বাড়ায়,
সামনে থাকলে অবহেলা!

এ কেমন কষ্ট বলুন?
মন বোঝেনা কিছুতে,
হাজার সময়, হাজার ভাবনা,
শান্তি পাই না মনেতে।”

নিজের বোকা বোকা কথার বুনন দেখে আনমনে হেসে ফেলল ফিহা। চোখদুটো বন্ধ করে সীটের কোণায় জানালামুখো হয়ে গুটিশুটি মেরে রইল। ঠান্ডা নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎ বাসটা মৃদু ঝাঁকুনির মতো কেঁপে উঠলে কিছুটা বিরক্তই হলো যেন। ঠান্ডা হাওয়ায় খুকখুক করে কাশতেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ফিহা বলল,

– আহ্, বাসে আস্তে উঠুন ড্রাইভার মামা। ঘুমাচ্ছি।

ড্রাইভার মামার কোনো সাড়াশব্দ-ই এলো না। কয়েক সেকেন্ড পুরোপুরি শান্ত থাকতেই হঠাৎ ক্যাচচ্ করে কিছু একটা আঁটকানোর শব্দ হলো। চকিতে ফিহার তন্দ্রাচ্ছন্ন মন সহসা ধক্ করে উঠল! বুকের ভেতরে কু ডাকা পাখিটা সেকেন্ডের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে! সটান মুখটা জানালার কাছ থেকে উঠাতেই দুম করে বাতিটা নিভে যায়। কেমন একটা দুর্বোধ্য ভয়ে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ” ইয়া আল্লাহ্ পাক ” বলে দুরুদুরু করে কাঁপতে থাকা পাঁজরটা লম্বা নিঃশ্বাসের ভেতর হাতের তালু ঠান্ডা করে দিচ্ছে। বাসের সামনের দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের জন্য কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তবু বুকে জমা ভয়টা সামাল দিয়ে গলা তুলল ফিহা,

– গাড়ির ভেতরে কে আছেন? কে আপনি? কথা বলছেন না কেন?

এবার যেন চোখ সয়ে আসা অন্ধকারে কালোমূর্তিটা দেখতে পেল ও। নিশ্চল ভঙ্গিতে কুচকুচে মূর্তিটা ওকেই যেন দেখছে! ব্যাপারটা ভাবতেই গা ছমছম করে কেঁপে উঠল ফিহা। চিৎকার দেওয়া যাবে না ভুলেও! প্রচণ্ড ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা এবার সামলাতেই হবে, যে করেই হোক! ধীরগতিতে সীট থেকে দাঁড়িয়ে পরতেই হঠাৎ ওই মূর্তি সামনে থেকে এগোতে শুরু করল। ভয়ে হাত-পায়ের শিরাগুলো খিঁচুনি দিয়ে আসছে, তবু শক্ত করে নিজের সাহসিকতায় যুঝতে লাগল ও। আরো একবার গলা উঁচিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,

– কে আপনি? কথা বলছেন না কেন? কেন এদিকে এসেছেন? আপনি আর এক-কদম এগোলে এক্ষুণি আমি অঘটন একটা ঘটিয়ে দেব!

যদিও শেষের কথাটা মুখ ফসকে এমনিতেই বেরিয়ে গেছে, তবু সেটা নিয়ে এখন ভাবনার বুদ্ধি খেলছে না। নিজেকে চূড়ান্তরূপে বাঁচানোর জন্যই সীট থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে পেছনের দিকে পিছোতে থাকে ও। মাথা খাটাতে লাগল ওর কাছে কি এমন কিছু আছে কিনা যেটা দ্বারা আহত করা সম্ভব। দ্রুত মাথা খাটানোর পূর্বেই ওই কালো মূর্তি এতোটা নিকটে এসে পরল যে কিছু বুঝে উঠার আগেই হ্যাঁচকা টানে ডানকাঁধ থেকে ছিঁড়ে নিল ওড়নাটা! সেফটিপিনের খোঁচায় চোখ-মুখ কুঁকড়ে উঠলে চরম ধাক্কায় ওকে সীটের উপরে শুইয়ে ফেলল মূর্তিটা! অস্পষ্ট অন্ধকারে দেখতে পেল ওর ওড়নাটা ডানহাতে প্যাঁচাচ্ছে ওই জানোয়ার। হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটিয়ে কিছু বলার আগেই পাশবিক হাতে ওর মুখটা চে পে ধরে জবানটা প্রায় বন্ধ করে দিতে চাইল! ফিহা নিঃশ্বাসের কষ্টে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলে নখ দিয়ে ওই হাতের চামড়া যেন ছিঁড়ে আনতে চাইল। তবু পাষাণ ভার হাতটা মুখ ও নাক থেকে না সরলে সর্বশক্তি দিয়ে মু°ষ্টি কষালো মুখে! শক্ত ঘু°ষিটা বোধহয় নাকের আশেপাশে লাগতেই কঁকিয়ে উঠা যন্ত্রণায় কয়েক কদম পিছিয়ে পরে মূর্তিটা! এই সুযোগে সীট থেকে উঠতেই শেষ সম্বল হিসেবে পায়ের হিল জুতোটা হাতে তুললেও চুলের মুঠিটা যেন খামচে ধরে পা°ষ°ণ্ডটা। চিৎকার করে বারবার চ্যাঁচিয়ে যাচ্ছে, “কাপুরুষ! অন্ধকারে একটা মেয়ের উপর প°শু°র মতো আচরণ করতে এসেছিস! তুই .. আহ মা!” চুল খামচে ধরার ফলে আর কিছু বলতে পারল না ও।
এসি বাস বলে জানালার পর্দাগুলোও দেওয়া। প্রবল জেদে চোয়ালজোড়া শক্ত করতেই ডানহাতে হিল জুতোটা তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি হিলের অংশটা দিয়ে আঘাত করল ফিহা। পরপর আঘাতে পা°ষ°ণ্ডটা কোনোভাবেই মুখ তুলে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছিল না। অস্ফুট আর্তনাদে দু-একটা তীব্র শব্দ করতেই চুল খামচানো হাতটা প্রায় ঢিলে করে ফেলেছিল। ফিহা নিজেকে ছাড়িয়ে ওই জুতোটা ওদিকেই ঢিল মেরে দৌড়ে পালাল দরজার মুখে। ঝটপট হাতে দরজার লকটা খুলে ফেলতেই আবারও দানবের মতো পেছন থেকে খামচাতে চাইল জা°নো°য়া রটা! সিঁড়িতে সবে পা দিতেই জানোয়ারটার হিংস্র থাবার আঁচড়ে বাঁকানটা যেন ছিঁড়ে যাবার মতো পীড়া হলো ওর। গগনবিদারী আর্তনাদে বাঁকান ধরে দ্রুত বাস থেকে বেরিয়ে পরলেও ডানহাত দিয়ে দরজাটা সজোড়ে ধাক্কা মেরে আলতো বন্ধের মতো ঝটপট নামল। শরীর ঝিমঝিম করা ব্যথায় পা টলে যাচ্ছে। অকুস্থল থেকে একদৌঁড়ে রাস্তার দিকে ছুটে যেতেই হঠাৎ গগনবিদারী হর্ণের জ্বলজ্বলে দুটো হেডলাইটের কাছে থমকে যায় ফিহা! দ্রুতগতির ওই গাড়ির কাছে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে দুইকান চেপে ‘ মা ‘ বলে তীব্র আর্তনাদটা করলে চারধার যেন কাঁপিয়ে তুলল! বাতাসে বাতাসে গমগম করে উঠল মেয়েলি ভীতস্বরটা, নীড়ের পাখিরা যেন প্রচণ্ড ভয়ে দূর আকাশে উড়াল দিয়েছে . . .

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা— টানটান অবস্থা। কেমন পরিস্থিতিতে আছেন জানাবেন। অপেক্ষা করার জন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা। আমার অফুরন্ত ভালোবাসা জানাই। ❤

[শব্দসীমা ২৮০০+]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here