নির্মোচন পর্ব ২৪

0
365

#নির্মোচন .❤
#পর্বসংখ্যা_২৪ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

— “এই পবিত্র আছোঁয়া ঠোঁটে আমারই একমাত্র ছোঁয়া থাকবে। এই আঙুলের ফাঁকে শক্ত আঙুল গুঁজবে আমারই হাত। ওই চোখদুটোর নীরব প্রতিটি অশ্রু শুধু আমি দেখব। জোছনা ভরা রাতে সাক্ষী হবে আমাদের আসঙ্গ সাক্ষাৎ।”

কথাগুলো মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না ওই চরম দাম্ভিক পুরুষ। আজও নিজ কঠোরতায় আবদ্ধ হয়ে নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রইল শুধু। শান্ত হয়ে থাকা পানপাতা মুখটি কাঠপুতুলের মতো নিস্পৃহ চোখে চেয়ে আছে। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণায় কোণায় তখনো বেজে চলেছে একটু আগের কথাগুলো। দু’হাতের নরম মুঠো মুচড়ে এলেও মস্তিষ্ক তখন জানান দিচ্ছে, গতকাল ঠিক কতটা চালাকি করে সুক্ষ্ম কাজটা করেছে এই লোক। এই মহাধূর্ত লোকটি নিশ্চয়ই কোনো একফাঁকে আলমারি থেকে খালামনির শাড়িটা খসিয়েছে। এরপর নিজের আনা পোশাকটা তৃতীয় ব্যক্তি সুফিয়া খালার মাধ্যমে এমন সময় পাঠিয়েছে, যখন কিনা “না” বা অন্যকিছু বলার সময়টুকু নেই! বেচারি খালামনি হয়ত জানেই না তার আদরের বোনঝির জন্য কিনে আনা সেই শখের শৌখিন শাড়িটা কারো ক্যালিনান গাড়ির ব্যাকসীটে কিডন্যাপ অবস্থায় ছিল। মাঝখান দিয়ে বৃষ্টি এসে পুরো কাহিনির ক্লাইমেক্স ঘুরিয়ে ফিহার কাছেই ওটা পৌঁছে দিল। কি অদ্ভুত খেল, কি অদ্ভুত এক দোলাচল! ফিহা ব্যাপারটা দেখে জোরে জোরে হাসবে, নাকি মহা ধূর্ত চালটা দেখে সাংঘাতিক একটা ভয় পাবে? বাইরে ঝড়ো বাতাসের প্রবল ঝাপটা শুরু হয়েছে। সেই ঝাপটার তোড়ে কোমল মুখের উপর আছড়ে পরছে চুলের আঘাত। দু’পক্ষের ভেতর কঠিন নীরবতা শেষ করতে সাঈদই আবার মুখ খুলল,

– যে হেল্পের জন্য ডেকেছিলাম, সেটা লাগবে না। প্রয়োজন নেই। যখন সময় হবে, নিজে এসে কাজটা করে যাবেন। টিশার্ট খুলে পিঠে হাত দেবার কাজটা ওয়াইফ হিসেবেই তোলা থাকুক। সেদিন মানবতা দেখিয়ে নয়, হক হিসেবেই করে দিবেন।

দু’কান গরম হয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল বুঝি! শক্তভাবে দাঁতকপাটি লাগিয়ে বাইরে থেকে নিজের খোলসটা শান্ত দেখাল ফিহা, যেন কথাগুলো ওকে স্পর্শই করছে না। নিজের তেজ সুপ্ত ব্যক্তিত্বে অটল থেকে খুবই শান্ত গলায় জবাব ছুঁড়ে বলল,

– রুমালটার জন্য ধন্যবাদ। আসি।

কথার ভেতর নূন্যতম অস্থিরতা না ফুটিয়ে সরাসরি তাঁর সামনে থেকে চলে গেল ফিহা। একদমই বুঝতে দিল না ওর ভেতরে কি বয়ে যাচ্ছে! একেকটি হুঁল ফোটানো কথাতে কতটুকু অস্থির হয়ে পরেছে তা ব্যক্ত করল না একবিন্দু। সিঁড়ি দিয়ে ফড়ফড় করে নামতেই হঠাৎ আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়ায় ফিহা! বুকের হৃৎপিণ্ড যেন একলাফ দিয়ে গলায় পৌঁছে গেছে! প্রচণ্ড ধুকধুকনির ভেতর নিঃশ্বাস আঁটকে এলেও ঠেলেঠুলে একটা হাসি দিয়ে বলল,

– এখানে … আপনি এখানে কেন খালু? উপরে যাচ্ছেন আপনি?

মাখন রঙা পান্ঞ্জাবীতে অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সোয়াদ জাকির। চোখে প্লাস পাওয়ারের চশমা। হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে তিনি দ্রুতপায়ে তিনতলার দিকে আসছিলেন। পথিমধ্যে ফিহাকে অমন ধড়ফড় করে নামতে দেখে কেমন প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। আচ্ছা মেয়েটা কি তিনতলা থেকে আসলো না? কিন্তু ও কেন তিনতলায় যাবে? ওখানে তো সব ছেলে, মুরুব্বিদের জন্য শোবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোয়াদ জাকির কোনোপ্রকার হম্বিতম্বি না করে সরাসরি প্রশ্নটা শুধিয়ে উঠেন,

– অন্ধকারে তুমি এখানে কি করছ মা? তোমার খালা নীচে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তোমাকে। তিনতলায় কি কাউকে খুঁজতে এসেছ নাকি অন্য কোনো দরকার?

খালুর সোজাসাপ্টা প্রশ্নে পায়ের তলায় সুড়সুড় করে উঠল ফিহার। এক ঝড় থেকে ছুটে এসে আরেক ঝড়ের সামনে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। গুলে উঠা শব্দগুলো দ্রুত সাজিয়ে গুছিয়ে মিষ্টি একটুকরো হাসি ছুঁড়ল ফিহা,

– মাজেদা ফুপুর হুকুমে লাকড়ি নিতে এসেছিলাম খালু। ফুপু বলল যে ঘরটা নাকি তিনতলার দিকে, তাই এখানে কিছু কাঠ নিতে এসেছি।

সোয়াদ এ কথায় আরো আশ্চর্য হন! ভ্রুঁদুটো আরো খানিকটা কুন্ঞ্চন করে বলেন,

– কাঠ?

নিজের অপারগ অবস্থা ঢাকার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টাটা চালিয়ে বলল ফিহা,

– জ্বী খালু, মাটির চুলার জন্য কাঠ। কাঠ দিয়ে রাতের খাবারটা নাকি গরম করা হবে। গ্যাসের চুলায় আগুন নেই। এজন্য কাঠ নিতে এসেছি।

সোয়াদ ভ্রুঁকুটি অবস্থায় কি যেন নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরই তিনি আসল কথাটা উচ্চারণ করে বললেন,

– মা নাবিলা, তোমার হাত যে আমি শূন্য দেখছি। হাতে একটা সাদা রুমাল ছাড়া কিছুই নেই। হাতে কাঠ কোথায়?

সারা শরীরে যেন হিম হাওয়ার মতো কিছু একটা বয়ে গেল ফিহার। ও যে কাঠ নিতে এসে আসল কাজটাই ভুলে গেছে সেটা এতোক্ষণে বুঝতে পারল। কিন্তু এখন খালুকে কি জবাবটা দেবে? মিথ্যা বলা ওর স্বভাবে নেই, ভেতর থেকে চোরের মতো মিথ্যাটা আসেও না, তাহলে? ডানহাতের মুঠোয় সাদা রুমালটাকে মুচলেকা করতেই হঠাৎ পেছন থেকে বাঁজখাই তীব্র স্বরটা ছিটকে এলো,

– কাঠ আমার কাছে। উপরে তাকান আপনি।

জলদ্গম্ভীর স্বরটা দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেতেই সোয়াদের দৃষ্টি তখন ফিহার পেছনে গিয়ে থামলো। দুটো হাতভর্তি করে একস্তুপ কাঠ নিয়ে ছেলে পিছু পিছু এসে হাজির হয়েছে। অন্যদিকে আকাশ থেকে পরার মতো আশ্চর্য বিহ্বল দৃষ্টি ছুঁড়ে ফিহা মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। ওর বিস্ময় মাখা মুখটার পানে একপলক তাকিয়ে সরাসরি সাঈদ বাবার দিকে চাইল,

– হাঁটুর বয়সী মেয়েকে দিয়ে আমরাই একগ্লাস আনাতে গেলাম না, সেখানে আপনার শ্যালিকার ননদ ভারি ভারি কাঠগুলো আনার জন্য একে পাঠায়। আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি! নীচে তলব বসেছে?

ছেলের কথায় ভ্রুঁজোড়া আরো কোঁচকালেন সোয়াদ জাকির। হাতদুটো কোমরের পেছন থেকে খুলতে খুলতেই অবাক কণ্ঠে বলে উঠেন,

– কাঠ বলতে এই ভারি কাঠগুলো?

এবার তিনি দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরাসরি ফিহার মুখটার দিকে শুধালেন,

– নাবিলা, এই ভারি কাঠগুলো আনার জন্য তুমি এখানে এসেছ মা? এগুলো কী তোমার বহনের যোগ্য? কে পাঠিয়েছে আসো দেখি। কেমন একটা কাজ করেছে এটা!

চিন্তিত মুখে পা ঘুরাতে নিচ্ছিলেন সোয়াদ জাকির, কিন্তু সহসা যে কাজটার জন্য এমুখো তিনি আসছিলেন সেটার প্রতি গুরুত্ব দিতেই উপরের অকাট্য গম্ভীর মুখটার দিকে চোখাচোখি দৃষ্টিতে চাইলেন। যেন চাহনি দিয়েই কিছু বোঝানোর চেষ্টা চালালেন নীরবে। সুক্ষ্ম একটা ইঙ্গিত তীক্ষ্ম মস্তিষ্কে ধরা পরতেই ধক্ করে কৃষ্ণাভ তারার চোখদুটো ক্ষুরধার হয়ে উঠল। মুখে কিছু না উচ্চারণ করলেও বাবা সোয়াদ জাকির কর্মঠ সুরে জানালেন,

– নীচে তোমার না আসলেও চলবে। ব্যাপারটা আমি দেখছি। তুমি এখানে কোনো ঝামেলা বাঁধাও সেটা আমি চাই না। রুমে যেতে পারো।

মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’পক্ষের শীতল যুদ্ধটা দেখে যাচ্ছে ফিহা। কেউ কারো চেয়ে কথাতে, যুক্তিতে, বুদ্ধিতে কোনো পরিপ্রেক্ষিতেই কম না। এ কেমন দ্বিধাগ্রস্ত ঝামেলার ভেতর ফেঁসে গেল ও? ফিহা খালুর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পিছু ফিরে গম্ভীর আদলের মুখটার পানে অস্বস্তি চোখে তাকাল। সেকেন্ডেই বাবার মুখটা থেকে কোমল মুখটার দিকে দৃষ্টি পরলে ওর কুঁকড়ানো চাহনিটা বুঝতে পারল সাঈদ। তৎক্ষণাৎ আবহাওয়াটা পালটা ঘুরিয়ে বলল,

– আমার জন্য খাবার পাঠাতে নিষেধ করবেন। নীচে থেকে ডাকাডাকি যেন না শুনি। আমি একটু আগে খেয়েছি, এখন খাব না। আপনি যেভাবেই হোক ম্যাটারটা সর্ট আউট করবেন। ঘুমাতে গেলাম।

বুকে চাপা রুদ্ধশ্বাসটা আস্তে করে ছেড়ে দিলেন সোয়াদ। যেন দশ টনের পাথর তার বুকের উপর থেকে নেমে গেছে এখন। মাথা নাড়িয়ে শান্ত সম্মতি জানিয়ে ‘ আসো মা। ‘ বলে নেমে গেলেন নীচে। খালুর ডাকটা কর্ণকুহরে পৌঁছালেও ফিহা তখনো অন্তর্মুখী, চাপা, মেপে মেপে কথা বলা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে।

– নীচে যান।

আবারও সেই “আপনি” সম্বোধন করা প্রচণ্ড বুক কাঁপিয়ে তোলা স্বর! ফিহা চূড়ান্ত সীমায় অসহায়ত্ব ফুটিয়ে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গির মতো তাকালে, হঠাৎই বাঁধ ভাঙা অসহ্যকর অনুভূতিতে তিক্তশ্বাস ছেড়ে বলল, “ধ্যাত্!”

বলেই মুখটা ঘুরিয়ে আপাত ক্ষোভে গজগজ করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায় ও। ভুলেও মুখ ফিরিয়ে “আপনি” বলা চরম পাষণ্ডটার দিকে তাকায় না! কি শুরু করেছে ওর সাথে? ফাজলামো?
ফিহাকে ওরকম ভাবে জ্বালাতন করে মনে মনে ভীষণ মজাই পেল। বহু বহুদিন পর অন্যরকম এক ফুরফুরে ছোঁয়া তার হাসিখুশিহীন জীবনটাতে আঁচড় বসিয়েছে। বুক ফুলিয়ে গভীর নিঃশ্বাসের দমকটা অবাধে, নীরবে, শান্তির উচ্ছাসে ছেড়ে দিতেই পা ঘুরালো জুনায়েদ সাঈদ।

.

প্রবাসী প্রতিবেশির ডুপেক্স বাড়িটা থেকে সরাসরি এ বাড়ির নীচতলায় আসে আফসানা ও সুফিয়া।রান্নাঘরের পাশের ঘরটাতে রোকসানা ও আরো কিছু মহিলা একত্র হয়ে কালকের বরযাত্রী নিয়ে শেষ প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছিল। কিন্তু সে কাজে চরম বাঁধা দিয়ে একদম রোকসানার সামনাসামনি এসে কড়া গলাতে বলে উঠেন আফসানা,

– সব কাজ সাইডে রেখে এদিকে আয়। কথা আছে।

আচমকা মহিলাদের হৈহৈ করা গুঞ্জনটা বাতাসের গতিতে থমকে যায়। কয়েক জোড়া চোখ রাগে টকটক করা আফসানার মুখটার দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে আরো একটি ঢলঢলে মুখ, মাজেদা। রোকসানা একবিন্দু তর্ক না করে ওই অবস্থাতেই বোনের সামনে সমীহ নজরে বলে উঠে,

– কি কাজ গো বড়োবু? দুলাভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? দীপের আব্বারে ডাকব?

– পারলে ডাক। মনেহয় দরকার পরতে পারে। তার আগে শুনে রাখ, তোর দুলাভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়নি। হলেও সেটা মুখ ফুটে বলার মতো স্বভাব উনার না। তোর বাড়িতে এটা-ওটা আনার জন্য, ভারি কাজের জন্য, যেকোনো দৌড়ঝাঁপের জন্য ব্যাটা মানুষ নেই? অভাব পরেছে?

কথার খেঁই ধরতে না পারলেও তবু রোকসানা উত্তর করল,

– ও বাবা! থাকবে না কেন? ঘরভর্তি তো কত মানুষ! দীপ আছে, ওর ভাইরা আছে, বন্ধুরাও আছে এতোগুলি মানুষ এইখানে; এইখানে আবার ব্যাটাছেলের অভাব পরবে কেন?

এবার যেন কোমর বেঁধে লেগে পরলেন আফসানা কাদির। রোকসানাকে তোয়াক্কা না করেই পায়ে পায়ে ঘরের আরো মহিলাদের সামনে গিয়ে সেখান থেকে একজনের দিকে ভ্রুক্ষেপ করে বললেন,

– ঘটনার আগা কোনটা, মাথা কোনটা আমি কিছুই জানি না মাজেদা আপা। একটু আগে খবর পেলাম আপনি নাকি আমার বাড়ির মেয়েকে দিয়ে লাকড়ি আনাতে তিনতলায় পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন এতেও কোনো সমস্যা নেই। ছোটোখাটো কাজের জন্য পাঠাতেন, তাতেও আমার সমস্যা ছিল না। আপনি মাকড়সার ঘরে লাকড়ি আনার জন্য কেন পাঠিয়েছেন শুধু এই উত্তরটা দিবেন। বলেন এখন।

যদিও বয়সের গুণতি ধরলে আফসানার চেয়ে ক’বছর বড়োই হবেন, কিন্তু সম্পর্কের দিক দিয়ে রোকসানার ননদ বলে তিনি বেশ ছোটোই এখন। কাজকর্ম থেকে গা বাঁচিয়ে যেখানে-সেখানে চুটিয়ে গপ্পো করতে থৈ থৈ শান্তি পান, এটা তো তিনি মুখ ফুটে এখন উচ্চারণ করতে পারবেন না। এই শিক্ষিত জল্লাদটা কাপড় কাঁচার মতো কেঁচে কেঁচে সবার সামনে ধুয়ে দিবে। ফিকে হাসি দিয়ে পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে বলে উঠলেন মাজেদা,

– হাঁটুর বিষে উপরে উঠতে পারছিলাম না আপা। পরে আপনার বোনের মেয়েকে দেখে একটু এনে দিতে বলছিলাম। বলাতে কিছু খারাপ হয়ে গেছে?

– খারাপের প্রসঙ্গ তুলেছি? আপনি দাঁত বের করে হাসি বন্ধ করুন। আমি এখানে রঙ্গ-তামাশার কথা বলছি না। আপনার যদি হাঁটুর ব্যথায় খারাপ অবস্থা হয়, তাহলে আমার কাছে বারবার আপনি গল্প জুড়তে আসেন কীভাবে? বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাঁটুতে গরম ছ্যাঁক লাগানোর কথা না?

আফসানার তলবের ভেতরেই সুফিয়ার পাশে থাকা আরেক গৃহিণী মহিলা মুখের জর্দা মেশানো গন্ধ সুফিয়ার কানে ছেড়ে বললেন,

– ইছ! বেডির শরম নাইকা। এইহানেও বাঁচালের মতো গপ্পো করোনের লাইগা আরেক ছেমড়ির কান্দে কাম বুজায়া দিছে। কামচোর বেডি।

সুফিয়া ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন,

– ক্যালক্যালায়া জদ্দা খান ক্যা? আপনে কতা কইয়েন না। মুখেরতে জদ্দার গন্ধ কয়।

মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে সেই মহিলা সবগুলো দাঁত ভেটকি মাছের মতো বের করে বলেন,

– আপনের বাড়ি কই আফা? আপনেরে চিনা চিনা লাগতাছে। লগে দেহি কতাবাত্তা সব মিল্লা যাইতাছে গা।

– আপনে তো দেহি ভালাই মানুষ! এইহানে একটা কাহিনি ঘইট্টা যাইতাছে আর আপনে এহন আমার লগে পিরিতির ক্যাচাল জুত্তে আইছেন। পরে কইতাছি খাড়ান। আগে মামলা এইডা শেষ হউক।

– আইচ্ছা আইচ্ছা আপা। আমিও এইফাঁক দিয়া জদ্দার পান ফালায়া মুখ ধুইয়া লইতাছি। দেহেন কী হয় হেরপর।

দু’জনের ভেতর কথা চলতেই আফসানার সপাটে ব্যবহারগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন সোয়াদ জাকির। তিনি আর মেয়েলি ঝামেলার ভেতর ঢোকার ইচ্ছে করলেন না। স্ত্রীর বুদ্ধিমত্তা এবং পরিস্থিতি সামলানোর গুণাগুণ বুঝে তিনি ফিহার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন,

– এখানে আমার কিছু করতে হবে? তোমার খালা একাই যথেষ্ট হবে না?

ফিহা দরজার বাইরে থেকে পুরো ঘটনা দেখতে পেয়ে খালুর দিকে ফিরলো। ঠোঁটের আগায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল,

– মনে হচ্ছে তো খালু। তবে সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে এতো বড়ো সিনক্রিয়েটটা খুবই খারাপ দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় না মাজেদা ফুপু খারাপ কোনো বুদ্ধি থেকে কাজটা করতে বলেছিলেন। উনার হাবভাব আর কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে উনি আড্ডা-রসিক মানুষ। খুবই আড্ডা দেন। কাজ-টাজ তেমন পছন্দ করেন না। তাই কাজের ভারটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু খালামণিকে থামানো উচিত না?

আধ পাঁকা গোফের নীচে তির্যক হাসি ফুটালেন সোয়াদ। চোখজুড়ে গর্বিত চাহনি, মুখ ভরা খিলখিলে হাসি, আর কণ্ঠে এক ছটাক কোমলতা ছড়িয়ে ফিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

– এটা তুমি বুঝো, আমি বুঝি, তোমার খালাও বুঝতে পারছে। কিন্তু সমস্যাটা কোনদিক থেকে এসেছে সেটা শুধু আমরাই জানি। বাইরের কেউ জানে না। আসো, এদের মহিলা সমিতির তর্ক চলতে থাকুক। আমরা বাবা-মেয়ে মিলে উঠান থেকে একপাক হেঁটে আসি।

এই শ্রদ্ধাশীল মানুষটির মুখে “বাবা-মেয়ে” শব্দটুকু শুনে অপার আনন্দে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় ওর। কতগুলো বছর, কতগুলো দিন, কতগুলো লম্বা দূরত্বের বেহিসেবি ক্ষণ শেষে আজ দেখা হয়েছে খালুর সাথে, কিন্তু কোথাও যেন এতটুকু তাল হারায়নি সম্পর্কে। সব সম্পর্ক এমন সুন্দর, স্বচ্ছ, টলটলে পানির মতো হতে পারে না কেন? কেন ইগো নামক কাঁটাটা সম্পর্কের মাঝে এসে ঢুকে যায়? ফিহা কোনো কথা না বলে চুপচাপ খালুর মতোই হাতদুটো পিছমোড়া করে হাঁটা দিল। সেই অবুঝ অবুঝ শৈশবের দিনগুলোর মতো।

.

সমস্ত বিয়েবাড়ি আমেজপূর্ণ পরিবেশে ঘিরে আছে। কোথাও এতটুকু ফুরসত নেই। কাজের ব্যস্ততায় দম ফেলার সুযোগটা পর্যন্ত পাচ্ছে না। দুপুর দুটোর দিকে বিশাল বরযাত্রী রওনা দিবে। সেই সঙ্গে কণের জিনিসপত্র নিয়ে শেষ মূহুর্ত্তের গোছগাছ সারছে বড়োরা। বাড়ির কতিপয় সদস্য, স্বজন, প্রতিবেশি, দূর থেকে আগত কিছু বন্ধুসুলভ মানুষদের নিয়ে বেশ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।একটা ছয় সীটের হাইব্রিড কালো গাড়ি নানা ফুলের শোভায় শোভিত হয়ে আছে। অন্যদিকে আজগর আলী কোনো এক পরিচিত লোক মারফত ঢাকা থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড়ো বড়ো দুটি বাস ভাড়া করে এনেছেন। গন্তব্য ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায়, কণেপক্ষের বিরাট জমজমাট কমিউনিটি সেন্টারে। টানটান উত্তেজনায় সবাই যখন শেষ মূহুর্তের সাজগোজ এবং সব ঠিকঠাক মতো আছে কিনা দেখছে, ঠিক সেসময়ই জানালা দিয়ে নীচের উঠোনে দৃষ্টি আঁটকালো ফিমার! কাল যেদিকটায় কালো আভিজাত্য গাড়িটি থেমেছিল, এখন সেদিকটা পুরোপুরি ফাঁকা! টায়ারের কষাটে দাগগুলো মাটি আঁচড়ে রেখেছে, কিন্তু গাড়িটার চিহ্ন অবধি নেই! কোথায় গেল? ওখানেই তো ছিল। এখন যে বরযাত্রী সব বেরিয়ে যাবে! সে কি ময়মনসিংহে যাবে না? দাঁত দিয়ে সদ্য লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁটটা কামড়ে ধরল ফিমা। জানালার পর্দাটা মুঠোর ভেতরে পাঁচ আঙুলে খামচে একটা অবাধ জেদে শক্ত হয়ে উঠল।

একই দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছে আরো একটি জানালা থেকে। তিনতলার থাইগ্লাস সরানো জানালা দিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে আছে তৌকির আহমেদ শিহাব। গলায় ফাঁস দেওয়া জায়গাটা এখনো লাল হয়ে আছে। তবে ঔষুধের ডোজে ব্যথা অনেকটা নেই। জেল দিয়ে চুল সেট করা হাতটা টিস্যুতে মুছে নিতেই হঠাৎ আফিদের উদ্দেশ্যে বলল,

– সামথিং ইজ রং আফিদ। কিছু তো একটা মিস ম্যাচ ব্যাপার আছে। আই কান্ট ফিগার দিস আউট।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রোফেশনাল স্টাইলে পারফিউম দিচ্ছিল আফিদ। শরীর থেকে ডানহাত একটু দূরে নিয়ে ফোঁস ফোঁস করে দু’বার স্প্রে করতেই চট করে শিহাবের দিকে তাকাল,

– কালকের অ্যাটাকটা নিয়ে? নাকি পিচ্চি ছেলেটার স্পেশাল কাহিনি?

শিহাব জানালার বাইরে তখনও কৌতুহল দৃষ্টি ফেলে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। বাঁ’হাতে রিষ্টওয়াচটা পরতে পরতে বাঁ ভ্রুঁটা গোয়েন্দার মতো উঁচুতে তুলে বলল,

– নট দ্যাট কিস আফিদ। কাল আমি আরেকটু হলে মারা পরতাম। লাস্ট কবে আমার উপর অ্যাটাক হয়েছিল মনেও নেই। আই ক্যান অ্যাসোর ইয়্যু দ্যাট লাস্ট নাইট ওটা রবারি কেস ছিল না। দ্যাট ওয়াজ ইনটেন্ড টু মার্ডার! মাত্র একজন ছিল। একজনই আমাকে পেছন থেকে গলায় টাইট কিছু দিয়ে চেপে ধরেছে। আই অ্যাম ড্যাম টু ড্যাম শিওর আফিদ, দ্যাট পার্সন ওয়াজ ওয়ান্টেড টু কিল মি।

বাংলার ভেতরে অ্যামেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজি মেশানো কথা শুনে আফিদ বরাবরই বিরক্ত হয়, কিন্তু আজ সে জায়গায় বন্ধুর কথা শুনে ভাবনায় পড়ে সে। কালরাতে যখন ড্রয়িংরুমের ওখানে বেসিনের সামনে ওকে পরে থাকতে দেখে, তখন আফিদ একটা মূহুর্ত্তের জন্য প্রচণ্ড ভয়-ই পেয়েছিল! হাতের সিগারেট ফেলে দ্রুত শিহাবকে রুমে এনে সবাইকে ডাকাডাকি করে সে। মন দিয়ে পুরো ঘটনা শোনার পর অনেক চিন্তাভাবনা আর যুক্তিতর্ক শেষে এটাকে ভয়াবহ ডাকাতির মামলা বলে আজগর আলী ঘোষণা দেন। যদিও এ এলাকায় মাঝে মাঝেই বড়ো ধরণের জঘন্য চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, তা এখনো ঘটে। এমনকি আলমারি ভেঙে সমস্ত কিছু লোপাট করার মতো দুর্ধর্ষ রেকর্ডও নাকি আছে। তাই শিহাবের ঘটনা দেখে কালরাত থেকেই চুরির ভয় ঢুকেছে এখানে। নতুন বউকে বিয়েতে দেবার জন্য সোনার ক’ভরি গহনা যে আছে, এটা নিশ্চয়ই জানতে পেরে কাল ভয়ংকর কোনো গুণ্ডা চুপিচুপি এখানে এসেছিল। আর সত্য কথা বলতে, গহনার আসল জায়গাটা দোতলার একটা রুমেই ছিল, তালাবন্দী আলামারির গোপন কুঠিতে।
কিন্তু শিহাবের মন বলছে অন্যকথা, অন্যকিছু। রাতারাতি যেই লোকের আসাতে সারা বাড়ির মধ্যে ছোটোখাটো তুফান বয়ে গেছিল, তার এখানে হস্তক্ষেপ আছে কিনা বুঝতে পারছে না। আর হস্তক্ষেপ থাকলেও কোন ব্যাপারের জন্য ওকে ধরাশায়ী করতে যাবে? শিহাব তো এখানে কাউকে তেমন চেনেও না! তাহলে? ঘটনা এখানে কি!

.

শেষবারের মতো চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হলো ফাহাদ। ভাবুক ভঙ্গিতে ওর চেহারার উপর অতল চিন্তার ছাপ গেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি ডানে-বাঁয়ে অনিশ্চিত ভাবে ঘুরাতেই ঠোঁটের কোণটা দাঁতে কামড়ে বলল,

– আউট অফ রিচ। কল যাচ্ছে না।

মেজাজটা কয়েকগুণ বিগড়ে যেতেই সজোড়ে একটা ঘুষি মারল লাবিব। টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাসটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠকঠকিয়ে কেঁপে উঠল। মুখ শক্ত করে নিজের ফোনটাও এবার ডায়ালে বসিয়ে বলল,

– কয়টার দিকে বেরোতে দেখেছিস?

গাড়ির চাবিটা নিয়ে তর্জনীর মাঝে গোল গোল নাড়াতে থাকলে ফাহাদ একটু ভেবে বলল,

– রাত আড়াইটার কাছাকাছি। বলছিল, অফিসের একটা লোক আর্জেন্ট কাজে দেখা করতে আসছে। এরপর ব্ল্যাক মাম্বা ছুটিয়ে ওই লোকের সাথে বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি।

কান থেকে ব্যর্থ কলের আওয়াজটা শুনতে পেয়ে ফোন নামালো লাবিব। মেজাজের কাঠি আরো একদফা ঝলসে উঠতেই খিটখিটে সুরে বলল,

– ওর বা°লের অফিস ছুটি দেয়নি? শালার মুখটা এখন খারাপ করাচ্ছে। আমি যেখানে ছুটি নিয়ে এসে পরছি, সেখানে এই অফিসটা থেকে ছুটি নিয়ে আসতে পারল না?

অসম্ভব তেজটা গলা ডিঙিয়ে বেরোনের পূর্বেই ‘ভুম ভুম’ করে হাতের ফোনদুটো কাঁপতে শুরু করেছে। দু’জনই নির্বাক! একদম একসঙ্গে ফোনদুটো ভাইব্রেট করছে! কয়েক সেকেন্ডের সেই কাঁপুনির মাঝে লাবিব আর ফাহাদ তৎক্ষণাৎ মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলাল। স্পষ্ট অক্ষরে চোস্ত ইংরেজিতে লেখা—

Nofity from Junayed Sayeed :
Crossroads Gazipur to Bhaluka Mymensingh.
On an urgent site visit with Executive Manager of Office. Reach you on the community center.
Network is LOW .

#FABIYAH_MOMO .

[#নোটবার্তা— ব্যাপক বড়ো পর্ব। আর আঁটলো না। আঁটলেও পড়তে পারবেন না। নাহলে আরেকটু অংশ জুড়ে দিতাম। খোলাসা কিন্তু একটু হলেও করেছি। এবার ধরুন দেখি। 😉❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here