নির্মোচন পর্ব ২৩

0
513

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২৩ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

কাঁধের উপর থেকে ধীরস্থিরভাবে সরিয়ে নিল প্রচণ্ড ভারি হাতদুটো। যেই হাতের ভর বুঝি কয়েক টনের কাছাকাছি হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছিপছিপে পাতলা কাঁধের উপর যতক্ষণ ওই হাতদুটো ভর করে ছিল, ততক্ষণ নড়াচড়া করার একচুলও হিম্মত জুটাতে পারেনি ফিহা। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি! লোকটার শারীরিক শক্তিমত্তা নিয়ে চরম একটা ভয় কাজ করছে এখন। বলবান হাতের রগ ফুলে ফুলে থাকা দাম্ভিক পেশিতন্তু এবং লোহার মতো শক্ত বুকের খাঁজকাটা সৌষ্ঠব্য পেশির অবস্থা দেখলেই বুকের রক্ত যেন হিম হয়ে আসে। ঘুলঘুলির ফাঁকফোঁকর দিয়ে আসা পাতলা ফিনফিনে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মানুষটির পোড় খাওয়া দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখ। একটু আগে যেই ব্যথাতুর ছাপটা তার চোখের মণিতে হালকা করে ফুটে উঠেছিল, সেখানে এখন ফুটে আছে ঠান্ডা আগুনের মতো চোখ। যে দুর্ভেদ্য চাহনির কাছে এখনো ফিহা অন্যান্যদের মতো একদমই অভ্যস্ত নয়। ঢোক গিলে নিজের শুকনো খরখরে গলাটা ভিজিয়ে নিতেই ফিহা আস্তে করে শুধাল,

– আপনি .. আপনি কি বলতে এসেছিলেন তখন?

কথাটা বলতে গিয়েও সহসা কেমন কেঁপে উঠল ফিহার স্বচ্ছ-সরল কণ্ঠস্বর। এ কাঁপুনির অর্থ নিজেও বুঝতে পারল না স্বয়ং ফিহাও। শুধু টের পাচ্ছে বুকের ভেতরে অজানা এক ভয়ের কুণ্ডলী প্রচণ্ড পাক খেয়ে যাচ্ছে। ওর ভীত ভীত অবস্থাটা বুঝতে পেরেই বোধহয় নিজেকে একটু সহজবোধ্য করল জুনায়েদ সাঈদ। তার অসম্ভব কঠিন ব্যক্তিসত্তার কাছে এখনো এই ছোট্ট কোমল প্রাণটা তৈরি হয়নি। তাকে বেশ সহজ আচরণ করতে হবে ওর সামনে। যতটা সহজবোধ্য আচরণ করলে এই প্রাণচঞ্চল নারীটি তার কাছে দ্বিধা-সংশয়-চিন্তা-ভাবনা এসব ভুলে তাকে মুখোমুখি নিতে পারবে। কাঠের স্তুপ সাজানো নোংরা লাকড়ি ঘরে আর একদণ্ড ওকে ধূলোর নিঃশ্বাস টানতে দিল না সাঈদ। সরু কবজিটা ডানহাতের বলিষ্ঠ মুঠোর ভেতরে পাঁচ আঙুলে খাবলে সেখান থেকে দ্রুতবেগে বাইরে নিয়ে বেরুল। লম্বা লম্বা পায়ের হনহন গতির সাথে তাল ঠুকে হাঁটতে পারছিল না ফিহা। এতো জোরে হাঁটছিল যে লোকটার নরম চুলগুলো পর্যন্ত হাঁটার অস্থির তালে ব্যগ্রভাবে উড়ছিল। এই অল্পতম সময়ে কখন যে ফোনটা ট্রাউজারের পকেট থেকে বের কানে বসিয়েছে তা খেয়াল করেনি ফিহার চোখ। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে এটুকু দেখল, ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে চরম তেজ দেখাতে গিয়েও নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় আঁটকে রেখে বলছে,

– ওই নোংরা ঘরে কোন সাহসে ওকে পাঠানো হয়েছে? এগুলো করার জন্য তোমার বোন এখানে নিমন্ত্রণ করেছে ওদের? এখানে জুতা মেরে গরু দান করার নাটক চলছে? আজগর বাড়ির ঘোলা জল খেয়ে যদি ওকে আর ছোটো আন্টির পরিবারকে অপমান করতে চায়, এই বিয়েবাড়ির বিয়ে যে কোনদিক দিয়ে ভাঙব সেটা উনি চিন্তাও করতে পারবেন না। তোমার শিশুসুলভ অবুঝ বোনটাকে হ্যান্ডেল করো। এখনো সময় আছে। পরে আমার হাতে-পায়ে ধরলে কোনো কাজে দিবে না।

ছেলের বেপরোয়া ভঙ্গির কঠোর বাক্য শুনে থমকে আছেন আফসানা। দইয়ে ভর্তি চা চামচটা মুখ পর্যন্ত এলেও ঠোঁট ডিঙিয়ে জিভে পৌঁছাতে পারল না। তার বজ্রাহত চাহনি দেখেই সুফিয়া খানম জুলজুল প্রশ্ন মাখানো চোখে আপার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশারায় চোখ দিয়ে যেন বোঝাল, “কি হইছে আপা? কেডায় ফোন দিছে?” আফসানা সে উত্তর না দিয়ে নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,

– আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না সাঈদ। তুই কীসের জন্য অন্যের ঝালটা আমার উপর মেটাচ্ছিস? কে কি করেছে? কাকে কোথায় পাঠিয়েছে?

– না বোঝার মতো কিছুই বলিনি মা জননী। যা এখন বলেছি সেগুলো নিয়ে ব্রেন খাটাও। উত্তর এখানেই আছে। লাস্ট একটা কথা এটাই বলব, কোনো প্রোকাস্টিনেশন ঝামেলার জন্য যদি অন্য কাউকে ভোগান্তিতে ফেলার চেষ্টা করে, তখন এমন মরাকান্নাই তোমার বোন আর তার শ্বশুরগোষ্ঠীকে কাঁদাব যে তারা শান্তিতে দু’দণ্ড টিকে থাকতে পারবে না। সময় থাকতে সামাল দাও।

“সাঈদ কোথায় কি হয়েছে? কীসের সামাল! খুলে বলবি তুই? এ্যাই!” —কথাটা তিনি ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই টুট্ টুট্ করে একনাগাড়ে যান্ত্রিক শব্দগুলো শুনতে পান কানে। ছেলে ফোন কেটে দিয়েছে। সামনে থেকে সুফিয়া যে ইচ্ছেমতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই আফসানার। চিন্তিত মুখে ভ্রুঁ কোঁচকানো অবস্থায় ঝট করে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পরতেই গম্ভীর সুরে হুকুম দিলেন তিনি,

– প্রশ্ন কোরো না সুফিয়া। আমার সঙ্গে এক্ষুণি তুমি রান্নাঘরের পাশের ঘরটাতে চলো। রোকসানার সাথে জরুরি কথাটা না বললেই নয়। সাঈদ আমাকে যে-স্বরে কথাগুলো বলেছে, সেখানে মনেহচ্ছে না ঘটনাটা সামান্য কিছু। চলো তাড়াতাড়ি, যেতে যেতে কথাগুলো বলছি।

আফসানার আদেশ শিরধার্য মেনে প্রৌঢ় শরীরটা ঝরঝরে চাঙ্গা করে বললেন সুফিয়া খানম,

– আপনের বইনের গুষ্টি কোনহানে গিট্টুটা বাজাইছে কে জানে। আজগর সা°পে যদি ব্যাকা-বোকা কিছু কইরা থাহে, ব্যাডার থোবড়া কইলাম আপনের পোলায় ফা°ডা°য়া লাইব।

.

লাকড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে হাতের ডানদিক বরাবর পরপর তিনটি রুম পেরোলেই, একদম শেষমাথায় থাকা সেগুন কাঠের দরজা দেওয়া রুমটা সাঈদের জন্য বরাদ্দ। আলাদা, একাকী, নিজের মতো নিজের চলাফেরা করার জন্য দীপ এই রুমটা নিজে বেছে দিয়েছে। বারো বাই বারো ফুটের ছিমছাম রুমটায় কেমন শান্তি মাখানো, দু’চোখ জুড়োনো, মন ভুলোনো শ্রী নীরবতা মিশে আছে। নব্ মোচড়ে ভেতরে ঢুকতেই শোঁ শোঁ করা শব্দে পাগলা হাওয়ার দল জানালার সবগুলো পর্দা উড়িয়ে ভেতরে ঢুকল। মন নরম করে দেওয়া প্রকৃতির চন্ঞ্চলতায় হাসি দিয়ে ফিহা মুগ্ধচোখে সেই প্রশস্ত জানালার দিকে এগোতে এগোতে কাছে যায়। দূর আকাশে রাত্রি ঘনানো অন্ধকার চাদর, চাদরের বুকে কামড় বসানো একচিলতে চিকন বাঁকা চাঁদের হাসি। কুয়াশার মতো তুলো তুলো মেঘেরা সেই হাসিকে ঢেকে দিতে চাইলেও চাঁদবুড়ি যেন উঁকি দিয়ে হাসি দিচ্ছে। জানালার উপর দু’হাত ফেলে গোলাপি নিখুঁত মেয়েলি কোমল ঠোঁটে প্রাণচঞ্চল করা মিঠে হাসি ঝুলছে।

সেই হাসি যদিও দ্বিতীয় ব্যক্তিটা দু’চোখে দেখতে পাচ্ছে না, তবু বড়োসড়ো হারিকেন আকৃতির চার্জার লাইটটা জ্বালিয়ে সেটা কাঁচের টি-টেবিলে রেখে উঠল। তাঁর অ্যাডিডাস কালো ট্রাউজারের পকেটে অসভ্য মোবাইল ফোনটা আবারও অসভ্যতা শুরু করেছে। পকেটের খাপে হাত ঢুকিয়ে পাওয়ার বাটনটা পুরোপুরি অফ করে দিতে দিতে ফিহার বাঁ’পাশটা নিঃশব্দে দখল করে দাঁড়াল। উত্তরের এদিকটায় ঝোঁপ-ঝাড়ে ভরা ছোটোখাটো জঙ্গলের মতো অন্ধকার অন্ধকার একটা জায়গা। দূরেও শহরের মতো ঘিন্ঞ্জি, হিজিবিজি, সংকীর্ণ লোকালয় গড়ে উঠেনি।
রক্তে শান্তি ছড়ানো মৃদু অনুভূতিরা আরো কোমল হয়ে আসলে বুকভরা বুনো শিউলির গন্ধে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় ফিহা। সেই চোখবন্ধ করা মুচকি সরল হাসিতে দম নেওয়ার দৃশ্যটুকু দেখে আস্তে আস্তে পুরুষালী খয়েরি রঙা ঠোঁটদুটোতে ফুটে উঠে ঐন্দ্রজালিক হাসি। স্থিরচোখের কৃষ্ণাভ মণির তারাদুটোতে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠে কারো নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হওয়ার নীরব চাহনি। সেই চাহনির মাঝেই যেন পাঁজরের তলায় অসম্ভব উচ্চ গতিতে ধুকধুক করছে মাংশল পিণ্ড। তার সংযমী চেতনা বারবার প্রলুব্ধ করছে, ওই পানপাতা মুখটি দু’হাতে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে নিতে। সারা মুখ থেকে অবাধ্য চুলগুলো একটা একটা করে সরিয়ে পরম আশ্লেষে গভীর করে তপ্তস্পর্শটুকু ছুঁয়ে দেয় ওই কপালে। তিরতির করে বন্ধ চোখদুটোর পাতা কেঁপে উঠলে তার নিরাপদ বুকটার ভেতর চেপে রাখে ওই মুখ।

আজও সেই অতীতে ফেলা আসা বড়ো অদ্ভুত একটি ঘটনার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সারাবাড়ি জুড়ে শোকার্তের চিৎকার কান্নাকাটি, হুঁশে নেই বাড়ির কোনো মহিলা বা মেয়ে। সেই কান্না ভরা বাড়ির ভেতর একটিমাত্র প্রাণ নীরব ছিল। দু’ঠোঁটে যেন অদৃশ্য স্কচট্যাপ লাগিয়ে পুরোটা সময় বোবা প্রাণীর মতো নির্জীব থাকে মেয়েটা। ফুলে উঠা চোখদুটো কী অসম্ভব লাল! ঝরঝর করে দু’গাল ভিজিয়ে নীরব অশ্রু ঝরে পরে যাচ্ছে, কিন্তু ঠোঁটে রা নেই, বাক্য নেই, সোরশোলের কোনো চিহ্নটুকুও নেই। শব্দহীন প্রাণীটির মতোই কখনো বাবার জন্য প্রেশারের ঔষুধ এনে দিচ্ছে, কখনো মুরুব্বি কোনো দাদুর জন্য জগ ঢেলে পানি দিয়ে যাচ্ছে, কখনো অমুক কোনো প্রতিবেশিণীর ডাকে এটা-ওটা ঘরোয়া জিনিসে হাত বাড়িয়ে একটু আধটু গুছিয়ে দিচ্ছে। শিফনের পাতলা ওড়নাটা মাথায় আলগোছে টেনে ঘোমটা দেওয়া, চুলগুলো বোধহয় এখানে তাড়াহুড়ো করে আসাতে আঁচড়াতে পারেনি। পরনে চিকেনকারির সাদা ধবধবে কামিজটা হাঁটু থেকে লম্বায় দুইইন্ঞ্চি নীচে থেমেছে, পায়ের গোড়ালি অবধি ঢাকা ঢিলেঢালা পাজামাতে শালীন বেশী মেয়েটির পরিমিত বোধজ্ঞান কতটা অভিভূত করেছিল, তা সেদিনও জানতে পারেনি। আর সেটা আজও অজানা। ভাবনার বুনন খুলে বহুক্ষণ পর মুচকি হাসি মাখানো সরল মুখটির পানে বলে উঠল সাঈদ,

– আন্ডার্স্ট্যান্ডিং, শার্প থিংকার, ম্যাচিউরিটি সেন্স, নেচার লাভার।

আচমকা সংবিৎ ফিরে পেলে চট করে লঘুস্বরটার দিকে তাকাল ফিহা। প্রশ্ন মাখানো অবাক চোখদুটিতে একমুঠো সংশয় ভরা উদ্বেগ, কি বললেন উনি? বুকের গহিন কোণ অবধি ছুঁয়ে দেওয়া মাদকে ভরা ওই চাহনিদুটোতে খেলা করছে নক্ষত্রের মতো ঔজ্জ্বল্য! অদৃশ্য চুম্বকের মতো সম্মোহন করে দেওয়া চোখদুটোতে দুরুদুরু করে কেঁপে উঠে ফিহার নরম বুক। অনুভব করে, খুব সন্তপর্ণে জানালার উপর থেকে হাতদুটো তুলে নিয়েছে সুদেহী পুরুষটা। পকেট থেকে ছোট্ট একটা রুমাল বের করে কাঠের ধূলো লাগা আলগা ময়লার আস্তরণ নিজ দায়িত্বে মুছিয়ে দিচ্ছে। খসে খসে পরছে শুকিয়ে যাওয়া খরখরে মেহেদি। ভারি একবুক দম ছেড়ে আবারও নীরবতা ভেঙে বলে উঠল সাঈদ,

– আমি ওভাবে কথা বলতে পারি না যেভাবে বললে একটা মেয়ে প্রসন্ন হয়। আমার ভেতরে স্পেশাল কোনো কোয়ালিটি নেই, আই নো অ্যাবাউট দ্যাট। ডিসকাস অন দিস টপিক রাইট নাউ ইজ আর্জেন্ট অ্যান্ড ইর্ম্পট্যান্ট। শ্যাল উই স্টার্ট?

চোস্ত টানে কথা বলার ভঙ্গি দেখে বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপে ফিহার। কি বিষয়ে কথা বলবে এখন? কোন ব্যাপারটা সরাসরি বলার জন্য এভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে সে? মুখের ভেতরে জিভ আড়ষ্ট হয়ে থাকলে ননীর পুতুলের মতো ধীরভাবে মাথাটা উপর-নীচ নাড়ায় ফিহা। তা দেখে সাঈদ নিমিষের ভেতর ওর হাতদুটো আপন মুঠোর বজ্রমুষ্টিতে পুড়ে নিয়ে বলল,

– অন-ডিউটি, স্পেশাল চার্জ বাদ দিয়ে ইউজলেস আনসার্টেন অফডে কাটানোর প্রয়োজন আমার নিশ্চয়ই নেই। সকাল এগারোটা, তেত্রিশ মিনিট, বায়ান্ন সেকেন্ডে একটামাত্র রং ডায়ালড্ ফোনকলের জন্য অফিসে টানা তিনদিন অফডে নিয়ে হৈচৈ চিৎকারে এসেছি। আমি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে এখন। কথা তখন দিয়েছিলাম সন্ধ্যায় আসব, আমি এসেছি। কিন্তু আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেননি নাবিলা হক!

মুখের উপর সপাটে এমন কথা শুনে আরো কুঁকড়ে যায় ফিহার বাঁধো বাঁধো মন। “তুই” সম্বোধন থেকে আপনি সম্বোধনটা শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে দুলছে। ও বয়সে কত ছোটো, তবু ওর মুখের “আপনি” সম্বোধনটা সে বলছে! ফিহা সবটুকু করা ভুলের জন্যই কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু আচ্ছন্ন করা নেশালু ঠান্ডা চোখদুটোতে তাকিয়ে তেমন কিছুই আর বলতে পারল না। মুখটা ওর দিকে একটুখানি নীচে নামিয়ে উচ্চতার সমান সমান করে বলল,

– সকালে কলগুলো কি কম দিয়েছিলাম? ধরেছেন একটাও? কলব্যাক করে একবারও জানার চেষ্টা করেছেন কেন অতোগুলো করেছি? তারপরও কীভাবে প্রশ্ন উঠে আমি আপনাকে একচেটিয়া অপমান করে খুশি হচ্ছি? জবাব কি একটাও দেওয়ার মতো আছে?

বারবার কর্ণকুহরে “আপনি” সম্বোধন শুনে মারাত্মক বিষিয়ে উঠল ফিহা। অসহায় ভরা চোখে কিছু বলতে উদ্যত হলে ঠোঁটে ‘ শ ‘ জাতীয় শব্দ করে থামিয়ে দিল সে। মাঝের ক্ষুদ্রতম দূরত্বটুকু আরেকটুখানি ঘুচিয়ে দিয়ে জলদ্গম্ভীর স্বরটা ফিহার সমস্ত সত্তা ছুঁয়ে বলল,

– আমার দেওয়া লাল শাড়িতে সেদিন একা একা ভিজেছেন। গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বিয়ের পর আপনার হাসবেন্ডের সাথেও সেই একই শাড়ি পরে ভিজবেন। তফাত শুধু এটুকুই— সেদিন জ্বরতপ্ত গায়ের তাপ ছেঁকে দিতে আপনার নিজস্ব পুরুষই থাকবে।

একমুঠো লজ্জার আবিরে গালদুটো রক্তিম হয়ে উঠলে চোখ নীচু করে ফিহা। ঝিমঝিম করা বৈদ্যুতিক স্পর্শ যেন দেহমনের আনাচে-কানাচে শিরশিরে তরঙ্গ ছড়িয়ে পরে। জানালা দিয়ে আসা উত্তাল বাতাসের ঝাপটা যেন আশু ঝড়ের পূর্ব সংকেত বয়ে আনছে। কাল কি বৃষ্টি হবে? বাঁকা চাঁদের হাসি তখন ঢেকে গেছে একরাশ কালো মেঘের নীচে। বজ্রমুষ্টিতে আঁটকে থাকা হাতদুটোয় আলতো একটু চাপ দিতেই চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে উঠে ফিহা। ঠিক তখনই আচ্ছন্নের মতো নেশালু ঠান্ডা চোখদুটোতে বড্ড আঁটসাঁট ভাবে আঁটকা পরে যায়। যেন ওই চোখ দিয়েই আরেকদফা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে দিচ্ছে নীরবে,

— “এই পবিত্র আছোঁয়া ঠোঁটে আমারই একমাত্র ছোঁয়া থাকবে। এই আঙুলের ফাঁকে শক্ত আঙুল গুঁজবে আমারই হাত। ওই চোখদুটোর নীরব প্রতিটি অশ্রু শুধু আমি দেখব। জোছনা ভরা রাতে সাক্ষী হবে আমাদের আসঙ্গ সাক্ষাৎ।”

অদূরে বেতের সোফাতে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠছে যান্ত্রিক ডিভাইস। স্ক্রিন জ্বলে জ্বলে বারবার নোটিফিকেশনের ধাক্কায় অন-অফ হচ্ছে সেটা। এই প্রথমবার যান্ত্রিক ডিভাইসের দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই তুখোড় অফিস কর্মকর্তার। হুঁশ নেই ট্রাউজারের পকেটে বন্ধ করে রাখা ফোনটার দিকেও!

.

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here