#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_২২ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
[অংশ ০১]
বুকের ভেতরে তীব্র এক ভয় জমে আছে। এ ভয় কীসের জন্য তা জানে না ফিহা। কীভাবে মানুষটার মুখোমুখি হবে তা নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিধা কাজ করছে। বাচ্চাটার মাধ্যমে সত্যি কী সে ডাক পাঠিয়েছে? নীচতলার হলঘরে অসংখ্য অনেক অতিথির ভিড়ে চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে যায়। তিনধাপ সিঁড়ি পেরোলে সামনে একটা উঠোন। ছোট্ট উঠোনের শেষমাথায় লোহার জং ধরা বড়ো গেট, গেটটা এখন বিয়ের আমেজে ঝলমল বাতিতে সেজে আছে। গেটের একটু সামনেই ঘুমন্ত পশুর মতো থেমে আছে কালো ক্যালিনান। যার মালিক এখন পোশাক বদলে কিছুক্ষণের ভেতর অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে যাচ্ছে। আজ যে হলুদের বর্ণিল এক আমেজ, চারধার জুড়ে হলুদ, বাসন্তী, কমলা রঙের বাহার; চোখ জুড়ানো মিঠে মিঠে এই আনন্দ উৎসবে কেমন করে আসবে সেই পাথরকঠিন মানুষটা? তাঁর ধোপদুরস্ত টানটান ইস্ত্রি করা ফর্মাল অফিসের গেটআপ পালটে কীভাবে আসবে সে? অন্য, অদেখা, সবচাইতে দুর্দান্তরূপে কী আজ দেখা দিবে? দুরুদুরু করে প্রখর শীতালু কম্পন ওর বুকের ভেতরে প্রচণ্ড কাঁপিয়ে তুলল। স্থিরচোখে দূরে থেমে থাকা গাড়িটার পানে দাঁত খিঁচুনি দিয়ে তাকিয়ে রইল। কাল ওই গাড়িটার ব্যাকসীটে কোণে ছোট্ট খোলসের মতো জ্বরতপ্ত দেহটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ফিহা। শুধু হালকা হালকা ওর মনে আছে, প্রচণ্ড হাড় কাঁপুনে শীতের ভেতর ওর কেন জানি এতটুকু পরিমাণ কষ্ট হয়নি। মোলায়েম একটা সুখ সুখ ঘুমের ভেতর পুরোটা রাস্তা, লম্বা জার্নি, অবিরাম বৃষ্টির ঝিরিঝিরি বর্ষণে এখানে এসে পৌঁছেছিল। হঠাৎ ডানকাঁধের উপর হাত পরতেই আমূল কেঁপে উঠল ফিহা! আকস্মিক এমন ঘটনায় মুখ ঘুরিয়ে চাইলে সরাসরি ফিমাকে দেখতে পায় ও। ফিমা বোকা বোকা মুখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
– হলোটা কী? এভাবে চমকে উঠলি কেন? দূর থেকে যে ফিহা ফিহা বলে ডাকছি, কথা কানে যায় না?
ফিহা অপ্রস্তুত ভয়টা দ্রুত সামাল দিয়ে বলল,
– স্যরি, শুনতে পাইনি। বলো, কী জন্য তুমি ডেকেছিলে?
– মা তোকে যেতে ডেকেছে। উপরে চল্। উপরে সবাই হলুদ ছোঁয়ানো শেষে ছোটোদের জন্য এখন অপেক্ষা করছে। গাঁধার মতো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিবিলাস করতে হবে না। হলুদ ছোঁয়ানো শেষে মেহেদি দিতে হবে।
– সবাই বলতে সব বড়োরা?
– হ্যাঁ, সব বড়োরা। আর একটা কথাও বলবি না। চুপচাপ সঙ্গে আসবি ব্যস্!
বড়ো বোনের কাটকাট ভঙ্গির আদেশ শুনে চুপচাপ হাঁটা দেয় ফিহা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে ফিমা ওর দিকে সরু চোখ করে বলল,
– মা তোকে এই পাতলা শাড়িটা দিল কেন? গরমের মধ্যে আমাকে একটা ফালতু জামদানী গছিয়ে দিয়ে কী প্রমাণ করতে চায়? আমি যে এসব শাড়ি-টাড়ি পরা একেবারেই পছন্দ করি না এটা কী তার বিবেক-বুদ্ধিতে খেলেনি? আশ্চর্য সব কাণ্ডকারখানা! আবার কিনা বড়ো বড়ো গলায় চাপা ছাড়ে, আমার নজরে দুই মেয়েই সমান! সব নাটক!
দু’হাতে শাড়ি ধরে ধরে উপরে উঠতেই মুখটা কঠিন হয়ে যায় ফিহার। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের প্রতি এরকম নীরব হিংসা দেখে কথাটা না বলে পারল না,
– গা থেকে এখন খুলে দিই? কী বলো? তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে মা তোমাকে পাত্তাই দেয় না! অথচ, সারাটাক্ষণ তুমি মায়ের কাছে আদরের দুলালী হয়ে থাকছ। বুদ্ধিতে বড়ো হও আপু, এখনো সময় আছে। শুধু শুধু স্বার্থপরের মতো আচরণ কোরো না।
ফিহার ওমন মুখ ঝামটা দেওয়া উত্তর শুনে অবাক হয়ে যায় ফিমা। কত বড়ো অসভ্য হলে বড়ো বোনের সাথে এভাবেও ফাজিলটা উত্তর দেয়! গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে জবানটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু বিয়েবাড়ির ভরা আমেজ দেখে কিছু করতে পারল না ফিমা। প্যান্ডেলে কাঠের পিঁড়িতে আসন পেতে বসে আছে বর। গায়ে সাদা স্যান্ডো গেন্ঞ্জি, পড়নে আরামদায়ক লুঙ্গি, গলায় একটা সবুজ রঙের গামছা ঝুলিয়ে বসে আছে। বড়ো একটা আলতা রাঙানো কুলার ভেতর ছোটো বাটিতে হলুদ বাটা, হলুদের ভেতর মিশে রয়েছে চন্দন, তার পাশে উপটানের বাটি, সাথে সার সার করে সাজিয়ে রাখা একস্তুপ দুর্বাঘাস। সেখান থেকে একগুচ্ছ ঘাস তুলে বরের গায়ে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে শিহাব। গালে হলুদ বুলাতে থাকলে একমুখ মিটিমিটি হাসিতে টিপ্পনী কাটল দীপ,
– তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা পাকা কর্ মামা। আর কত দেরি করবি তুই? এখন তো সব হাতের কাছে রেডি করা আছে। জাস্ট চামচটা তুলে খাবারটা নিয়ে মুখের ভেতরে পুড়ে নিবি। এখানেও কী ব্যাটা ফর্মালিটিস করতে হবে?
শিহাব ওর দুই বাহুতে হলুদ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,
– সবকিছুর জন্য পার্ফেক্ট টাইম আছে দোস্ত। এই পার্ফেক্ট টাইমের আগে ও পরে যা-ই করবি সেটাই ভুলভাল কাজ হবে। আমি স্মুথলি সব হ্যান্ডেল করতে চাইছি। তোর বিয়েতে কোনো প্রবলেম হোক এরকম ইনটেনশন নিয়ে দেশে আসিনি। তোর ম্যাটারটা আগে শেষ হোক, দ্যান আমারটা নিয়ে ভাবতে বসছি।
– তোর ভাবতে ভাবতে যদি দেরি হয়ে যায় ব্যাটা?
– নেভার। হবে না মাই ফ্রেন্ড। আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট ওয়েল। ইয়্যু শ্যুড থিংক অ্যাবাউট ইয়্যুর সুইট হানিমুন।
শিহাবের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসি দিল দীপ।বাকি বন্ধুরা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে দূরে দাঁড়ানো শাড়ি পড়ুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে প্রসাধন বলতে কিছুই নেই মেয়েটার। ঠোঁটে লাল টুকটুক করা লিপস্টিক, চোখে কাজল-কালো রেখা, বাসন্তী রঙা শাড়িটার ভেতর ছিপছিপে পাতলা ছোট্ট দেহটা মুড়িয়ে রেখেছে, আর কোমর ছাপানো চুলগুলো অবাধ স্রোতে ছেড়ে দেওয়া। দু’হাত নেড়েচেড়ে হাসিমুখে কী যেন বলে যাচ্ছে মেয়েটা। তার পাশের মেয়েটা সে কথা মুগ্ধচোখে, সরল হাসিতে শুনে যাচ্ছে। মেয়েটার কণ্ঠস্বর এতোদূর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় না, তবু রিনরিনে কণ্ঠটা দু-একবার যা শুনেছে, তাতেই মনে হয়েছে বড়ো মধুর সে কণ্ঠ! মাঝে মাঝে বেসামাল হাওয়ায় উড়তে থাকা চুলগুলো আঙুলে আঙুলে গুঁজে নিচ্ছে কানে। কানে তার লাল খয়েরি রঙের ঝুমকো। তপন কোল্ড ড্রিংক্সের ক্যানে ঠোঁট ছোঁয়াতেই হঠাৎ তার দৃষ্টিদুটো থমথম হয়ে রইল। মেয়েটার কানের কাছে দুর্লভদর্শনের মতো কালো ছোট্ট তিলটি ফুটে আছে। ওই ক্ষুদ্র মোহময় সৌন্দর্যটি তপনের মুখভর্তি পানীয়টা মুখেই থামিয়ে দিল। গলা দিয়ে সেটা আর তেষ্টা মেটাতে নামল না। তপনের অমন চক্ষুস্থির, গাল ফোলানো অবস্থা দেখে শিহাব কৌতুহলী চোখে সেদিক বরাবর চাইল। সঙ্গে সঙ্গে তার দু’চোখ ব্যাপক আশ্চর্যে ফেটে পড়তেই তৎক্ষণাৎ তপনের দিকে ফিরল সে। চাপা আক্রোশে ঠাস করে এক চাট্টি কষালো শক্ত মাথার পেছনে। বেচারা তপন বৈদ্যুতিক শক্ লাগার মতো অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে উঠতেই মুখ ফসকে সবটুকু পানীয় ঝর্ণার মতো আমেনার গায়ে গিয়ে পড়ল। আমেনা আহাম্মকের মতো নিজের মোটা, গাট্টাগোট্টা শরীরে চোখ বুলালে হঠাৎ বর্ষণে ভিজে গেলে প্রথম ক’মিনিট কিছুই বুঝতে পারল না। এরপর মুখ তুলে তপনের দিকে তাকালে এতোক্ষণের পুরো ঘটনা পানির মতো পরিষ্কার বুঝতে পারল। চোখে-মুখে খলনায়কের মতো কোপদৃষ্টি বর্ষণ করে বলল,
– তুই পিচকারিটা ফেলেছিস?
তপন অস্বস্তি ভরা চোখে আমতা আমতা করে বলল,
– বু,
– বু বু করা বন্ধ কর।
– বু, আমি তোমাকে দেখিনি . .
আমেনা নিজের দিকে তর্জনী তাক করে বলল,
– তুই আমাকে দেখতে পাসনি?
তপন বুঝতে পারল, এর চাইতে জঘন্য মিথ্যা কথা আর হতেই পারে না। বুর মতো ভারী শরীরের মানুষকে দেখতে পায়নি এর চাইতে নাটুকে মিথ্যা আর হতে পারে? কিন্তু এখন কী করে নিজের দোষটা ঢাকা দিবে সে? রাগ রাগ দৃষ্টিতে সে শয়তান শিহাবের মুখটার পানে চাইল, আরেকবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল বহুকষ্টে হাসি আঁটকাতে থাকা দুই হা রা মি বন্ধুর দিকে। এদের মতো বা ট পা র থাকলে সেধে সেধে শত্রু বানাতে হবে? একজন ওয়ান ম্যান আর্মি সেজে হবু প্রিয়তমাকে পাহারা দিচ্ছে, অন্যদিকে দুই গা.দ্দা.র হা রা মী তপনের দুঃখী দুঃখী বেচারা মুখটা দেখে না-পারছে হাসি আঁটকাতে, না-পারছে জ.ল্লাদের মতো আমেনার হাত থেকে বাঁচাতে। বাকিরা সবাই মজা পেয়ে তুমুল হাসিতে হো হো করে হাসছে। আমেনা তার শখের শাড়িটা নষ্ট হবার দরুন ঝাঁজালো স্বরে কিছু বলতে নেবে, কিন্তু আগেই ছাদের খোলা দরজার পানে সহসা দৃষ্টি থমকে যায়, আর কিছু বলতে পারে না আমেনা। আকাশ-পাতাল কুণ্ঠায় পা পিছিয়ে পিছাতে থাকে। আজও সেই চোখের দিকে তাকালে বুকটা ধড়ফড় ধড়ফড় করে কেঁপে উঠে। কেন কেঁপে উঠে এ তথ্য আমেনা জানে না। শুধু জানে ওই শীতল চাহনির চোখদুটো বহুদিন আগেও যেমন নিষ্ঠুর দেখাতো, আজও তা তেমনি করে চাপা নির্মমতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। তবু এই মানুষটাকে মনে-প্রাণে একসময় নিজের করে চেয়েছিল। কত স্বপ্ন বোনা চোখে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই মানুষটার জন্য ভেবেছে। তার কিশোরী দিনের প্রথম আবেগ, প্রথম চাওয়া, প্রথম উচ্ছ্বাস, প্রথম ভালো লাগা শুধু তার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রথম প্রথম জায়গাটা আজও সেভাবে মলিন পড়ে আছে। শুধু সময়ের তালে তালে বদলে গেছে দিনকাল, তবু বুকের ভেতরে হু হু করে উঠে অপূর্ণতার গল্প। যে গল্প প্রতিটি মেয়ের অন্তরে কিছু না-পাওয়া কষ্ট, কিছু না-বলা স্বপ্ন, কিছু অপূর্ণতার ঝুলি হয়ে হৃদয়-সিন্দুকে আজীবন বদ্ধ হয়ে থাকবে। কখনো খোলা হবে না সে সিন্দুক। কখনো জানবে না সেই অপ্রাপ্তির কথা।
ফিহা নিজেকে ভীড়ের মাঝে আড়াল করে প্যান্ডেলের সামনের অংশটা দেখতে লাগল। গায়ে কালো টিশার্ট, লেফট্ পকেটের কাছে অ্যাডিডাস লেখা কালো রঙের ট্রাউজার পরে এসেছে। হাতে হলুদ মাখিয়ে দীপের গালে ছুঁয়ে দিতেই কী যেন বিড়বিড় করে বলল। কথাগুলো শুনে দীপ একটা হাসি দিতে গিয়ে লজ্জায় চোখদুটো নীচে নামায়। ফিহা বুঝতে পারছে না এই রসকসহীন জীবটা কী এমন বলেছে যে দীপ ভাই ওমন লজ্জা পেল! ন্যাপকিনে হাতটা মুছে নিয়ে যে পথে এসেছিল, সে পথেই মানুষটা বেরিয়ে যায়। তবু যাওয়ার আগে চুপচাপ ছাদের প্রতিটি কোণে দূরদৃষ্টি চালিয়ে শুধু একটিবারের জন্য দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু চন্ঞ্চল মুখটার দেখা মেলল না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ তিনতলার দরজায় যে অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটা দেখতে পেল, তা দেখা সত্ত্বেও সাঈদ অচেনার মতো ভঙ্গি করে পাশ কাটিয়ে নেমে যায়। তিনতলার দরজার কাছে একটি যুবককে ঘিরে ছোটোখাটো জটলা। সেই মেয়েলি জটলার ভেতর ফিহা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই যুবকের হাতে সেবাযত্ন করছে। যুবকের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে পরম চিত্তে বরফ বুলিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা অতোগুলো মেয়ে থাকতে ওরই এটা করতে হলো কেন? আর কেউ কী এসব করতে পারতো না? ও কী তাহলে সব ব্যক্তিকে একই নজরে দেখে? সবার ক্ষেত্রেই কী এই পরম সেবাটা বিলাতে থাকে? তাহলে. . . তাহলে তার বেলায় যে হাতে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া, দু’বার তাকে যত্ন করে খাওয়ানো, তার প্রতি ছোটো ছোটো অনুভূতিগুলো কী স্রেফ একটা নাটক ছিল?
.
– আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া? হাত কী এখনো জ্বলছে?
– না। এখন একটু কমেছে। তোমার সমস্যা না হলে এই মলমটা একটু লাগিয়ে দাও।
ফিহা মুখ তুলে শিহাবের শান্ত মুখটার পানে একবুক অস্বস্তি নিয়ে তাকাল। মুখ ফুটে বলতেও পারছে না, ভাইয়া! আপনারটা আপনি করে নিন না। প্লিজ? কোন খপ্পরে যে পড়েছে ও কে জানে। বারবার একটা না একটা কিছু ঘটেই যাচ্ছে। ফিহা চুপিচুপি ছাদ থেকে বেরিয়ে যেতেই এক দৌড়ে তিনতলার রুমে ঢুকতে নিচ্ছিল। যেন সাঈদ ওকে দেখার আগেই গা ঢাকা দিয়ে পালাবে। কিন্তু পথিমধ্যে শিহাবের সাথে চোটপাট এক ধাক্কা লাগতেই বেচারার হাত উলটে পুরো গরম কফিটা ডানহাতের উপর ঝলসে যায়। আকস্মিক এমন ভয়াবহ কাণ্ডে হতভম্বের মতো ‘ স্যরি স্যরি ‘ বলতে থাকে ফিহা। কিন্তু ফর্সা চামড়াটা দগদগে লাল হয়ে উঠলে ফিহা বাধ্য হয়ে বরফ আনতে আর সেবা করতে লেগে পড়ে। একটু আগে যে ওর সামনে দিয়ে জাঁদরেল মেজাজের লোকটা চলে গেছে সেই তালটা পর্যন্ত ওর নেই। শিহাবের হাতে মলম বুলিয়ে দিতেই বাকি উৎসুক মেয়েগুলো যার যার কাজে চলে যায়। এবার সুযোগ পেয়ে শিহাব গলাটা একটু খাঁকারি মেরে নরম সুরে বলল,
– এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজটা অকয়ার্ড লাগছে দেখতে। তোমার যদি প্রবলেম না হয়, ক্যান উই সিট দেয়ার? ইন দ্যা ওপেন ব্যালকনি অর অ্যানি নরমাল স্পেস?
প্রত্যুত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছে না ও। এমনিই এই লোকটার কাছে অপরাধী বনে আছে। যদি এই দুরন্তপণার কথা মার কান অবধি চলে যায়, তাহলে আর রক্ষে নেই! মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচকে বলে দিল ফিহা,
– জ্বী আসুন, ওদিকের বারান্দায় বসে মলমটা লাগিয়ে দিচ্ছি।
শিহাব কপট হাসিতে চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে তাকালে ফিহা তখন হেঁটে হেঁটে দক্ষিণদিকের বারান্দায় ঢুকে। বিরাট বড়ো খোলা বারান্দা, কোনো গ্রিল নেই। মেঝেটা চকচকে আয়নার মতো সাদা টাইলসে মোড়া। পাঁচফুট উঁচু স্টিলের রেলিং, রেলিং ধরে দাঁড়ালে হুঁ হুঁ ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা চোখমুখ ছুঁয়ে যায়। বারান্দার বাঁদিকে বসার জন্য দুটো চেয়ার পাতা, সঙ্গে একটি ছোট্ট গোল টেবিল। চেয়ার টেনে দু’জন তখন বসে পরতেই ফিহা টিউব থেকে মলম নিয়ে হাতের উলটোপিঠে মাখাতে শুরু করল। এমনই একটি পুরুষালী হাতে ধানমন্ডির সবচেয়ে সুন্দর বাড়িতে বসে যত্ন করে মলম ছুঁয়ে দিয়েছিল। তবে সে হাতটি ধরতে একটুও দ্বিধা কাজ করেনি, কখনো মনে হয়নি ওই হাত ধরা যাবে না বা ওরকম কিছু। কিন্তু এখন এই হাতটি ধরতে গিয়ে প্রচুর অস্বস্তি ভর করেছে। কতক্ষণে কাজটা শেষ করে ইস্তফা দিবে তা নিয়ে যত চিন্তা! এমন সময় শিহাব দূর আকাশের পানে দৃষ্টি রেখে প্রসন্নচিত্তে বলল,
– বাংলাদেশের চেহারা খুব সুন্দর। এখানকার আকাশ-বাতাস, নৈসর্গিক প্রকৃতি, মানুষের মন সবকিছুতে আলাদা একটা টান মিশে আছে। এই মিশে থাকা ভাবটা আদৌ বিদেশের মাটিতে খুঁজে পেলাম না।
সারল্য ভরা কণ্ঠ শুনে ফিহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
– আমাদের দেশটা খুব আন্তরিক ভাইয়া। এ দেশের ধূলো ভরা মাটিতে এখনো পুরোনো দিনের স্মৃতি মিশে আছে। প্রাচীন বাংলার দুর্দান্ত শাষণামল যদি কালের আর্বতনে হারিয়ে না যেতো, আজ দেখতেন এই বাংলাদেশটা কতো উন্নত হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু আপনি এমন প্রকৃতিপ্রেমীর মতো কথা বলছেন কেন?
– কেন? প্রশংসা করা কী বারণ? এ দেশে থাকি না বলে এখানকার রূপ-বৈচিত্র্য নিয়ে বলা নিষেধ?
– না তা কেন হবে? এ দেশের মানুষ নিষ্ঠুর নয়। যথেষ্ট আন্তরিক। আপনাদের মতো দুইদিনের অতিথিকে সবাই খুব যত্ন-আত্তি করবে।
ফিহার সামান্য খোঁচা দেওয়া কথাতে শব্দ করে হেসে উঠে শিহাব। মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতি, কথার চাল খুব সাবধানে চালতে পারে। চেয়ারের হাতলে কনুই ঠেকিয়ে বাঁহাতটা ঠোঁটের কাছে ভাবুক ভঙ্গিতে রাখল। চেয়ে চেয়ে গলায় হাসি ঢেলে বলল,
– কোন স্ট্যান্ডার্ডে পড়ছ তুমি? কলেজ অর স্কুল?
– কলেজ। ইন্টার প্রথম বর্ষে।
– এতো ছোটো তুমি? তুমি আমার চেয়ে কম করে হলেও লম্বা একটা অ্যাজে ছোটো হবে।
এ কথা শুনে আরো একবার হাসি দিয়ে মুখটা নামাতে যাচ্ছিল ফিহা, কিন্তু শিহাবের কাঁধ গলিয়ে দূরের দিকে চাইতেই সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে কেঁপে উঠল! চক্ষু ছানাবড়া দৃষ্টিতে আস্তে আস্তে ঠোঁট ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। পাশের রুমের জানালায় কোনো গ্রিল নেই। রুমটা ভীষণ অন্ধকার। সেই অন্ধকার মাখা রুমের ভেতর অবিচল, গম্ভীর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখটা কফির মগে ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছে। মৃদু বাতাসে কপালের সামনের চুল উড়ে ডানকোণের সেই ছোট্ট সাদা ব্যান্ডেজটা উন্মোচন করে দিল। তার দু’চোখের দৃষ্টি কেমন ভয়াবহ, যেন বরফের মতো শীতল হয়ে আছে ওই শাণিত ক্রুদ্ধ চোখ। ওই চোখ দিয়েই ফিহার উপর কালবৈশাখীর আগাম ঝড়টা বুঝিয়ে দিচ্ছে। যেন ফিহাকে সে সামনে পেলে একটুও মাফ করবে না। একটুও না। ভেতরের চূড়ান্ত রাগের স্তবক থেকে মনে মনে উচ্চারণ করল সাঈদ,
“এমন পাপ আমি করিনি, যার জন্য এই দৃশ্যটাও আমার দেখা লাগবে। ”
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা — কী মনে হচ্ছে? কী হবে সামনে? কী আসবে আগামী পর্বে?
.
Masallah Fabiyah mommo manai osadharon kichu ami oppakhai roilam kintu api