নির্মোচন পর্ব ১৯

0
1155

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৯ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

চোখের সামনে যমদূত দাঁড়িয়ে থাকলেও বুঝি এতোটা ভয় পেত না! তবে এখন পাচ্ছে। ভয়ে গলার স্বরটা পর্যন্ত গুলিয়ে যাচ্ছে। মা কী সব শুনে ফেলেছে? শুনে ফেললে বিপদ, মহাবিপদ! চাইলে এখুনি একছাঁট মিথ্যা কথা বলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে পারে। তবে মায়ের মধ্যে মিথ্যা ধরবার মতো চটুল এক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেই গুণটার জন্য আজও পর্যন্ত কোনো মিথ্যা কথা মায়ের সামনে টিকে থাকতে পারেনি। ফিমা কোপদৃষ্টি বর্ষণ করে ঠিকই ফিহার দিকে কটমট চোখে তাকিয়েছিল। কিন্তু ফিহা সেদিকে বুদ্ধিমানের মতো পাত্তা না দিয়ে দরজার দিকে মনোযোগ ছুঁড়ে বলল,

– ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ? ভেতরে আসো মা। তুমি আমাকে এতোক্ষণে দেখতে আসছ? সুফি খালা জানালো তোমার আসতে নাকি আজ অনেক সময় লেগেছে। রাস্তায় কী খুব জ্যাম ছিল? বাবা কোথায়?

ফিহার একপ্রস্থ চালাকিটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ফিমা সতর্ক হয়ে যায়। পেছন থেকে মা নাজনীন নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে ছোটো মেয়ের পাশে এসে বসলেন। সুফিয়ার কাছ থেকে শুনেছেন কালরাতে উনার ছোটো মেয়েটা হাড় কাঁপানো জ্বরে নাজেহাল ছিল। তবে জ্বর আসার পেছনে আসল ঘটনা কী, তা তিনি এখনো জানেন না। মেজাজটা খুব গরম হলেও শারীরিক দুর্বলতার কথা চিন্তা করে ফিহার প্রতি সদয় থেকে বললেন,

– মগবাজারের ওখানে দেড়ঘণ্টা জ্যামে বসে ছিলাম। মরার জ্যাম তো ছোটার নামই নেয় না। বসে বসে আমার মেজাজটা যা খারাপ হচ্ছিল! তোর বাবা নীচে দুলাভাইয়ের সাথে গপ্পো জুড়ে দিয়েছে। দেখা করে আসিস। তোর নাকি জ্বর এসেছে? কাল কলেজ ছুটির পর কতক্ষণ ওভাবে শয়তানটার মতো ভিজেছিস? একশো বার বলেছি বৃষ্টিতে ভিজবি না, বৃষ্টিতে ভিজবি না। আমার কথা কোন্ জনমে কানে নিবি কে জানে!

মুখটা কাঁচুমাচু করে উত্তর খুঁজলেও ফিহা হাতাপিতা করে জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। মুখ খুললে একে একে অনেকগুলো প্রসঙ্গ এখানে এসে যাবে। ও যে একটা পাষণ্ড লোকের জন্য বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অপেক্ষা করেছে এ কথা কী মা বুঝবে? বুঝবে না। উলটো বাড়িঘর ভষ্ম করা এলাহিকাণ্ড বয়ে যাবে। ফিহা ট্রে থেকে শরবতের গ্লাসটা তুলে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বলল,

– আমার কথা আগে পুরোপুরি শোনো মা। না শুনে প্লিজ চিৎকার চ্যাঁচামিচি কোরো না। কাল কলেজ ছুটির কথা ছিল চারটা, সাড়ে চারটার দিকে। ওই জায়গায় বৃষ্টির অমন অবস্থা দেখে কলেজের স্যার-ম্যাডামরা বাধ্য হয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন সাড়ে তিনটার দিকে। আমরা সবাই যার যার বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছি। সাফা তো আমাকে পারে না টেনে হেঁচড়ে ওদের বাসায় নিয়ে যায়। আমি যাইনি। কিন্তু সমস্যাটা হলো অন্যদিকে। রিকশা একটা জোগাড় করে, বিশ টাকার ভাড়া পন্ঞ্চাশ টাকা দিয়ে আমি ঠিকই বাসায় পৌঁছে গেলাম। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখি গেটে তালা ঝুলছে। পরে লাইলী আপাদের দারোয়ান এসে জানালো, তুমি নাকি বাবার সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছ। আসতে আসতে নাকি সন্ধ্যা হবে। এদিকে বাবা ওই আজগুবি ঘটনার পর আশেপাশে কারোর বাসায় যেতে নিষেধ করে দেয়। বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাব, কাদের বাসায় উঠব এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি আবার সাফাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরি। কিন্তু রাস্তায় একটা রিকশাও আমি পাচ্ছিলাম না। তার উপর খালামনি বলেছিল চারটার দিকে গাড়ি পাঠিয়ে দিবে, এর মধ্যে আমার ফোনটাও ছিল বন্ধ। এই অবস্থার ভেতর আমি আর কী করব? ওইটুকু সময়ের ভেতর যতক্ষণ ভিজেছি তাতেই আমার ঠান্ডা লেগে জ্বর এসে গেছে। এখন তুমি সব শোনার পর বলো, দোষটা কী আসলে আমার ছিল নাকি অমন পরিস্থিতির? আমি তো জানতাম না কাল তুফানের মতো ঝড়বৃষ্টি নামবে, আর তুমিও কিনা চলে যাবে চেকআপের জন্য। শুধু শুধু কী ভিজেছি?

মেয়ের পুরো কথা শোনার পরও নাজনীনের মনটা কেমন খচখচ করে বিঁধছে। ফিহা যা যা বলল তা কী নিরেট সত্য? এ কথা ঠিক যে তিনি কাল চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন, এবং এসেছেনও সন্ধ্যা সাতটার একটু আগে। ওইটুকু সময়ের ভেতর এমন একটা দুরাবস্থা হয়ে যাবে জানলে হয়ত বাসা থেকেই তিনি বেরোতেন না। মেয়ের কপালে ডানহাত ছুঁয়ে জ্বর দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন মা। কপালটা ঠান্ডা হয়ে আছে এবং গায়ে জ্বর নেই। নাস্তার ট্রেটা ঠেলে দিয়ে তিনি ফিমাকে পাঠিয়ে দিলেন কাজের জন্য। ফিহা পানসে মুখে পরোটার টুকরো পুড়তে পুড়তে নীচুস্বরে বলল,

– মা, আমাদের বাসায় কী এখনো সমস্যাটা হয়? কেউ কী আমার রুমে আসে?

নাজনীন মেয়ের দিকে গম্ভীর স্বরে বললেন,

– না। আসে না। বজলু ভাই বাড়ি বন্ধকের জন্য চাপাচাপি করছেন। উনার ধারণা বাড়িতে খারাপ জ্বীনের আসর পরেছে। তার মধ্যে তোরা দুটো কুমারী মেয়ে। বাড়িতে আর একটাও পুরুষ মানুষ নেই। এসব শোনার পর কেউই আমাদের বাসায় এখন আগের মতো আসে না। এর মধ্যে আরেক ঘটনা শুনলাম। মিন্টুদের ভাড়াটিয়াটা একদিন পানি খেতে উঠে রাত তিনটার সময় কাকে যেন আমাদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। তোর রুমের ওদিকটা তো সবসময় অন্ধকার থাকে, আবার পেছন দিকে বাবুদের এজমালি জায়গা। পরিষ্কার কিছু দেখতে পায়নি। আমি তোর বাবাকে সব জানানোর পর উনিও এখন বন্ধকের কথা চিন্তাভাবনা করছেন। কেন যে আমাদের উপর একটার পর একটা বিপদ ধেয়ে আসছে আল্লাহ্ মালিক জানেন। এই তল্লাটে এমন ঘটনা কারো সাথে হয়নি। সেখানে আমাদের উপর এমন বিপদ কেন আসছে বুঝতে পারছি না।

মার বিচলিত কথায় ফিহা আর খেতে পারে না। স্পষ্ট দেখতে পায় মার দু’চোখ জুড়ে অমানিশা রাতের মতো গভীর দুশ্চিন্তা। এই দুশ্চিন্তা দুটো অবিবাহিত মেয়ের ভবিষ্যৎ সুন্দর জীবন নিয়ে। যদি ওদের বাড়িটা নিয়ে এমন ঘটনার গুজব রটতে থাকে, তবে কী মেয়েদুটোকে তিনি সৎপাত্রে হস্তান্তর করতে পারবেন? কেউ কী বিয়ে করবে ওদের? যে সমাজে একটা মিথ্যা গুজবও মেয়েদের ভাগ্য বিনষ্ট করে দেয়, সে সমাজে তিনি যোগ্য, সুপুত্র, বিশ্বাসভাজন বর কী পাবেন? নাজনীনের অন্তরাত্মা সবসময় একটা ব্যাপারে সন্দেহ করে চলেছে। কেউ কী তার মেয়েদের উপর প্রতিশোধ চালাতে এমন সব ঘটনার সৃষ্টি করছে? এই সমাজের উপর বিশ্বাস, ভরসা, আস্থার ঝুলি কীভাবে রাখবেন একজন মা? ন্যায়বিচারের জন্য কার মজলিশে মাথা ঠুকবেন তিনি?

.

আকাশ জুড়ে ফুটফুটে কিছু সাদা মেঘ তুলোর মতো ভাসছে। বাতাসে কদম ফুলের মিষ্টি মিহি গন্ধ, বাতাবি লেবুর কড়া মিঠে ঘ্রাণ, পায়ের কাছে ছোট্ট এক টুকরো সোনা রোদ অবুঝ ছোট্ট শিশুর মতো লুকোচুরি খেলাটা খেলছে। ছাদের রেলিং ধরে মুখ নীচু করে ছোট্ট উঠোনে রান্নার পসরা দেখছে ফিহা। দু’গাল জুড়ে নেমে পরেছে ওর কোমর ছাপানো লম্বা চুল। হিমেল স্নিগ্ধ বাতাসে চুল উড়ার দৃশ্যটুকু দূর থেকে দেখছে এক শ্যামবর্ণের দীর্ঘকায় যুবক; যে আচানক ফোনে কথা বলা থামিয়ে স্থির, শান্ত, সম্মোহন দৃষ্টিতে ছাদের সেই মেয়েটির পানে তাকিয়ে রয়েছে। অচেনা সুন্দর মেয়েটির গায়ে সুনীল আকাশের মতো আকাশি রঙের কামিজ, গলায় দেখা যাচ্ছে ধবধবে সাদা ওড়না, মুখজুড়ে কী অপার্থিব সৌন্দর্য সারা ঠোঁটে-মুখে ফুটে রয়েছে! যেন ওই মুখে একবার চোখ পড়লে চোখ ফেরানো যাবে না। কানের ফোনটা নামিয়ে রেখে ডানপাশে দাঁড়ানো বাবড়ি চুলের যুবকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– দীপ, ছাদে দাঁড়ান মেয়েটা কে? বোন হয়?

ডেকোরেটরের লোকদের সাথে কথা বলতে থাকা দীপ হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে মুখ ঘুরাল। বন্ধুর কথায় দূরপানে সেই ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

– হ্যাঁ দোস্ত, কেন?

– এর আগে কখনো দেখিনি। মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর। মিষ্টি একটা পুতুলের মতো দেখতে। এর আগে তোদের বাড়িতে ওর আসা-যাওয়া দেখিনি। ও কী তোদের বাড়িতে প্রথম এলো?

ছাদে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যিকার অর্থেই অনিন্দ্য সুন্দরী। মিষ্টি একটা ফুলের মতো নরম তুলতুলে। তার হরিণী সুন্দর চোখদুটোতে ফুটে রয়েছে অপার স্নিগ্ধ মায়া। দীপ একগাল হাসি দিয়ে বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বলল,

– তুই কী এখানে বিয়ে খেতে এসেছিস নাকি পাত্রী খুঁজতে? আমার বিয়েতে কোনো কম্প্রোমাইজ নয় শিহাব। আমাকে এখন জলদি জানা, দুপুরের দিকে জয়দেবপুর মার্কেটের দিকে যাবি নাকি বিছানায় পরে পরে ঘুমুবি তুই? তোর ঘুম ভালো হয়েছে?

শিহাব বলা ছেলেটির চোখে হাসি হাসি ভাবটা আঠার মতো লেগে আছে। ঠোঁটজুড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে অদ্ভুত দ্যুতি মেশানো হাসি। এই হাসি কী অন্য কোনো ব্যাপারের ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা বুঝতে পারছে না দীপ। সে শিহাবের হাত ধরে টেনে বটতলার দিকে যেতে যেতে বলল,

– তুই কী জার্নি করে এখনো টায়ার্ড দোস্তো? যদি টায়ার্ড ফিল করিস তবে তোর যেতে হবে না। তুই থাক। তুই আমার রুমে গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দে। মাকে বলে দিচ্ছি, তোর জন্য কড়া করে একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে দিতে। আয়, বাড়ি চল।

বাড়ি ফেরার কথা শুনে চোখদুটো চকচক করে উঠল শ্যাম সুদর্শন ছেলেটার। সে আসলেই চাইছে এক্ষুণি কোনো একটা বাহানা দেখিয়ে বাড়িমুখো ফিরতে। ছাদে থাকা সেই অচেনা মেয়েটির ব্যাপারে তার উৎসুক মনটা যেভাবে যেহারে উশখুশ করছে, এটা তার জন্য সম্পূর্ণই বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। মেয়েটি বড়ো অদ্ভুত রকমের সুন্দর।তার গোলাপি মিষ্টি ঠোঁটদুটোতে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ছিল। যে আকর্ষণটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে হলে রাত জাগা অন্ধকারে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা পুষতে হবে। উঠোনে ইট দিয়ে বানানো উঁচু উঁচু চুলায় রান্না চড়াতে গিয়ে থমকে যায় মহিলার দল। নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে বলাবলি করতে থাকে, ছেলেটা হচ্ছে দীপের স্কুলজীবনের বন্ধু। ওর চারটা বন্ধুর মধ্যে এই বন্ধুটা গতকাল রাত তিনটার সময় সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছে। বাবা-মা দুজনই ডাক্তারি পেশার সঙ্গে সেদেশে যুক্ত। দু’ভাইয়ের মধ্যে ছোটো এই ছেলেটা বাবার মতো একজন নাম করা কার্ডিওলজিস্ট। দেখতেও ভারী সুপুরুষ, চৌকশ চেহারা। পুরো নাম তৌকির আহমেদ শিহাব। এখনো তার বৈবাহিক অবস্থা অবিবাহিত। তবে মার্কিন মূলুকে বেড়ে উঠার দরুন বেশ কিছু প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক তার ছিল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে তাকে রুমের জন্য পাঠিয়ে দীপ চলে যায় কাজে। এদিকে শিহাব রুমের দিকে পা না বাড়িয়ে হাঁটা দেয় ছাদের দিকে। দু’মিনিট ওর সাথে কথা বললেই যাবতীয় প্রশ্নের উশখুশ করা উত্তর এবং জেনে যাবে মেয়েটির নামধাম, পরিচয়। রেলিং ধরে উপরে উঠতে উঠতে ক’হাত সামনে আরো দুটি মেয়ে কথা বলতে বলতে উঠছিল,

– আচ্ছা দীপ ভাইয়ের কী সবগুলো ভাইবোন এসে পরেছে?

– আরে না, কীসের? বাকি আছে তো! এখনো বড়ো জনের আসা বাকি আছে। তুই তো তাকে দেখিসনি শ্যামা। সে কিন্তু দীপ ভাইয়ার থেকে দুই বছরের বড়ো। আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম, তখন উনি দীপ ভাইয়াদের পুরোনো বাড়িটায় একবার ঘুরে গেছিলেন। দেখতে যেমন হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট, তেমনি কথার ধার খুব। শেষবার যখন ঘুরে গেছিল ওই বাড়ির আশেপাশে সবকয়টা মেয়ে তাকে নিয়ে ফুসুর-ফাসুর করেছে। আমাদের আমেনা বু আছে না? দাঁড়া একমিনিট! তুই আগে আমাকে প্রমিস কর এই কথা ভুলেও কাউকে বলবি না। প্রমিস কর। প্রমিস করছিস?

– হ্যাঁ হ্যাঁ প্রমিস। বলব না। তারপর কী হয়েছে বলো।

– বু তো তাকে দেখার পর ক’দিন নারী-দেবদাসের মতো হ্যাংলামো করেছে। পরে জেঠামিয়া সব শোনার পর বিয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। জেঠামিয়ার তো বিরাট জায়গা-সম্পত্তি আছে আছে, ওগুলো দিয়ে যৌতুকের লোভও দেখিয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। তারা ছেলে বিয়ে দেবে না। ছেলে তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছে। এসব শোনার পর বুয়ের অবস্থা আরো খারাপ। এরপর একটা ঘটক ধরিয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ে করিয়ে দেয়। এবার বুঝছস কেন আমেনা বু আমাদের রোকসানা চাচিরে দেখতে পারে না? এটাই হলো কারণ। আমেনা বু মনে করে, তার মতো “ক্লাস এইট” ফেইল করা মেয়েকে চাচিই মনেহয় কানেপড়া দিয়ে উল্টা-সিধা বুঝিয়েছে। কারণ, চাচি আবার আমেনা বুর ঠোঁটকাঁটা স্বভাবটা পছন্দ করতো না। সে কী আবার আপন ভাগিনার জন্য অমন মেয়ে পছন্দ করবে? ভুলেও না! সব মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে এতদূর আসছে বুঝছিস?

– আল্লাহ্! তাই তো বলি, আমেনা বু দীপ ভাইয়ের বিয়েতে কেন আসতে চায় না। তলে তলে যে এতদূর কাহিনি রটে গিয়েছে তা তো আমরা জানতাম না।

– জানবি কীভাবে? ফুপু কী তোদের পারিবারিক বিষয়ে কোনোকিছু জানিয়েছে? জানায়নি। ফুপু আর ফুপা দু’জনই এসব জানতো। জানতো দেখেই ভাইয়ার বিয়েতে ওই খালার পরিবারকে দাওয়াত দিতে না করেছিল। তবু চাচি মান রক্ষার জন্য দিয়েছে।

– ধুত্! আমার মা এসবে জড়াতে যাবে কেন? এটা তো চাচা-জেঠাদের সমস্যা!

– হোক গে সমস্যা। চারবছর আগে এমনি একটা তামাশা হয়ে গেছে ওটা তো জানিস। ওই ঘটনা আর আমেনা বুর তামাশা এ দুটো কাহিনি মিলে সম্পর্ক এখন আগের মতো নেই। আর ওই ভাইয়াটা যদি বিকেলের দিকে আসে তাহলে আল্লাহ আল্লাহ কর যেন বিয়েবাড়িতে কোনো অঘটন না ঘটুক। উনি অল্প কথায় বাঁশ মেরে দেওয়া লোক। খুবই ডেন্ঞ্জারাস।

কানে ফোন এঁটে, কথা বলার মতো সুক্ষ্ম একটা অভিনয় চালিয়ে সবটুকু কথা শুনে নিল শিহাব। যদিও এই ধরণের নীচুস্তরের কর্মকাণ্ড এর আগে সে কখনো করেনি। তবু আজ মেয়েদুটোর কথা শুনে অদ্ভুত একটা কৌতুহল থেকে ওদের পিছু পিছু সব শুনে নিয়েছে। কে এই লোক? এই মেয়েদুটো কাকে নিয়ে এতোটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছে? আবার মুখে মুখে বলছে ওই লোক খুব হ্যান্ডসাম? কপালের মধ্যখানে কয়েক ফালি ভাঁজ পরে যেতেই শিহাব আর ছাদে গেল না। সে পা ঘুরিয়ে ফিরে গেল বন্ধুদের আড্ডাখানায়। দোতলার বাঁদিকে বিশাল বড়ো খোলা বারান্দায় তিন বন্ধু হাসিঠাট্টায় মশগুল হয়ে আছে। শিহাব সেখানে একটা চেয়ার টেনে বসে পরতেই হঠাৎ চাপা উদ্বেগে বলে উঠল,

– দীপের কোনো বড়ো ভাই আছে গাইজ? এতো বছর অ্যাব্রড থাকার জন্য আমি কী কিছু মিস করে ফেলেছি?

হঠাৎ শিহাবের মুখে এমন খাপছাড়া প্রশ্ন শুনে সকলের আড্ডা সহসা থমকে যায়। তপন কোকের গ্লাসটা টেবিলে থেকে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠে,

– কীসের জন্য বল তো? কেউ কিছু বলেছে তোকে?

তপনের উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে আফিদও এবার মুখ খুলে,

– তুই এখন কার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিস জানিস না? দীপের যে একটা খালাতো বড়ো ভাই আছে আগে শুনিসনি তুই?

শিহাব ওদের দু’জনের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে কিছু একটা আঁচ করার চেষ্টা চালিয়ে বলল,

– না। ইন ফ্যাক্ট, আমি এই ব্যাপারে একটু আগে জানতে পেরেছি। দীপ তো আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলল না। ঘটনা কী?

তিন বন্ধু তখন নিজেদের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে আবার শিহাবের দিকে ফিরল। ফেরার আগে তপন চোখের ইশারায় হাসিবের দিকে কী যেন একটা ইশারা করে গম্ভীর মুখে জানাল,

– তুই যার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিস, সে এখানে আসলে ঠিক হবে না। অনেক কিছু তুই দেদারসে করতে যেয়ে বাঁধা পাবি। আঁটকে যাবি। যেমন, এই ব্লিডিংয়ে দীপের অনেকগুলো কাজিন জমা হয়েছে। ফুপু, খালা, চাচা, জেঠা সব বংশের মেয়ে। হিসাবটা বুঝতেছিস শিহাব?

ওদের চারজনের মাঝে ছোট্ট একটা গোল টেবিল। সেই টেবিলের উপর চকচকে একটা লাইটার, বিদেশি ব্রান্ডের দু’প্যাকেট “উইনস্টোন” সিগারেট, একটা স্বচ্ছ কাঁচের ছাইদানিতে গুঁড়ো গুঁড়ো তামাক এবং কালো কুচকুচে তিন বোতল কোক রাখা। উইনস্টোন নামের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে শিহাব সেটা অগ্নিসংযোগ করে বলল,

– আমাকে সরাসরি কিছু খুলে না বললে কিছুই বুঝতে পারব না।

এবার আড়ি ভাঙতে বাধ্য হলো আফিদ,

– অর্নাস ফোর্থ ইয়ার থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত সবকটা সীট খালি। এই সীটের মালিক হতে চাইলে এটাই হচ্ছে মোক্ষম সুযোগ। একেকটা সীটের দাম ট্রেনের উইন্ডো-সীটের মতো। ওই সিনিয়র সিটিজেন যদি এ বাড়িতে এসে পরে তাহলে ব্যাপারটা ফিল করতে পারবি না। বুঝে নে, কড়া সিকিউরিটির ভেতর পরতে হবে।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এবার শিহাবও যেন ভ্রুঁ কুঁচকাতে বাধ্য হয়। দু’আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে আশ্চর্য কণ্ঠে বলে উঠে,

– কিন্তু আমি তো এখানে তোদের মতো ফূর্তি করতে আসিনি। ইভেন আই হেভ নো টাইম ফর ইট। তোরা কী করে ভাবছিস এখানে এসে দীপের কাজিনদের নিয়ে মজা করব? স্যরি, নিজেরা যা মন চায় তাই কর্। আমি এখানে এসেছিলাম তোদের কাছে দীপের ভাইটার ব্যাপারে জানতে। বাট তোরা আমাকে স্পেসিফিক কিছুই জানাতে পারলি না। আচ্ছা সেই জেন্টেলম্যান কীসে জব করেন জানিস? ডোন্ট নো, বাট আমি তার ব্যাপারে নরমাল আগ্রহ থেকে জানতে চাচ্ছি।

তিনজোড়া চোখের দৃষ্টিদুটো কেমন কৌতুহলের ছাঁচে ছোটো ছোটো হয়ে যায়। কী যেন বোঝার চেষ্টায় তারা শিহাবকে আর ঘাঁটানোর প্রবৃত্তি করল না। কোকের বোতলে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে হাসিব বলে উঠল,

– কর্পোরেট সেক্টরে আছে এটুকু জানি ডাক্তারবাবু। কোন কোম্পানিতে কাজ করে সেটা কেউ জানে না। ওই সেক্টরে থাকতে গেলে বহুত পা চাটা লাগে। দেখ গে ওই শা লা চাটতে চাটতে কতখানি উপরে উঠছে। এই চাটাচাটির জন্যই তো দীপের কোন্ আপুকে জানি রিজেক্ট মেরে দিছিল।

দু’কানে সবটুকু কথা শুনতে পেলেও শিহাবের দূরদৃষ্টি এখন আকাশের দিকে স্থির। ডানহাতে কায়দা করে টানছে সিগারেট এবং মুখভর্তি করে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। বাকি তিনবন্ধু আড্ডায় মেতে উঠলে হঠাৎ শিহাবের ভারি গলাটা গমগম করে বেজে উঠল,

– ছাদে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। নাম জানি না। পড়ণে আকাশি কামিজ, সাদা ওড়না। ডানহাতের কবজিতে সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। মেয়েটার মুখে কী নিয়ে দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল জানি না। বাট বাংলাদেশের মাটিতে এরকম কিছু এক্সপেক্ট করব ভাবিনি। ওই দুশ্চিন্তার কারণ আমি জানতে চাই। জানতে চাই ওইটুকু শরীরের মাথায় কী নিয়ে অতো হেডেক হচ্ছে।

হঠাৎ আড্ডা থামিয়ে একে অন্যের দিকে তাকাতে থাকে তারা। আস্তে আস্তে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসতে থাকল আফিদ ও তার বন্ধুরা। যা বোঝার, তা তারা বুঝে গেছে। এবার নিজেদের কাজে কোনো বাঁধা নেই।

ভেজানো দরজার সরু ফাঁক দিয়ে স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছে লাবিব। মুখে পাউরুটির স্লাইসটা তার দু’ঠোঁটের ফাঁকে ওভাবেই আঁটকে আছে। পাশ থেকে লাবিবের অবস্থা দেখে ফিসফিস সুরে বলে উঠল ফাহাদ,

– এগুলা কী হচ্ছে লাবিব? এখানে এমন কিছু জীবনেও আমি আশা করি নাই। আসছিলাম এদের সাথে আড্ডা দিতে। কিন্তু এদের কথাবার্তা . . .

ফাহাদের কথায় সংবিৎ ফিরে পেয়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াল লাবিব। মুখ থেকে পাউরুটির স্লাইসটা সরিয়ে ফেলে চরম হতবাক হয়ে বলল,

– এদের কথাবার্তা শুনে আমার কাছে ভালো লাগল না ফাহাদ। বারবার একটা দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। চার বছর আগে কী হইছে, না হইছে ওসব নিয়ে ওরা কীভাবে জানলো? নিশ্চয়ই দীপ ওদের সাথে মাতব্বরি করে কথাগুলো বলছে? কত বড়ো জাউরা হইলে এই ধরণের কাজটা করতে পারে ভাব্!

– স্মোকার শা লা রে লা ই ত্থা য়া ওর ডিগ্রি পিছন দিয়ে ঢু কা য় দিতে মন চাচ্ছে। কত বড়ো খা ই শ ট্টা হলে আরেক বাড়ির ইজ্জত নিয়ে পরে থাকতে পারে?

– এবার যেন খারাপ কিছু না-হোক ভাই। তুই, আমি যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতেছি, ওটা যদি সত্যি সত্যি ফলে যায় তাহলে সর্বনাশ! এমনটা না-হোক। এমনটা কোনোভাবেই না-হোক!

.

ছাদের চওড়া রেলিংয়ে পরে আছে ফুল চার্জ করা ফোন। হাতের বাঁদিকে রাখা এক বয়ামভর্তি সুস্বাদু আচার। ঢাকনা আলগা করে রাখলেও তা থেকে এক টুকরো আচার আজ মুখে তুলেনি। শান্ত, নিবিড়, ভাষাহীন চাহনিদুটো দূরের কোনো অচেনা ভুবনে জেলবন্দি হয়ে আঁটকা আছে। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থির অস্থির ভাব। কেমন একটা চন্ঞ্চলতায় ভরা উন্মুখ, অসহ্য অবস্থা। মনে হচ্ছে নিজের কোনো মহামূল্যবান সম্পদকে বহুক্ষণ যাবৎ দেখতে পাচ্ছে না। হাতদুটোর ভেতরে কিছু একটা ছুঁতে গিয়েও শূন্য। এই শূন্যতার ভাষা বোঝার জন্য আঁকুপাঁকু করে উত্তর খুঁজছে ফিহা। কিন্তু উত্তরের ঝুলি যে আজও বন্ধ! দূর থেকে চোখ নামিয়ে ডানে থাকা ফোনটার পানে চাইল। আজও কী প্রাণপ্রিয় বান্ধবিকে একটা কল করবে? সেদিনের মতো কথার জাদুতে সবকিছু ভুলিয়ে দেবার জন্য? আঙুল নাড়াতে নাড়াতে অবশেষে ফোনটা মুঠো করে কলটা ডায়ালে চাপল ফিহা। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই দু’চোখ বন্ধ করে বলল,

– আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। আজও কথার মাঝে ইন্টারাপ করবি না। মন দিয়ে না শুনলে কিছুই বুঝবি না। আর না বুঝলে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করবি। আমার খুবই অসহ্য ধরনের ফিল হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে ছেড়েছুড়ে সব চলে যাই। একটা মানুষের উপর চরম রাগ হচ্ছে, জিদ উঠছে, এমনকি তাকে সামনে পেলে কড়া করে দুটো কথাও শুনিয়ে দিব; কিন্তু তবু তার প্রতি ঘৃণা হচ্ছে না। একটুও না। উলটো সকালে সে নাস্তা করে অফিস গিয়েছে কিনা তা নিয়ে আমি টেনশন করছি। আমি এমন গাঁধার মতো কর্মকাণ্ড কেন করছি সাফা? আমার মধ্যে এমন অস্বাভাবিক আচরণ কী করে, কীভাবে ঢুকল? কীভাবে সম্ভব এসব? আমি প্রচুর চেষ্টা করছি নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর। কিন্তু দিনশেষে ফাঁকা ফাঁকা উত্তর ছাড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। মা, সুফি খালা, আপু, খালামনি সবাই এখানে মজুত আছে। তবু আমি কি যেন মিস করে চলেছি। খুব করে চাচ্ছি আমার সামনে আসুক। এখুনি আসুক!

একনিঃশ্বাসে গড়গড় করে কথাগুলো বলে দিতেই হাঁপানোর মতো দম নিচ্ছিল ফিহা। ঠোঁট গোল করে একের পর এক শ্বাস ছাড়তেই ওপাশ থেকে খরখরে কণ্ঠটা জানিয়ে উঠল,

– “ অপেক্ষা করুন। আপনার কাছে সন্ধ্যায় পৌঁছে যাব। অতো টেনশন করে নিজের ক্ষতি ডাকতে হবে না। খেয়ে নিয়েছি। ”

শ্বাস, চোখ, ঠোঁট সবই সহসা ভয়ংকর ভাবে স্থির হয়ে গেল। ভেতরে ভেতরে পাঁজরের তলায় একটা তীব্র ধকধকানি টের পাচ্ছে। পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতিটা নেমে যেতেই ফোনটা নামিয়ে দেখল। ছয়বর্ণের শব্দটুকু “ Sayeed ” .

#FABIYAH_MOMO .

#নোটবার্তা : ধরে নিন, এটা ঠিকঠাক, খাপে খাপ, সংশোধিত পর্ব। গতকাল যেটা ডিলিট দিয়েছি তার সাথে মিল রাখিনি। অতঃপর চটপট সবাই মন্তব্য রাখুন। দেখি কার কতটুকু ভালো লেগেছে এটা। সবাইকে বুকভরা স্নেহ, আদর ভালোবাসা। ❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here