নির্মোচন পর্ব ১৮

0
897

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৮ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

কানের কাছে ওমন শীতল কণ্ঠের ফিসফিস শুনেও নড়তে পারল না ফিহা। তার জ্বরদগ্ধ শরীরটা তাতে সায় দিতে পারল না। হাড়ের গিটে গিটে ব্যথা হয়ে ওঠা দুর্বল, নাজুক, অসাড় শরীরটা সীটের ওইটুকু কোণে ছেড়ে দিল অবলীলায়। মাথাটা শুধু জানালার কাঁচে ঠেকা দিয়ে দুর্বল গলায় ছোট্ট করে বলল, বাবাকে ঘুমোতে বলো মা। আমার জন্য তাকে আর জেগে থাকতে দিয়ো না। কাল অফিস যেতে হবে। আমি . . আমি ঠিক আছি . . . ফুস করে দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট নিঃশ্বাসের গরম বায়ুটুকু বেরিয়ে যেতেই পেছন থেকে শক্ত বেড়ির মতো আগলদুটো জড়িয়ে ধরল ওকে। ওম ওম করা অনুভূতির ভেতর শীতের সকালে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোনোর মতো আদুরে তন্দ্রায় তলিয়ে গেল ফিহা। জানালার কাঁচে কপাল ঠেকানোর জায়গাটুকু আর জানালার কাঁচে রইল না; কারো রুক্ষ হাতের তালুতে ভর দিয়ে ওভাবেই সারাটা রাস্তা সীটের কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমোলো। ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে বিষিয়ে উঠা ইস্পাতকঠিন মনটা গাড়ির এসিহীন অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে ছিল সাঈদের। কনুইয়ের কাছে স্লিভ গুটানো শক্ত পেশির হাতদুটো কারো জ্বরতপ্ত লম্বা লম্বা নিঃশ্বাসের গতিতে সংকোচন-প্রসারণ হচ্ছে। কেন নিজের দায়িত্ববোধের বাইরে অন্য একটি দায়িত্ব তাকে অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে? তার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না এভাবে অন্য কারোর জন্য নিজের অস্থির, উচাটন অবস্থা জাহির করার! কী প্রয়োজন এতে? সে তো চাইলে এখুনি নিজের দেরি করে আসার কারণটা সঠিক প্রমাণ করে উলটো ওকেই বোকার মতো অপেক্ষা করার জন্যে দোষী সাব্যস্ত করতে পারতো; কিন্তু তা না করে নিজের দোষ স্বীকারের মতো চুপ হয়ে রইল। চোখের সামনে প্রিয় শখের গাড়িতে এক ঘা লাগানোর দৃশ্যটা যদি অন্য কেউ করতো তবে আজ খু ন করে মাটিতে পুঁতে রাখার মতো কাজে তার দু’হাত কাঁপতো না। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের সামনে দিয়ে যাবার সময় ডেরেক ফার্নান্দেজ তার পেশাদার শান্ত গলায় বলে উঠল,

– আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পর বড়োকর্তা খুব চটানো গলায় সবাইকে অপমান করেছেন। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন আজকের মতো এফিশিয়েন্ট একটা দিনে আপনি থাকবেন, কিছু বলবেন উনার সাথে। যখন দেখলেন আপনি আপনার ডেস্কে নেই এরপর তিনি আমাকে আর জুবায়ের আহসানকে দেড়ঘণ্টা যাবৎ লেকচার শুনিয়ে সব ডিসক্লোজ করেছেন। ঘটনা তেমন ভালো নয়। সামনে আমাদের আরো ভুগতে হবে।

ডেরেকের কথায় চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেলেও চুপচাপ কথাগুলো শুনে গেল সাঈদ। ডেরেক একটু থেমে সামনে দাঁড়ানো একটা মৌমিতা বাসকে অতিক্রম করে আবারও বাকী কথাটুকু বলে উঠল,

– আপনার জন্য টপ-নচ্ ব্রান্ডের লিমিটেড এডিশন কফিটা ডকে রাখার পর খুব সন্দেহ হচ্ছিল। যখন শুনলাম আপনার ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে তখন আর সন্দেহটা চেপে রাখতে পারলাম না। ওটা আমার হেফাজতে রেখেছি।

চট করে কপালের মসৃণ চামড়াটা কুঁচকে গেলে সাঈদ উদ্বিগ্ন গলায় শুধাল,

– ডকের বাড়তি চাবিটা কোথায় রেখেছেন আপনি?

– এই যে,

বলার সঙ্গে সঙ্গে শার্টের বুকপকেট থেকে ছোট্ট চাবিটা বের করে দেখিয়ে দিল ডেরেক। একগাল হাসি দিয়ে নিজের চালাকচতুর বুদ্ধিতে অহং দেখিয়ে বলল,

– বড়োকর্তা এজন্যই চটেছেন স্যার। আপনার জন্য আসা হাই-এফিশিয়েন্ট কফিটা আপনি না দেখেই অন্য কাজের উছিলায় চলে গেছেন, এটা মানা তাঁর জন্য খুব কষ্টকর ছিল। আর ফাহমিদ স্যার চাইছিল আপনার এই জিনিসটা আগেভাগে হাতিয়ে নিয়ে বড়োকর্তার সামনে নিজেকে যোগ্য, সঠিক প্রমাণ করবে। এখনো এই প্ল্যাটফর্মে পা চাটাগিরি স্বভাবটা বন্ধ হলো না। জিহবার ছাল উঠে যাবে তবু খাল কাটা বন্ধ হবে না।

পোড় খাওয়া শক্ত কঠিন মুখটা বাঁপাশের জানালায় স্থির করে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল সাঈদ। তাকে আজ রাতের মধ্যেই ঘুম, ক্লান্তি, খাওয়া-নাওয়া সব বাদ দিয়ে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। নাহলে চাকরি তো হারাবেই, সঙ্গে দুটো জরিমানা লেগে আইনি মামলাও ঠুকে যেতে পারে বলে আশংকা। দু’হাতের ভেতর শুকনো তোয়ালে দিয়ে মোড়া নরম দেহটা পরম আরামে গা ছেড়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। মুখটা জানালার দিকে থাকায় আলো-আঁধারিতে দেখা গেল না। ডানহাত দিয়ে পায়ের তলায় ঠান্ডা ঠান্ডা তালুগুলো ম্যাসেজ করে দিলেও এখনো তা গরম হবার নাম নেই। ছুটিটা আদৌ চারটার দিকে হয়েছিল নাকি আরো আগে এটা জানা গেলে বুঝতে পারতো। রাস্তায় জ্যামের অবস্থা বিরক্তিকর পর্যায়ে না গেলেও রাত হবার দরুণ কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসছে গাজীপুরগামী রোডটা। বোধহয় আবহাওয়ার এমন খারাপ অবস্থা দেখে সাহস করে কেউ বাইরে বেরোতে পারেনি। ফিহা শরীরের আড়মোড়া-সহ বহুক্ষণ পর নড়েচড়ে উঠতেই অস্ফুট স্বরে কাশতে কাশতে ওপাশ থেকে এপাশ ঘুরে বসলো। টের পায়নি ওপাশ থেকে এপাশ ঘুরার ফলে ঠিক কোন্ জায়গাটায় মুখ লুকিয়ে আবারও চোখ বুজে ফেলেছে। গায়ে জড়িয়ে থাকা শুকনো তোয়ালেগুলো গা থেকে খসে পড়তেই চট করে সেগুলো ধরে ফেলে আবারও ওকে ঢেকে দিল সাঈদ। তার সাদা শার্টের উপর গরম গাল, গরম শ্বাস যেভাবে বুকের চামড়া ভেদ করে খাক করে দিচ্ছে তাতে অনুমান করা সম্ভব গায়ের তাপমাত্রা এক ডিগ্রীও কমেনি। পেটের কাছে গরম হাতদুটো কিছু খোঁজার মতো হাতড়ে হাতড়ে অবশেষে তামাটে কঠিন ভয়ংকর শক্ত শরীরটা ঘোরের ভেতর জড়িয়ে ধরল। এই প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তার বুকের উপর মেয়েলি শ্বাস এবং মেয়েলি হাতের নরম স্পর্শগুলো পিঠে টের পেল। প্রতিটি ধক্ধক্ করা হৃদস্পন্দনের তালে নিজের শ্বাসটাও ওর সঙ্গে মেপে মেপে টানছে সাঈদ। কোথাও এতটুকু বেশি শ্বাস টানলে যদি সেই ভুলে ওর ঘুমটা ভেঙে যায়? যদি মাথাটা সরিয়ে ফেলে আবারও সেই জানালার কাঁচে মুখ ফেরাতে সরে পড়ে? দু’চোখ বন্ধ করে কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে রইল সাঈদ, নড়ল না। প্যান্টের লেফট্ পকেটে বারবার কাঁপতে থাকা জরুরি কলের সেলফোনটাও এই মূহুর্তের জন্য ছেড়ে দিল সে। এখন, এই রাত্রিকালীন মূহুর্ত, এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির চলন্ত গাড়ির ভয়ংকর স্তব্ধতা, একটি নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকা আরেকটি পবিত্র প্রাণের জ্বরাক্রান্ত দেহ— এ কী তার পাশবিক, নির্মম, অতিশয় উগ্র গুণাবলীর সাথে খাপ খাবে কোনোদিন? কখনো কী ওর মনের মতো স্বাভাবিক কথা বলা পুরুষ, হাসিতে-খুশিতে মন ভুলানো একজন প্রেমিক, কথায় কথায় প্রেমের গ্রন্থিরচনা করা ব্যক্তি— এ কী তার চাঁচাছোলা ব্যক্তিত্বের পক্ষে সম্ভব? নিঃশব্দে একটা শ্বাস ছেড়ে একমুখ প্রশ্ন করল নিজেকে,

– আমার সোফিস্টিকেটেড কথাবার্তা যেখানে আমার ফাদার-মাদারই বোঝে না, সেখানে অন্য একটা ব্যক্তির কাছে আশা রাখা ঠিক? ইন পয়েন্ট অফ ফ্যাক্ট, আমার কথাবার্তা একটা মেয়ের কাছে ইন্ট্রেসটিং লাগলেও হেলদি একটা পর্যায়ে সেটা একঘেয়ে হতে বাধ্য। আই কান্ট রিলেট মাইসেল্ফ টু অ্যানিবডি। যার কাছে আমার কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়, তার কাছ থেকে আশা রাখা, আশা করা সবটাই ভুল।

রাতের বৃষ্টি ভেজা সড়ক দিয়ে, গাজীপুর চৌরাস্তা শহর পেরিয়ে, আরো এক কিলোমিটার দূর ‘শাহ আলম বাড়ি’ জায়গাটার কাছে গাড়ি থামল। রাতের অন্ধকারে ছিমছাম, ঠান্ডা, সবুজে ঘেরা জায়গাটা কেমন ভূতুড়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। কোথাও বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারটা ব্লাস্ট হয়ে এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে কিনা সন্দেহ, তবে শহরের বুকে এরকম একটা গ্রাম্য গ্রাম্য ছোঁয়ার পরিবেশ দেখে বহুদিন পর মনপ্রাণ শান্ত হবার কথা। পকেট থেকে সাবধানে ফোনটা বের সুফিয়া খালাকে কল করল সাঈদ,

– পেছনের দরজা দিয়ে বের হোন। গায়ে প্রচুর জ্বর। একটু ধরে ধরে সাবধানে নিয়ে যাবেন।

কানে ছোট্ট বাটন ফোন চেপে ঝাঁঝানো গলায় চটে উঠলেন সুফিয়া,

– ক্যা? আমি ধইরা ধইরা লইয়া যামু ক্যা? আল্লায় তুমারে হাত-পা দিছে না? এট্টুখানি আগ্গায়া ওরে বাইত পৌঁছায় দিলে কী এমুন কষ্টডা হইব?

ঝাঁজালো কথার নীচে আসল উদ্দেশ্যটুকু বুঝতে পেরে ফিহার দিকে তাকাল সাঈদ। তার নিরুত্তাপ চোখদুটোতে মেখে আছে অপরাধ করার কুণ্ঠা। কানে ফোন চাপা অবস্থায় আবারও নিরস গলায় বলে উঠল সে,

– ব্যাক করব। আমি এখানে থাকার জন্য আসিনি। আপনি প্লিজ বাইরে এসে সাবধানে ওকে নিয়ে যান।

স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বললেও সুফিয়ার মনে হলো কিছু একটা গণ্ডগোল নিশ্চয়ই হয়েছে। এভাবে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে যাওয়ার কথা কেন বলবে? উলটো সে-ই তো ফিহাকে কোলে করে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিতে পারে। সুফিয়া ফোনটা কেটে দিয়ে একটা টর্চলাইট ধরিয়ে পাতা চুঁয়ে পড়া বৃষ্টির ছাঁটে বেরিয়ে গেলেন। বিয়ের গেট সাজানো ঝাঁড়বাতির আলোতে সদ্য হেডলাইট নেভানো গাড়িটার উপর লাল, নীল, সবুজ বাতির ঝিকিমিকি খেলা চলছে। নিঃশব্দে প্যাসেন্ঞ্জার সীটের দরজা খুলে দাঁড়ালে সুফিয়া আর চুপ রইলেন না তখন,

– তুমি কই যাইতাছ এহন?

ফিহার গা থেকে আস্তে আস্তে শুকনো তোয়ালেগুলো সরিয়ে ফেলে ওকে শরীর থেকে আলগা করছিল সাঈদ। ভেজা শ্যাওলার বুনো গন্ধে চারপাশটা মৌ মৌ করলেও সুফিয়ার ঝাঁজ মাখানো কণ্ঠ ফের ভেসে এল,

– আমি কিন্তু আপার কাছে সব কইয়া দিমু সাঈদ! তুমি আমার কাছে বহুত কতা লুকাইন্না শিক্কা গেছ। তুমারে বার বার কইরা বুজাইতাছি এইডা করো, ওইডা করো তুমি আমার কতা কানেই লইতাছ না। কালকা তুমার ছোডো ভাইয়ের বিয়া আর তুমি এহন নাবিলারে নামায়া দিয়া চুপচাপ যাইতাছ গা। এইডা কী তুমার খালার গুষ্ঠি ভালা চোখে দেখব? হ্যাঁ? কতা বুজো না আমার?

– যাদের চোখদুটো মানুষকে ছোটো করতে অন্ধ, তাদের কাছে মৃত্যুর মতো অজুহাতটাও মিথ্যা। এরা মৃত ব্যক্তির সামনে বসে বলবে এই লোক তো ঘুমের নাটক করছে। এই বিপজ্জনক মহিলাগুলো আমার সামনে আসলে কী বাজে অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন আপনি? আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না দীপের বিয়েতে ওর ষোলগোষ্ঠী উদ্ধার করে আমি অ প মা ন করি। আপনি আমাকে থাকাথাকির ব্যাপারে বুদ্ধি না দিয়ে দয়াকরে এর সিচুয়েশনটা ঠিক করে দিন।

কেটেকুটে খাপমতো উত্তরটা বসিয়ে দিয়ে কথার জালে ঠান্ডাভাবে ফাঁসিয়ে দিল সাঈদ। বেচারি সুফিয়া ঝাড়ি দিতে এসে নিজেই যেন কথার মারপ্যাঁচে আঁটকে গেলেন এবং চুপচাপ গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন ফিহাকে। সুফিয়ার হাতে কিছু টাকা, ফিহার ব্যাগ এবং দুটো ঔষুধের পাতা বুঝিয়ে দিয়ে শেষ কথাটুকু বলল সাঈদ,

– মাথা ধুয়ে, শরীর মুছিয়ে এই ক্যাপসুল দুটো খাইয়ে দিবেন। আপনার আপা জ্বরের কারণ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আমার ভুলে এমনটা হয়েছে। ওর ঘাড়ে দোষ চাপাতে যাবে না একদমই। অফিসের কাজ শেষ করে কাল বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে আসব, আর না আসলে বিয়ের দিন বিয়ে খেয়ে চলে যাব। আমার জন্য আশা রেখে বসে থাকবেন না। গেলাম।

গাড়ির দরজা বন্ধ করার শেষ সেকেন্ডগুলোতে সুফিয়ার কাঁধে নিষ্পলক চোখে তাকিয়েছিল সাঈদ। হুঁশহীন মুখটা একটাবারের জন্য দেখতে চেয়েও দেখতে পারেনি। চুলে ঢেকে রয়েছে চোখ, নাক, ঠোঁট ও থুতনি। বুকভরা দমটা ছেড়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চোখের পলকে গাড়িটা বেরিয়ে গেল হুঁশ করে। যতদূর পর্যন্ত পেছনের লাল বাতিদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকে গেলেন সুফিয়া। ঠিক তৃতীয় তলার দক্ষিণদিকের জানালায় আরো একটি নির্ঘুম মানুষ সেই যাওয়াটা চুপ করে দেখছিল। আলকাতরার মতো রাতের অন্ধকারে বহুদূর পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে করছিল কালো ক্যালিনান গাড়ির টকটকে লাল বাতিদুটো। দু’চোখ ভরে দৃশ্যটুকু দেখতে দেখতে হঠাৎ কে যেন ঘুম ঘুম স্বরে পাশ থেকে ডেকে উঠল,

– এ্যাই ফিমা, ঘুমাবে না তুমি? এখনো জানালা ধরে বসে আছ?

.

ভাঙাচোরা পথ, কিছুটা শহর থেকে দূর, হর্ণে ভরা শব্দ থেকে মুক্ত একটা জায়গার নাম শাহ আলম বাড়ি। যদিও জায়গাটার এমন অদ্ভুত নাম শুনলে কিছুটা ভাবনায় পড়তে হয়, তবে গাজীপুর চৌরাস্তা পেরিয়ে এমন সুন্দর একটা নিরালায় পৌঁছলে চোখের সামনে সবকিছু আরাম আরাম অনুভূত হবে। রোকসানা কাদিরের পাকা বাড়িটা শহরের মধ্যে হলেও কিছুটা মফস্বলের দিকে পড়েছে। চারিদিকে ঠান্ডা একটা আবহাওয়া এবং সবসময় সবুজে ঘেরা শব্দহীন পরিবেশ রূপে অনেকের কাছেই প্রশংসা পেয়ে এসেছে। তিনতলা বিল্ডিংটার চারতলা পর্যন্ত ছাদ দিয়ে রাখা এবং প্রতিটি তলা ভাগ করেছে নিয়েছে দীপের বাবা-সহ দুই চাচা। আজ সকাল থেকেই চারতলার ছাদ দেওয়া জায়গাটায় হলুদের প্যান্ডেল বসানো হচ্ছে। লোকজনদের হৈ হুল্লোড় করা আওয়াজে আস্তে আস্তে দু’চোখ খুলে সামনে তাকাল ফিহা। সকাল সাড়ে নয়টায় সূর্যিমামা ২৯° তাপমাত্রায় আলো বিকিয়ে নতুন দিনের জানান দিচ্ছে। প্রথম ক’মিনিট বুঝতে পারল না ও আসলে কোথায় আছে এবং কার বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছিল। থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকতেই গতকালকের ঘটনা, জমকালো নবীনবরণে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামা, চারটার জায়গায় সাড়ে তিনটায় কলেজ ছুটি হয়ে টানা ছয়টার কাছাকাছি বৃষ্টিতে বসে থাকা, এরপর ঝামটি দিয়ে কিছু কথা শুনিয়ে গাড়িতে উঠা পর্যন্ত স্মরণে আছে। এরপর আর কিছু মনে নেই। গায়ে জ্বর নেই যদিও; তবে ছেড়ে যাওয়া জ্বরটা ওর শরীর থেকে অনেকখানি শক্তি নিয়ে চলে গেছে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে লক্ষ করল সামনের টেবিলটার উপর ওর মোবাইল ফোনটা চার্জ হচ্ছে। কিন্তু সাইডব্যাগ থেকে চার্জার বের করে কে ওর ফোনটা চার্জে বসিয়ে দিল? মা করেছে এটা? মা কী এখন ছোটো খালামনির বাড়িতে এসে পড়েছে? উঠে গিয়ে দুর্বলপায়ে ফোনটা নিয়ে এসে বিছানায় বসে অন করল ফিহা। লক খুলে ফোনটা সচল করতে দেরি, এক লহমায় ভোঁ ভোঁ করে উন্মাদের মতো ফোনটা অসংখ্য নোটিফিকেশনে কাঁপতে লাগল। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে দেখল প্রতিটা নোটিফিকেশনের উপর ‘ মিসড্ কল, মিসড্ কল, মিসড্ কল ‘ উঠে শেষমেশ ফোনটা হ্যাং মেরে গেছে। ক্ষ্যাপাটে কুকুরের মতো গোঁ গোঁ সেরে একটু স্বাভাবিক হলে ছোট্ট করে লেখা শব্দটুকু দেখল, Missed call from – Sayeed . . . (132) . ধড়াস করে খাঁচায় বন্দি হৃৎপিন্ডটা কেঁপে উঠলে হাত থেকে ফোনটা ছেড়ে দিল ফিহা। গতকাল দুপুর তিনটা চব্বিশ থেকে পাঁচটা চল্লিশ পর্যন্ত একশো বত্রিশটা কল দেখে থমথমে মুখ নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। এতোক্ষণ যে ব্যাপারটা একেবারেই খেয়াল করেনি, লক্ষ করেনি নিজের গায়ে এটা কী জড়িয়ে আছে, তা দেখে ফিহা বিস্ফোরণ চাহনিতে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। খালামনির কিনে দেওয়া এই মেরুন রঙের শাড়িটা কখন পড়ল? গতকাল সকালে যখন ভূতুড়ে কাণ্ডের মতো এটা আলমারি থেকে উধাও হয়ে গেল তখন তো তন্নতন্ন করে কোথাও খুঁজে পায়নি এটা! তার মানে গাড়ির ব্যাকসীটে যে শাড়িটা ও পড়েছিল এটা ছিল খালামনির শাড়ি। এই শাড়িটা তবে ওই লোকের গাড়ির ভেতরে লুকানো ছিল এবং উদ্দেশ্য ছিল ফিহা এটা পড়তে না পারুক! কী সাংঘাতিক! কী ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপার!

– নাবিলা উইঠা গেছ তাইলে? আহো হাতমুখ ধুইয়া সবাইর লগে দেহা করো। তুমার মা ইট্টু আগে জান্নি কইরা পৌঁছাইল। এহন তুমারে খুঁজতাছে কিন্তু। আহো।

পেছন থেকে প্রৌঢ়া সুফিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে সংবিৎ ফিরে পায় ফিহা। হতভম্ভ ভাবটা মুখ থেকে মুছে নিয়ে আলগোছে বলল,

– জ্বী। মাকে বলুন আমি হাতমুখ ধুয়ে দশ মিনিটের ভেতর আসছি। আপনি যান।

– আইচ্ছা, দেরি কইরা না তুমি। তাড়াতাড়ি আইয়ো কিন্তু।

হেসে কথা বলা সুফিয়া যদি একবার দেখতে পেতেন ফিহার মুখটা কী পরিমাণে স্তব্ধ হয়ে আছে, তবে তিনি অনুমান করতে পারতেন ভুলটা আসলে কোথায় হয়েছে। রাতে শাড়িটা যদি বুদ্ধি করে পালটে দিতেন তিনি, তবে এই সুক্ষ্ম চালাকিটা ধরতে পারতো না কেউই। কাপড়ের ব্যাগটা খুলে যখন ফিহা জামাকাপড় বের করছিল, ঠিক সেসময় দরজা দিয়ে ঢুকল আরেকজন ব্যক্তি। তার ক্ষিপ্র পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায় ফিহা। বড়ো বোনের অমন পাষাণমূর্তি দেখে প্রশ্ন করার আগেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো সাবিলা হক ফিমা। মুখভর্তি রাগটা দমন করে গনগনে ক্ষোভে হুঁল ফুটিয়ে বলল,

– রাত বারোটার পর নির্লজ্জের মতো কীভাবে বাড়িতে আসছিস? ভেতরে লজ্জা করে নাই? আমাকে জোর গলায় বলিস ছেলেবন্ধু নিয়ে ঘুরাঘুরি না করতে, আর নিজের বেলায় ঠিকই ষোলআনাটা বুঝে চলিস? কেলেঙ্কারি একটা না ঘটালে তোর কলিজা ঠান্ডা হবে না? মাকে আমি বলব?

গুণে গুণে ক’বছরের বড়ো যদি ফিমা না হতো, তবে ওর মুখের উপর চটাশ করে এক চ ড় বসাতো ফিহা। রাগে ওর দুর্বল শরীরটা ঝিমঝিম করে কাঁপলেও হঠাৎ ফিহার আত্মাটা যেন ছটফটিয়ে উঠল! ফিমার পেছনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে জমে গেল ফিহার মুখ। দৃষ্টি হয়ে গেল স্থির, নির্বাক, ভয়ংকর ভাবে স্তব্ধ!

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here