#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৭ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
বুকের ভেতর বুঁদবুঁদ করে জেগে উঠা ভয়, শঙ্কা, দুরাশা সবকিছু কেমন অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। একটা মেয়ে এখান থেকে আর কতদূরই-বা যেতে পারে? ফাঁকা, সুনশান, গা ছমছম করা রাস্তায় একটা মানুষও নেই, নেই কোনো যানবাহনের টিকি বা রিকশাওয়ালার চেহারা। আজ শহরের অবস্থা এমন বিদঘুটে কেন? আকাশে থেমে থেমে ঝিলিক দিয়ে উঠছে দিনের মতো ফর্সা অদ্ভুত আলো এবং তা সেকেন্ডের মধ্যেই চারধার কাঁপিয়ে তীব্র হুঙ্কারে ফেটে পরছে নিস্তরঙ্গ শহরের বুকে। ঝুমবৃষ্টির ভেতর শান্ত শোণিত চোখদুটি ডান থেকে বামে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারও সবক’টা দোকানের নীচে, টংয়ের আশেপাশে নীরব চক্ষুর অভিযান চালাল। কিন্তু ফলাফলের অবস্থা তখনো শূন্য রয়ে গেছে। গায়ে লাল টকটকে শাড়িটা জড়িয়ে কোথায় বসে থাকতে পারে তা সে জানে না, তবু অবচেতন মনের কাছে বাঁধা পড়ে ডানদিকের রাস্তা বরাবর হাঁটা দিলো সে। মিনিট দুয়েক হাঁটতে হাঁটতে একটি পরিত্যক্ত, চালচুলোহীন আবছা অন্ধকার রেস্টুরেন্টের কাছে থামলেও খেয়াল করল না একটু দূরে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে! যেই পা ঘুরিয়ে ফিরতি পথে হাঁটা দিবে এমন সময় তার শিকারিসুলভ ভয়ংকর ঠান্ডা চোখদুটো পায়ের কাছে কয়েক টুকরো ভাঙা কাঁচের চুড়ি এবং মুকুট থেকে খুলে পরা একটি দুমড়ানো মুচড়ানো লাল গোলাপের ফুলটা দেখতে পেল। এটা কী ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনার কুলক্ষণ নাকি রাগের বশে কিছু একটা করে ফেলেছে? ওইটুকু আলামত দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবার কথা, কিন্তু তা না হয়ে বরং শান্তভঙ্গিতে কানে গুঁজা ছোট্ট ডিভাইসটা ক্লিক করলো সাঈদ,
– সাইনবোর্ড এরিয়ার আশেপাশে আপনাদের ডেরেক ফার্নান্দেজ স্যারকে পঁয়ত্রিশ মিনিটের ভেতর আসতে বলুন। অ্যাকুরেট চল্লিশ মিনিটের কাছাকাছি আর-আর সেভেন-সিক্স কালো মডেলটা ব্লু-এইচ দোকানটার কাছে থামবে।
– জ্বী স্যার এখুনি বলে দিচ্ছি। স্যার আপনার সাথে একটা কথা ছিল। আপনার জন্য স্পেশাল কফির লিমিটেড এডিশনটা একটু আগে এসে পৌঁছেছে। আমি কী আপনার কফিটা ডকে রেখে দেব?
– দরকার নেই। ওটা শেল্ফের পাশে টেবিলের উপর রাখুন। আমি না আসা পর্যন্ত কাইন্ডলি ওতে হাত লাগাতে যাবেন না।
স্পষ্ট সুরে কথাগুলো উচ্চারণ করতেই কান থেকে বস্তুটা খুলে ফেলে পকেটে পুড়লো সাঈদ। মাটি থেকে আলামতগুলো তুলতে তুলতে তার মসৃণ কপালের ঘমার্ক্ত চামড়াটা ক্রমশ কুঁচকে যেতে লাগল। মুখের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে দু’চোখ বিস্ফোরণ ভঙ্গিতে আঁটকে গেল। কাঠের পরিত্যক্ত বেন্ঞ্চির উপর পা তুলে হাঁটু মুড়ে প্রচণ্ড শীতে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে ওইটুকু দেহ। পড়ণের লাল টকটকে সুন্দর শাড়িটা বৃষ্টির পানিতে ন যযৌ ন তস্থৌ হয়ে ভয়ংকর অবস্থা! আঁচলের শেষ অংশটা দিয়ে যেভাবে নিজের ওইটুকু দেহটা মুড়ে তিরতির করে কাঁপছে তা দেখে আর একটা মূহুর্তও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ওর একহাত সামনে গিয়ে থামতেই বুকের সবটুকু রাগ, খেদ, আকাশসম চিন্তাকে একত্র করে দিয়ে কাটাকাটা স্বরে বলে উঠল সাঈদ,
– ফোন বন্ধের ব্যাপারে আমি কিছুই বলব না। না আমার কিছু বলার আছে। এইটুকু বায়বীয় জ্ঞান অবশ্যই এক্সপেক্ট করেছিলাম একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসুক এবং আমাকে জানানো হোক আমি ঠিক আছি। এই ছোট্ট কাজটা করার পেছনে দুই মিনিট খরচ হতো, কিন্তু কাজটা কেন জানি ম্যাডাম করেননি।
সাঈদের কথা বলার ধরণে উনুনের মতো আগুন ঝলসে উঠলেও বুকের বাঁপাশ জুড়ে তখনো তার ভয় মাখানো ফলাটা কামড় বসিয়ে আছে। হৃৎযন্ত্রের পেশি কতটা উন্মত্ত আচরণ করছে তা শার্ট খুললে বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব। অন্যদিকে, নত করে রাখা মাথাটা উপরের দিকে তুললে একজোড়া রক্তাভ চোখের ফোলা ফোলা চাহনিটুকু ছুঁড়ে দিলো ফিহা। ঠান্ডায় ওর নরম তুলতুলে ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে উঠলেও তীব্র আক্রোশ ফুটিয়ে বলল,
– আপনার মতো ভয়ংকর মিথ্যাবাদী লোক আর কখনো আমার সামনে অধিকার ফলাতে না-আসুক। আগে জানলে কখনোই আপনার অপেক্ষা করতাম না! আপনি একটা —আপনি একটা পা. ষ ণ্ড। আজকের পর আর কখনো আমার সামনে আসবেন না!
কঠিন বাক্যগুলোর নীচে ফুটে উঠেছে একজনের প্রতি দাউদাউ করা অভিমানভরা ক্রোধ, আর সেই ক্রোধিত চোখের মায়াটুকুতে আঁটকে রয়েছে ঠান্ডা নীরস চাহনি। ফিহা কোলের সাইডব্যাগটা কাঁধে তুলে গাড়িতে যেয়ে বসলে, বসার আগে মাথার মুকুটটা একটান দিয়ে খুলে ফেলে রাস্তা বরাবর ছুঁড়ে মারলো। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে গাড়ির দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিলেও শখের ক্যালিনান গাড়ির ব্যথা দেখে আজ তার মালিক কিছুই বলল না। ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো দৃশ্যটুকু তার দৃষ্টিগোচর হলেও সাঈদের পালটা মেজাজের ঝড়টুকু আহত, নীরব, গর্জনহীন বাঘের মতো নিস্তেজ হয়ে রইল। গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে যখন এসির পাওয়ারটা বন্ধ করে দিচ্ছিল, তখনো তার বাঁপাশ থেকে ফোঁপানো শীতে কাতরানোটা দেখতে পাচ্ছিল সাঈদ। কিন্তু কীভাবে ওর শরীর থেকে সবটুকু কষ্টকণা শুষে নেবে তা পুরুষালী চিন্তা থেকে ভাবতে পারছে না। যে পন্থায় অমন ঠান্ডা দেহকে উষ্ণত্বের চাদরে মুড়ে দেয়ার নিয়ম রয়েছে সেটা কোনোভাবেই এই মূহুর্তের জন্য খাটাতে পারবে না সে। কিংবা, খাটানোর মতো সুশীল পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি তাদের মাঝে। নতুবা, গাড়িটা সাইডে পার্ক করে পেছনের ডেকি থেকে নিজের এক্সট্রা শার্ট, ওভারসাইজ টিশার্ট এনে পরিয়ে দিতো ওকে এবং ঘণ্টাখানেকের জন্য নিজের বুকটার মধ্যে ওম দিয়ে রেখে দিতো। সঙ্গে আলগোছে খাইয়ে দিতো দুটো জ্বরের ক্যাপসুল। এরপর সারা রাস্তা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এলেও সকালের দিকে জ্বরটা ছেড়ে দিতো অনায়াসে। ফিহা দু’হাতে শরীর কুঁকড়ে, পা মুড়িয়ে জানালা বরাবর মুখ রেখে চুপ করে চেয়ে আছে। দুর্বল, শান্ত, ফুলে উঠা চোখের কোল জুড়ে ভরে ভরে উঠছে ছলোছলো অশ্রু। শরীরটা শীতের জন্য দুলে দুলে উঠলে ওর চোখভর্তি অশ্রুগুলো টুপটুপ করে ঝরে পড়ল। ডানপাশ থেকে সুদৃঢ় কণ্ঠটা আবারও ফিহার জন্য বলে উঠল,
– সময়মতো না পৌঁছালে একটা লোক মিথ্যাবাদী হয়, নাকি যেটা হয় সেটা আনপাংচুয়েল ইস্যু?
দু’কানে স্পষ্ট কথাটুকু শুনলেও না শোনার ভান করে চুপ থাকল ফিহা। জানালার কাঁচে ফুটে উঠা লাল লাল চোখের অভিমানী মুখটার দিকে চেয়ে বলে উঠল,
– কথা দিয়ে কথা না রাখা ব্যক্তিরা মিথ্যাবাদীর সমতুল্য। মিথ্যাবাদীদের কাছ থেকে শতভাগ, শতহাত, শত মাইল দূরে থাকা উচিত। তাদের অকপটে বলা মিথ্যাগুলোর জন্য নিজেকেই খুব ছোটো মনে হয়। মনে হয় আমি না-জানি কতটা তুচ্ছ। হয়ত তুচ্ছ বলেই তারা আমাকে এভাবে অপমান করল। গতকাল স্যার আপনাকে কথায় কথায় একটা সত্য কথা বলেছিল, সেই সত্য আমি এখন বুঝতে পারছি। আপনাদের মতো হাই ইনফ্লুয়েনশিয়াল ব্যক্তিদের কাছ থেকে মূল্য পাওয়া আসলে মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই তো বেলা চারটা থেকে পৌণে ছয়টা পর্যন্ত অমন অপেক্ষা করিয়েও আপনার মুখে একটাবারের জন্যও স্যরি ফুটেনি। আসলে, কিছু বলার নেই আমার। দ্বিতীয়বারের মতো অপমানিত হয়ে নিজেই লজ্জায় পরে গেছি। আমি এসব ভুলব না।
শেষের বাক্যগুলোতে ওর শান্ত স্বরটা স্বাভাবিক রইল না। গলার কাছে কুণ্ডলী পাকানো কান্নাটা ওর নিঃশ্বাস আঁটকে ভীষণ যন্ত্রণাই দিলো ওকে। শুনতে শুনতে সাঈদের স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটো ঢিলে হয়ে আসলে আস্তে আস্তে গাড়িটা থেমে গেল পাশে। হঠাৎ জানালার বাইরে স্থির অবস্থা দেখে মুখটা ডানে ফেরাল ফিহা, দেখল, ওই মানুষটা ওর দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। গাড়ির ভেতর বাড়তি কোনো আলো নেই; তবে ল্যাম্পপোস্ট থেকে আসা ফিনফিনে হলুদ আলোয় দেখতে পেল মানুষটা সিটবেল্ট খুলছে। সে কী ফিহার কাছে এসে, ওই মাদক ভরা চাহনি ছুঁড়ে, তার দেরি করে আসার কারণটুকু বলবে? বলবে যে অমুক একটা ভয়ংকর কাজে আঁটকে যাওয়ার ফলে আমি সময়মতো আসতে পারিনি? মনে মনে অদ্ভুত এই ইচ্ছাটা পোষণ করলেও ফিহা জানে না কেন সে এটা চাইছে। কেন চাইছে লোকটা তার সুন্দর ঠোঁটদুটো নাড়িয়ে এইবার সত্যিটুকু বলুক। কিন্তু না, বলল-ই না। গাড়ি থেকে ছাতাসহ বের হবার আগে কেমন খরখরে গলায় বলে উঠল,
– চেন্ঞ্জের জন্য ব্যাকসীটে গেলে ভাল হয়। চার-পাঁচ ঘণ্টার লম্বা জার্নিতে ভেজা কাপড়ে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ না। যা প্রয়োজন তা রেখে দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে সামনের সীটে আসার প্রয়োজন নেই।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলা শেষে বিপরীত রাস্তার একটি দোকানের কাছে চলে গেল সাঈদ। খালি গাড়ির ঝিম ধরানো অন্ধকারে ওভাবেই কিছুক্ষণ পড়ে রইল ফিহা। হাত-পা তুলে কাপড় বদলানোর মতো শক্তিটুকু তিলতিল করে ফুরিয়ে আসছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতদুটো আঁচল থেকে বের করে বহুকষ্টে ব্যাকসীটে যেয়ে পৌঁছল। ডানদিকের নরম গদিতে একটা ছোটো হাতার ব্লাউজ দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগল। তবু ব্যাপারটা কী ওর জ্বরের জন্য অনুভব হলো কি না জানে না, তবে সেখানে একটি শাড়ি রাখা দেখে আপাতত ওই সম্বলটুকুই অদক্ষ হাতে গায়ে মুড়ে নিলো। বাইরে থাকা মানুষটিকে ‘কাজ শেষ’ ইঙ্গিতটুকু বুঝিয়ে দিতেই সীটের উপর পা তুলে বাঁদিকের জানালা ঘেঁষে কুঁঁকড়ে রইল ফিহা। পিঠের উপর আঁচল টেনে ছোট্ট খোলসের মতো সংকুচিত হয়ে কাঁপতে থাকলে এমন সময় গাড়িতে অচেনা, অজানা, ঘ্যাটঘ্যাট কণ্ঠে কাকে যেন বলতে শুনলো,
– হায় ঈশ্বর! এই অধমের উপর এত বড়ো পাপটা চাপিয়ে দিবেন না। এটা সত্যি যে আমি চার্চে ছিলাম। এখন সামান্য এইটুকু জিনিসের জন্য এমন করলে আমি হার্ট হতে বাধ্য। আমি আমার দায়িত্বজ্ঞান থেকে এটুকু করতে চেয়েছি এছাড়া আর কিছুই না।
– আপনার চার্চে থাকাটা প্রয়োজন ছিল। আগে জানলে অন্য কাউকে আসতে বলতাম।
এবার শেষের কণ্ঠটা শুনে বুকভরা স্বস্তি পেল ফিহা। কিন্তু শারীরিক স্বস্তিটা ওকে স্বাভাবিক থাকতে দিলো না। হাড়গোড় ভেঙে আসার মতো তীব্র বেদনায় জর্জরিত হয়ে চোখ বুজে প্রায় নেতিয়ে পড়ল। মাতাল মাতাল একটা ঘোরের ভেতর অনুভব করল ওর পাশে বোধহয় মা বসে আছে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে শাষনের সুরে বলছে,
– এইবার বিছানায় পরে শত আঃ উঃ করলেও তোমার জ্বর সারাতে আসব না। আমাকে তোমরা পেয়েছ কী? কাজের বেটি? সারাদিন তোমাদের সেবা-যত্ন করতে করতে এক পা কবরে ঢুকিয়ে ফেলব, তাও তোমাদের কলজে ঠান্ডা হবে না — তা হবে না, তা হবে না। আজকে তোর বাপ্ আসুক। জ্বরের ঔষুধ আনলে জানালা দিয়ে ফিক্কা মে রে দিব। স্কুল থেকে আসার সময় যেই ফূর্তিটা করে ভিজে ভিজে আসছস না, আজকে মজাটা বুঝবি না।
তবু মা শিউরের কাছে বসে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রাটা পারদ স্কেলে না কমে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্ঘুম চোখদুটো নিয়েই বসে থাকে মা। মাঝরাতে যখন কাঁপুনি দিয়ে তাপমাত্রা বাড়ে, তখন ফিহা দাঁত কটকট করতে করতে ঘুমের ঘোরে মাকে বলে, “শীত করছে মা। কাঁথা দাও।”। আজও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করে অমন ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ভেতর বলে উঠল ফিহা, “আমার শীত করছে মা। কাঁথা দাও।” অবস্থা দেখে চমকে উঠার জায়গায় ভ্রুঁদুটো কুঁচকে রইল মানুষটা। সীটের একেবারে কোণার দিকে ছোট্ট একটা পুটলি হয়ে এদিক বরাবর পিঠ দিয়ে বসে আছে ও। আস্তে করে একধাপ এগিয়ে যেতেই ওর কানের কাছে মৃদুস্বরে ডাকল,
– নাবিলা,
ফিহা ঘুম ঘুম স্বরে জ্বরের ঘোরে বলল,
– হুঁ।
– কাঁথা নেই।
এমন নৈর্ব্যক্তিক উত্তর শুনে আবারও ঘোরের জগতে ডুবে যায় ফিহা। যখন বাসায় মোটা লেপটা বাদে সবগুলো পাতলা কাঁথাই ওর গায়ে দেওয়া হয়ে যায়, তখন মা নিরুপায় হয়ে ডেকে আনে বাবাকে। বাবা সারাদিন বেগার খাটুনি খেটে এলেও মাঝরাতে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে গিয়ে ফিহার পায়ে তেল মালিশ করতে লেগে যান। চুলা থেকে গরম করে আনা সরষে তেলে মেয়ের নরম পায়ের তালুদুটো বাবা পরম স্নেহে যত্ন করে মালিশ করে দেন। যেন মেয়ের বরফের মতো ভয়ংকর ঠান্ডা পাদুটো গরম হয়ে যাক। সে সুস্থ হয়ে উঠুক। মা ভ্যাপসা গন্ধযুক্ত লেপটা অসুস্থ মেয়ের গায়ে চাপাতে সাহস করে না। ছোটোবেলায় যেভাবে বুকে জড়িয়ে মায়ের ওম ওম গন্ধে সন্তানকে আগলে নিয়েছে, তেমনিভাবে জ্বরাক্রান্ত মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মাও ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। জেগে থাকেন শুধু বাবা। বাবা ঘুমান না। মা-মেয়েকে এ ঘরে রেখে বড়ো মেয়েকে দেখে আসার জন্য চলে যান। ফিহার এখনো মনে হচ্ছে তার শরীরে বোধহয় ওম ওম কিছু জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যা থেকে নিঃশ্বাসের সাথে সাথে অনুভব করছে পুরুষালী দেহের মাতাল মাতাল করা ঘ্রাণটা। ঠান্ডা পায়ের তালুতে অনুভব করছে গরম একজোড়া হাতের যত্ন করে ছুঁয়ে দেওয়া মালিশ। ফিহা আড়মোড়া ভেঙে নড়াচড়া করতে চায় কিন্তু দেহের ভেতর ঘাপটি মারা জ্বরটা তাকে তাচ্ছিল্য করে বুড়ো আঙুল দেখায়। হঠাৎ সেসময় মনে হলো পিঠের উপর থেকে ওম ওম দেয়া আরামের কাঁথাটা কেউ সরিয়ে ফেলেছে। ভেজা চুলের জন্য মাথাব্যথায় চিলিক দিয়ে উঠলে ফিহা চোখ খিঁচড়ানো পীড়ায় মৃদুসুরে বলল,
– মা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। ফিমা আপু কাঁথা নিয়ে গেছে।
মেয়ের প্রলাপ শুনে মা চোখ মেলে তাকালে মুখটা কঠিন করে নাক ফুলায়। দুটো চোখ রাঙানি দিয়ে বড়ো মেয়ে ফিমার উদ্দেশ্যে ঝাঁজ মাখিয়ে বলে,
– তুই ওর গা থেকে কোন সাহসে কাঁথা সরাতে গেলি? এক্ষুণি আমার হাতে দে বলছি। আমার সাথে নাফরমানী করলে একদম ভালো হবে না ফিমা। কাঁথা ফেরত দে।
মাঝরাতে বাথরুমের জন্য উঠতে গিয়ে মাকে প্রায়ই ছোটোবোনের কাছে আবিষ্কার করে ফিমা। তার ছোটোবোন যে স্কুল থেকে আসার সময় ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অসুখ করে এনেছে এটা তো বোকা, গাঁ. ধা, নি. ষ্ঠু. র মা বুঝেই না। মায়ের প্রতি রাগ দেখিয়ে অশ্রুভরা চোখ নিয়ে ওখানেই কাঁথা ফেলে ছুটে যায় ফিমা। এরপর সকাল থেকে মায়ের শুরু হয় বড়োমেয়ের রাগ ভাঙানোর যুদ্ধ। আজ জ্বরের ঘোরে শৈশবের এমন আবোলতাবোল স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে কেন? কেন মনে হচ্ছে জ্বরের মতো এই অসুখটা মৃত্যুর মতো স্বাদ পাইয়ে দিচ্ছে? আবারও আড়মোড়া ভেঙে আগুনের মতো গরম শরীরটা নড়াচড়ার চেষ্টা করল ফিহা, কিন্তু কেন যেন মনে হলো একটা নরম স্পর্শ ওর কান ছুঁয়ে গেছে। আচ্ছা এটা কেন মনে হলো দুটো নরম ঠোঁটের স্পর্শ-ই ওর কান ছুঁয়ে বলে গেছে? যেন ফিসফিস স্বরে কেউ বলেছে,
— “শেষবারের মতো স্যরি। আর হবে না। ”
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : আমার জট পাকানো মাথাটা এবার একটু স্বস্তি পেল। মাথায় এক মণ চিন্তা, একঝাঁক চাপ নিয়ে লেখাটা একদমই এগোচ্ছিল না। কী যে কঠিন অবস্থায় পড়েছিলাম. . . তবে আলহামদুলিল্লাহ্, এবার স্বস্তি। পর্বটা পড়ে আমার স্নেহের মানুষগুলো অবশ্যই মতামত জানাবেন। আমি ব্যাকুলভাবে সকলের মন্তব্যগুলো পড়ার অপেক্ষায় আছি। জলদি করুন . ❤