নির্মোচন পর্ব ১৬

0
838

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_১৬ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

দুরুদুরু করে কেঁপে উঠা বুকের বাঁপাশের যন্ত্রটি আবারও অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে। এসির সুশীতল হাওয়ায় ঠান্ডা অনুভব করলেও ফিহার ভেতরের অবস্থা শান্ত, প্রকৃতিস্থ নয়। কোলে পরে থাকা সাইডব্যাগটির ভেতর যে বস্তুটি ওকে অস্থির করে তুলেছে, সেই “আমি আসব” কথাটির দরুন ভেতরটা ঝড়ো বাতাসের মতো উচাটন হয়েছে খুব। পাশ থেকে আফসানা সরল গলায় খাঁকারি দিয়ে বললেন,

– তোর কী শাড়িঘটিত ব্যাপারটার জন্য মন খারাপ বুড়ি?

সীটের বাঁপাশে বসা ফিহা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে খালামনির দিকে ফিরল,

– না তো। শাড়ির মতো তুচ্ছ জিনিসের প্রতি মন খারাপ করে লাভ আছে কোনো? আমার বান্ধবী বলে, মন খারাপ করতে হয় মানুষের প্রতি। জিনিসের প্রতি না।

সহাস্য ভঙ্গিতে হেসে দিয়ে ফিহার হাতটা পরম আদরে কাছে টেনে নেন আফসানা। নিজের দু’হাতের মুঠোয় ছোটো হাতটিকে জড়িয়ে ধরে চোখভরা হাসিতে বলে উঠলেন তিনি,

– এতোকিছু কী করে চিন্তা করিস তোরা? তোর মাকেও তো কখনো এমন করে বলতে দেখিনি। তোর বয়সে যদি আমারও এই ধরণের বাস্তব-জ্ঞান থাকত তাহলে জীবনের শক্ত, কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার আগে বহুবার আমি ভাবতে পারতাম। পারিনি। এখন এই বয়সে এসে জীবনের হাবভাব আর যোগ-বিয়োগগুলো সঠিক ফলাফল দিতে পারে না।

– বাস্তব জ্ঞান শব্দটা যদি ম্যাচিউরিটি বুঝিয়ে থাকে, তবে আমি ম্যাচিউর হইনি খালামনি। রাস্তায় শুয়ে থাকা একটা অসহায় ছেলেকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম ও কী করে একটা শক্ত রাস্তায় ঘুমাতে পারে, ঘুমাতে কোনো কষ্ট হয় কিনা। সে আমার প্রশ্নে মুচকি হাসি দিয়ে এমন সব উত্তর দিয়েছিল খালামনি, যা আমাকে পরবর্তী দু’দিন স্বস্তির ঘুমে ঘুমোতে দেয়নি। অথচ, পিচ্চিটার বয়স ছিল মাত্র সাত। সে আমার কাছে চমৎকার কিছু ফুল বিক্রি করতে ভুখা পেটে এসেছিল। তিনদিন ওর ছোট্ট পেটে পানি ছাড়া কিছুই পরেনি।

এই পর্যায়ে আফসানা চুপ করে বোনঝির দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু। হাতের মুঠোয় থাকা ছোটো হাতটিতে হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ ঢেলে চুমু খেলেন। কেন জানি বুকের ভেতরটা বোবা কান্নার মতো কিছু একটা বিঁধে বিঁধে আসছিল। আর কোনো শব্দ খুঁজে না পেয়ে বাকী পথটুকু ওভাবেই ফিহার হাতটাকে জড়িয়ে ধরে নানা অবান্তর চিন্তায় ডুবে থাকলেন আফসানা। কলেজ গেটের কাছাকাছি গাড়িটা থামিয়ে দিতেই এবার মুখ খুলে হাসি দিলেন একটু,

– বান্ধবীদের সাথে জমিয়ে আনন্দ-ফূর্তি করে সাবধানে চলে যাস। আমি সব কাজ সেরে আগামীকাল তোর খালুর সাথে বিয়েবাড়িতে ঠিক পৌঁছে যাব। কোনো সমস্যা বা প্রয়োজন হলে সরাসরি আমাকে কল দিবি, মনে থাকবে কথা?

– মনে থাকবে। তুমি আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। সবকিছু শেষ করে দ্রুত খালুকে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যেয়ো। আমি এখন যাই খালামনি? ওরা সবাই ডাকছে।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, যা। আমি কিন্তু বারবার তোকে বলে দিচ্ছি কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল দিবি। কোনো দ্বিধা করবি না। সাবধানে যা।

জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফিহার শেষ প্রস্থানটুকু মিলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত চোখ ভরে ভরে দেখতে লাগলেন আফসানা। ড্রাইভারকে বলে গাড়ি ঘুরিয়ে যাত্রা করলেন চিরচেনা সেই ব্যস্তমুখর অফিসের পথে। ঠোঁটের তৃপ্তির হাসি, আর চোখজুড়ে খেলা করছে কাঁথা বোনা নানা স্বপ্ন।

নবীনবরণ নিয়ে সদ্য কলেজে উঠা প্রতিটি নবাগত শিক্ষার্থীর মনে প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে। সবুজ ঘাসে মোড়া বিশাল মাঠটির শেষপ্রান্তে বড়োসড়ো একটি দৃষ্টিনন্দন স্টেজ সাজানো। সেই স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং কলেজের সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ নিয়ে ছোটোখাটো বক্তৃতা দিচ্ছেন মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ। একঘেয়ে সেসব বক্তৃতার ফাঁকে চিপসের পাঁচটি প্যাকেট খুলে পাঁচজনের মধ্যে ভাগবন্টন দ্বারা নীচুস্বরে চুটিয়ে আড্ডা চলছে। সেই আড্ডার মূল বিষয়বস্তু “ব্যাডা মানুষ সারাদিন ফ্লার্ট কইরা রাতে বলব মুভ-অন করতে পারে নাই। এইসব বলার মানে কী!” , অথচ এই অমূলক কথাটার আসল মানেটা কী সেটাই এতক্ষণ যাবৎ বুঝতে পারছে না ফিহা। এদিকে নিয়মশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা রোভার স্কাউট, রেন্ঞ্জার ইউনিট এবং বিএনসিসি’র দলটা একটু পরপর ওদের দলটাকে চুপ থাকার জন্য ব্যর্থ ওয়ার্ণিং দিয়ে যাচ্ছে, তবু ওদের ফিসফিসানি গুরুত্বপূর্ণ বাকবিতণ্ডা তাতে একচুল বাঁধা পাচ্ছে না। সুবর্ণা বুকভরা দম্ভ নিয়ে বিজ্ঞের মতো বলল,

– ছেলেরা কী জীবনে একটা মেয়ে নিয়ে পোষাইতে পারছে? সব ছেলেরা নি. র্লজ্জ, ফা. জিল, একেকটা চূড়ান্ত লেভেলের ছ্যাঁ. চড়া। নাহলে কেউ তিন বছরের রিলেশন ভুলে ভার্সিটির কচি মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করতে যায়?

সাফা মুখ ঝামটা মেরে সরাসরি কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল,

– তোর হেনতেন জান্টুস ভালো না বইলা সব ছেলেদের তুই কোন্ লজিকে এক ভাবতে যাস? তোর বাঁধন যে কোন্ ক্ষেতের মূলা ওইটা কী কেউ জানে না? সাইধা সাইধা বাঁশ খাইতে যাও আর বাঁশ খাওয়ায় দিলে ছেলেদের দোষ! ফাতরামির জায়গা পাও না, না?

– আশ্চর্য! এই কথা দ্বারা কী বুঝাতে চাস! বলতে চাইছিস আমি ইচ্ছে করে চয়েজেব্যাল ব্যাপারটা ভাবতে চাই না?

– তোর মধ্যে চয়েজেব্যাল ব্যাপারটা থাকলে তো ভাববি! আগেই পছন্দ করছস একটা গা ন্ঞ্জু ট্টি রে। আর এখন সব পোলাপানরে ওই গা ন্ঞ্জু ট্টি রে দিয়া মাপতে আসছস। আরে তোর বাপ-ভাইয়ের দিকে একবার তাকায়া দ্যাখ! আঙ্কেল কী তোরে ভুলেও কোনোদিন চ ড় লাগাইছে? লাগায় নাই। অথচ, তুই-ই আমাদের সেদিন বললি বাঁধন তোরে পাবলিক প্লেসে থাডায়া এক চ ড় মা. র ছে। এখন দোষটা কার? বাঁধনের? নাকি তোর খাচ্চর মার্কা চয়েসের? হুদাই একটা ছেলেরে দিয়া সব ছেলেদের নির্লজ্জ বইলা ফালালি।

– যা সত্য তা নিয়ে বলা কী ভুল?

– অবশ্যই ভুল না। কিন্তু তুই কথাটাই বলছস একশো পার্শেন্ট ডাহা মিথ্যা। আজাইরা লজিক বানায়া বানায়া তুমি পুরুষজাতিরে ব্লেইম দিবা, আর ঘরে গিয়া “পাপা কী প্রিন্সেস” সাইজা নাটক করবা তা তো চলব না খালাম্মা। তোমার আব্বা যেই ধাতুতে তৈরি, বাকী আট-দশটা পুরুষও ওই সেম ধাতুতে গড়া ভদ্রঘরের সুসন্তান। শুধু শুধু মাছির মতো ভনভন করা লুই. চ্চা পোলাপানদের জন্য তুমি কোন্ আক্কেলে সবাইরে মাপতে যাবা? কলেজে উঠছ এখন, নিজেরে “বড়ো বড়ো ভাব দেখাইতাছ”, তাও নিজের চিন্তাভাবনা এমন নিব্বা-নিব্বিদের মতো রয়ে গেছে কেন? আপগ্রেড করাইতে পারো না?

বাকী তিনজন নীরব দর্শক মুখে চিপস ঢুকিয়ে মুচুরমুচুর শব্দে বাকবিতণ্ডা দেখে চলেছে। একজন নিজের প্রেমিককে দিয়ে পুরো পুরুষজাতিকে “অবান্ঞ্চিত” বলে দাগ কেটে দিচ্ছে, অপরজন নিজস্ব কিছু যুক্তি দ্বারা প্রতিটি ফালতু উদ্ভট কথাকে মাটির সাথে ফা লাফা লা করে মিশিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি একজন দক্ষ রেফারির মতো ব্যাপারটা ঠান্ডা করে বলল,

– তোরা থামবি! এইবার তো থাম! সেই কখন থেকে একই টপিক নিয়ে চুইংগামের মতো লম্বা করে যাচ্ছিস! আমাদের “থান্ডার-ফাইভ” টিমের চার নাম্বার রুলসে কী ছিল? যতকিছুই হোক — কখনো আমাদের ভেতর থার্ড পার্সনের আলোচনা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করা যাবে না। তাহলে এখন চার নম্বর নিয়মভঙ্গের জন্য তাসনিম সাফা এবং সূর্বণা দত্তকে শাস্তিস্বরূপ বাগানবিলাস রেস্টুরেন্টে ট্রিট দেওয়ার আদেশ দেয়া হলো। চুপচাপ দুইটায় মিলে আগামী মাসের এই তারিখে ওই রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিবি। ন্যাকামি শুরু করলে এইবার তোদের মুখ ভেঙে কঠিন জবাব দেব!

ইলার তর্জনী তুলে কট্টরভাবে বলা দেখে পুরো চারজনই স্তব্ধ অবস্থা ভেঙে হোহো হাসিতে ফেটে পড়ল। তারা খেয়ালই করল না স্টেজ থেকে ফিন্যান্স বিভাগের একজন শিক্ষক তখন স্পিচের লাইন ভুলে গিয়ে কটমট চোখে ওদের পাঁচজনের অবস্থা দেখছে। শেষমেশ ফিহার জোড়াজুড়িতে সবাই সেখান থেকে উঠে নিরিবিলি একটা গাছতলায় গিয়ে দুপুরের খাবারটুকু নিয়ে বসলো। সাফা বাদে বাকী তিনজন নিজ নিজ ব্যক্তিগত পুরুষের সাথে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পরলে ফিহা একটু দূরে বসে খাবারটা খেতে শুরু করল।

– গতকাল কী নিয়ে অস্থির হয়েছিলি বন্ধু? আমাকে কথাটা বলা যায় না?

মুখে লোকমা পুড়তে গিয়ে এমন প্রশ্ন শুনে আবারও একই উত্তর দিলো ফিহা,

– মেয়েদের তো মাঝেমাঝে মুড সুইং হয় বন্ধু। ধরে নে আমারও রাতে ওরকম কিছু হয়েছিল।

– ধুত! আমি ওসব কথা বিশ্বাস করি না। তুই আমাকে খুলে বল, গতকাল দিন থেকে রাত পর্যন্ত এমন কী হয়েছিল যার জন্য তুই খাপছাড়া গোছের কথাবার্তা বলছিলি। কেউ কিছু বলেছে তোকে?

– কিছু হলে আমি নিজেই তোকে সব খুলে বলতাম বন্ধু। কিছু হয়নি। খাওয়া শুরু কর।

সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়ে পরার দরুন খিদেয় প্যাকেটের খাবারটুকু পর্যাপ্ত বলে মনে হচ্ছে না। তবু সেটা এতটুকু বুঝতে না দিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছিল ফিহা। মাথার উপর কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল টুকটুকে ফুলের ছাদ, পায়ের নীচে নরম নরম কচি সবুজ ঘাস, সূর্যের তাপীয় অবস্থা একটু একটু করে বদলে গিয়ে আবহাওয়া এখন বৃষ্টির আদলে রূপ নিচ্ছে। দিনের আলোটা থোকা থোকা মেঘের নীচে হারিয়ে যেতেই সাফা কেমন চমকে উঠে বলল,

– বৃষ্টি হবে নাকি? আকাশটা হুট করে এমন কালো করল কেন? কীরে! আমাদের অনুষ্ঠান কী তাহলে বৃষ্টির কবলে ভাটা পড়ল?

ফিহা খাবার চিবোতে চিবোতে মুখ তুলে আকাশের পানে হঠাৎ বদলে যাওয়া রূপটুকু দেখল। যদিও এখন গ্রীষ্ম শেষে বর্ষার ঋতু চলছে, লাগাতার বৃষ্টি হবার ঘোর মৌসুম, তবু আজকের জন্য বৃষ্টিটা কী ফিহার আনন্দের জন্য একটু ক্ষান্ত দেওয়া যেত না? হঠাৎ সাফা অদ্ভুত ধরণের একটা প্রশ্ন করে উঠল,

– এই বউ বউ রঙের লাল টকটকে শাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ দেখেছে তোকে?

গলায় খাবার আঁটকে যাবার মতো খুক খুক কাশিতে চমকে তাকাল ফিহা। বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে অনুচ্চস্বরে বলল,

– এমন অদ্ভুত কথা বলছিস কী জন্যে?

– আমি যতটুকু জানি তোর বড়ো খালামনির বাসায় তোর একটা ভাই আছে। যেই ভাইয়ের সাথে তোদের মাখো মাখো টাইপ সম্পর্ক নেই। তুই যে ওই বাসা থেকে এই সাজে বেরিয়েছিস তোর সেই ভাই কোনো কমপ্লিমেন্ট দেয়নি?

ফিহার মনেহচ্ছে সাফার চোখে কিছু না কিছু ধরা পরেছে বলেই এমন একটা ভয়ংকর প্রশ্ন করেছে ও। তাছাড়া এটা সত্যি যে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ওই লোকটা ওকে চুপ করে উপর থেকে দেখছিল, কিন্তু মানুষটা সবসময়ের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করে তেমন কিছুই ওকে প্রশংসাসূচক বলেনি। খাবারের খালি বাক্সটাতে হাত ধুতে ধুতে ফিহা প্রত্যুত্তর করে বলল,

– তুই যেটা ভাবছিস উনি ওরকম মাইন্ডের মানুষ না বন্ধু। খালামনির সাথে ফোনে ফোনে আমার যোগাযোগ থাকলেও বাকী সদস্যদের সাথে কখনো আমার ওরকম সম্পর্ক হয়নি। হ্যাঁ এটা সত্যি যে খালুর সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক আছে; সেটাও নানাবাড়িতে গিয়ে যখন একা হয়ে পরেছিলাম ঠিক সেসময়কার কথা। আজ সেই ঘটনা প্রায় দেখতে দেখতে চার বছর গেছে গেছে। এখন সব স্মৃতি।

পানির বোতলটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে ফিহার চোখের দিকে চাইল সাফা। মানুষের ঠোঁট, মন, মস্তিষ্ক চতুরভাবে মিথ্যা বললেও চোখ কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। নিজের প্রাপ্ত উত্তরটুকু বুঝে নিয়ে সাফা বোতলের ক্যাপ লাগাতে লাগাতে বলল,

– ওই দিনের পর তোরা আর নানাবাড়িতে যাসনি, তাই না? দেখাও করিসনি কেউ কারোর সাথে?

– নানাবাড়িতে নানা-নানী না থাকলে আর কীভাবে যাই বল্? ওই দুটো মানুষ দুনিয়ার বুক থেকে ছিটকে যাওয়ার পর সবগুলো পরিবার একে একে আলাদা হয়ে গেছে। আমি খুব অল্পবয়সেই আমার নানাবাড়িটা হারিয়ে ফেলেছি বন্ধু। এভাবে হারিয়ে ফেলার করুন যন্ত্রণা আজীবন আমার বুকটার মধ্যে শূন্যতা নিয়ে থাকবে।

বলতে বলতে ভারি নিঃশ্বাসটুকু সশব্দে ছেড়ে দিতেই মনের গহিণ বনে বুনো জন্তুর মতো কিছু স্মৃতির দলেরা হানা দিলো। আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় শুক্রবারে যে বয়স্ক ব্যক্তিটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলে যান, তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল পুরো তিন তিনটে পরিবারের শেকড়। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে সেই সকালবেলা ঘরভর্তি মানুষের শোকাহত ধ্বনি, উঠোনে স্টিলের খাটিয়ায় শোয়ানো ‘ নানুভাই ‘ ডাকা মানুষটার ঠান্ডা, নিষ্প্রাণ দেহ এবং মাটির তিনহাত ঘরে দাফন করে আসার পর সেই থমথমে করুন অব্যক্ত এক পরিবেশ। এরপর আর কিছু মনে করতে পারে না ফিহার স্মৃতির ঝুলি। হয়ত মনে করতে চায় না পিছনে ফেলে আসা সেইসব কালরাত্রির ঘটনা।

.

পকেটের লেফট সাইড থেকে কার্ডের মতো বস্তুটি বের করে দরজার ডানদিকে থাকা ছোট্ট বক্সে স্পর্শ করল সাঈদ। এরপরই দরজাটা খুলে গিয়ে তার জন্য অল্প একটু ফাঁক হয়ে আনলক হলো সেটা। বাঁহাতের কালো ডায়ালের ঘড়িটা তিনটে বিশের দিকে নির্দেশ দিচ্ছে এবং তাকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে এখুনি রওনা দেওয়া আবশ্যক। দ্রুত পার্কিং সেকশনে পৌঁছে যেতেই সেখানকার দারোয়ান তাকে সমীহ কণ্ঠে বলল,

– আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। স্যার কী চলে যাচ্ছেন এখন?

– জ্বী।

– যাওয়াটা কী আর্জেন্ট? বাইরের অবস্থা বেশি ভালো না স্যার। এই অবস্থায় গাড়ি চালানো খুব রিস্কি।

কপালের মসৃণ চামড়ায় চিন্তার কিছু ভাঁজ পড়ল সাঈদের। গলাটা ওভাবেই শক্ত রেখে প্রশ্ন করল একদফা,

– অফিস থেকে ডেরেক সাহেবের গাড়ি বেরিয়েছে?

– না স্যার। ডেরেক স্যারও আপনার মতো গাড়ি নিয়ে বেরোনের সাহস করেছিলেন, কিন্তু বৃষ্টির এই তাণ্ডব দেখে ভয়ে উনি আর গাড়ি নিয়ে যাননি। এই বৃষ্টির মধ্যে আপনি গাড়ি চালাতে পারবেন না স্যার। আপনি এখন উপরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। বৃষ্টি একটু কমার গতি দেখলে আমি নীচ থেকে আপনাকে ইন্টারকম করে খবর পাঠিয়ে দিব।

দুপুর তিনটে বাজলেও বাইরের চেহারা খুবই বীভৎস হয়ে আছে। এটা ভালো লক্ষণের পরিচয় দিচ্ছে না মোটেই। ঝড়োবৃষ্টির ঝাপটায় একহাত পর্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে আর অন্যদিকে হাতেও খুব একটা সময় নেই। কোনোপ্রকার কথাকে তোয়াক্কা না করে চট করে গাড়িতে চড়ে বসলো সাঈদ,

– সামনের গেটটা কী করে ক্লিয়ার করবেন আপনি জানেন। ওদের প্রত্যেককে বলে দিন আমি গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছি। রাস্তায় কোনোপ্রকার ব্যারিকেড যেন না থাকে, সাবধান।

বলেই গাড়িটা একচান্সে বেদম গতিতে ছুটিয়ে পার্কিং সেকশনটা ছাড়িয়ে ফেলল সাঈদ। বৃষ্টির মধ্যে শাঁই শাঁই গতিতে ছুটতে গাড়ির জন্য অদূরে থাকা বড়ো বড়ো দুটি গেট দু’পাশ থেকে দ্রুতগতিতে হাঁ করে খুলে যাচ্ছে। গাড়ির ওয়াপিং সিস্টেমটা জোরে জোরে বৃষ্টির ছাঁটগুলো ডানে-বামে সরিয়ে দিতেই সামনের ঝাপসা সদৃশ অবস্থার ভেতর চূড়ান্ত ঝুঁকিতে গাড়ি ছুটাল সে। বাঁকানে গুঁজে রাখা ছোট্ট ব্লুটুথ ডিভাইসে ক্রমাগত ফিহার বন্ধ ফোনের সিগন্যাল পেয়ে আসছে। এটা বৃষ্টির জন্য নেটওয়ার্কজনিত সমস্যা, নাকি রাগ করে ফোনটা বন্ধ করেছে এটা অনুমান করতে পারছে না। এই প্রথম নিজের কোনো অসংলগ্ন কর্মকাণ্ডের প্রতি চরমভাবে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। শক্ত স্টিয়ারিংয়ে পরপর দুটো হিংস্রাত্মক ঘুষি কষিয়েও ঢাকার পানি জমা রোডে একঘণ্টা যাবৎ তখনো আঁটকে রইল সাঈদ। চারপাশ থেকে সব গাড়ির ইন্ঞ্চিন প্রায় বন্ধ হলেও জ্যাম কখন ছাড়াবে সে বিষয়ে বলতে পারছে না কেউই। মোবাইলটা বের করে যেই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ কলটা বসাতে নিবে ঠিক তখনই গোঁ গোঁ শব্দে চারধার অস্থির হয়ে উঠল। একপলকের ভেতর আবারও দুটো সবল হাত স্টিয়ারিংয়ে উঠে চরম একটা উত্তেজনার ভেতর একেকটি গাড়িকে টেক্কা দিয়ে, চাতুরি করে, সাইড কেটে পাক্কা চল্লিশ মিনিটের মাথায় ঝুম বৃষ্টির ভেতর কলেজ গেটের কাছাকাছি এসে থামল। কিন্তু আফসোস, কলেজ গেটটা বন্ধ হয়ে আছে এবং পৌণে ছয়টায় দিকে কোনো শিক্ষার্থীকে সেখানে অপেক্ষারত অবস্থায় দেখতে পেল না সাঈদ! বুকটা তীব্র আশঙ্কায় কেমন ভয়ংকর ছোবলে কামড় দিয়ে উঠল,

“কোথায় গেল? এখনো তো বাসায় ফিরেনি! তাহলে . . .? ”

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here