#নির্মোচন .❤
#পর্বসংখ্যা_১৫ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
ধুরন্ধর চালাক এবং কুটিল বুদ্ধিসম্পন্ন এই মানুষটি দিনকে দিন চিন্তার বাইরে চলে যাচ্ছে ফিহার। হাতের মুঠোয় ছোট্ট চিরকুটটি নিয়ে বড়ো আশ্চর্য হয়ে শেষপর্যন্ত আর রুম থেকে বেরোল-ই না। অন্যদিকে সোফায় বসা সাঈদের শান্তসুলভ চোখদুটো দোতলার ঠিক ডানদিকের দরজাটায় পর্যবেক্ষণ সেরে শেষপর্যন্ত আগন্তুকের দিকে শক্তকণ্ঠে বলে উঠল,
– অসমাপ্ত কথাটা শেষ করুন মাস্টার মশাই। আপনাকে বসিয়ে বসিয়ে কফি খাইয়ে আমার ব্যস্ত স্ক্যাজিউলের সময়গুলো নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আমার মধ্যে ধৈর্যের স্কেলগুলো যথেষ্ট খারাপ এবং জঘন্য। তাই অযথা আমাকে অধৈর্য বানিয়ে নিজের জন্য বেনামি বিপদ ডেকে আনবেন না। শুরু করুন।
মুখ নিঃসৃত প্রত্যেকটি বাক্যে মৃদু ক্ষোভটা প্রকাশ পেলেও কর্তৃত্বের মতো দৃঢ় আদেশটা ফুটে উঠেছে সাঈদের। ইয়াসিন এখনো জানে না কেন এই লোকটার সামনে প্রচণ্ড নার্ভাস হওয়ার পাশাপাশি ঠান্ডা একটা আবহাওয়াতেও কুলকুল করে ঘাম দিচ্ছে। ইয়াসিন শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে কথার ফুলঝুঁড়িটা খুলে দিলো ভয়ে ভয়ে,
– আমাকে ভুল বুঝবেন কিনা জানি না তবে আপনাকে এমন জায়গায় দেখেছি যেখানে কিনা ভদ্রঘরের ছেলেপেলেরা যায় না। তাই জায়গাটার নাম উচ্চারণ করতে একটু দ্বিধায় ভুগছি . . .
কফি বানাতে থাকা শান্ত চোখদুটো একপলকের জন্য থমকে গেলেও সেটা একচুল বুঝতে দিলো না জুনায়েদ সাঈদ। নিজেকে ভয়ংকর ভাবে ঠান্ডা রেখে চরম শান্ত গলায় বলে উঠল,
– বলতে যদি সমস্যাই হয় তাহলে আপনার উচিতই হয়নি টপিকটা তোলার। আপনি জানেনই না প্রোফেশনালিজ্যম কাকে বলে এবং কখন, কোথায়, কী ধরণের টপিক তুললে সঠিক প্রশ্নের অ্যাকুরেট ইনফো পাওয়া সম্ভব। আপনি যতক্ষণ ধরে কথাটা প্যাঁচিয়ে যাচ্ছেন ততক্ষণে আমার কাছ থেকে যোগ্য জবাবটা পেয়ে চুপচাপ বিদায় হতে পারতেন।
আবারও সেই আগুন ঝলসানো কথার নীচে চাপা পরে খাক হয়ে গেল ইয়াসিন মাহমুদ। মুখের কথা জিভ দিয়ে বেরোনোর পূর্বেই তা পেটের ভেতরে তালগোল পাকিয়ে কামড় দিচ্ছে প্রচুর। একটা লোক কীভাবে এতোটা নির্দয়ের মতো পাষাণ হয়ে ঠান্ডা কৌশলে অপমান করতে জানে? ইয়াসিন যে একজন শিক্ষক এবং তাকে যে গুরুতুল্য সম্মান দিয়ে চোখ নীচু করে কথা বলা উচিত এটা কী এই অভদ্র লোক জানে না? ইয়াসিন সুক্ষ্ম ক্রোধটা আড়াল করে নিয়ে ঠান্ডাভাবে বলল,
– আপনি মানুষটা অন্যরকম এটা আপনার কথা দ্বারাই বুঝতে পারছি। বাট আমার উপরে ক্ষেপে যাওয়ার মূল কারণটা কিন্তু এখনো বুঝতে পারলাম না।
সোফার বুকে পিঠ হেলিয়ে দাম্ভিক ভাবে পায়ের উপর পা তুলে বসল সাঈদ। কফির ধোঁয়া উঠা পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
– বোঝার তো কথা। আপনার মতো হেঁয়ালি করে তো বলছি না।
– আমি এখানে আপনার কাজিনকে পড়াতে এসেছি সাঈদ সাহেব। অন্য কোনো ইনটেনশন আমার ছিল না। আমার সাথে কেন এই ধরণের শক্ত আচরণ দ্বারা অসম্মান করে চলছেন সেটা আমি আসলেই বুঝতে পারছি না।
– শিক্ষক যদি স্টুডেন্টের ভেজা পোশাকের দিকে ক্ষুধার্ত শকুনের মতো তাকিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ওই শিক্ষকের প্রতি সম্মান কাজ করার কথা না। তাও আমার বাড়িতে, আমার সামনে, আমার-ই রিলেটিভের দিকে! ছাড়টা কোথায় পাচ্ছেন বুঝতে পারছেন তো মাস্টার মশাই?
গলার কাছে বিশ্রীভাবে দম আঁটকে আসার মতো ভয়ংকর অবস্থা হলো ইয়াসিনের। তৎক্ষণাৎ সে উপলব্ধি করতে পারল এখনই ইস্তফা না দিলে বড়ো ধরণের বিপদ হবে। বাজপাখির মতো গুণাগুণ এবং নেকড়ের মতো পৈশাচিক হিংস্রতা নিয়ে এই লোক যেভাবে পাশার ডান খেলে যাচ্ছে সেখানে দুই মিনিট অপচয় করা মানেই ঝুঁকি! কাঁপা কাঁপা হাতে কফির হ্যান্ডেলটা ধরে বড়ো একটা চুমুক দিলো কফিতে, এবং বুঝতে পারল কফিটার স্বাদ অত্যন্ত সুস্বাদু ধরণের মজা। দুর্ধর্ষ খারাপ পরিস্থিতির কবল থেকে বাঁচানোর জন্য কয়েক মিনিটের মাথায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় জানাতে উদ্যত হলো ইয়াসিন। রেইনকোটটা গায়ে গলিয়ে হাসতে হাসতে অতি তুচ্ছ একটা কারণ দর্শিয়ে বলল,
– আজ যেতে হচ্ছে মিস্টার। ফিহাকে যেহেতু পড়াচ্ছি না তাই বাসায় গিয়ে সিভির ইর্ম্পট্যান্ট কাজগুলো দেখতে চাচ্ছি। আপনাকে অসময়ে এভাবে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আজকের এই মজাদার কফিটার জন্য ধন্যবাদ। আপনি কিন্তু চমৎকার কফি বানাতে পারেন। আজ আসি, আসসালামুয়ালাইকুম।
বুকের কাছে ভাঁজ করা হাতদুটো খুলে ফেলে ডানহাতটা করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলো সাঈদ। স্বভাবসিদ্ধ জলদগম্ভীর কণ্ঠে কেটে কেটে উচ্চারণ করল,
– এরপর থেকে কমন সেন্সটা হাঁটুতে না ফেলে ব্রেনে ঢুকিয়ে আসবেন। কারো পার্সনাল লাইফ নিয়ে অহেতুক আগ্রহ আপনার জন্য ভাল কিছু বয়ে আনবে না। আমি অত্যন্ত খুশি হব যদি আমাকে নিয়ে নির্লজ্জের মতো ঘাঁটাতে না-আসেন। মেইবি লাইফ ডাজেন্ট গিভ ইয়্যু অ্যা সেকেন্ড চান্স। ডোন্ট ব্রিং সাম ডেভাস্টেটেড সিচুয়েশন ফর ইয়্যুরশেল্ফ। ওয়াআলাইকুমসসালাম।
দু’চোখ ভর্তি রাগ, খেদ, অপমান মাখানো দৃষ্টি ছুঁড়ে শেষপর্যন্ত হাতটা হ্যান্ডশেক করল ইয়াসিন। কেন জানি আর একটি কথাও তার মুখ দিয়ে ঝরে পরলো না। ঝুম বৃষ্টির অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই মনে মনে শুধু একটি কথাই আওড়াতে লাগল — “ আপনি যে কোন্ লাইনের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রেখে চলেছেন, এ ব্যাপারে আপনার পরিবার কিছু জানে না। যদি আপনার ইতিহাস সম্বন্ধে একটু হলেও ফাঁস হয়ে যায় সেদিন আপনি ধ্বং. স! আজ আপনি যে হারে আমাকে অপমান করে কথাগুলো বললেন, তার একেকটি খুচরো হিসাব আপনার ক. লিজাটা টু. করো টুক. রো করে ছিঁ. ড়ে ফেলবে সাঈদ। সেদিন আপনি একজনের চোখে আজীবনের জন্য মৃ. ত. হয়ে যাবেন। ”
.
থাইগ্লাসের বুকে অসংখ্য বৃষ্টিফোঁটা এঁকেবেঁয়ে নামছে নীচে। রুমের লাইটটা আপাতত নিভিয়ে দেওয়া। চোখের সামনে ধূ ধূ করা অবিরাম বৃষ্টির ফোয়ারার সাথে রুমভর্তি অন্ধকারটা চমৎকার লাগছে। কেন জানি ফিহার মনে হচ্ছে ওর আগামী দিনগুলো খুব একটা ভাল যাবে না। আজকের এই ঝুমবৃষ্টির মতো পৈশাচিক কোনো ঘটনা সুযোগের সন্ধানে ওঁত পেতে আছে। বুকের ভেতরে ঘন কালো মেঘের মতো জমে উঠছে ভয়, আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে হৃদয়ের কোণে ব্যাকুল কোনো অস্থিরতা। কানদুটোতে নব্ মোচড়ানোর মৃদু শব্দ পেতেই ধীরপায়ে রুমে প্রবেশ করার শব্দটুকু পেল। মাথা ঘুরিয়ে দেখার ইচ্ছা হলো না কেন জানি, তাই পেছনে থাকা মানুষটির উদ্দেশ্যে জানালামুখো হয়ে প্রশ্ন করল ফিহা,
– স্যার চলে গেছেন?
প্রত্যুত্তর করল পেছনে থাকা মানুষটি,
– হুঁ।
জবাবটুকু শুনে আবারও প্রশ্ন করল ফিহা,
– রাতের খাবারটা এখন খাবেন নাকি পরে?
বড়ো অদ্ভুতকাণ্ডের মতো আর কোনো সাড়াশব্দ এলো না পেছন থেকে। পরপর দুই মিনিট অপেক্ষা করার পর আবারও একই প্রশ্নটা শুধিয়ে উঠল ফিহা,
– আপনি কী রাতের খাবারটা এখন খাবেন নাকি . . .
প্রশ্নটা করতে গিয়ে মাথা ঘুরাতেই শব্দগুলো ওখানেই আঁটকে গেল ওর। তাজ্জবের মতো দুই ভ্রুঁ কুঁচকে আবিষ্কার করল রুমে কেউ নেই। অর্থাৎ, মানুষটা ওকে এই রুম থেকে বেরোনের ইঙ্গিত দিয়ে নিজেই এখান থেকে সরে পরেছে। এরপর আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে রইল না। নিজের রুমে ফিরে দরজা চাপিয়ে মোবাইলটা নিয়ে বসলো ফিহা। সারাদিনে ঘটে যাওয়া এই অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনাগুলোর ভাবসম্প্রসারণ মিলাতে গিয়ে ভেতরটা কেমন শিরশির করে কাঁপছে। আচ্ছা সাফাকে কী একটা কল দিয়ে এই বিচিত্র, অদ্ভুত, কেমন-কেমন করা অবস্থাগুলোর ব্যাপারে এখুনি বলে দেবে? সঙ্গে সঙ্গে সাফার নাম্বারে ডায়াল বসাতেই কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কলটা রিসিভ হলো,
– কীরে ফিহা, কী খবর? কী ভেবে এখন কল দিলি? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
ফিহা বুকভর্তি দমটা সশব্দে ছেড়ে বলল,
– শোন্, এই মূহুর্তে যা যা বলব সব মনোযোগ দিয়ে শুনবি। কোনো কথা বলবি না। কথার মাঝে ইন্টারাপও করবি না। যা যা বলব সব সিরিয়াস ভঙ্গিতে শুনতে হবে, রাজী?
– ফিহা কিছু হয়েছে? তুই এমন ভঙ্গিতে কথা বলছিস কেন?
– জানি না। আমার খুবই অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা জিনিস দেখেও দেখছি না। কিন্তু সেটা যে কী, ওটাই বুঝতে পারছি না। আমি এই ধরণের সমস্যায় আগে কখনো পড়িনি। পড়লেও আমার মনে নেই। শর্ট টাইম মেমোরি লস হলে হতে পারে। কিন্তু আমার মধ্যে কেমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যেটা আমি ব্যাখ্যা দিতে পারছি না।
ফিহার বিচলিত কণ্ঠের অবস্থা শুনে ভেতরে ভেতরে কেমন ঘাবড়ে গেল সাফা। হুট করে ফিহার মধ্যে এই ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হলো কেন? নিজের চুল আঁচড়ানো বাদ দিয়ে ফিহাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– ফিহা, কোনো চিন্তা করবি না। আমি আছি। কী সমস্যা হয়েছে আমাকে সম্পূর্ণ খুলে বল। কোনো সমস্যা না হলেও যা যা ফিল হচ্ছে সেগুলোই প্লিজ বলতে থাক। তোকে ভিডিয়ো কল দিব? ভিডিয়ো কলে কথা বলবি?
– আরে না পাগল।
ফিহা বুঝতে পারল তার প্রাণপ্রিয় এই বান্ধবীটি প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় নিজেও বড্ড অস্থির হয়ে উঠেছে। অতোটা ভীতিপ্রবণ অবস্থা না বুঝিয়ে ফিহা হাসি দিয়ে বলল,
– টেনশন করিস না বন্ধু। অতোটা দুর্বল আমি নই। আজ কেন জানি সবকিছুতে অস্থিরতা খুঁজে পাচ্ছি। ঠিক যেমন বোর্ড পরীক্ষা দেবার আগের রাতগুলো হয়ে থাকে ওরকম কোনো টেনশন।
– ঠিক করে বল তো কী নিয়ে টেনশন করছিস? শাড়ি কিনে দেয়নি খালামনি? ফিহা, শাড়ির জন্য যদি মন খারাপ করে বসে থাকিস দোস্ত, তাহলে তুই এখনই শুনে রাখ আমার শাড়ি পরার ইচ্ছা এইখানেই খতম। আমি শাড়ি পরব না। তুই জামা পরে আয়, আমিও জামা বের করে ইস্ত্রি দিচ্ছি। সাজগোজের জিনিস সব আমার কাছে আছে, তুই আমার সাথে কলেজের অডিটোরিয়ামে বসে বসে সাজবি। বাকিদের ন্যাকামো, ঢঙ, তামাশা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। ওদের আমি সামলাব, আমি দেখব। তুই প্লিজ টেনশন ফ্রি হয়ে এখানে চলে আয়।
ফিহা বাকরুদ্ধ হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। কলের ডিউরেশন তিরতির করে বয়ে চললেও সাফার এতোখানি আন্তরিকতা মুখের ভাষা ছিনিয়ে নিয়েছে। ফিহা তো শাড়ির জন্য মন খারাপ করে বসে নেই। ওর মনটা আজ কেমন যেন অস্থির আচরণ করছিল বলে সাফাকে ব্যগ্র স্বরে কথাগুলো বলেছে। দীর্ঘক্ষণ এই নীরবতার পর সাফাই নিজ থেকে বলল,
– আমি নিশ্চিত এটা নিয়েই তুই মন খারাপ করে বসেছিলি। সামান্য এই তুচ্ছ শাড়ির জন্য তুই মন খারাপ করবি কেন? পৃথিবীতে মন খারাপের জন্য আর কোনো শক্ত কারণ খুঁজে নিতে পারলি না? এই যেমন, আমার সাথে তোর ভাইয়ের হুট করে কোমর বেঁধে ঝগড়া লাগলে প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। এগুলোকে বলে আসল মন খারাপ। ওইসব তুচ্ছ-ফুচ্ছ জিনিসের জন্য মন খারাপ করলে বেচারা মন খারাপকে আরো অপমান করা হয়। তখন মন খারাপ ব্যাটা চোখ উল্টিয়ে বলবে, ‘ আমাকে মানুষের পেছনে মূল্য না দিয়ে জিনিসের পেছনে গ্যাঁদাচ্ছিস কেন? মানুষ কী দুনিয়ায় অভাব পরছে? ‘ এবার বুঝছিস তাহলে ব্যাপারটা?
অতি নীচুদরের এমন যুক্তি শুনে ফোনের এপাশে খিলখিল করে হাসতে লাগল ফিহা। ইহজনমে এমন গোবেট চিন্তার কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ, তবু সাফাকে সায় জানিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
– আচ্ছা আচ্ছা, এভাবে তো ভেবে দেখিনি বন্ধু। তুই তো বন্ধু আমার চোখ থেকে পর্দা সরিয়ে দিলি। তবে বল তো একটা ব্যাপার। আমাদের যে হাসি, কান্না, ভালোলাগা, আবেগ, অস্থিরতা এগুলো কী সবসময় মানুষের জন্যই বরাদ্দ থাকা লাগবে? জিনিসের প্রতি এদের অনুভূতি কাজ করবে না?
– জীবনেও না। মানুষ না থাকলে জিনিসের কী মূল্য? জিনিস তো একটা মাধ্যম মাত্র। এখানে মানুষ আমাদের জন্য যেই অনুভূতি নিয়ে জিনিসটা দিয়ে থাকে ওইটা মূলত আসল কাজ। ধর্ আংকেল আর আমি দু’জনেই তোরে একবক্স করে কিটক্যাট চকলেট দিছি। এখানে কিটক্যাটটা হচ্ছে জিনিস এবং আংকেল আর আমি হচ্ছে মানুষ। এখন তোর কাছে চকলেটের ফিলিংসটা নির্ঘাত আংকেলেরটাই বেশি ভাল লাগব। কারণ, আংকেল আমার চাইতে তোর কাছে একটু বেশি মূল্যবান। সেইম কাজটাই যখন অতি কাছের মানুষ করে থাকে তখন ওই মানুষটার দেওয়া একটা সুঁতাও অনেক মূল্যবান। বুঝতে পারছস আমার কথা?
ফিহা ‘হুঁ’ বলে উত্তরটুকু দিল ঠিকই, কিন্তু ওর অবাধ্য মন দূর জগতে অন্যমনষ্ক হয়ে কিছু একটা হাতাপিতা করে খুঁজছিল। বোধহয় কোনো আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর, কিংবা মনের ক্যানভাসে থাকা পাজলের কোনো অবিন্যস্ত টুকরো।
.
ভোরের আলো ফুটে উঠতেই ধাম ধাম শব্দে কানদুটো যেন ফেটে যাবার জোগাড়। কপাল কুঁচকে উঠে ঘুম ঘুম চোখদুটো আলতোভাবে খুলে শব্দ উৎসের দিকে ভয়ংকর বিরক্ত নিয়ে তাকাল।
– ঘুমেরতে উঠো মাইয়া। ও নাবিলা? হুনতাছ নি তুমি? এহন দেরি করলে কিন্তু অনুষ্ঠানে যাইতে পারতা না। নাবিলা?
কুয়াশার মতো আস্তরণটা চোখের সামনে থেকে কেটে যেতেই ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো ফিহা। ঘড়ির দিকে সন্ধানী চোখদুটো নিক্ষেপ করতেই দেখল সকাল পৌণে সাতটা। তাড়াতাড়ি চুলটা হাতখোঁপা করতে করতে সুফিয়ার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে জানান দিল,
– উঠেছি খালা। আপনি ঝটপট নীচে যান। নীচে গিয়ে জলদি নাস্তাটা রেডি করুন। আমি দশ মিনিটের ভেতর আপনাকে ডাক দিব।
বহু জল্পনা-কল্পনা শেষে আজকের এই দিনটি নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করছে ফিহা। মোবাইলটা নিয়ে দেখল রীতিমতো চার বান্ধবীর মিসড্ কল উঠে আছে এবং সঙ্গে দুটো অ্যালার্মের বন্ধ করে রাখার অবস্থা। দ্রুত গোসলটা সেরে এসে যেই আলমারিটা খুলে ভেতরে তাকাল ফিহা, ওমনেই দু’চোখ বিস্ফোরিত করে ‘ইয়া আল্লাহ্! বলে এক বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল। পুরো আলমারির ওইটুকু অংশ পাগলের মতো তছনছ করে খুঁজতে লাগল শাড়ি। শাড়িটা গায়েবি ঘটনার মতো পুরো আলমারির চারধার থেকে সমস্ত রুম জুড়েই উধাও হয়ে গেছে। অপরদিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা আফসানা এরকম অলৌকিক ঘটনার কাহিনি দেখে সাতসকালে স্থির থাকতে পারছেন না। তাঁর বাড়িতে কী মোনালিসা সেই বিখ্যাত চিত্রকর্মের মতো ভূতুড়ে চুরির ঘটনা শুরু হলো নাকি? হাতে মাত্র আর একঘণ্টা সময় আছে রেডি হয়ে রওনা দেবার জন্য। এর মধ্যে কোথা থেকে তিনি মেয়েটার এমন খায়েশের জিনিসটি উদ্ধার করে আনবেন? আফসানা কোনো বাক্যব্যয় না করে সরাসরি নিজের সবচাইতে সুন্দর শাড়ি থেকে একটা শাড়ি পছন্দ করে বিছানায় রেখে বললেন,
– কোনো তর্ক করবি না। এখন হাতে সময় নেই তর্ক করার জন্য। খালামনি যেটা বের করে দিয়েছি ওটা পরেই তুই ঝটপট রওনা দিবি। হুঁ কাজ চালু কর্। দেরি করা যাবে না।
আফসানার কাঠ কাঠ কণ্ঠের আদেশসূচকে ফিহা কিছুই বলার ফুরসত পেল না। রেডি হবার জন্য উঠে দাঁড়ালে রুমে শশব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করলেন সুফিয়া। তাঁর হাতে নাস্তার ট্রের পাশাপাশি অপরহাতে হ্যাঙ্কারের মতো ঝুলিয়ে রেখেছে লাল টকটকে বস্তু। যার রাজকীয় রঙে চোখদুটো সম্মোহনের মতো আঁটকে যায়; ভেতরে ভেতরে কাজ করে রুচিশীল শৌখিনতার আকর্ষণ। সুফিয়ার হাতে ওই রাজকীয় লালের বস্তটি দেখে ফোনে কথা বলতে থাকা আফসানা ব্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
– এই জিনিস তুমি কোথা থেকে টুকে আনলে? এই শাড়ি তো আমার না!
সুফিয়া যেন মজা পাচ্ছেন এমন একটা হাসি দিয়ে বললেন,
– আমি কী একটাবারও কইছি এইটা আপনের শাড়ি? এইটা আমি কালকা নাবিলার লিগা মার্কেটের থিকা কিনছিলাম। এহন আবার জিগাইয়েন না কহন কোন ফাঁক দিয়া কিনছি। আপনে তো পুরা টাইম ফোনে কথা কইয়াই কুল পান নাই এই শাড়ি কিনোনের খবর জানবেন ক্যামনে? যাউক গা। এহন এইডা ভালায় ভালায় আজকা পইরা লাক। একদিন পরলে শাড়িত কিছু হইব না। লও,
বলেই ফিহার হাতে শাড়িটা ধরিয়ে দিয়ে মিটিমিটি ঠোঁটে হাসতে লাগলেন তিনি। এই হাসির অর্থ বুঝতে পারল না বোকা বনে যাওয়া ফিহা। খালামনির সহযোগিতায় পনের মিনিটের ভেতর সম্পূর্ণ রেডি হয়ে গেল ওই বেশভূষায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রথম নিজেকে অন্যবেশে অন্য রূপে দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল ফিহা। জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা হিসেবে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে শাড়ির খোলসে। হাতের কনুই অবধি ঢাকা লাল টকটকে ভেলভেটের ব্লাউজটি যেন ওর জন্যই একান্ত তৈরি করা। মাথার মধ্যখানে সিঁথি তুলে অল্পকিছু চুল মুখের উপর গালের দু’পাশে ঝুলছে। ঠোঁটে পরেছে লিপস্টিকের লালচে ছোঁয়া। সুন্দর দুটি নিখুঁত মায়াবী চোখে আইলাইনের সুক্ষ্ম সৌন্দর্যটুকু ফুটে উঠেছে আরো, মাথায় পরিয়ে দিয়েছে থোকা থোকা লাল গোলাপের কৃত্রিম মুকুটটুকু। নিজের হাতের দিকে চোখ বুলাতেই রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দগুলো তরঙ্গায়িত হলো, সেই শব্দে যেন মিষ্টি ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসির ঝিলিক। আফসানা ও সুফিয়া চুপটি করে ফিহার নীরব মূহুর্তটুকু মিটিমিটি হাসিতে উপভোগ করছিলেন এবং মনে মনে ভাবছিলাম নিজেদের মিষ্টি স্মৃতির কথা। আফসানা একধাপ এগিয়ে ফিহার পিঠ জুড়ে রেশমী ঝলমল চুলগুলো ছড়িয়ে দিলেন,
– জীবনে প্রথম যেদিন শাড়ি পরেছিলাম ওই শাড়িটা সেদিন আম্মা পরিয়ে দিয়েছিল। আজ আম্মা নেই। কিন্তু তোকে দেখে ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।
বুকভরা ভারি নিঃশ্বাসটুকু ছেড়ে দিয়ে চোখের কোণাটা আঙুলের ডগায় মুছলেন আফসানা। ঠোঁটে আনন্দের হাসি ফুটিয়ে বললেন,
– যা গাড়িতে গিয়ে বস্। আমি আসছি।
বুকভরা উচ্ছলতা নিয়ে রুম থেকে বেরোলেও ডানদিকের রুমটা দেখে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল ফিহার। কালরাত থেকে দরজাটা বন্ধ এবং ওই কফিম্যাট বয়ামটা আনতে যাওয়ার পর থেকে আর সামনাসামনি দেখেনি লোকটাকে। চুপচাপ জায়গাটা অতিক্রম করে বাড়ির বাইরে গিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়াল ফিহা। প্রভাতের মিঠে রোদে চারধার উদ্ভাসিত হয়ে চোখের কাছে দারুণ রোমান্ঞ্চকর লাগছে! এই ছোট্টখানি জায়গাটা কী অদ্ভুত! পাখির কলকাকলি মেশানো কিচিরমিচির ডাকগুলো শুনে চোখ বুজে ফেলেছিল ফিহা, ঠিক তখনই ওর কানে স্টিলের গায়ে ‘টকটক’ শব্দ করার মতো আওয়াজটুকু মনোযোগ কাড়ল। চোখ খুলে অস্থিরভাবে এদিক-সেদিক তাকাতেই এবার দ্বিতীয়দফায় একই শব্দটা শুনতে পেয়ে উপরে তাকায় ও। বারান্দায় থাকা সাদা টিশার্ট পরা এলোমেলো চুলের ব্যক্তিটি থেমে থেমে তার কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। ফিহা আহাম্মকের মতো হতবুদ্ধি হয়ে ঠোঁট ফাঁক করে তাকিয়ে রইল। ওই মাদকের মতো ঠান্ডা চাহনিদুটো কী প্রখর, স্থির, বৈদ্যুতিক স্পর্শের মতো তুখোড়! ফিহা দুটো মুঠোয় শাড়ির আঁচলটা খামচে ধরতেই উপর থেকে ছিঁটকে এলো প্রশ্ন,
– ছুটি কয়টায়?
ওই ধারাল চোখের আকৃষ্ট চাহনিতে বাঁধা পরে ফিহা শান্ত গলাতে জবাব ছুঁড়ল,
– চারটায়।
হঠাৎ সেসময় আফসানাকে কথা বলতে বলতে বাইরে আসতে দেখে আর দাঁড়িয়ে থাকল না ও। চট করে গাড়িতে উঠে বসতেই কোলের ফোনটা বিপ্ বিপ্ করে নোটিফিকেশন দিয়ে উঠল,
— “ আমি আসব। ”
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : পরীক্ষার মতো দীর্ঘদিনের রণযুদ্ধ এবং পরিবারের কিছু খায়েশ মিটিয়ে আবারও হাজির। তবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়েছে এতো লম্বা একটা গ্যাপ দেবার জন্য। এতে অপেক্ষা করার মতো কঠিন ব্যাপারটা সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক, আমি এর জন্য ভীষণভাবে দুঃখিত। আশা রাখছি সকলের অপেক্ষারত মনটি আবারও প্রাণ প্রফুল্লতায় সজীব হয়ে উঠবে। আমার হৃদয়ঙ্গম স্নেহ . . . ❤