নিভৃত কুহক শেষ পর্ব

0
1008

#নিভৃত_কুহক (পর্ব ১০)

মে, ২০২২

১.
মুনিয়া ডেস্কে রাখা টেবিল ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছে। মে মাসের ৩০ তারিখ আসতে আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। রেহনুমা নামের সেই মেয়েটার বিয়ের উনিশ বছর পূর্তি। যে কি না অমন অদ্ভুত একটা বিয়ের কার্ড বানিয়েছিল। আচ্ছা, মেয়েটার চোখে আরিফ নামের ছেলেটা যে মায়া দেখেছিল সেটা এখনও আছে? বিশ্বাস হয় না। এই যে সাব্বির, সেদিন রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোল, ভেবেছিল ও ঠিক হয়ে গেছে। ক’দিন বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু এখন আবার আগেরমতোই। ইদানিং ওর বিজনেসটাও ভালো যাচ্ছে না, বলছে গাড়ি বিক্রি করে দেবে। কথায় কথায় বলে, ‘এই পৃথিবীতে সবাই বেইমান।’

মুনিয়া ঠিক বুঝতে পারে কেউ হয়ত ঠকিয়েছে, তাই সেদিন রাতে ওর কাছে আশ্রয় খুঁজেছিল ক্ষণিকের জন্য। আসলে মায়াটা ভেতর থেকে আসতে হয়, যেটা ওর জন্য নেই।

একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মুনিয়া এবার বিয়ের কার্ডের নিচে দেয়া মোবাইল নম্বরটা বের করে। নম্বরটা ক’দিন আগেই মিস কল দিয়ে চেক করেছিল ওদের টিম, সচল আছে। আজ ও কথা বলে সময়টা চেয়ে নেবে।

ফোনটা হাতে নিতেই মুনিয়ার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। মনে মনে গুছিয়ে নেয় ও, তারপর ফোনটা করে। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না। মুনিয়া শক্ত করে ফোন কানে চেপে ধরে আছে, হার্টবিট বাড়ছে ক্রমশই। ফোনটা কেটে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে একজন রিসিভ করে, ভারী গলায় বলে, ‘কাকে চাচ্ছেন?’

মুনিয়া নিঃশ্বাস চেপে বলে, ‘আমি আজাদ প্রোডাক্টসের গুলশান ব্রাঞ্চ থেকে মুনিয়া বলছি। আপনার ফোন নম্বরটা একটা বিয়ের কার্ড থেকে পেয়েছি, আরিফ রেহনুমার শুভবিবাহ। বিয়ের কার্ডে উল্লেখ করা তারিখ অনুযায়ী সামনের ৩০ মে ওদের উনিশ বছর পূর্তি হবে। আমদের কোম্পানির পক্ষ থেকে একটা শুভেচ্ছা জানাতে চাই। আপনি কি ওদের ঠিকানা দিতে পারবেন? আর আপনার পরিচয়টাও যদি দিতেন।’

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো কথা শোনা যায় না, তারপর নরম গলায় লোকটা বলে, ‘আমি ওই বিয়ের কার্ডের আরিফ। আপনারা সত্যিই এমন শুভেচ্ছা জানান?’

মুনিয়ার বুক চলকে ওঠে, এই সেই আরিফ! সত্যি সত্যি মানুষটাকে খুঁজে পেল, তাও এত সহজে! এখনই জানতে ইচ্ছে করছে রেহনুমার কথা, ওদের মায়ার কথা। নিজেকে সামলায়, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, এটা আমি শুরু করেছি। আপনি ঠিকানা দিলে আমিই আসব। আমার খুব ইচ্ছে রেহনুমার সাথে কথা বলার, আপনাদের দেখার।’

ওপাশ থেকে আরিফ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কেন বলুন তো?’

মুনিয়া উৎসাহের সাথে বলে, ‘আপনাদের বিয়ের কার্ড দেখেই মনে হয় একটা মায়ার গল্প আছে আপনাদের। আমি সেই গল্পটা শুনব, যদি বলেন।’

ওপারে একটা দীর্ঘ নীরবতা, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘আচ্ছা, তাহলে ওইদিন বিকেলেই চলে আসুন। আমি ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

ফোনটা রাখতেই মুনিয়া টের পায় ও উত্তেজনায় কাঁপছে। ভাবা যায়, উনিশ বছর আগের এক মায়াময় মানুষের গল্প ও শুনতে যাচ্ছে। একটু পরেই ওর মোবাইলে মেসেজ আসে, খুলে দেখে আরিফ ঠিকানা পাঠিয়েছে। একটু অবাক হয়, শাহবাগে একটা দোকানের ঠিকানা, বাসায় না? দোকানের নামটা খুব সুন্দর, ‘সুঁই সুতা’। মুনিয়া মনে মনে ভাবে এদের সব কিছুই কেমন মায়াময়, সুন্দর।

মুনিয়া এবার ওর টিমের লোকজনদের সব গুছিয়ে নিতে বলে। সেদিনের জন্য ফুল, কেক, মিষ্টি আর বিশেষ করে বিয়ের কার্ডটা।

২.
মুনিয়া যখন শাহবাগের ‘সুঁই-সুতা’ দোকানের সামনে এসে পৌঁছে ততক্ষণে বিকেল। একটু আগেই ঝড় হয়েছিল, সাথে বৃষ্টি। তাতে করে আবহাওয়াটা ঠান্ডা। না হলে যে গরম পড়েছিল এই ক’দিন।

শোরুমটা বেশ বড়, দেখেই বোঝা যায় খুব চালু দোকান। কিন্তু লোকটা বাসায় যেতে না বলে এখানে আসতে বলল কেন? যাই হোক, নিশ্চয় এর পেছনেও গল্প আছে। মুনিয়া তীব্র কৌতুহল নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন মাঝবয়েসী লোক এগিয়ে আসে, হাসিমুখে বলে, ‘আমিই আরিফ। আসুন আমার সাথে।’

মুনিয়া অবাক হয়ে দেখছিল লোকটাকে, কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা। চশমার পেছনে চোখ দু’টিতে গভীর মায়া। রেহনুমা কই? কৌতুহলী চোখে ও আশেপাশে তাকায়। অনেক মেয়েই কাজ করছে কিন্তু এর মাঝে কাউকে ওর ঠিক রেহনুমার মতো লাগে না।

আরিফ একটা কাচঘেরা রুমে নিয়ে ওকে বসায়। কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ‘আমাদের মেয়ে রেণুকা, সামনের বছর এইচএসসি দেবে।’

মেয়েটা ওকে সালাম দেয়, মুনিয়া হেসে মাথা নাড়ে। আর চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। তার মানে ওরা ভালো আছে, সংসার করছে। কিন্তু এখনও রেহনুমাকে দেখতে পেল না!

না পেরে এবার ও জিজ্ঞেস করেই ফেলে, ‘রেহনুমা আপু কই, ডাকুন প্লিজ। ওনাকে দেখার জন্য আমি ছটফট করছি। আপনাদের দু’জনের গল্প শুনব।’

রেণুকা নামের কিশোরী মেয়েটা মাথা নিচু করে, আরিফের মুখটাও একটু গম্ভীর হয়ে যায়। সেটা দেখে মুনিয়ার বুকের ভেতর একটা অজানা আশংকা দোলা দিয়ে যায়। রেহনুমা কি আলাদা হয়ে গেছে? তাই বুঝি এখন পর্যন্ত ওকে দেখা যাচ্ছে না? শেষ পর্যন্ত তাহলে কি মায়ার সংসার টেকেনি?

ওর বিচলিত অবস্থা দেখে আরিফ মৃদু হেসে বলে, ‘রেহনুমা তো এখানে নেই। তবে ও আসবে। আপনার আপত্তি না থাকলে এই কেক, ফুল, আর বিয়ের কার্ডটা নিয়ে চলুন আমার সাথে, একটা জায়গায় যেতে হবে।’

মুনিয়া কেমন এলোমেলো চোখে তাকিয়ে থাকে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। তাহলে কি রেহনুমা সত্যিই আলাদা হয়ে গিয়েছিল?

ওরা তিনজনে গাড়িতে ওঠে। আরিফ সামনের সিটে আর পেছনে মুনিয়া আর রেণুকা। মেয়েটার চেহারা বাবার সাথে মিল আছে। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যামলা। এটা মনে হতেই একটু হাসে মুনিয়া। ও নিজেও গায়ের রঙ দেখছে! মুনিয়া ওর সাথে গল্প করার চেষ্টা করে, কিন্তু এগোয় না। মেয়েটার মন কেমন যেন খারাপ সেটা মুনিয়াকেও ছুঁয়ে যায়।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যায়। মুনিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করে ও শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ের পাশে এসে পৌঁছেছে। আরিফ ইশারা করে নেমে আসতে। মুনিয়া প্রথমে বুঝতে পারে না, তারপর হঠাৎ করেই মনে হয় এটা হয়ত ওদের দু’জনের কোনো স্মৃতিময় জায়গা।

ওরা তিনজন একটা বেঞ্চিতে বসে। ড্রাইভার কেক, ফুল আর বিয়ের কার্ড দিয়ে যায়। সময় পার হয়, কিন্তু কেউ আসে না। আরিফ চুপচাপ জলের দিকে তাকিয়ে আছে, সাথে মেয়েটাও। মুনিয়া কেমন একটা ধন্দে পড়ে যায়। একটা সময় থাকতে না পেরে বলে, ‘কই, রেহনুমাকে আসতে বলেছেন?’

আরিফ ওর দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে, তারপর বলে, ‘ওহ, একদম ভুলে গেছি। দাঁড়ান, ওকে মিস কল দেই। দু’টো মিস কল দিলেই ঠিক চলে আসবে।’

মুনিয়া হা করে তাকিয়ে থাকে। এটা কী ধরনের কথা! ফোন না দয়ে মিস কল কেন দেবে? এই যুগে কেউ মিস কল দেয়?

আরিফ সত্যি সত্যিই দু’টো মিস কল দেয়। মুনিয়া খেয়াল করে রেণুকা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা কি কাঁদছে?

একটু পর আরিফ বিয়ের কার্ডটা হাতে নেয়, পরম মমতায় হাত বোলায়। তারপর ঘোর লাগা গলায় বলে, ‘রেহনুমা, তুমি এসেছ? দেখো আমাদের বিয়ের কার্ড। এই মেয়েটা এসেছে আমাদের বিয়ের উনিশ বছর পূর্তির শুভেচ্ছা জানাতে। কী দারুণ ব্যাপার না, বলো! আর তোমার মেয়ে দেখো কেমন কাঁদছে। আসো আমরা সবাই মিলে কেকটা কাটি।’

মুনিয়া বিস্ফারিত চোখে আরিফের দিকে তাকিয়ে আছে। রেণুকা মেয়েটা এখন ডুকরে কাঁদছে। কোথাও একটা ভীষণ গোলমেলে কিছু হয়েছে। মুনিয়া চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘রেহনুমার কী হয়েছে, সত্যি করে বলুন।’

আরিফ ভেজা চোখে তাকায়, তারপর এক বুক হাহাকার নিয়ে বলে, ‘নেই! আমাদের একা করে স্বার্থপরের মতো চলে গেছে। রেণুকার জন্মের সময় ওর মা রেহনুমা মারা যায়, ২০০৫ সালে।’

মুনিয়ার বুকটা কেউ খামচে ধরে, মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। পাশে বসে থাকা রেণুকাকে ও এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই মেয়েটা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ফুঁপিয়ে বলতে থাকে, ‘আমার জন্যই মাকে চলে যেতে হলো।’

মুনিয়ার চোখের জল বাঁধ মানে না। একটা মায়ার গল্প শুনতে এসে এমন কষ্টের একটা গল্প শুনবে ও ভাবতেই পারেনি।

অনেকক্ষণ ওরা চুপচাপ বসে থাকে। একটা সময় আরিফ আলতো করে বলে, ‘আসুন, আমরা কেকটা কেটে ফেলি। এই পুকুর পাড়টা আমাদের আশ্রয় ছিল। যখনই আমাদের কারোও মন খারাপ হতো এখানে এসে বসতাম। দু’বার মিস কল দিলেই আরেকজন চলে আসত। এটাই নিয়ম ছিল।’

মুনিয়া মুগ্ধ চোখে ওর কথা শোনে। তারপর আকুল গলায় বলে, ‘আমাকে পুরো গল্পটা বলবেন?’

আরিফ একটা মায়াময় হাসি হাসে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’

ধীরে ধীরে আরিফ গল্পটা বলতে থাকে। রেণুকার এই গল্পটা মুখস্ত। বাবা প্রায়ই এই পুকুর পাড়ে ওকে নিয়ে আসে, আম্মুর গল্প শোনায়।

আরিফ গল্পের শেষে এসে বলে, ‘আমাদের বিয়েটা কার্ডের তারিখ মতোই হয়ে যায়। তারপর দু’টো বছর যেন আমরা সুখে ভাসতে লাগলাম। ও যখন কনসিভ করল সে কী আনন্দ আমাদের! সাথে একটা ভয়ও ছিল, একটু বয়স বেশিই হয়ে গিয়েছিল ওর।

আমার তখন ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে। আম্মার সাথে আমার কিডনি ম্যাচ করাও হয়েছে যাতে লাগলেই দিতে পারেন। এর মাঝে রেহনুমার শরীর একবার খুব খারাপ করল। হাসপাতালে টানা নয়দিন ছিল। তাতে ও ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তারপর অবশ্য ঠিক ছিল সব। কিন্তু যেদিন ডেলিভারি হবে সেদিন থেকেই ব্যাপারটা জটিল হতে শুরু করল। একটা সময় ডাক্তার জানালেন অবস্থা ক্রিটিক্যাল, যেকোনো একজনকে বাঁচাতে পারবেন। আমি বলেছিলাম, রেহনুমা। ডাক্তার চলে গেলেন, আর আমি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও রেহনুমাকে ফেরত চাইলাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল হয়ে বললাম, এই মানুষটা সারাজীবন কষ্ট পেয়েছে, এবার তো একটু সুখ পাক। তার অনাগত সন্তানকে বুকে নেবার আনন্দটুকু যেন পায়। বিধাতা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন, কেড়ে নিলেন আমার মায়ার বসতবাড়ি।’

এটুকু বলে আরিফ চুপ করে যায়। মুনিয়া ঠোঁট চেপে কান্না সামলায়। রেণুকা শুন্য দৃষ্টিতে পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আরিফ নীরবতা ভেঙে বলে, ‘রেহনুমা আমাদের নিয়ে খুব ভাবত। ও মাঝে যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তখন একটা কাজ করেছিল। ওর মনে কেন জানি মৃত্যুর ভয় ঢুকে গিয়েছিল। জোর করে মরণোত্তর দেহদানের ফরম ফিল আপ করে গিয়েছিল। আর আমাকেই কিডনি দেবার কথা লেখা ছিল। আমি অনেক নিষেধ সত্ত্বেও ও এটা করেছিল। এখন মনে হয়, ও কি আমাকে সুখী করতে ইচ্ছে করেই আগেভাগে চলে গেল? মায়ার খেলায় রেহনুমা কখনোই আমাকে জিততে দেয়নি।’

মুনিয়ার মনে হয় ও রেহনুমাকে দেখতে পাচ্ছে। ওর মনের ভেতরে যে এক সমুদ্র মায়া তার কিছুটা যেন টের পাচ্ছে। আফসোস মানুষটার সাথে দেখা হলো না।

মুনিয়া চোখ মোছে, তারপর বিব্রত গলায় একটা প্রশ্ন না করে থাকতে পারে না। বলে, ‘আচ্ছা, রেণুকাকে দেখে রাখতে আপনার একার পক্ষে কষ্ট হয়নি?’

আরিফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘আপনি আসলে জানতে চাচ্ছেন আমি আবার বিয়ে করেছি কি না?’

মুনিয়া ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে মাথা দোলায়। আরিফ বিষণ্ণ হেসে বলে, ‘এত মায়া দিয়ে যে মানুষটা আমাকে ঘিরে রেখেছিল তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমি তো আজও রেহনুমাকে সমানভাবেই পাই। হ্যাঁ, রেণুকা জন্মের পর আমি একদম এলোমেলো হয়ে যাই। রেহনুমার চলে যাওয়া মেনেই নিতে পারিনি অনেকদিন। সারাক্ষণ এই পুকুর পাড়েই এসে বসে থাকতাম। এক সময় মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। আমার এই অবস্থা দেখে সেই মিতা আপা একদিন খুব করে আমায় বকলেন। বললেন, ‘রেণুকার মাঝেই তো রেহনুমা বেঁচে আছে। তুমি যদি এমন করে থাকো তাহলে যে মেয়েটার অযত্ন হবে, রেহনুমাও রাগ করবে।’

হঠাৎ করেই আমার চোখ খুলে গেল। আরে তাই তো, আমার রেণুকা যে ওর অংশ। সেদিন থেকে আমি মেয়েকে আঁকড়ে ধরলাম, নতুন করে বাঁচতে শুরু করলাম। ওকে সময় দিতেই আমি আমার চাকরিটা ছেড়ে দেই। রেহনুমার এই মায়ার দোকান ‘সুঁই-সুতা’ নতুন করে চালু করি। আমি কাটাকুটি পারতাম। তাই সমস্যা হয়নি। বাবা মা সাথে ছিলেন, রেহনুমার মাও সময় দিত রেণুকাকে। তাই পেরেছি। আর রেহনুমা তো আছেই, যে সবসময় একটা নিভৃত কুহকে ঘিরে রাখে আমাদের।’

মুনিয়ার কেন জানি এখন ভালো লাগছে। এমনই তো হবার কথা। মায়া যে মায়া বাড়ায়। মায়া থাকলেই বেঁচে থাকা যায়।

ওরা সবাই মিলে কেকটা কাটে। মুনিয়া টের পায়, রেহনুমা নামের সেই মায়ার মানুষটা কাছেপিঠেই আছে। ওদের দেখছে। না, মুখটা দুঃখী না, বরং আনন্দের। আরিফ যে আজও ওকে বুকে করেই রেখেছে। ওর স্মৃতিতে এক বিন্দু বালুকণাও পড়তে দেয়নি।

সেদিন মুনিয়া বাসায় ফেরার পথে ভাবে রেহনুমা যে মায়ার বীজ বুনে দিয়ে গেছে আজ তা মহীরুহ। সত্যিই তো আরিফের বেঁচে থাকতে আর তো কাউকে লাগে না। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে,
ইশ, এই অমূল্য মায়াটুকু যদি ও পেত! খুব কম মানুষই বুঝি এই মায়ার দেখা পায়। আর যারা পায় তারা ভাগ্যবান।

রাত বাড়ে, আরিফ ওর শোবার ঘরের দেয়ালে রেহনুমার ছবির দিকে তাকিয়ে অপলক চেয়ে থাকে। কী মনে হতে আলমারি খুলে পুরনো একটা শার্ট বের করে। তারপর শার্টের বোতামগুলোতে অনেক মায়ায় হাত বোলাতে থাকে। সেই প্রথম থেকেই রেহনুমা ওর জীবনের ছেঁড়া ফাঁটা কষ্টগুলো সুখের সুঁই সুতো দিয়ে বুনে দিত। এমন কী জীবনের শেষ মুহুর্তেও ওর শরীরের একটা অংশ দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে গেল, সুস্থ করে দিয়ে গেল। এই অদ্ভুত মায়ার বসতবাড়ি ছেড়ে কেউ বেরোতে পারে? ও পারেনি, আজও রেহনুমা ওকে ঘিরে রাখে। ও প্রতিদিন রেহনুমার সাথে মায়ার সংসার পাতে, মনে মনে কথা চলে, অভিমান হলে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে, তারপর মনের অজান্তেই দু’টো মিস কল দেয়। সেই মিস কল এই পৃথিবী ছাড়িয়ে স্বর্গের দুয়ারে পৌঁছে কি না তা জানা না গেলেও এটুকু অন্তত আরিফ বোঝে যে রেহনুমা ওর পাশেই বসে আছে, হাতটা ধরে,অনেক মায়ায়।

(সমাপ্ত)

** প্রিয় পাঠক, এই ক’টা দিন গল্পের মায়ার সাথে আপনাদের মায়াটুকু জড়িয়ে ছিল। প্রতিটা পর্বে আপনাদের এত সুন্দর মন্তব্য পেয়েছি যে আমি সত্যিই অভিভূত। আপনাদের মায়াটুকু অগাধ।

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৪/০৪/২০২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here