নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ৮

0
195

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_৮
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“মিস্টার শাহরিয়ার মাহতাব শেখ, আমরা দুঃখিত। কারণ আপনার কোম্পানির সাথে আমাদের কোম্পানি আর কখনো চুক্তিবদ্ধ হবে না। আপনার থেকে আমরা আর কোনো ধরনের পোশাক নেব না। আপনারা নিজেদের কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারছেন না। এভাবে চললে আপনাদের সাথে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

কথাটা শুনে মাহতাব যেন বড়সড় রকমের ধাক্কা খায়। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে ফোনের এপাশ থেকে উত্তেজিত স্বরে বলে,

“এসব আপনি কী বলছেন মিস্টার তৌহিদ? আপনাদের সাথে আমাদের পরিচয় তো দুই/একদিনের নয়। তিন বছর ধরে একসাথে কাজ করছি আমরা। আপনাদের থেকে এবার দশ লক্ষ টাকার অর্ডার নিয়েছিল আমার কোম্পানি। আমার কোম্পানি থেকে ইতোমধ্যে সবগুলো পোশাক বানানো হয়ে গিয়েছে। আজই তো ডেলিভারি হওয়ার কথা।”

“স্যরি মিস্টার শেখ, উপরমহল থেকে যা বলা হয়েছে আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। আর কখনো আপনার কোম্পানির সাথে আমরা কাজ করতে পারব না।”

কল কেটে যায়। মাহতাব হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। তার মা*থা কাজ করছে না। দশ লক্ষ টাকা তো কম নয়। এখন এতগুলো টাকার পোশাক সে কী করবে? এই ভেবেই নিশ্বাস আটকে আসছে তার।

মাহতাবের অফিস কক্ষের পাশ থেকে কেউ একজন সরে যায়। অতঃপর কল করে একজনকে জানায়,

“অর্ডার ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় কোম্পানিকে অনেক লসের সম্মুখীন হতে হবে।”

অপরপাশ থেকে আগন্তুকের বলা কথাগুলো শুনে কল কেটে দেয় সে।

মাহতাব বিষন্ন মনে বাসায় ফিরে সিরাতকে দেখে অসহায় চোখে তাকায় তার দিকে। সেদিন সিরাতের গায়ে হাত তোলা ঠিক হয়নি ভেবে চোখ নামিয়ে নেয়। বাবা, মা আর শ্বশুরবাড়ির সবাই চলে গেলে মা থা য় জিদ চেপে যায় মাহতাবের। এতদিন সিরাতের সব কথা শুনেছে কেবল বাবার ভয়ে। এরপরেও তার বাবা যখন সব জেনে গিয়েছে তখন সিরাতকে সহ্য হচ্ছিল না মাহতাবের। রাগের বশবর্তী হয়ে সিরাতের গায়ে হাত তুলে ফেলেছিল এই কারণে। বিয়ের পর এটাই ছিল প্রথম গায়ে হাত তোলা। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে আর কোনো কথায় বলেনি। দেখলেও কেমন যেন এড়িয়ে যায়।

“কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন অস্থির লাগছে কেন?”

নিমুর প্রশ্নের উত্তরে মাহতাব ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“কিছু হয়নি।”

নিমু পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“মিথ্যা বলছ কেন? কিছু তো অবশ্যই হয়েছে।”

“নিমু আমাদের কোম্পানির অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল। দশ লক্ষ টাকা লস খেতে বসেছি আমরা।”

“কী বলছ তুমি? দশ লক্ষ টাকা? কীভাবে হলো এসব?”

“আমি নিজেও জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”

“এই এসবের জন্য তোমার কোম্পানি পথে বসবে না তো? তাহলে তো তুমিও পথে বসে যাবে। আমাদের সংসার চলবে কীভাবে তাহলে? আমি কিন্তু তোমার সাথে অভাবের সংসার করতে পারব না।”

নিমুর প্রশ্নে অবাক হয় মাহতাব। এই মেয়েটা নিজের স্বার্থ ছাড়া কি আর কিছুই ভাবতে পারে না!

“তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না আমি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”

চলে যায় মাহতাব। নিমু একমনে ভাবে,

“আমি বিয়ে করে আসতে না আসতেই এই ছেলের সমস্যা শুরু হয়ে গেল। এরচেয়ে তো বিয়ে না করে প্রেমিকা হয়ে থাকায় ভালো ছিল। না চাইতেই সব পেয়ে যেতাম।”

মাহতাব বাসায় আসার পরপরই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় সিরাত। তারিনের সাথে দেখা করে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে চলে যায় অন্য একজনের সাথে দেখা করতে।

রাস্তার পাশে ছোটখাটো একটা বাড়ি। বেশ পুরোনো বাড়ি বলা চলে। এই বাড়িতে অভি একাই থাকে। বছর দুয়েক আগে মা’কে হারিয়েছে। আর ছোটোবেলায় হারিয়েছে বাবাকে। বাড়ির দরজায় আওয়াজ করতেই বেরিয়ে আসে অভি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুলগুলো কোঁকড়ানো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর চোখে উদাসীন ভাব। এই ছেলেটার এমন রূপ দেখে সিরাত বরাবরই হাসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। মুখে হাসি রেখে ভেতরে ঢুকে বলে ওঠে,

“আজও একইরকম রয়ে গেলি।”

অভি চুলের মাঝে হাত দিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দেয়,

“বোকা প্রেমিকেরা কখনো পাল্টায় না। তারা আজীবন একই রয়ে যায়।”

“আর কতকাল এভাবে একা থাকবি শুনি? বিয়ে-শাদি করবি না নাকি?”

“তোর মতো এত বিয়ের শখ নাই আমার। তোর তো সুখে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বাচ্চার মা হয়ে গেলি।”

“আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে এখনো শান্তি লাগে?”

“জানি না। তো এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল হঠাৎ?”

“কেন? মনে পড়া বারণ নাকি?”

“ছেড়ে চলে গেলি তো নিজেই। আমাদের সবাইকে ছেড়ে অজানায় পারি জমালি। আমার না খুব জানতে ইচ্ছে করে, ভালো আছিস তো তুই?”

সিরাত মলিন হেসে জবাব দেয়,

“আমি ভালো নেই রে। একদম ভালো নেই। বাস্তবতার সাথে সাথে লড়াই করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি।”

“তেজস্বিনীর মুখে এমন কথা মানায় না।”

“আগের আমি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিলাম বিয়ের পর। তবে এখন পুনরায় সেই রূপে ফিরতে হবে।”

“কী হয়েছে তোর? আমাকে সব বিস্তারিত বল।”

“অভি তোকে আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। বাকি সবকিছু পরে বলব। আপাতত এই দু’টো ছবি রাখ। এদের বিষয়ে সবকিছু জানতে চাই আমি। আর এক্ষেত্রে গোপনে একমাত্র তুই আমাকে সাহায্য করতে পারবি।”

সিরাতের হাত থেকে ছবি দু’টো নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে অভি জানায়,

“এদের খোঁজ নিয়ে তুই কী করবি?”

“বললাম না? সবকিছু পরে বলব। তুই যত দ্রুত সম্ভব এদের খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবি।”

“আচ্ছা জানাব।”

“আজ তাহলে উঠি।”

“মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম এলি। এক কাপ চা খেয়ে যা।”

“বাচ্চাকে নিয়ে রাতের বেলা বাইরে বের হই না আমি। এখন বাড়িতে যেতে হবে। খুব শীঘ্রই তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে। ভালো কথা, যার কথা ভেবে আজও উদাসীন তুই, সে কিন্তু বিবাহিত। ভুলে যাওয়া সহজ নয় জানি। তবুও বলব, ভুলে যা সব। নতুন করে জীবন শুরু কর। যে তোর হবে না তার জন্য আর অপেক্ষা করিস না।”

দরজার সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে অভি বলে ওঠে,

“এক জীবনে ক’জনকে ভালোবাসা যায় রাত? আমি একতরফা ভালোবেসে ভালো আছি। তোর আমার কথা না ভাবলেও চলবে। তুই বরং নিজেকে নিয়ে ভাব।”

সিরাত অসহায় চোখে পেছন ফিরে তাকায়। অভি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের কোণে জমে থাকা তরল পদার্থ মুছে চলে যায় সিরাত।

“মাম্মা তুমি কাঁদছ?”

মেয়ের কথায় সিরাত হাসার চেষ্টা করে বলে,

“না সোনা, আমি কাঁদছি না।”

“তোমার চোখ লাল হয়ে আছে।”

“গতকাল ঠিকমতো ঘুম হয়নি তো তাই এমন লাগছে।”

ছোট্ট মেয়েটাও হয়তো মায়ের কষ্ট বোঝে। মায়ের কোলে চুপটি করে বসে বুকে মা থা রাখে। মেয়েকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে রাতের শহর দেখে সিরাত।

এইচএসসি পরীক্ষার আগের তিন মাস প্রতিদিন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ে রাস্তার পাশে থাকা টং দোকানে চা খাওয়া, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর গড়াগড়ি খাওয়া, রাস্তার মাঝে উদাসীন হয়ে চলাফেরা করা, এসবই ছিল সিরাতের নিত্যদিনের কাজকর্ম। এগারো জনের বন্ধুমহল ছিল তাদের। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভবঘুরে ছিল সিরাত। মেয়ে হয়েও তার সকল কাজকর্ম ছিল ছেলেদের মতো। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছেলেদের সাথে মা*রা*মা*রি করা থেকে শুরু করে যেকোনো ঝামেলায় সবার আগে সিরাতকে পাওয়া যেত। সে যে অন্যায় সহ্য করতে পারত না একদমই। তবে যেকোনো বিপদে একে-অপরকে বাঁচানোর জন্য সবাই একসাথে এগিয়ে আসত। বিশেষ করে সিরাতকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা ওর সাথে ছিল অভি আর..

“ম্যাডাম নামবেন না? বাড়ির সামনে চলে আসছি।”

রিকশাওয়ালা ছেলেটার কথা শুনে সিরাতের ঘোর কাটে। রিকশা থেকে নেমে একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় সিরাত।

“আমার কাছে ভাঙতি নাই এখন।”

“সমস্যা নেই, বাকিটা ফেরত দিতে হবে না। আচ্ছা, তোমার বয়স কত? দেখে তো বেশি বয়স মনে হচ্ছে না।”

“আমার বয়স উনিশ বছর।”

“পড়াশোনা করো?”

“হ্যা, এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেব।”

“তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়েছ কেন এখন?”

“আসলে গত সপ্তাহে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন অবস্থা তেমন একটা ভালো না। তাই বাবার হয়ে আমি রিকশা নিয়ে বের হয়েছি।”

“আচ্ছা তোমার ফোন আছে?”

“হ্যা আছে।”

“তোমার নাম্বারটা আমাকে দিয়ে যাও। প্রয়োজনে আমি তোমাকে কল করব। আমার বাসা তো চিনেই রাখলে। এরপর কোথাও যাওয়ার হলে আমি তোমাকে কল করব। ফ্রি থাকলে চলে এসো।”

ছেলেটার থেকে নাম্বার নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায় সিরাত। নাবিহা রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢুকে আগে মেয়েকে ভালোভাবে শুইয়ে দেয় সে। তারপর ঘরের দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here