#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“মাহতাব আর তুরাগ কোথায়?”
জ্ঞান ফেরার পর সিরাত সর্বপ্রথম এই প্রশ্ন করায় অভি উত্তর দেয়,
“তোদের দুই বান্ধবীর ওদেরকে নিয়ে এত চিন্তা কীসের? নিজেরা মৃ*ত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলি। অথচ ভাবছিস ওই অসভ্যগুলোর কথা!”
“দুই বান্ধবী মানে? আর কার কী হয়েছে?”
ইভান অভিকে ইশারায় চুপ করতে বলে নিজে উত্তর দেয়,
“তুই এখনো অনেকটা অসুস্থ। আগে সুস্থ হ। তারপর সব শুনিস।”
“না, এখনই বল আমাকে। আর কে অসুস্থ?”
পাশ হতে অথৈ জবাবে বলে,
“মাওয়া অসুস্থ। তুরাগ যখন তোকে মা*রতে পারল না তখন মাওয়াকে আঘাত করেছে। ওর পেটে ছু*রি ঢুকিয়ে দিয়েছিল।”
অথৈ এর কথা শুনে সিরাত উত্তেজিত হয়ে গেলে ইভান শান্ত স্বরে বলে ওঠে,
“শান্ত হ রাত। মাওয়া এখন ঠিক আছে। তাছাড়া মাওয়া তুরাগ আর মাহতাবকে গু*লি করেছে। ওরা ওদের শাস্তি অবশ্যই পাবে।”
সিরাত চিন্তিত হয়ে যায় ইভানের কথা শুনে। মুখ গম্ভীর করে বলে,
“ওরা দু’জন বেঁচে আছে তো?”
“হ্যা, বেঁচে আছে। আমাদের হেফাজতে আছে। তুই চিন্তা করিস না।”
বন্ধুদের কথার মাঝে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেন ইতি ইসলাম। তার কোলে নাবিহা ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সুন্দর চেহারাটা যেন কয়েক দিনের মাঝেই মলিন হয়ে গিয়েছে। মা আর মেয়ের এমন বিষণ্ণ চেহারা দেখে সিরাতের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
“মা!”
মেয়ের মুখে এতদিন পর ‘মা’ ডাক শুনে আত্মা শান্ত হয় মিসেস ইতি ইসলামের। ঘুমন্ত নাতনিকে উর্মির কোলে দিয়ে মেয়ের পাশে বসে পরম যত্নে তার সম্পূর্ণ মুখে হাত বুলিয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠেন ইতি ইসলাম।
মায়ের হাতের উপর হাত রেখে সিরাত বলে,
“কেঁদো না মা। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। সুস্থ আছি।”
“আমার মেয়েটার হাতে এত মোটা ব্যান্ডেজ, কপালে র*ক্ত জমে আছে, ঠোঁট কেটে র*ক্ত জমে আছে। এসব দেখেও আমি কীভাবে শান্ত থাকি? আমার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে আম্মু।”
“আমি ঠিক হয়ে যাব। হার মেনে নেওয়ার মেয়ে তো আমি না। তোমার দোয়া আমার সাথে আছে৷ মায়ের দোয়া সাথে থাকলে কি কেউ খারাপ থাকতে পারে মা?”
মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে সিরাত আবদার করে,
“আমার মা*থায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না মা। কতদিন হলো তোমার কোলে শুয়ে তোমার আদর খাই না। মায়ের কোলে শুয়ে যে শান্তি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না।”
সিরাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার মা*থায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দেয় মা। এর মাঝে নাবিহার ঘুম ভেঙে যায়। মা’কে শুয়ে থাকতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।
“মাম্মা মাম্মা!”
মেয়ের মুখ থেকে এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত সেই ডাক শুনে চোখের কোণে পানি জমে যায় সিরাতের। ডান হাতে ব্যথা থাকায় বাম হাত দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে ডাকে সে। উর্মি নাবিহাকে সিরাতের পাশে বসিয়ে দিলে মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরায় সিরাত। মেয়ের সম্পূর্ণ মুখে অসংখ্য চুমু এঁকে দেয়। ছোট্ট ছোট্ট হাত দু’টো ধরে হাতের পিঠেও চুমু এঁকে দেয়।
“মা আমার, তুমি ঠিক আছ? নানুমনির কাছে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিলে তো?”
“নাবিহা আমার থেকে বেশি তারিনের কাছে ছিল। ওর কাছেই এই কয়েকদিন থেকেছে। মেয়েটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। নাবিহাকে তো ওই দেখে রেখেছে।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সিরাত তারিনের দিকে তাকায়। সে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
“এই মেয়ে তুই এভাবে কাঁদছিস কেন হ্যা? আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে রাখলি। তার জন্য তো আমি তোর কাছে চির ঋণী হয়ে গেলাম।”
“একটা মা*ইর দিব তোকে। তোর মেয়ে মানে আমাদের সবার মেয়ে। ওর দেখভাল করা আমার দায়িত্ব। তার জন্য আবার কীসের ঋণ রে? খুব পর ভাবিস আমাকে তাই না?”
“তুই আমার কাছে আয়।”
তারিন সিরাতের কাছে এগিয়ে গেলে সিরাত ওর হাত ধরে বলে,
“আমি হয়তো স্বামী সুখ পাইনি। কিন্তু চরম পর্যায়ের ভাগ্যবতী না হলে তোদের মতো বন্ধু পাওয়া যায় না রে। একজন আমার জন্য জীবন বাজি রাখল। আরেকজন আমার মেয়েকে এত যত্নে রাখল। বাকিরা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করে আমাকে উদ্ধার করল। তোরা না থাকলে হয়তো আমি আজ বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তেজস্বিনীদেরও হেরে যেতে হয়। কিন্তু তোরা আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিস। জীবনে প্রকৃত বন্ধু থাকা কতটা প্রয়োজন সেটা তোরা খুব ভালোভাবে প্রমাণ করেছিস। আমার মা, আমার পরিবার, আমার মেয়ে, আমার বন্ধু, সবাইকে খুব ভাগ্য করে পেয়েছি আমি। এক জীবনে তো সব পাওয়া যায় না। আমি ভালো স্বামী পাইনি তো কী হয়েছে? বাকি সব তো পেয়েছি। এই আমার পরম সৌভাগ্য!”
“তোর কথা শেষ হয়েছে? তাহলে এবার বিশ্রাম নে।”
ইভানের কথায় সিরাত বায়না ধরে বসে।
“আমি এক্ষুণি মাওয়ার কাছে যাব। আমাকে নিয়ে চল।”
“এই অবস্থায় তোর কোথাও যাওয়া যাবে না।”
“আমি এতকিছু জানি না। হয় আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল, নয়তো ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।”
“আজব তো!”
“তোরা কিছু করবি? নাকি আমি এই শরীর নিয়ে উঠব?”
নাবিল হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে,
“তোরা কী যমজ বোন?”
সিরাত ভ্রূদ্বয় সংকুচিত করে বলে,
“কী হয়েছে?”
“এখানে তুই জেদ ধরেছিস। ওখানে মাওয়া পারলে এখনই তোর কাছে ছুটে চলে আসে।”
“আত্মার সম্পর্ক এটা বুঝলি?”
“খুব বুঝেছি ম্যাডাম। তাই তো এত এত ঝামেলা করে মাওয়াকে তোর কেবিনে নিয়ে এলাম। এখন থাক দুই বান্ধবী একসাথে।”
ফারহানকে দেখে সিরাত খুশি হয়ে বলে,
“তুই কখন এলি?”
“আমি আজ ভোরে এসেছি। নকশির থেকে সবকিছু শুনে আমি আর থাকতে পারিনি। আরো আগেই আসতাম। কিন্তু এই হারামির দল আমাকে প্রথমে কিছুই বলেনি।”
“তোকে আর আমরা আলাদা করে চাপ দিতে চাইনি দোস্ত।”
“হ্যা ভাই তোরা তো আমার খুব বড়ো উপকার করে ফেলেছিস এটা করে।”
ফারহান আর নাবিলকে থামিয়ে দিয়ে সিরাত বলে,
“তোরা একটু থাম। আমি এখন মাওয়ার সাথে একা থাকব। বাকিরা বের হয়ে যা।”
নকশি সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“একজনকে পেয়ে বাকিদের ভুলে যাবি তুই? এটা তোর থেকে আশা করিনি হুহ।”
“ওরে আমার অভিমানিনী পরে অভিমান করিস। এখন বের হ সবাই।”
মা আর মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে বাকিদের সাথে পাঠিয়ে দেয় সিরাত। কেবিনে কেবল থেকে যায় সে আর মাওয়া। মাওয়াকে একদম সিরাতের পাশাপাশি রাখা হয়েছে। সিরাত এক হাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এখন কেমন আছিস তুই?”
মাওয়া ডান হাত দিয়ে সিরাতের হাত ধরে বলে,
“তোকে সুস্থ হতে দেখে আমি কি খারাপ থাকতে পারি?”
“এত বড়ো ঝুঁকি না নিলেও পারতি।”
“চুপ কর তো তুই। বেশি কথা বলবি না একদম।”
“আচ্ছা আমার একটা অনুরোধ রাখবি?”
“অভির কথা বলবি তাই তো?”
“হুম। দেখ অনেক তো হলো ভুল বোঝাবুঝি। এবার তোরও জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। আর অভির থেকে বেশি ভালো তোকে অন্য কেউ বাসতে পারবে না।”
“আমি আজ ওকে বিয়ের জন্য হ্যা বলেছি।”
“এহ্?”
সিরাতকে অবাক হতে দেখে মাওয়া হেসে বলে,
“বাকিরা এখনো কিছুই জানে না। আগে সুস্থ হই। তারপর বলব।”
“কীভাবে হলো এসব?”
“আসলে তুই যেদিন নিখোঁজ হলি সেদিন আমি ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফোন বন্ধ করে দু’জন নদীর পাড়ে বসে ছিলাম কতক্ষণ। সত্যি বলতে আমিও অভিকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমি সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাবা ওকে পছন্দ করে না। তাকে মানানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল আমার। সেদিন বাবার সাথে ঝগড়া করেই বের হয়েছিলাম। জানিস? অভি আমাকে প্রপোজ করেছে ওইদিন। ওর মনের কথাগুলো শোনার পর ওকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছিল না আমার। আমি তোকে সবকিছু জানানোর জন্যই ফোন অন করেছিলাম। তখনই নাবিল কল করে বলে তুই নিখোঁজ। এরপর তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গেলাম আমরা। ওকে আর মনের কথা বলতে পারিনি। অবশেষে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ওকে মনের কথা বললাম।”
“তা কী বলেছিস শুনি?”
“ভালোবাসি!”
কথাটা বলার সময় মাওয়াকে ব্লাশ করতে দেখে সিরাত মুচকি হেসে বলে,
“যাক, সবার ভালোবাসা একে একে পূর্ণতা পাচ্ছে তাহলে!”
মাওয়া সিরাতের কথা শুনে বলে,
“সবার ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায়নি রাত।”
“মানে?”
“ইভান আর তোর ভালোবাসা যে অপূর্ণ রয়ে গেল।”
“আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে যা হয়নি সেটা এখন হবে ভেবে থাকলে ভুল করবি তোরা। আর কিছুদিন পর নাবিহা চার বছরে পা দেবে। আমার বিয়ের বয়সও প্রায় ছয় বছরের কাছাকাছি। যারা আমাকে ছয় বছর আগে মেনে নেয়নি তারা এখন আমাকে মেনে নেবে বলে মনে হয় তোদের? আর যেখানে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে সেখানে তো আমি কখনোই যাব না। ইভান ভালো বন্ধু হতে পারে। ভালো সন্তান হতে পারে। হয়তো ভালো বাবাও হতে পারবে। কিন্তু ভালো স্বামী কিংবা ভালো প্রেমিক কখনোই হতে পারবে না!”
“জীবনকে কি দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া যায় না?”
“অবশ্যই যায়। কিন্তু তেজস্বিনীরা কখনো আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারে না। আমি আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারব না। ইভানকে ভালোবেসে আমি কষ্ট ছাড়া কিছু পাইনি। একটা কথা কি জানিস তো? বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব অবধিই সুন্দর। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো তাই।”
“একা কী বাঁচা যায়?”
মাওয়ার এমন প্রশ্নে সিরাত খুব সুন্দর করে বলে,
“ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে বর্তমান নষ্ট করা বোকামি। এখন বর্তমান নষ্ট হলে ভবিষ্যতে গিয়ে আমাদের অতীতও আমাদের কষ্ট দেবে। আমরা কতদিন বাঁচব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চিত জীবনে জীবনসঙ্গী ছাড়া বাঁচা যাবে না এটা কোথাও লেখা নেই। আমার মেয়েকে নিয়ে আমি বাঁচার চেষ্টা তো অন্তত করি। একজন জীবন থেকে যেতে না যেতেই অন্যজনকে নিয়ে ভাবার তো প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে একা বেঁচে থাকার স্বাদও নিতে হয়। তেজস্বিনী শব্দটার মানে তো তোর অজানা নয়। আমি সমাজের সেই সকল মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাই যারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারছে না। এবার আমিও একটু একা বাঁচতে চাই। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা না হয় তখন ভাবা যাবে। বৃদ্ধ বয়সের কথা চিন্তা করে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে চাই না। এমনও তো হতে পারে, হয়তো বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আমি চলে যাব এই দুনিয়া ছেড়ে। তাহলে সেই বৃদ্ধ বয়সের কথা ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে আমি কেন ভাবতে যাব? এই ভাবাটাও আমার কাছে অপচয়!”
চলবে??