নিভৃতে তেজস্বিনী পর্ব ২৩

0
120

#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_২৩
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা

“ইভান সিরাতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

চোখের ঘুম নিমিষেই হারিয়ে যায় ইভানের চোখ থেকে। ভোর ছয়টা বেজে সাইত্রিশ মিনিটে এমন কোনো খবর শোনার জন্য সে একদমই তৈরি ছিল না। কণ্ঠে উত্তেজনা রেখে ইভান প্রশ্ন করে,

“কী বলছিস এসব তুই? সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বল তামান্না।”

“গতকাল সন্ধ্যায় সিরাত একটা কাজে বাইরে যায়। ওর রাত নয়টার মধ্যেই ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনো বাড়ি ফেরেনি সিরাত। সিরাতের আম্মু কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। এদিকে নাবিহাকে রাত থেকে হাজার রকমের চেষ্টা করেও কেউ কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। আমি এই খবর পেয়েই তারিনকে নিয়ে সিরাতদের বাড়িতে এসেছি। ভাই, তুই তো এখানকার থানার এসআই। তুই কিছু একটা কর। যেভাবেই হোক সিরাতকে খুঁজে বের কর।”

“আচ্ছা তুই শান্ত হ। আমি আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি।”

ফোন রেখে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে ইভান। তার মা*থা কাজ করছে না। রাস্তায় বের হয়ে একটা গাড়িও খুঁজে পায় না সে। দিশা না পেয়ে ইভান দ্রুত পা চালিয়, এক প্রকার দৌড়ে মিনিট কুড়ির মাঝেই সিরাতদের বাড়িতে চলে আসে। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় ছোট্ট নাবিহার কান্নার আওয়াজ শুনে থেমে যায় ইভান। কিছু একটা ভেবে দ্রুত কল করে অভিকে। দুইবার কল দেওয়ার পরেও অভিকে না পেয়ে নাবিলকে কল দেয়। কল রিসিভ করে ঘুম জড়ানোর কণ্ঠে নাবিল বলে,

“কি ভাই এত সকালে কেউ কল দেয়? কী হয়েছে বল?”

“রাখ তোর ঘুম। এদিকে সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি ওদের বাড়িতে আয় তুই।”

“সিরাতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? এই সকাল বেলা তুই আমার সাথে ফাজলামি করছিস ভাই?”

“দিব এক থা*প্পড়। তোর মনে হয় আমি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে মজা করছি? এত কথা বলার সময় নাই। তুই তাড়াতাড়ি এখানে আয়। রাখছি আমি।”

“আরে শোন তো আমার কথা!”

নাবিলের আর কোনো কথা না শুনেই কল কেটে দেয় ইভান। ভেতরে গিয়ে তারিনের কাছ থেকে নাবিহাকে কোলে নিয়ে বলে,

“কী হয়েছে আম্মু? তুমি কাঁদছ কেন?”

নাবিহা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,

“আমি মাম্মার কাছে যাব।”

“হ্যা যাবে তো সোনা। মাম্মা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। এখন তুমি কিছু খেয়ে নাও। নয়তো মাম্মা বাড়ি ফিরে এসব শুনলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবে।”

“না, আমি খাব না। আমাকে মাম্মার কাছে নিয়ে চলো।”

“আচ্ছা আমি তোমাকে প্রমিস করছি, আমি খুব দ্রুত তোমার মাম্মাকে তোমার কাছে নিয়ে আসব।”

“সত্যি?”

“তিন সত্যি। কিন্তু তার আগে তোমাকে খেতে হবে। তুমি আমার কথা না শুনলে কিন্তু আমি তোমার মাম্মাকে এনে দিব না।”

ইভানের কথায় নাবিহা অল্প পরিমাণে খাবার খেয়ে নেয়। খুব বেশি খায় না। তবে যেটুকু খেয়েছে এই মুহূর্তে এটাই যথেষ্ট ভেবে আর কেউ বাচ্চাকে জোর করে না খাওয়ার জন্য।

ইতি ইসলাম ইভানের কাছে এসে ভেজা গলায় বলে,

“বাবা আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দাও তুমি। মেয়েটা আমার সারারাত বাড়ি ফেরেনি। কে জানে কি বিপদ হলো মেয়েটার। ওর বাবা সকাল থেকে খোঁজ নিচ্ছে। চেনাজানা সবাইকে কল দেওয়া শেষ। কেউ জানে না ওর খবর। শাহেদ চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি একা হাতে কত দিক সামলাব বলো?”

“আন্টি আন্টি আপনি একটু শান্ত হন। আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যেভাবেই হোক সিরাতকে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়ে আনব আমি।”

“শুধু তুই কেন? আমরা সবাই মিলে আমাদের বন্ধুকে খুঁজে বের করব। আমরা কিচ্ছু হতে দিব না ওর।”

নাবিলকে হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখে ইভান সেদিকে এগিয়ে যায়। পেছন পেছন নকশি আর উর্মিও চলে আসে। ইভান বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“তোরা এত সকালে আসতে গেলি কেন?”

“এটা কোনো প্রশ্ন হলো ভাই? আমাদের বন্ধু নিখোঁজ। আর আমরা বাড়িতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাব হ্যা?”

উর্মির কথায় ইভান বলে,

“আচ্ছা এসে ভালো করেছিস। এখন ভেতরে আয়। তোদের সাথে আলোচনা করব আমি কিছু বিষয় নিয়ে।”

“একটু অপেক্ষা কর। অথৈ রাস্তায় আছে। ওও আসুক।”

নাবিলের কথায় ইভান সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“সবাইকে খবর দিয়েছিস তুই? তা অভি আর মাওয়াকে জানাসনি?”

“অভিকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। আর মাওয়ার ফোন বন্ধ।”

“এই দুইটার আবার কী হলো!”

“ওদের সাথে পরে যোগাযোগ করে নিচ্ছি। আগে সিরাতের খোঁজ নিতে হবে।”

এর মাঝেই অথৈ চলে আসে। ইভান সবাইকে নিয়ে বসে বলে,

“আন্টি সিরাত সন্ধ্যায় কী কাজে বেরিয়েছিল?”

“আমাকে বিশেষ কিছু বলেনি৷ একটা ফোন কল এলো। দুই মিনিটের মতো কথা বলে আমাকে বলল, আম্মু তুমি নাবিহার খেয়াল রেখো। আমি একটু বের হচ্ছি। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে ফিরে আসব।”

“আপনি কোনো প্রশ্ন করেননি যে সিরাত কোথায় যাচ্ছে?”

“জিজ্ঞেস করেছিলাম। শুধু বলল, খুব জরুরি একটা কাজে বের হচ্ছি। তোমাকে ফিরে এসে সব বলব।”

“তারপর কী হলো?”

“ওর তো নয়টার মধ্যে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু এগারোটা বাজার পরেও যখন ফিরল না তখন আমার চিন্তা হচ্ছিল। আমি একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছিলাম। কল যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। অস্থিরতা নিয়েই বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু এতক্ষণ পরেও যখন ফিরল না তখন ওর বাবা আশেপাশে গিয়ে খোঁজ নিল। কিন্তু সেখানেও আশানুরূপ কোনো ফল আমরা পাইনি।”

তারিন নাবিহাকে ফিডার খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,

“ওকে কল কে দিয়েছিল? আমাদের আগে এটা জানতে হবে।”

“কোনোভাবে কলটা ওকে মাহতাব দেয়নি তো?”

তামান্নার কথায় সবার মনে অজানা এক ভয় বাসা বাঁধে। নকশি আতঙ্কিত হয়ে বলে,

“মাহতাবের সাথে সিরাতের এভাবে দেখা করতে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে? তাছাড়া যদি মাহতাবের সাথেই দেখা করতে গিয়ে সিরাত নিখোঁজ হয় তাহলে তোরা ভাবতে পারছিস এরপর কী হবে?”

“শুধু ভাবতে পারছি না, বুঝতেও পারছি। মাহতাব সিরাতের উপর অনেক ক্ষেপে আছে। সিরাত ওর সাথে যা যা করেছে তারপর তো রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। আর রেগে গিয়ে যদি ওই ছেলে সিরাতের কোনো ক্ষতি করতে চায় তাহলেও আমি খুব একটা অবাক হব না। কারণ এদের মতো ছেলেদের পক্ষে সবকিছুই সম্ভব।”

ইভানের কথায় সবার গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে। তাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধুটার বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি তো? এসব ভেবেই সবার শ্বাস নেওয়ার গতি ভারি হয়ে আসে।

অন্ধকার এক ঘরের মধ্যে চেয়ারের সাথে খুব শক্ত করে হাত, পা বেঁধে রেখেছে সিরাতের। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকিয়ে হাতে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে মৃদু আওয়াজ করে ওঠে সিরাত। মা*থাটা ভীষণ ব্যথা করছে তার। গলা শুকিয়ে এসেছে। ধীর কণ্ঠে সে বলে,

“কেউ আছেন এখানে? আমাকে একটু পানি দিন। গলা শুকিয়ে এসেছে আমার।”

প্রথমে কয়েক বার ধীরে বললেও কেউ আসে না। তাই বাধ্য হয়ে যথাসম্ভব চিৎকার করে সিরাত বলে,

“আমাকে এভাবে বেঁধে রাখার মানে কী? কেউ আছেন এখানে? সামনে আসুন আমার।”

কথাটা শোনার সাথে সাথে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে একজন ব্যক্তি। অন্ধকারের মাঝে তার চেহারা ঠিক স্পষ্ট দেখতে পায় না সিরাত। খানিক্ষণ পর ব্যক্তিটি ঘরের আলো জ্বালালে সিরাত চমকে ওঠে। তার কণ্ঠস্বরে আপনাআপনি ভেসে আসে একজনের নাম।

“তুরাগ!”

সিরাতের মুখে নিজের নাম শুনে মুচকি হেসে তুরাগ বলে,

“বাহ্! এতদিনেও আমাকে ভুলতে পারোনি তাহলে। মাওয়ার সাথে সাথে তুমিও আবার আমার প্রেমে পড়ে যাওনি তো?”

“মুখ সামলে কথা বলো। তোমার মতো অত্যন্ত নিকৃষ্ট একজনের প্রেমে পড়ার মতো নোংরা মানসিকতা আমার নয়। কেন আটকে রেখেছ আমাকে? এতদিন পর ফিরে এসে আমার কাছে কী চাও তুমি?”

“আরে কুল কুল। সব সময় এত রেগে গেলে চলে নাকি হ্যা?”

সিরাতের গলা একেবারে শুকিয়ে যাওয়ায় সিরাত ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। তুরাগের দিকে তাকিয়ে বলে,

“আমাকে একটু পানি দাও।”

“পানি খাবে তুমি? দাঁড়াও, আনছি।”

ঘরের এক কোণ থেকে এক বোতল পানি এনে সিরাতের সামনে ধরে তুরাগ।

“তোমার হাত তো বাঁধা। কীভাবে পানি খাবে তুমি? আমিই খাইয়ে দেই কেমন?”

কথাটা বলে বোতলের মুখ খুলে সিরাতের মুখের সামনে বোতল নিয়ে যায় তুরাগ। সিরাত পানি খাওয়ার জন্য মুখ খুললে তুরাগ ওর চোখের সামনে বোতলের সবটুকু পানি মেঝের উপর ফেলে দেয়। সিরাত হতভম্ব চোখে তুরাগের দিকে তাকালে সে ভ্রূ নাচিয়ে বলে,

“এত কষ্ট করে তোমাকে এখানে ধরে এনেছি কি আদর, আপ্যায়ন করার জন্য? আমি তো তোমার কষ্ট দেখতে চাই সিরাত। তুমি তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর সেটা দেখে আমি মানসিক শান্তি পাব। হাহাহাহাহ!”

তুরাগের এই হাসি সিরাতের কাছে অসহনীয় লাগে। একরাশ বিরক্তি আর রাগ নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে।

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here