নতুন_শহরে ৮.(শেষ পর্ব)

0
3510

#নতুন_শহরে
#কুরআতুল_আয়েন

৮.(শেষ পর্ব)
ইস্পাত কখন থেকে সারারুম জুড়ে পায়চারী করছে।রাগে তার শরীর শিরশির করছে।ইসুর উপর মাত্রাতিরিক্ত ভাবে রেগে আছে ইস্পাত।সেই সাথে তার বাবা মুহিব আহম্মেদের উপরও।ইস্পাতের এখন মনে হচ্ছে কেন যে তার নাম ইস্পাত রাখতে গেলো!!ইস্পাত মনে মনে ভেবে নিয়েছে তার নাম নিয়ে সে ঘোর আন্দোলন করবে তার বাবা মুহিব আহম্মেদের সাথে।আন্দোলনের মূল টপিক হবে ‘নাম নিয়ে ঘোর বিপদ’!!

ইস্পাত মাথা থেকে আন্দোলনের কথা ঝেড়ে ফেলে দিলো।সব চিন্তা বাদ দিয়ে এখন ইসুর অপেক্ষায় বিরহ প্রেমিক হয়ে পড়লো।ইসুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ইস্পাতের একপ্রকার যায় যায় অবস্থা।একবার ভাবছে,সবার সামনে থেকে ইসুকে কোলে তোলে নিয়ে আসবে,আবার পরক্ষণেই ভাবে,মান-সম্মানের তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।তাই,ইস্পাত ক্যাবলা কান্তের মতো সারা রুম পায়চারী করতে লাগলো।

ইসু রিনি আহম্মেদের কাছ থেকে একদফা কথা শুনে ইস্পাতের রুমের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।সামনে ইমামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইসু মুখে শুকনো এক টুকরো হাসি টানলো।ইসুর হাসি দেখে ইমাম সাথে সাথে মেয়েদের মতো মুখ ভেঙচি কেটে চলে গেলো।ইসু ইমামের এইরকম ব্যবহারে মনে হয় আকাশ থেকে টুপ করে পড়লো।বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘ইমাম মেয়ে হলে বেশ মানাতো।কি সুন্দর করে মেয়েদের মতো মুখ ভেঙচি কাটলো।আমিও তো এতো সুন্দর করে মুখ ভেঙচি কাটতে পারি না।মুখ পুরোপুরি বাঁকিয়ে ভেঙচি কাটলে বেশ লাগে।যেমন ইমামকে লেগেছে।আচ্ছা আমাকে বললে ও শিখিয়ে দিবে?’

কথাগুলো বিরবির করতে করতে ইসু ইস্পাতের রুমের সামনে এসে থামলো।ভিতরে ঢুকতে তার খুব লজ্জা করছে।ইসু কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লজ্জাটা দূর করার চেষ্টা করলো।আপনাআপনিই হাসি আসছে তার।ইশশ!!এইভাবে যদি ইস্পাতের সামনে যায় তাহলে ইস্পাতে তাকে কিই বা ভাববে।তাই অন্যদিকে ঘুরে কিছুক্ষণ হেসে নিলো।কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়ে ইস্পাতের রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো।দরজা টার ছিটকিনি লাগাতেই ইসুর কাছে নিজেকে কেমন যেনো জামাই জামাই লাগতে শুরু করলো।আর ইস্পাত কে বউ বউ।কারণ,তার জায়গায় তো এখন ইস্পাতের থাকার কথা ছিলো।কিন্তু,উল্টো হয়ে তাকে এখন জামাইয়ের অভিনয় করতে হচ্ছে।এবার ইসুর খুব খারাপ লাগছে।এমনকি ইস্পাতের উপর রাগও হচ্ছে।ইস্পাত কেনো আগে রুমে ঢুকে পড়লো।বরং,ইস্পাতের অপেক্ষা করা উচিত ছিলো তার রুমে ঢোকার আগ পর্যন্ত।ইসু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।বিছানার পাশে বসতে গেলেই কোথা থেকে ইস্পাত তেড়ে এসে ইসুকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো।

ইস্পাত দাঁত কটমট করে বললো,

‘আমার নাম কি?’

ইসু গেলো বেক্কল বনে।ইস্পাতের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।তাই,মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে চোখ পিটপিট করে বললো,

‘জ্বি!ইস্পাত আহম্মেদ।’

ইস্পাতের পাল্টা প্রশ্ন,

‘কি হই আমি তোমার।’

‘স্যার অবলিক স্বামী।’

‘আমার ভাইয়ের নাম কি?’

‘লোহা না মানে ইমাম আহম্মেদ।’

ইস্পাত রেগে গিয়ে ইসুর মাথার পিছনে জোরে একটা ঠেলা দিলো।যার ফলে,ইসুর মাথাটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে যায়।এমন হওয়ায় ইসু অসহায় চোখে তাকালো ইস্পাতের দিকে।ইস্পাত নাক ফুলিয়ে বললো,

‘সেই শুরু থেকেই আমার নাম নিয়ে তোমার এতো সমস্যা।কেনো ইস্পাত কি কারোর নাম হয় না নাকি।’

ইসু বারকয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,

‘আসলে আপনার নাম টা শুনলে মনে হয় পদার্থ বিজ্ঞানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘তো আমি কি অপদার্থ নাকি।পদার্থ বিজ্ঞানের বিজ্ঞান না হলেও আমি কিন্তু পদার্থ।আমার ওজন আছে,ভর আছে,জায়গা দখল করি তো আমি পদার্থ না হয়ে কি অপদার্থ হবো।তুমি কি গাধী ইসু?এইটাও জানো না।’

ইসুর ভাবনায় পড়ে গেলো।সে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।তার মাথা আলুথালু হয়ে আছে।ইসুর মনে হচ্ছে ইস্পাত পাগল হয়ে গিয়েছে।ইসু কিছুটা ধীর গতিতে এগিয়ে গেলো ইস্পাতের সামনে।ইস্পাতের হাত ধরে বললো,

‘আপনি কি ঠিক আছেন?আমার মনে হয় আপনার মাথায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে।একটা স্যালাইন গুলে দিবো?’

ইস্পাত তালগোল পাঁকিয়ে বললো,

‘ইসু মাথায় গন্ডোগোল হলে কি স্যালাইন খায়?’

ইসু কিছুটা ভাবনায় বিভোর হয়ে বললো,

‘খায় না??’

ইস্পাত কপাল চাপড়াতে লাগলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘নারে গাধী!পাতলা পায়খানা হলে স্যালাইন খায়।আমার তো পাতলা পায়খানা হয় নি।তাই আমার এখন স্যালাইন লাগবে না।দয়া করে একগ্লাস পানি দাও।’

‘পানি কোথায় পাবো?’

ইস্পাত এবার দ্বিগুণ রেগে গিয়েছে।কিছুটা মিহি গলায় বললো,

‘ওয়াশরুমের কমোডে পাবে পানি।’

ইসু দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই ইস্পাত জোর গলায় ধমক দিয়ে বললো,

‘এই তুমি ওয়াশরুমে যাচ্ছো কেন?পানি কোথায় থাকে তুমি জানো না?আমার সাথে ফাইজলামি হচ্ছে।খাওয়ার পানি কি তুমি পায়খানা মিশ্রিত হলদেটে পানি খাও?ওহহ্ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম,পানি না খেলেও তুমি পায়খানা মিশ্রিত পানি দিয়ে কুলকুচি করতে পারো।কিন্তু,আমি পারি না।ভুলবশত,তোমার পাল্লায় পড়ে খেয়ে ফেলেছিলাম।এখন দয়া করে ডাইনিং রুমে গিয়ে টেবিলের উপর পানির যে বোতল টা দেখতে পাবে সেটা আমার জন্য আনলেই হবে।’

ইসু ইস্পাতের ধমক খেয়ে থতমত খেয়ে যায়।সে তো ভাবনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিলো ইস্পাতের মাথায় আসলেই কোনো গন্ডগোল হয়েছে কিনা।আগে তো ইস্পাতকে এমন দেখে নি।এরিমধ্যে,হুশ জ্ঞান হারিয়ে কি বলতে গিয়ে কি বলেছে বা কি করতে গিয়ে কি করে ফেলতে চেয়েছিলো তা নিতান্তই ইসুর অজানা।কিছুক্ষণ ইস্পাতের দিকে তাকিয়ে পানি আনার উদ্দেশ্যে দরজা খুলে দিলো এক দৌড়।

সকালে ঘুমঘুম চোখ নিয়ে ইসু বিছানায় গোল হয়ে বসে রইলো।পাশেই ইস্পাত খালি গা’য়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।ইস্পাতের ফর্সা পিঠটায় তিলের বাহার জমে আছে।ইসু চোখ দুটো কচলে ইস্পাতের পিঠটার দিকে নজর দিলো।তিলের মেলা দেখে ইসু একটু ঝুঁকে আলতো হাতে ইস্পাতের পিঠটায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিল গুনতে লেগে পড়লো।পনেরো পর্যন্ত গিয়ে ইসুর তালগোল পাঁকিয়ে গিয়েছে।মনে হচ্ছে একটা তিল সে বারবার গুনছে।আবারও গুনতে নিলে সেই একই অবস্থা হয় ইসুর।শেষমেষ ইসু তিলগুলোর উপর রাগ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।গোসল করে একটা শাড়ি পড়ে গুটিগুটি পা’য়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।লিভিং রুমে কাউকে না দেখে ইসু হাসি মুখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।চুলোয় চায়ের পাতিল বসাচ্ছে আর মনে মনে বিরবির করছে,
‘ভাগ্যিস শ্বাশুড়ি মা এখনো ঘুম থেকে উঠে নি।তাই রান্নাঘরে আসার সুযোগ পেয়েছি।উনাকে দেখলেই আমার বাঘিনী লাগে।ইশশ!লাস্টে কিনা বাঘিনী একটা শ্বাশুড়ি পেয়েছি।আর,দেওরঝির কথা তো বাদেই দিলাম।যেইভাবে তাকায় আমার দিকে মনে হয় আমি নেউলে।অবশ্য,একদিনে যা বুঝলাম আমাদের সম্পর্ক টা সাপে নেউলের সম্পর্কই হবে।আর,শ্বশুড় কে তো এখন পর্যন্ত দেখিই নি।আচ্ছা!উনি কোথায়?উনি কি আমার শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন না কি।হতেও পারে,বাঘিনীর সামনে না থাকাই ভালো।’

ইসু চা করে সকালের জন্য নাস্তাও করে ফেললো।রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো।সবেমাত্র সাত টা বাজতে চললো।একটু পর ইস্পাতকে ডেকে তুলবে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য।ইসু আজকে ভার্সিটি যাবে কিনা তা নিয়ে ভাবছে।গালে হাত দিয়ে রান্নাঘরের ছোট জানালা টা দিয়ে বাহিরের গাছপালার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো।কিছুক্ষণ পর ভালো মেয়ের মতো মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বললো,
আজকে ভার্সিটি যাবো না।নতুন বউদের প্রথম দিন ভার্সিটি যেতে হয় না।পরের দিন থেকে যেতে হয়।এইটা কোথায় লিখা আছে তা জানি না আমি!তবে,আমি বলেছি মানে এইটা কোথাও না কোথাও লিখা তো অবশ্যই আছে।আচ্ছা!পরে দেখে নিবো ক্রোমে সার্চ দিয়ে।

রিনি আহম্মেদ হাই তুলতে তুলতে রান্নাঘরে এসে ইসুকে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লেন।সকাল সকাল ইসুকে রান্নাঘরে দেখে তিনি বেশ খুশি হয়েছেন।আনন্দে উনার চোখে পানি আসার উপক্রম।আনন্দ হওয়ার একমাত্র কারণ হলো,উনার আজকে রান্না করতে হবে না।প্রত্যেক দিন সকাল সকাল উঠে রান্না করে সবাইকে খাইয়ে,রেডি করে বিদায় জানিয়ে নিজেকেও স্কুলের দিকে দৌড়াতে হয়।মাঝেমধ্যে তো দেরিতে গিয়ে প্রথম ক্লাস মিসও দিয়ে ফেলেন।আর,কাজের মেয়ে একদিন আসলে তো আরেকদিন আসে না।কাজের মেয়ের কথা বাদেই থাক।

ইসু সবার জন্য নাস্তা রেডি করে টেবিলে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো।শাড়ির আঁচল টা নাড়িয়ে নাড়িয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।উদ্দেশ্য,ইস্পাত কে ঘুম থেকে ডেকে তোলা।ইসু রুমে ঢুকেই দেখলো ইস্পাত অলরেডি রেডি হয়ে পড়েছে।ইস্পাত শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতাম লাগাতে লাগাতে ইসুর দিকে তাকালো।ইসু ঘাড় চুলকিয়ে বললো,

‘আপনি উঠে পড়লেন কেন?আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে আমি ঘুম থেকে উঠাবো।’

ইস্পাত তাড়া দিয়ে বললো,

‘প্রতিদিনকার অভ্যাস।সবসময় তো নিজে উঠেই ভার্সিটি যাই।অন্যদিন তো আরো আগে উঠি।আজকে একটু লেইট হয়ে গিয়েছে।’

ইসু চোখ বড় বড় করে বললো,

‘কেনো কেনো?’

ইস্পাত ইসুর দিকে তাকিয়ে মুখে মিষ্টি একটা হাসি টেনে ধরলো।এমতাবস্থায় বললো,

‘কাল রাতের জন্য আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।কাল রাতে যেনো কি হয়েছিলো।বলবো নাকি!!’

ইসু লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে।মুচকি হেসে মাথাটা নিচু করে ফেললো।ইস্পাতের দিকে তাকিয়ে যখন দেখলে ইস্পাত তার দিকেই এগিয়ে আসছে ইসু থতমত খেয়ে শাড়ি উঁচু করে দিলো এক দৌড়।ইসুর দৌড় দেখে ইস্পাত কতোক্ষণ অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

ইসু চোখ বন্ধ করে দৌড়ানোর ফলে ইমামের সাথে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো।ধাক্কা খেতেই ইসু কিছুটা জোরে চেঁচিয়ে বললো,

‘ইশশ!কোন লোহার সাথে ধাক্কা খেলাম আমি।কি শক্ত রে বাবা।’

ইসুর কথা শুনে ইমাম গাল ফুলিয়ে ইসুর দিকে তাকালো।পরমুহূর্তেই কিছুটা শক্ত গলায় বললো,

‘আমি লোহা হলে তুমি টিন।ইসু মার্কা ঢেউ টিন।’

ইসু ফট করে চোখ খুলে ইমামের দিকে তাকালো।ইমামকে সামনে দেখে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইমাম মুখ ভেঙচি কেটে চলে গেলো।ইসু ঠোঁট দুটো বাঁকা করে ইমামের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
—-
ইস্পাতের হাত টা শক্ত করে ধরে রেখেছে ইসু।সামনেই মোফাজ্জল আলম গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে আছেন ইসুর দিকে।ইসু আব্বার দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারছে না।ভয়ে তার হাত,পা অসাড় হয়ে আসছে।তাও,আবার সামনে শ্বশুড়,শ্বাশুড়িও রয়েছে।এই প্রথম ইসু তার শ্বশুড় মুহিব আহম্মেদকে দেখেছে।কালো হলেও চেহারায় অদ্ভুত একটা মায়া আছে।ভালো করে একবার লক্ষ্য করলে তাকিয়ে থাকতেই মন চাইবে।

মোফাজ্জল আলম মাথা নিচু করে বললেন,

‘তোরে পাঠাইছিলাম আমার স্বপ্ন পূরণ করতে।আর তুই কিনা বিয়া কইরা ফেললি তাও আবার আমারেও জানাইলি না।তোর খালা আছিয়ার কাছ থাইকা জানতে হইলো।আমি কি এতো খারাপ বাপ!!’

ইসু মুখে হাত গুজে কেঁদে উঠলো।দৌড়ে গিয়ে মোফাজ্জল আলমের পা’য়ে গিয়ে বসলো।পা দুটো শক্ত করে জাপটে ধরে বললো,

‘আব্বা!আমি ভুল করেছি।খুব বড় অন্যায়ও করেছি।আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবো আব্বা।আমি নিজের পা’য়ের দাঁড়াবো আব্বা।’

মোফাজ্জল আলম মুচকি হেসে ইসুকে নিজের বুকে টেনে নিলেন।ইস্পাতকে উনার বেশ মনে ধরেছে।মেয়েকে তো উনি সুখীই দেখতে চেয়েছিলেন।এমনকি,ইস্পাতের বাবা মার ব্যবহারেও মোফাজ্জল আলম বেশ খুশি হয়েছেন।সেই সাথে ইস্পাত তো আছেই।একজন মাঝি হয়েও তাঁকে এইখানে সম্মান দেওয়া হয়েছে।প্রকৃত শিক্ষার ধরণ মনে হয় এটাই।মোফাজ্জল আলম বিকেল পর্যন্ত থেকে পুনরায় গ্রামে চলে যান।ইস্পাত উনাকে থাকতে অনেক অনুরোধ করেছিলো কিন্তু মোফাজ্জল আলম ইচ্ছা করেই থাকেন নি।উনি আজকে ভিষণ খুশি।এই খুশিটাকে উনি উনার স্ত্রী আয়েশা বেগমের সাথে ভাগ করে নিতে চান ।আজকে আয়েশা বেগম বেঁচে থাকলে অনেকটা খুশি হতেন ইসুকে দেখে।তবে,মোফাজ্জল আলমের বিশ্বাস আয়েশা বেগম তাঁর ইসুকে প্রাণভরে দেখছেন দূর থেকে সেই সাথে দোয়াও দিচ্ছেন।

ইসু বারান্দার গ্রিল ধরে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আব্বা চলে যাওয়ায় তার ভিষণ কান্না পাচ্ছে।ইসুর খুব ইচ্ছা করছিলো আব্বার সাথে চলে যেতে।আজকে ইসুর খুব মা’য়ের কথা মনে পড়ছে।গ্রামে থাকলে এখন সে তার মা’য়ের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতো।ইসু দূর আকাশের পানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘মা!আমাকে দেখতে পাচ্ছো তুমি।তোমার ইসু সুখে থাকবে মা।তুমি একদম চিন্তা করো না।’

ইস্পাত ইসুর পিছনে দাঁড়িয়ে ইসুকে জড়িয়ে ধরলো।ইসুর কাঁধে নিজের থুঁতনীটা রেখে ফিসফিস করে বললো,

‘আমরা অনেক সুখী হবো ইসু।দেখবে একদিন তুমি এসে আমাকে বলবে,আমার এতো সুখ ভালো লাগছে না আমি একটু কষ্ট পেতে চাই।’

ইস্পাতের কথা শুনে ইসু খিলখিল করে হেসে দিলো।ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললো,

‘ধুর!এমন কখনো হয় নাকি।’

‘দেখে নিও তুমি।’

ইসু ইস্পাতের কথা তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে পুনরায় আকাশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।এই বিস্তর আকাশ টা তার কাছে বেশ লাগছে।এখন তার মুক্ত পাখি হতে ইচ্ছে করছে।এই বিস্তর আকাশে পাখিদের মতো উড়তে ইচ্ছে করছে।
_________
সময়ের সাথে সাথে অনেকগুলো দিন কেটে যায়।দিনের পর সপ্তাহ,সপ্তাহের পর মাস এমনকি মাসের পর প্রায় তিন তিনটা বছর কেটে গেলো ইসু আর ইস্পাতের দম্পতি জীবনের।এই তিনটা বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও ইস্পাত ঠিক আগের মতোই প্রেমিক পুরুষ রয়ে গেছে।ইস্পাতের এক একটা কান্ডকারখানা দেখলেই ইসুর মনে হয় তারা নতুন বিয়ে করেছে।আসলেই,ইসু অনেক সুখী ইস্পাতের মতো একজন জীবন সঙ্গী পেয়ে।

ইসু ফোলা পেট টা নিয়ে ধীর গতিতে বিছানায় বসে পড়লো।মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে।ইস্পাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খয়েরী রঙের একটা পাঞ্জাবী পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো।আজ রুমুর গা’য়ে হলুদ।রুমুর বরের নাম জিসান।জিসানের সাথে তার পারিবারিক ভাবেই বিয়ে ঠিক হয়েছে।ছেলে,ছেলের পরিবার ভালো দেখে আছিয়া বেগম আর দ্বিমত করলেন না।

ইসু কটমট চোখে তাকিয়ে আছে ইস্পাতের দিকে।ইস্পাতকে দেখছে আর ভিতরে ভিতরে ক্রোধ জ্বলে উঠছে।গতকাল থেকে বলে যাচ্ছে সে রুমুর বিয়েতে যেতে চায়।তার কোনো অসুবিধা হবে না।কিন্তু,ইস্পাত ইসুর কথা শুনেই না করে দিয়েছে।ইস্পাতের এক কথা,ইসু প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কোথাও যেতে পারবে না।ইস্পাত রিস্ক নিতে চায় না।বিয়ে বাড়িতে কোথায় লেগে গিয়ে যদি ইসু ব্যথা পায় তাই ইস্পাত ইসুকে কড়া আদেশে না করে দিয়েছে।তারপর থেকেই ইসু মুখ গোমড়া করে বসে আছে।ইসু ভেবেছিলো মুখ গোমড়া করে বসে থাকলে ইস্পাত তাকে তার সাথে করে নিয়ে যাবে।কিন্তু,ইস্পাত সেদিকে কোনো খেয়ালই করলো না।বরং,কি সুন্দর করে টইটই করে চলে গেলো।
———————
ইসু কলেজ থেকে এসে দ্রুত গতিতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।ফ্রেশ হয়ে সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে নিলো।আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল গুলোকে চিরুনি করে ঈশিতার দিকে এগিয়ে গেলো।মেয়েটার সবেমাত্র আটমাস হয়েছে।একদম ইস্পাতের মতো দেখতে।ইসু কলেজের একজন লেকচারার।ইসু পেরেছে সবদিক সামলে নিয়ে চলতে।সংসার সামলে ইসু তার আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে।সংসারের প্রতিটি কাজ রিনি আহম্মেদ ইসুকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছেন।ইসু শ্বাশুড়ি না একজন মা আর মায়ের ন্যায় একজন বান্ধুবী পেয়েছে।আর,ইমাম যেনো ইসুর ছোট ভাই।আসলেই তাদের সম্পর্ক টা সাপে নেউলের সম্পর্ক।কেউ কাউকে কথা শুনাতে পিছু পা হয় না আবার কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেও পারে না।

হুট করেই ঈশিতা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো।ইসু চমকে মেয়ের দিকে তাকালো।ঈশিতার কান্না দেখে ইসু বুঝে নিয়েছে ঈশিতার ডায়াপার পাল্টাতে হবে।ইসু ঈশিতার ডায়াপার পাল্টিয়ে দিয়ে কোলে নিয়ে সারা রুম জুড়ে হাঁটতে লাগলো।ইসু হাঁটছে আর ঈশিতাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে।মাঝেমধ্যে পিছন ফিরে দেখছে ঈশিতা ঘুমিয়েছে কিনা।কিন্তু,বাচ্চা ঈশিতা একবার চোখ বন্ধ করে তো আরেকবার খোলে রাখে।এইভাবে পনেরো মিনিট হাঁটার পর ঈশিতার চোখ দুটো কিছুটা বুজে আসে।এমন সময়,ইমাম ইসুর কাছে এসে গলা ছেড়ে বললো,

‘ওই টিন টিন!দস্তা কি ঘুমিয়ে পড়েছে।’

ইসু ঠোঁটে আঙুল চেপে ইমামকে চুপ থাকতে ইশারা করার আগেই ঈশিতা চট করে চোখ খুলে ড্যাবড্যাব করে তাকালো ইমামের দিকে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আচমকাই ঈশিতা গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো।ঈশিতার কান্না দেখে ইসু কিছুটা ভড়কে যায় সাথে ইমামও।ইসু কটমট চোখে তাকিয়ে ইমামকে বললো,

‘লোহার বাচ্চা লোহা!দিলি তো ঘুম ভাঙিয়ে।এখন তুই ওকে ঘুম পাড়াবি।’

ইমাম ক্যাবলার মতো একটা হাসি দিয়ে বললো,

‘টিন!দস্তা একদম তোমার মতো হয়েছে।আমার মতো হলেও হতো।’

‘ওই লোহা!আমার মেয়ের নাম ঈশিতা।কোনো দস্তা বস্তা না।’

ইমাম মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘এ্যাঁ!টিন আর ইস্পাতের মেয়ে দস্তাই হবে।তাছাড়া আর কিছুই হবে না।’

ইসু দাঁত কেলিয়ে বললো,

‘লোহার বাচ্চাও এলুমিনিয়াম হবে।আর কিছুই হবে না।টিট ফর ট্যাট ব্রো।’

ইমাম মুখ ভেঙচি মেরে চলে যায়।ইসু হাসতে হাসতে শেষ।ইসু ঈশিতার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঈশিতা তার দিকে গোলগাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।ইসু দাঁত বের করে হাসতেই ঈশিতা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো।ঈশিতার কান্না দেখে ইসু এবার আহাম্মক হয়ে গিয়েছে।ইসু ভ্রুকুটি কুঁচকে ঈশিতাকে ধমকি গলায় বলতে লাগলো,
‘আমার হাসি কি তোর ভালো লাগে না।বাপের মতো যদি আমার হাসির খারাপ মন্তব্য করিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।মনে রাখিস পেটে তোকে আমি ধরেছি তোর বাপ না।তাই,আমার প্রশংসা করবি সবসময়।’

ঠিক সেই সময়ে রিনি আহম্মেদ সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন।ইসুর কথা সম্পূর্ণ উনার কানে এসেছে।তাই তিনি হাঁটা থামিয়ে ইস্পাতের ঘরের পর্দা সরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘কিরে ইসু!আমাকে নকল করে আমার নাতনিকে কি বলছিস?’

ইসু জোরপূর্বক হেসে বললো,

‘ইয়ে মা!তোমার নাতনিকে একটু বকা দিচ্ছিলাম আর কি।আমার হাসি দেখলেই কাঁদে।কিন্তু,তোমার ছেলের হাসি দেখলেই মাড়ি বের করে হাসে।মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি ওর মা না।হাসপাতালে মনে হয় বাবু পাল্টে দিয়েছে আমাকে।’

রিনি আহম্মেদ শব্দ করে হেসে উঠলেন ইসুর কথা শুনে।এমতাবস্থায় বললেন,

‘এইরকম আমারও মনে হয়েছিলো।শেষমেষ তো তোর বাবার উপর রাগ দেখিয়েছি।’

রিনি আহম্মেদ হাসতে হাসতে চলে যান সেইখান থেকে।ঈশিতা এতোক্ষণ কান্না থামিয়ে মা আর দাদির কথা শুনছিলো।আগামাথা না বুঝলেও সে খুব মজা পাচ্ছিলো।কিন্তু,দাদি চলে যেতেই ঈশিতা আগের ন্যায় ট্যা ট্যা করে কেঁদে উঠলো।ইসু আর না পেরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
‘ইমাম ঠিকই বলে,তুই আসলেই একটা দস্তা।ইস্পাতের মেয়ে দস্তা।’

গোধূলির শেষ অংশ।আকাশের চারপাশে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে।ইসু মুচকি হেসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।বাহির থেকে বয়ে আসা মৃদু বাতাস টা ইসুর খুব ভালো লাগছে।নিজেকে ইসু খুব সুখী মনে করে।ইস্পাতের ভালোবাসায় কোনো কমতি পায় নি সে।তাকে নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,তার ছোটখাটো ইচ্ছা গুলো নিজের সাধ্যমতো পূরণ করা,এইসব কিছুই ইস্পাত খুব মনোযোগ দিয়ে করেছে।সেই সাথে ভালোবাসার গাঢ় অনুভূতি তো ছিলোই।ইসু বুঝতে পেরেছে ইস্পাতের সেইদিনের কথাটা খাপে খাপ মিলে গিয়েছে।আসলেই সে অনেক সুখে আছে।এই নতুন শহরে তার জন্য এতো সুখ অপেক্ষা করছিলো তা ভাবতেই ইসুর ঠোঁটে রোদের ঝলমলানির মতো একটা ঝিলিক মারা হাসি ফুটে উঠলো।

ইস্পাত ঈশিতাকে কোলে করে ইসুর কাছে এগিয়ে গেলো।এতোক্ষণ ইস্পাত ঈশতার সাথে খেলেছিলো।ইস্পাতের এক কথা আগে মেয়েকে সময় দিবে তারপর অন্যকিছু।ভার্সিটি থেকে এসেই ইস্পাত আগে ঈশিতার সাথে সময় কাটায়।নানান কথার বুলি ঈশিতার সামনে তুলে ধরে।আর ছোট্ট ঈশিতা বাবাকে পেলে মনে হয় চাঁদ হাতে পেয়ে গিয়েছে।ইস্পাতের একটা আঙুল ঈশিতা নিজের ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে।প্রথম যেদিন ঈশিতা ইস্পাতের আঙুল ধরেছিলো সেদিন ইস্পাত খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলো।ইস্পাত নিজেকে অনেক লাকি মনে করে।কারণ,তার ঘরে একটি ফুটফুটে জান্নাত রয়েছে।

ইস্পাত ঈশিতাকে কোলে নিয়ে ইসুর কাছে এগিয়ে গেলো।ইসুকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘কি ভাবছো তুমি?’

ইসু আনমনেই বলে ফেললো,

‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন,আমরা অনেক সুখী হবো।তবে,আমি আপনার থেকে আরো সুখ চাই।বোকার মতো ওইটা বলবো না আমার এতো সুখ ভালো লাগছে না,আমি কষ্ট পেতে চাই।বরং আমি বলবো,আমি এর থেকেও আরো একশোগুণ সুখ চাই।’

ইস্পাত ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দিলো।ইস্পাতের হাসি দেখে ঈশিতাও খিলখিল করে হেসে তাকিয়ে রইল ইস্পাতের দিকে।ইসু,বুকে হাত গুজে ভ্রুজোড়া কুঁচকে বললো,
‘একদম হাসবেন না আপনি।আপনার জন্য আমাকে নিয়ে এখন আমার মেয়েও হাসছে।’

কে শুনে কার কথা ইস্পাত হেসেই যাচ্ছে।ইস্পাতের সাথে তাল মিলিয়ে ঈশিতাও হাসছে।ইসু আড়চোখে তাদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো।চোখ জোড়া তার চিকচিক করছে।দুফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লেও ইসুর ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান।ইস্পাতও ইসুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটো দিয়ে ইশারা করে ইসুর ঠোঁটে চুমু এঁকে দিলো।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here