#নতুন_শহরে ki
#কুরআতুল_আয়েন
৭.
ইসু রিসোর্টের বারান্দায় থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।দূরের গাছগাছালির দিকে একমনে তাকিয়ে আছে।ইসু গাঢ় লালচে খয়েরী রঙের সুন্দর একটা শিপনের শাড়ি পড়ে আছে।বিয়ের পরের দিন ইস্পাতের থেকে পাওয়া এই শাড়িটি।দুপুর হতে চললো এখনো ইস্পাত আসছে না।সেই সকালে বেরিয়েছিলো রিসোর্ট থেকে এখনো আসার কোনো নামেই নেই।রুমু ঢুলুমুলু পা’য়ে ইসুর কাছে এসে বসলো।বেচারি রুমু এতোক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।ইস্পাতের ফোন পেয়ে বাধ্য হয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠে আসতে হলো।ইসুর কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা হাই তোলে বলতে লাগলো,
‘তোর জামাই ফোন করেছিলো।বলেছে,আসতে একটু দেরি হবে।চিন্তা করিস না।’
ইসু মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে।রুমুর কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললো না।ইসুর খুব অভিমান হয়েছে ইস্পাতের উপর।তার আসতে দেরি হবে এই কথাটা রুমুকে না বলে তাকে তো বলতে পারতো।তার নাম্বার তো ইস্পাতের ফোনে আছে।তার মানে কি,ইস্পাত তার নাম্বার টা সেইভ করে নি।ভাবতেই ইসুর মুখ আরো চোখা হয়ে যায়।
রুমু চোখ দু’হাতে কচলে ইসুর দিকে তাকালো।ইসুকে শাড়ি পড়তে দেখে রুমু বড়সড় একটা ঝটকা খেলো।অবশ্য,বিয়ের দিনেও পড়েছিলো।তবে,আজকে বেশি সুন্দর লাগছে।আলুথালু চোখ নিয়ে রুমু ইসুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ইসু!এই শাড়িতে তোকে একদম ফাটাফাটি লাগছে।তোর জামাই দিয়েছে বুঝি।’
ইসু মুখটাকে বেঁকিয়ে বললো,
‘কখন থেকে আমার জামাই আমার জামাই করে যাচ্ছিস।উনি তোর স্যার হয় রুমু।সম্মান দিয়ে কথা বলবি।’
‘তোর এইসব লেইম কথা তোর কাছেই রাখ।তোর জামাইয়ের সাথে আমার এখন শালী দুলাভাইয়ের সম্পর্ক।এইজন্য তো ঠিকভাবে শালীর ব্যবহারের প্র্যাক্টিস টা করছি।
ইসু কিছু বলে নি।তবে,মনে মনে খুব বিরক্ত হচ্ছে।ইসুর কোনো উত্তর না পেয়ে রুমু সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকালো ইসুর দিকে।আচমকাই রুমুর চোখ গিয়ে পড়লো ইসুর বুকের কাছে কালচিটে দাগটার উপর।রুমু খানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
‘ইসু তোর বুকে কিসের দাগ এইটা।কেউ কি কাঁমড়িয়েছে তোকে?’
ইসু লজ্জায় মাথাটাকে নিচু করে ফেললো।কাল রাতের কিছু মুহূর্ত মনে পড়ে যায়।ইস্পাতের পাগলামির ফলস্বরূপে এই কালচিটে দাগটা ভেসে উঠেছে।কিই বা দরকার ছিলো ইসুকে এইভাবে কাঁমড়ানোর।শরীরের আরো জায়গায় জখম হয়েছে।গোসল করার সময় ইসুর চোখে পড়েছে।কিন্তু,বুকের কাছের এই দাগটা ইসুর চোখে পড়ে নি।ইসু এবার হারে হারে বুঝতে পেরেছে ইস্পাত আসলেই তার হলদেটে শরীরটায় তার ভালোবাসার চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে।তবে,এখন বেশ লজ্জা লাগছে ইসুর।
রুমু ইসুকে লজ্জা পেতে দেখে এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে রইলো ইসুর দিকে।ইসুর কনুইয়ে টোকা দিয়ে বললো,
‘কিরে!বল এইটা কিসের দাগ।’
ইসু দাঁত কটমট করে তাকালো রুমুর দিকে।রুমু কনুইয়েতে টোকা দেওয়ার ফলে ইসুর হাত টা কেমন ব্যথা করছে আর সেই সাথে ঝিনঝিনও করছে।ইসু কিছুটা মিহি গলায় বললো,
‘তোর এতো জানতে হবে না এইটা কিসের দাগ।তবে,এইটা একটা দাগ।কিন্তু,কিসের দাগ তা বলা খুবই মুশকিল।’
রুমু হেসে ইসুর দিকে এগিয়ে গেলো।ইসুকে আঁকড়ে ধরে বললো,
‘আমি জানি এইটা ইস্পাত স্যারের ভালোবাসার চিহ্ন।এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে এতে।তোরেই তো জামাই।যাক অবশেষে তোরা এক হয়েছিস।’
ইসু দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো।রুমুর কথায় সে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে।না জানি,ইস্পাতের সামনে কি হবে তার।ইসু কিছুক্ষণ নখ কাঁমড়িয়ে ভাবলো,আজকে আর ইস্পাতের কাছে যাবে না সে।বিয়ের পর থেকেই ইসুর কাছে ইস্পাতকে কেমন প্রেমিক পুরুষ মনে হচ্ছে।তা এক দিনেই বুঝে ফেলেছে ইসু।অবশ্য,ইসুর তো বুঝার কথা!কারণ,ইস্পাত তো তার প্রেমিক পুরুষের কিছুটা প্রমাণ দিয়েছে।
—-
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চললো।ইস্পাত এখনো আসছে না দেখে ইসু বেশ খানিকটা চিন্তায় পড়ে যায়।রুমে পায়চারী করছে আর শাড়ির আঁচল টা নিয়ে খেলছে।এমন সময় দরজার শব্দ পেতেই ইসু সামনে তাকায়।ইস্পাতকে দেখে ইসুর মন নিমিষেই আনন্দে মেতে উঠলো।সাথে সাথেই দুশ্চিন্তার রেশ সরে গিয়ে একরাশ লজ্জা এসে ভর করলো।ইস্পাত সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো।ভার্সিটি তে গিয়েছিলো গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের জন্য।সারাদিনের পরিশ্রমের পর লম্বা একটা গোসল না দিলে চলেই না।কিন্তু ইসু তো ভেবেছিলো অন্যকিছু।ইস্পাত বাহির থেকে এসে আগে তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,তাকে এই শাড়িটায় খুব সুন্দর লাগছে।কিন্তু,তা না করে সোজা চলে গেলো ওয়াশরুমে।ইসুর দিকে একবারো তাকালো না পর্যন্ত।
ইসু বিছানার এককোণায় বসে আছে।ইস্পাত নিজেকে পরিপাটি করে ইসুর কোলে শুয়ে পড়লো।ইস্পাত ইসুর কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ইসু!মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো।প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।মনে হয় ব্যথায় ছিঁড়ে যাবে।’
ইস্পাতের কথায় ইসুর খুব মায়া হলো।কেন জানি ইস্পাতকে তার জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে।নিজের ইচ্ছেটাকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বালিচাপা দিয়ে ইসু ইস্পাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।আরামে ইস্পাত কিছুক্ষণের মধ্যে ইসুর কোলেই ঘুমিয়ে যায়।
মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে পৌঁছতেই ইসুর ঘুম ভেঙে যায়।পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের কোলে ইস্পাতকে দেখে ইসুর বিকেলের কথা মনে পড়ে গেলো।ইসুও ইস্পাতকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।ইসু ইস্পাত কে সরিয়ে উঠতে নিলেই ইস্পাতের ঘুম ভেঙে যায়।ইস্পাত শুয়া থেকে উঠে বসলো।লম্বা লম্বা চুলগুলো ঠিক করে ইসুর দিকে তাকালো।ইসু কতোক্ষণ ইস্পাতের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে জায়গা পরিত্যাগ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ইস্পাত ইসুর হাত ধরে আটকিয়ে দেয়।হেঁচকা টান দিয়ে ইসুকে নিজের কাছে এনে চেপে ধরে।এমন হওয়ায় ইসু খুব লজ্জায় পড়ে যায়।লজ্জায় ইস্পাতের দিকে তাকাতেও পর্যন্ত পারছে না।শুধু মনে হচ্ছে,কখন ছাড়বে ইস্পাত আর সে এক ছুটে পালিয়ে যাবে।
ইস্পাত ইসুকে জড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।ইসুর দিকে কতক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো।আচমকাই ইসুকে নিচে ফেলে দিয়ে ইস্পাত ইসুর উপরে উঠে এসে ইসুর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো।গলায় খোঁচা খোঁচা দাড়ির আঁচড় পেতেই ইসু ইস্পাতের টি-শার্ট পেছন দিক থেকে খামচে ধরলো।কাল রাতেও এমন হয়েছিলো।ইস্পাত নিজের মতো ব্যস্ত।ইসু ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
‘ছাড়ুন!বাসায় যাবেন না।সন্ধ্যা হয়ে আসলো।’
ইস্পাত এমতাবস্থায় বলতে লাগলো,
‘যাবো!!একটু পরেই বেরিয়ে পড়বো।তবে,আমার না যেতে ইচ্ছে করছে না।তোমাকে নিয়ে এইভাবে সারাজীবন থাকতে ইচ্ছা করছে।’
ইস্পাতের গরম নিঃশ্বাস ইসুর গলায় আঁছড়ে পড়ায় ইসুর যায় যায় অবস্থা।তার উপর ইসুর খুব সুড়সুড়ি লাগছে।সেই সাথে নাক চুলকিয়ে একটা বড়সড় হাঁচি দিতেও ইচ্ছা করছে।ইসু কোনোমতে নিজেকে ঠিক রেখে বললো,
‘আচ্ছা আমাদের কি মেনে নিবে?যদি কোনো সমস্যা হয়??শিমু ম্যাডাম যদি আমাকে বেত দিয়ে মারে তাহলে কি হবে?’
ইসুর বাচ্চামো কথা শুনে ইস্পাত হেসে দিলো।হাসতে হাসতে ইসুর কথার পিঠে বললো,
‘সেসব তখন দেখা যাবে।আপাতত এখনের সময় টা উপভোগ করো।পরে কি হবে তা ভেবে আমাদের এই মুহূর্তের কাটানো সুন্দর সময় টাকে অবহেলায় পড়ে থাকতে দিও না।’
‘আচ্ছা!আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন না তো।আমার খুব ভয় হচ্ছে।’
ইস্পাত ইসুকে আরো শক্ত করে জাপটে ধরলো।কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘না রে বোকা!কখনোই যাবো না।’
ইসু স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো।তাও,ভিতরে ভিতরে কেমন যেনো অস্থিরতা করছে।বারবার মনে হচ্ছে,সে ইস্পাত কে হারিয়ে ফেলবে।
সন্ধ্যার দিকেই সবাই রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যায়।ইস্পাতের ফ্রেন্ডস রা ইস্পাত আর ইসুর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় অন্যপথে।রুমু,ইসু আর ইস্পাত এখন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।পাশে মেইনরোড দিয়ে বাস,গাড়ি সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যের দিকে।রুমু একটু সামনে এগিয়ে হাঁটছে।রুমু ইচ্ছা করেই সামনে এগিয়ে গেলো ইসু আর ইস্পাতকে একটু স্পেস দেওয়ার জন্য।নতুন বিয়ে হলে তো নতুন দম্পতি একটু কাছাকাছিই থাকতে চায়।ইসু বুকে হাত গুজে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে।অন্ধকার ফুটপাতের রাস্তা টায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।তার মনের ভিতর শুধু অস্থিরতা কাছ করছে।ইস্পাত ইসুর পাশে শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,
‘কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি?’
ইসু ইস্পাতের গলার আওয়াজ পেয়ে অন্ধকার রাস্তাটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ইস্পাতের দিকে তাকালো।অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইসু ইস্পাতকে বললো,
‘জানি না!তবে খুব অস্থিরতা লাগছে।কেন জানি খুব ভয় হচ্ছে।’
‘ইসু!মন থেকে সেসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দাও।দেখবে ভালো কিছু হবে আমাদের সাথে।’
ইসু আর কিছু বলেনি।চুপ করে মাথা নিচু করে আগের ন্যায় হেঁটে যাচ্ছে।ইস্পাত ইসুর দিকে তাকিয়ে আছে।ইস্পাত বুঝতে পেরেছে ইসুর মনের অবস্থা।ইসু যে তাকে হারানোর ভয় পাচ্ছে।
ফুটপাতের সামনেই একটা ফুচকা স্টল দেখতে পেলো ইস্পাত।ইসু নিচের দিকে তাকিয়ে এতোটাই মগ্ন ছিলো যার ফলে,ফুচকা স্টল টি তার চোখেই পড়ে নি।ফুচকা তো ইসুর খুব প্রিয় তা ইস্পাত আগে থেকেই জানে।ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ইসু যে রাক্ষসীর মতো গপগপ করে একটার পর একটা ফুচকা গিলতো তা ইস্পাত লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো।আর মুচকি মুচকি হেসে নিজের ফোনে ইসুর ছবিও তুলে নিতো।এইসব এখন পর্যন্ত ইসু জানেও না।ইস্পাত গলা কেশে বললো,
‘বউ আর শালী ফুচকা খাবেন না আপনারা?’
রুমু ফোনে ব্যস্ত ছিলো যার ফলে ফুচকা স্টল টি তার চোখে পড়ে নি।ইস্পাতের কথার আওয়াজ পেয়ে রুমু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘কি যে বলেন না স্যারভাই।ফুচকা কি বাদ দেওয়ার জিনিস নাকি।’
ইস্পাত ভ্যাঁবাচেকা খেয়ে গেলো রুমুর স্যারভাই ডাক শুনে।মুখটা কুঁচকে বললো,
‘স্যারভাই এইটা আবার কেমন ডাক?আগে তো কখনো এইরকম অদ্ভুত ডাক শুনি নি।’
রুমু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ভার্সিটির শিক্ষক এইজন্য স্যার,ইসুর জামাই হয়েছেন এইজন্য দুলাভাই।দুইটা তো একসাথে ডাকা সম্ভব না।তাই কাট মার্কের মতো কমিয়ে স্যারভাই তে এসেছি।’
ইস্পাত রুমুর কথা কর্ণপাত করেই হো হো করে হেসে উঠলো।এতে রুমু বেশিখানিকটা লজ্জা পেয়ে ফুচকা স্টলের দিকে এগিয়ে গেলো।এতোকিছুর মাঝেও ইসু আগের মতোই মনমরা হয়ে আছে।সে শুধু ভাবছে,বাসায় সবার সামনে দাঁড়াবে কীভাবে!আর তার আব্বার মুখোমুখিই বা হবে কীভাবে।তার আব্বার স্বপ্ন পূরণে কি বাধা চলে এসেছে!তার আব্বা তো তাকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলো কিন্তু,এইখানে এসে যে এইরকম একটা ঘটনা তার জীবনের সাথে জড়িয়ে যাবে তা কিছুতেই ভাবতে পারে নি ইসু।
ইস্পাত ইসুকে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
‘ইসু চলো ফুচকা খাবে।তোমার তো খুবই প্রিয়।’
ইসু ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো ইস্পাতের দিকে।নিজের উপর এখন তার খুবই রাগ হচ্ছে।কেন সে বিয়ে করে নিলো ইস্পাতকে!কি জবাব দিবে তার আব্বাকে।আব্বার স্বপ্ন গুলো কি তাহলে সে পূরণ করতে পারবে না।ইসুর কেন জানি এই নতুন শহরে দমবন্ধ হয়ে আসছে।ইসু মাথা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।ইসুর কান্না দেখে ইস্পাত হকচকিয়ে যায়।ইস্পাত ইসুর কাছে আসতে নিলেই ইসু থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
‘কেন এসেছিলেন আপনি আমার জীবনে?কেন দেখা হলো আপনার সাথে আমার।আপনার জন্যই আমি আমার আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি নি।হ্যাঁ!হ্যাঁ!আপনার জন্যই।আপনাকে ছাড়া তো আমি থাকতে পারছিলাম না,নিজেকে খুব একা একা লাগছিলো।যার জন্য,আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম।কিন্তু,এখন কি হবে আমার!আমি কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো আব্বার সামনে।কি জবাব দিবো আব্বাকে!!’
ইস্পাতের নিজেকে এখন খুব অপরাধী লাগছে।ইশশ!কেনই পাগলের মতো ইসুকে বিয়ে করে নিলো।তারই বা কি করার ছিলো,সে তো ইসুকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারছিলো না।আবার তখনি তার সাথে শিমুর বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।সবকিছুই একসাথে ঝড়ের গতিতে আসায় ইস্পাত কেমন যেনো তালগোল পাঁকিয়ে ফেলেছিলো।তার মন শুধু বলেছিলো,যেভাবেই হোক ইসুকে নিজের করে নিতে।মনের কথাকেই তো প্রায়োরিটি দেওয়া দরকার।তাই,ইস্পাত মনের কথাই শুনেছে।
ইস্পাত ইসুর কাছে এগিয়ে গেলো।ইসুকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
‘তোমার আব্বার স্বপ্ন পূরণ তুমি করবে ইসু।আগে তুমি একা ছিলে এখন আমিও তোমার সাথে যুক্ত হয়ে তোমার আব্বার স্বপ্ন পূরণের পথে তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।তুমি শুধু আমাকে ভুল বুঝো না ইসু।তুমি ভুল বুঝলে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারবো না।আর,আমার কাছে থাকলে যদি তোমার স্বপ্ন পূরণে সমস্যা হয় তাহলে আমি তোমার স্বপ্ন পূরণের আগ পর্যন্ত তোমার সামনে আসবো না।একদম তোমার আব্বার স্বপ্ন পূরণের পরেই না হয় তোমার কাছে ধরা দিবো।’
ইস্পাতের কথা শেষ না হতেই ইসু ইস্পাতকে জাপটে ধরলো।ক্রন্দনরত গলায় বলতে লাগলো,
‘আমি আপনাকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।রাগের মাথায় কি বলেছি তা একদমই বুঝতে পারি নি।আমাকে ক্ষমা করে দিন আপনি।আমি আপনার সাথে থেকেই আব্বার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।কিন্তু,আমার খুব ভয় হচ্ছে।’
‘হুশশ!পাগলী!কোনো ভয় নেই।আমি তোমার সাথে আছি ইসু।’
ইসু এখনো কেঁদেই যাচ্ছে।বারবার চোখের সামনে শুধু আব্বার চেহারা টা ভেসে উঠছে।কিছুক্ষণ পরেই ইসু কান্না থামিয়ে দেয়।সে কিছুতেই ইস্পাতের মনে দুঃখ দিতে চায় না।ভুল তো তার ছিলো,ইস্পাতকে অবহেলা করেছিলো বলেই তো ইস্পাত বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু,এখন এইভাবে কান্না করলে ইস্পাত নিজেকে অপরাধী,ছোট ভাববে।তাই,ইসু কান্না থামিয়ে হাসি মুখে ইস্পাতের হাত টা নিজের হাতের ভাঁজে ঢুকিয়ে নিয়ে বললো,
‘ফুচকা খেতে চলুন।অনেকক্ষণ হলো,ফুচকা গুলো আমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে।এখন তাদের কাছে না গেলে তারা খুব রাগ করবে।’
ইস্পাত মুচকি হেসে ইসুর কথার সায় দিয়ে বললো,
‘চলো।ওদের কাছে গিয়ে তোমার মনের ইচ্ছা,বাসনা পূর্ণ করে আসি।’
ইস্পাত আর ইসু গিয়ে দেখে রুমু অলরেডি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।এমনকি প্রায় অর্ধেক টাই খাওয়া হয়ে গিয়েছে।ইসু মুখটাকে সরু করে বললো,
‘তুই খাওয়া শুরু করে দিলি রুমু তাও আবার আমাকে রেখে।ঘোর অন্যায় করেছিস তুই।’
রুমু আরেকটা ফুচকা মুখে ঢুকিয়ে নিলো।চিবোতে চিবোতে ইসুর কথার পিঠে বলে উঠলো,
‘তোর তো জামাই আছে আমার তো কেউ নেই।তাই ফুচকা খাওয়াই শুরু করে দিয়েছি।’
ইসু কিছুক্ষণ রুমুর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে রইলো।মেয়েটা যে এইভাবে বেসামাল কথা বলবে তা ইসুর জানাই ছিলো না।ইসু আর কথা না বাড়িয়ে ফুচকা ওয়ালার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘মামা!ভালো করে ঝাল দিয়ে একপ্লেট ফুচকা দিন তো।’
ইস্পাত ইসুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।একটু আগে মেয়েটা কি কান্নাই না করছিলো আর এখন ঠোঁটে হাসি বিদ্যমান।ইস্পাত মনে মনে ভেবে নিয়েছে,সে ইসুকে কিছুতেই কষ্ট দিবে না।যেভাবেই হোক ইসুকে সে আগলে রাখবে।তার এখনো তাদের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে।ট্রেনের এক একটা কাহিনি মনে পড়তেই ইস্পাত আনমনে হেসে উঠলো।
—-
ইসু যেই ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো।ইসু থরথর করে কাঁপছে।কিন্তু,ইস্পাতের কোনো ভাবান্তর নেই।সে দিব্বি স্বাভাবিক ভাবে সোফায় বসে আছে।ইসু অসহায় চোখে তাকালো ইস্পাতের দিকে।ইস্পাত ইসুর মুখ পানে একবার চেয়ে পুনরায় সামনে দাঁড়ানো রিনি আহম্মেদের দিকে তাকালো।রিনি আহম্মেদ মাথায় আইস ব্যাগ নিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন ইস্পাত আর ইসুর দিকে।রিনি আহম্মেদের বেশি রাগ হচ্ছে ইস্পাতের উপর।বিয়ে করে কি সুন্দর ফোন করে বলে,মা আমি শিমুকে বিয়ে করতে পারবো না।আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেছি।শিমুকে বিয়ে করার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিলাম।তুমিই বলো মা,ভালোবাসার মানুষ যখন কষ্ট দেয় তখন কি নিজেকে ঠিক রাখা যায়।তাই তো আমি রাগের বশে এইসব করে ফেলেছি।আমার উপর রাগ না করে তুমি প্লিজ ওইদিকটা সামলাও মা।
ইস্পাতের এই কথাগুলো রিনি আহম্মেদের মাথায় জোঁকের মতো লেগে আছে।তখন যে উনার মনের অবস্থা কি হয়েছিলো সেইটা একমাত্র উনিই জানেন।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ছেলের মুখে এমন একটা কথা শুনা বড্ড বেমানান।তার উপর আত্নীয়স্বজনের কটূ কথা আবার পাড়া-পড়শীর কটূ কথা।সব মিলিয়েই রিমি আহম্মেদ ইস্পাতের উপর অনেকটা রেগে আছেন।একটিবার তো উনাকে বলতে পারতো ইস্পাত,যে তার শিমুকে পছন্দ না।সে অন্যকাউকে ভালোবাসে।আর,এইদিক দিয়ে উনি শিমুর পরিবারকে সামলাতে গিয়ে অনেকটা হিমশিম খেয়েছেন।ভাগ্যিস আছিয়া বেগম ছিলেন তার পাশে।না হলে তো আরো সুনামি বয়ে যেতো উনার উপর দিয়ে।তবে,শিমুর জন্য উনার খুব খারাপ লেগেছিলো।মেয়েটা কতোটাই না কষ্ট পেলো।ইমাম যদি বড় হতো তাহলে ধরে বেঁধে উনি শিমুকে ইমামের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন।কারণ,শিমুকে তো উনি নিজে পছন্দ করেছিলেন।তবে,ইসুকেও উনার বেশ লেগেছে।ইসুর চেহারাতে একটা বোকা বোকা ভাব আছে।রিনি আহম্মেদ এখন ভেবে দেখলেন,বোকা বউয়েই তো ভালো।সব সময় শ্বাশুড়ির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।তবে,এখন গলা যাবে না।একটু রেগে থাকতে হবে।
তাই,রিনি আহম্মেদ আগের থেকেও মুখটাকে অন্ধকার করে রেখেছেন।অন্যদিকে আছিয়া বেগম ইসুর দিকে অসহায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।তিনি খুব খুশি ইসুর জন্য ইস্পাতের মতো একটা ভালো ছেলে পেয়ে।বোন মারা যাওয়ার পর থেকেই তো ইসু একদম একা হয়ে গিয়েছিলো।বোনের প্রেমের বিয়ে ছিলো বলে উনার বাপের বাড়ির কেউ ইসুকে মেনেই নেয়নি।তবে,প্রথম যেদিন উনার বোন ইসু পেটে আসার খবর টা দিয়েছিলো তখন যে উনি কি খুশিটাই না হয়েছিলেন।এমনকি খুশিতে উনি কেঁদেও দিয়েছিলেন।ভেবে নিয়েছিলেন,এই বুঝি বোন আর বোনের স্বামীকে মেনে নিবেন উনার বাপ,ভাইয়েরা।কিন্তু,সে গুড়ে বালি!বরং,এই খবর টা পেয়ে উনার বাপ,ভাইয়েরা ইসুকে মানতে তো নারাজ সেই সাথে ইসুকে জারজ সন্তানও বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।কথাগুলো ভাবতেই আছিয়া বেগমের শরীর শিরশির করে উঠলো।তবে,এখন ভয় হচ্ছে রিনি আহম্মেদ কে নিয়ে।উনার মুখ দেখেই আছিয়া বেগম ভয়ে কয়েকশো ঢোক গিললেন।
ইমাম কখন থেকে বলে যাচ্ছে আমি ওকে ভাইয়ার বউ হিসেবে মানি না।ইসু পারছে না কেঁদে দিতে।তার এখন মনে হচ্ছে কেন যে এই ছেলের সাথে ছাঁদে ওইদিন কথা বলতে গিয়েছিলাম।ইস্পাত কটমট করে তাকিয়ে রইলো ইমামের দিকে।সে কি চকলেট খাইয়ে কালসাপ পু্ঁষেছে নাকি।কই ভাইয়ের হয়ে কথা বলবে,তা না করে কখন থেকে চিল্লিয়ে যাচ্ছে আমি ওকে ভাইয়ার বউ হিসেবে মানি না।ইস্পাত পারছে না ইমামকে ক্রিকেট বল বানিয়ে ছক্কা মেরে বাউন্ডারির বাহিরে ফেলে দিতে।
রিনি আহম্মেদ ছোট ছেলের কথা শুনে মনে হয় আকাশ থেকে পড়লেন।উনি ভেবে পাচ্ছেন না কেনই উনার ছোট ছেলে এই বোকাসোকা মেয়েটাকে মানতে রাজি হচ্ছে না।ইমামের ভিতরের কথা বের করার জন্য উনি আদুরে গলায় বললেন,
‘কেনো রে বাবা!তুই এমন বলছিস কেনো?’
ইমাম তেড়ে গিয়ে বললো,
‘আম্মু তুমি কি ওকে মেনে নিয়েছো?’
রিনি আহম্মেদ হ্যাঁ ও বললেন না!আবার না ও বললেন না।শুধু কড়া গলায় বললেন,
‘বাপের মতো আমাকে পাল্টা প্রশ্ন না করে আমার প্রশ্নের জবাব দে।পেটে তোকে আমি ধরেছি তোর বাপ না।তাই,বাপের মতো না হয়ে আমার মতো হওয়ার চেষ্টা কর।’
‘আমি ওকে মানি না কারণ,ও আমাকে লোহা বলেছে।বলেছে,ইস্পাতের ভাই নাকি লোহা হয়।ইমাম হয় না।’
রিনি আহম্মেদ হাসতে গিয়েও পারলেন না।হাসলে অবস্থা উনার হাতের বাহিরে চলে যেতে পারে।তবে,বিরবির করে বললেন,মেয়েটা তো জব্বর পাজি।
মিনিট পাঁচেক সময় নিয়ে রিনি আহম্মেদ নিজেকে ঠিক করে বললেন,
‘বলবেই তো।ইস্পাত নাম টা তোর বাপে রেখেছে না এইজন্য।তোর নাম টা তো আমি রেখেছি।কি সুন্দর নাম রেখেছি আমি।শুনলে মন জুড়িয়ে যায়।একবার বললে বারবার শুনতে মন চাইবে।ইশশ!কেন যে ইস্পাতের নাম টা আমি রাখতে পারলাম না।’
ইস্পাত চোয়াল শক্ত করে তাকালো ইসুর দিকে।যার অর্থ আজকে ইসুকে পেলে খবর আছে।ইসু শুকনো ঢোক গিলে সবার দিকে একবার তাকিয়ে পরমুহূর্তেই আছিয়া বেগমের দিকে তাকালো।আছিয়া বেগম মুখে মিষ্টি হাসি বজায় রেখে দূর থেকে ইসুকে আশ্বস্ত করলেন।
চলবে..