#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৮
#লেখায়_জারিন
১৫৯.
লিস্ট দেখে এক এক করে সব জিনিসগুলো মিলিয়ে নিল নক্ষত্র। সেগুলো আলাদা করে টেবিলে গুছিয়ে রেখে ফোঁস করে ক্লান্তির শ্বাস ছাড়লো সে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে রীতিমত। মাত্র দুজনের সংসারের খুঁটিনাটি কত কি লাগে…এই প্রথম দেখলো সে।এমন বাজার সদাই করার ব্যাপারে সে বরাবরই কাঁচা। কখনো প্রয়োজন পড়েনি করার, তাই অভ্যাসও নেই।বড়জোর বিদেশে থাকাকালীন সুপারমল থেকে টুকিটাকি বাজারসদাই করতো নিজের জন্য। একলা মানুষের আর বেশি কি লাগে।কিন্তু, আজ ইরিনের এখানে এসে জানলো সংসার করতে গেলে কত কি লাগে!
সব কাজ শেষ করে সোফায় গিয়ে বসলো সে। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলো তাতে। চোখ বন্ধ করে আবারও ভাবতে লাগলো আজ বিকেল বেলা ছাদে দাঁড়িয়ে রাফিদের বলা কথাগুলো।
রাফিদের সাথে কথোপকথনের একপর্যায়ে গিয়ে রাফিদের তাকে বলে, ‘ইরিন অনেক সাহসী একজন নারী, মি. নক্ষত্র। হোক সেটা ভুল করার ক্ষেত্রে বা অকপটে ভুল স্বীকার করার বেলায়। নিজের জীবনের তিক্ত,বিষাক্ত…বিভৎস যে অতীত সে অবলীলায় আমাকে বলে গেছে…খুব সাহসী নারী না হলে এটা কখনোই সম্ভব না। তবে, আমার কি মনে হয় জানেন মি. নক্ষত্র? ইরিনের এই সাহসের সবচেয়ে বড় ক্রেডিটটা বরাবরই আপনারই ছিল। আর আজও তাই।
‘ মানে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘বিয়ের পর যে স্বাধীনতা আপনি তাকে দিয়েছিলেন বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাস ভাঙার সাহসটা সে পেয়েছিল আপনার থেকে দূরত্বের কারণে। যে সময়টা আপনার তাকে সময় দেওয়া উচিৎ ছিল, তাকে বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা করার, নিজেদের দাম্পত্য জীবনকে গোড়া থেকে গড়ে নেওয়ার ছিল ঠিক সে সময়ই আপনি তার থেকে দূরত্ব রেখে চলেছিলেন। জানি সেটাও ইরিনের জন্যই ছিল। কিন্তু, আপনার ভুলটাও এখানে কম বলবো না।
আসলে কি জানেন তো মি.নক্ষত্র…মানুষ যখন নিজের অপছন্দের ব্যক্তি/ জিনিসের সাথে নিয়মিত সময় কাটায়, তাকেও পছন্দ কিন্তু হয়েই যায় একটা সময়। সেই সময়টুকুর অভাবের সুযোগ নিয়েই ওয়াসিফ ইরিনের ব্রেন ওয়াস করেছে। আর যতক্ষণে ইরিন অবচেতন মনে আপনার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছিল ততোদিনে ওয়াসিফের ওয়াস করা ব্রেনটা তাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছিল। বিভ্রান্ত করেছিল। তারপরেও, তার অজান্তেই পাল্লাটা আপনার জন্যই ভারী ছিল।তাই এতটা নির্দ্বিধায় নিজেকে আপনার কাছে উজাড় করে দিয়েছিল। নওরিনকে জন্ম দিয়ে আপনাকেই দিয়ে যেতে চেয়েছিল। কারণ,সে জানতো নওরিন ঠিক কি ছিল আপনার জন্য।
‘এখন কি আপনি ওর পার্সোনাল লাইফ নিয়েও ওর হয়ে ওকালতি করতে চাইছেন, মি. রাফিদ?’ রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘ওকালতি করছিনা। শুধু তাকে প্রেজেন্ট করছি আপনার কাছে। যে দিকটা আপনার অভিমান নামক নিছক অন্যায় জেদের কারণে কখনো চোখেই পড়েনি আপনার।’
‘ওহ…রিয়েলি, মি. রাফিদ?’
‘ইয়েস…অফকোর্স মি. নক্ষত্র। আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এত সব কিছুর পরে….জীবনের সব ছোটবড় ধাক্কাগুলো সামলে ইরিন আজও বেঁচে আছে, সেটা কার জন্য? আপনার জন্য..মি. নক্ষত্র। আপনি তাকে এতটাই ভালোবাসা দিয়েছিলেন একসময় যে,সে আপনার এই ভালোবাসায় জড়িয়ে গিয়েই নতুন করে বাঁচার সাহস পেয়েছে।আপনার ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার জন্যই ভুল করে হলেও নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করেছিল। শুধু আপনাকে একটা সন্তান দিবে বলে। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের জন্য ফিরে পাবে বলে।
আবার এই যে, আজও সে এত লড়াই করছে মানসিকভাবে, সমাজের কতগুলো অন্ধ নিয়ম, প্রথা, কু কথার বিপরীতে…বিবাহিত হয়েও একলা একটা বাড়িতে থাকছে….আপনার কি মনে হয় আমাদের এই সমাজে এটা খুব সহজ কোন বিষয়?
কিন্তু, এসবের সাহসও সে আপনার থেকেই পেয়েছে। আপনাকে ভালোবেসে সে এতটাই গভীরভাবে আপনাতে জড়িয়েছে যে তার ধ্যান জ্ঞানে সর্বপ্রথম ভালোবাসার, ভরসার মানুষটি আপনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন।আপনার ব্যক্তিত্বের অনুসারী হওয়ার চেষ্টায় একা বাঁচার লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। ইরিন বলে, ‘সে নক্ষত্র বন্দনায় মরমে মরেছে। ‘ আমি বলি কি মি. নক্ষত্র, ‘ইরিন বেঁচেই আছে শুধু আপনাকে নিজের যোগ্যতায় অর্জন করবে বলে। ‘
‘সিরিয়াসলি, মি. রাফিদ? এভাবে ডিভোর্স নিয়ে, দূরে গিয়ে সে আমায় অর্জন করবে? হাস্যকর!’ বিদ্রুপ করে হেসেই কথাটা বললো নক্ষত্র।
‘দূরে গেলেই নাকি কাছের জিনিসের গুরুত্ব বোঝা যায়। কিন্তু, ও বেচারি তো দূরে এসেও আপনার গুরুত্ব পেল না।’পরোক্ষভাবে নক্ষত্রকে কাটক্ষ করে বললো রাফিদ।
‘পুতুলের আম্মুর সাথে আপনার বন্ধুত্ব কতদিনের?
‘ ৪ মাসের বেশি কিছু সময়। কেন?’
‘আমি তার সাথে ৫ বছর সংসার করেছি। আমার থেকে ভালো জানার কথা নয় আপনার তাকে। – রূঢ় স্বরে বললো নক্ষত্র।
‘আপনি স্বামী হয়ে ৫ বছর ইরিনের সাথে সংসার করেছে। মাঝে অনেক বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে আপনাদের সংসারে..জীবনে। তবে তার আগে ১ বছর কিন্তু সব স্বাভাবিকই ছিল। সুন্দর ছিল।
‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
‘জাস্ট এটুকুই যে, আমি ইরিনের ভালো বন্ধু। আপনিও যদি কেবল স্বামী বা ভালোবাসার মানুষের বাইরে তার বন্ধু হয়ে উঠতেন, তাহলে হয় তো আমার থেকেও বেশি বুঝতেন আপনি তাকে। ‘
গমগমে গলায় কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল রাফিদ। বড় করে একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।
নক্ষত্র অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাফিদের দিকে। ইরিনের সাথে তার নিজের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা বেশ জোরালো ভাবেই নাড়া দিয়েছে নক্ষত্রের মাথায়। সে সব সময় একজন ভালো স্বামী, ইরিনের ভালোবাসার মানুষ হতে চেষ্টা করেছে। এবং স্বামী হিসেবে সে সফলও বলতে গেলে।ইরিনও তাকে ভালোবেসেছে। কিন্তু, সে কি কখনো ইরিনের বন্ধু হতে চেয়েছিল? প্রয়োজন মনে করেছিল? চেষ্টা করেছিল কি কখনো? তার জীবনের প্রথম নারী আকর্ষককে প্রেয়সী…স্ত্রী বাদে কখনো কি কেবল একজন আলাদা মানুষ হিসেবে ভেবেছে নিজের পাশে? বন্ধুর মত তার মন বন্দরে জায়গা করার কথা ভেবেছে? কই…ভাবেনি তো কখনো!’ কপালে দু দন্ড ভাঁজ ফেলে চিন্তায় ডুবে গেল নক্ষত্র।
‘আ’ম স্যরি মি. নক্ষত্র। আই গট হাইপার। বাট ট্রাস্ট মি…আই রিয়েলি মিন ইট। আমি ইরিনকে যতটা জেনেছি সে নিজেকে পুরোপুরিভাবে আপনাকে সঁপে দিয়েছে।তার সাহস, আত্মবিশ্বাস, ভরসা, বিপদ সামলে উঠার বোধবুদ্ধি কিংবা একলা বাঁচার অনুপ্রেরণা সবটাই সে আপনার থেকে পেয়েছে। আপনাকে নিজের জীবনের নক্ষত্র মানে সে। আপনাকে ভালোবাসে বলেই নিজের ওই ভুলটুকুকে সে অপরাধ ভেবে প্রবল অপরাধবোধে ভুগে প্রতিনিয়ত।
জীবনের উদ্দেশ্যই তার এখন আপনার ক্ষমা পাওয়া। আপনার ভালোবাসা ফিরে পাওয়া।
জানেন…আমি যখন আপনার মত করেই আপনার দিকটা নিয়ে ভেবেছিলাম আমার তাকেই দোষী মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কেবল নিজের নিম্নমানের চিন্তাভাবনার, অযাচিত মনোবাসনার কারণে নিজের ভুলে নিজের জীবন নষ্ট করেছে ইরিন । আপনার মত স্বামীকেও কষ্ট দিয়েছে। তাই, তার ডিভোর্সের ব্যাপারে আপত্তি করেছিলাম আমি। তখন সে আমাকে একটা কথা বলেছিল।
‘কি কথা?’ কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘পুরুষ প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী আর নারী অর্জনে। আর আজ আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি, নিঃসন্দেহে আপনি একজন ভালো স্বামী, ভালোবাসার পুরুষ হিসেবে অনন্য…কিন্তু ইরিন কেবলই আপনার প্রাপ্তি। তাকে যদি একবারের জন্যও অর্জন করতেন চাইতেন তাহলে হয় তো গল্পটা আজ অন্যরমক হতো। ‘
‘পুতুলের আম্মুকে আপনি খুব ভালো বোঝেন, তাই না মি. রাফিদ?’
‘বন্ধু তো! বোঝাটা আবশ্যক। তাছাড়া, ইরিনকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তার মত সাহসী এবং সংযমী নারী খুব কমই দেখা যায় আজকালকার যুগে।যদিও এর কিছুটা তার জীবনের পরিবর্তিত রূপ। তবে সেটার কৃতিত্বও আপনার। ‘
মুচকি হেসে বললো রাফিদ। নক্ষত্র অবাক নয়নে তাকিয়ে রাফিদের কথার সাথে এ হাসির অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করলো। এরই মাঝে রাফিদ আবার বললো,
‘আরেকটা কথা মি. নক্ষত্র, ইরিন নিজের ভুলের জন্য এতখানি শাস্তি কখনোই প্রাপ্য ছিল না। একটা মেয়েকে যখন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন পুরুষ অন্যায়ভাবে স্পর্শ করে সেটা তাকে শারীরিক কষ্টের চাইতেও বেশি কতখানি মানসিক যন্ত্রণা দেয় এটা কেবল সেই নারীই জানে। হোক সে পুরুষ তার স্বামী বা বহির্ভুত কেউ। অন্যায়,পীড়াদায়ক স্পর্শ কিন্তু সে কখনোই প্রাপ্য নয়।
আর আমরা পুরুষরা যতই মুখে মুখে বুলি আউড়াই না কেন যে, আমরা বুঝি তাদের এ কষ্টটা। এটা কখনোই পুরোপুরি সত্যি নয়। এটা ফিল করার ক্ষমতা যদি পুরুষের থাকতো তাহলে সে অন্যায় দৃষ্টিতে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকাতো না। অন্যায় স্পর্শ, ধর্ষণ তো অনেক পরের ব্যাপার। আর ইরিন তো সেখানে…’
আর বলতে পারলো না রাফিদ। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। নক্ষত্র বিস্ময় জাগা নয়নে তাকিয়ে দেখলো রাফিদের মুখে ইরিনের জন্য ফুঁটে উঠা তীব্র কষ্টটা।
রাফিদ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল কিছুটা সময় নিয়ে। নক্ষত্রকে কিছু বলবে তার আগেই তার মোবাইল বেজে উঠলো তার। ফোন বের করে দেখলো একজন ক্লাইন্টের কল। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ছাদের অন্য কোণায় চলে গেল রাফিদ।
নক্ষত্র এখনো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাফিদের দিকে। তার বলা কথাগুলো ভীষভাবে ভাবিয়ে তুলছে তাকে। মনে মনে দুয়ে দুয়ে চারের হিসাব মিলায় সে। এক আদিম ভয়ের তাড়নায় সে হিসাবটাও এলোমেলো করে ফেলে স্বেচ্ছায় । বিশ্বাস করতে চায় না, যা সে ভাবছে। ইরিন কি তবে এই জন্যই সেদিন তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি? রাফিদও কি বন্ধুত্বের বাইরে নিজের জন্য আশা করে ইরিনকে? তার জন্যই কি এভাবে এত কিছু করা?
নক্ষত্র বেশি কিছু ভাবতে পারে না এই নিয়ে। রাফিদের কথায় দুয়ে দুয়ে চার মিলানোর হিসাবে ভাটা পড়ে তার। ফোনকলে কথা শেষ করে এসে রফিদ বলে, ‘আমাকে এখন যেতে হবে মি. নক্ষত্র। কাজ পড়ে গেছে একটা। পরশু একেবারে কোর্টে দেখা হবে আপনার সাথে। তবে, যাওয়ার আগে একটা কথা বলতে চাই আপনাকে, ইরিনকে এই অহেতুক আত্মদহন থেকে মুক্তি দিন প্লিজ। হয় তাকে আগের মত আপন করে নিন, নয় তো ডিভোর্স দিয়ে সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করুন একেবারে। নিজের মত সুখ শান্তিতে বাঁচার অধিকার তারও আছে।যেটা আপনার জন্য সম্ভব হচ্ছে না। ‘
‘আপনি এত করে ওর মুক্তি চাইছে… কারণ কি?’ বাঁকা স্বরে প্রশ্ন করে নক্ষত্র। রাফিদ প্রথমে বুঝতে পারে না তার প্রশ্নের পেছনে জানতে চাওয়া উত্তরটা। ভ্রু কুচকে তাকায় নক্ষত্রের দিকে। কিছুটা সময় নেয় ভাবার জন্য। তারপর, ঝটপট উত্তর করে, ‘ যদি বলি নিজের জন্য?’
‘এটা কি আদৌ কখনো সম্ভব?’ বাঁকা হেসে বলে নক্ষত্র।
‘ইরিন চাইলেই সম্ভব। আমি আছি তার জন্য…সব সময়…সব অবস্থাতেই!’ মুচকি হেসে বললো রাফিদ।
‘পুতুলের আম্মুকে না অনেক বোঝেন আপনি? তাহলে এই ভুল ধারণা কি করে মাথায় আসে আপনার!’
‘আমি বুঝি বলেই শিওর হয়ে বলছি। আপনি একবার বোঝার চেষ্টা করে দেখুন তো, ফলাফল কি আসে!কোনটা কার ভুল ধারণা আর সত্যিটা আসলে কি! ভেবে দেখুন মি. নক্ষত্র। সব কিছুর শেষে আমার কাছে ইরিনের সুখটাই ইম্পর্টেন্ট।’ আলতো হেসে বললো রাফিদ। নক্ষত্র বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই হাসিমাখা মুখের দিকে। মানুষটার কথার রহস্য উদ্ধারের প্রচেষ্টা তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে। তবে রাফিদ তাকে সামনাসামনি আর সুযোগ দিল না। শুকনো হেসে বললো, ‘আশা করি দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন আপনি। আসছি। ‘
কথা শেষ করে রাফিদ দাঁড়ালো না আর। নেমে গেল ছাদ থেকে। পেছনে ফেলে গেল বিভ্রান্ত নক্ষত্রকে।’
১৬০.
‘ক্লান্ত লাগছে খুব?’ -কোমল নারীকন্ঠে ভাবনার সুতো কাটলো নক্ষত্রের। ধীরেসুস্থে চোখ মেলে তাকালো সে ।সামনে ইরিন দাঁড়িয়ে আছে। নক্ষত্র সোজা হয়ে বসতে বসতে বললো, ‘নো…আ’ম ফাইন।’
‘ওহ’। ইরিন বললো।
নক্ষত্র এবারে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো ইরিনের দিকে। ছাই রঙা ঢিলেঢালা সুতির সালোয়ারকামিজ পড়া। চুলগুলো আধভিজা। চোখ মুখও ভীষণ সতেজ লাগছে এখন। বোঝাই যাচ্ছে, গোসল করেছে সে। চুলের মোটামুটি ঝরঝরে ভাব জানান দিচ্ছে তাতে ড্রায়ারের গরম হাওয়া ছুঁয়ে গেছে। ইরিনকে ছেড়ে ঘড়ির দিকে তাকালো নক্ষত্র। আটটা পাঁচ বাজে। বাড়ি ফেরা দরকার। পুতুল অপেক্ষা করছে। আচমকা তার মনে হলো, সে এখনো এখানে আছে কেন? কি কারণে? নিজের মনের প্রশ্নে নিজেই অবাক হলো নক্ষত্র। কিন্তু, সঠিক কোন যুক্তি বা উত্তর কোনটাই খুঁজে পেল না এই প্রশ্নের বিপরীতে।নিজের এহেন কাজের বিরক্তি, হতাশায় ফোসঁ করে একটা শ্বাস ফেললো সে।তারপর, ঝটপট উঠে দাঁড়ালো সোফা ছেড়ে।
ইরিন অবাক হলো নক্ষত্রের এমন অস্থিরতায়। তাকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে নক্ষত্র বললো, ‘রাতে বাসার দরজা জানলা ভালো করে লক করে শুবে। আসছি।’
‘আপনি চলে যাবেন?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করলো ইরিন।
‘ হ্যাঁ, তোমার এখানে থাকতে এসেছি নাকি?’ নক্ষত্র রুক্ষস্বরে বললো।
নক্ষত্রের কথার ধরণে মেজাজ খারাপ হলো ইরিনের। সেও গোমরা মুখে পাল্টা জবাব দিল।
‘তাহলে এতক্ষণ এভাবে বসে ছিলেন কেন?আমি তো আগেই বলেছিলাম, বুড়ি বাসায় নেই।’
নক্ষত্র থতমত খেয়ে গেল ইরিনের এমন কথায়। সত্যিই তো সে জেনে শুনেও কেন বসে ছিল এখানে? কার অপেক্ষায়? সে তো নিজেই জানে না কিছু।ইরিনকে কি বলবে!
নক্ষত্রকে এমন চিন্তিত মুখে দেখে ইরিনের মন নরম হলো। শান্ত কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কি কোন কিছু নিয়ে স্ট্রেসড, পুতুলের বাবাই? কোন সমস্যা?’
ইরিনের এমন আচরণে চমকে উঠলো নক্ষত্র। চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো সে। ক্লান্ত গলায় বললো, ‘নাহ। ঠিক আছে সব।’
‘পরশু কেসের হেয়ারিং। আপনি আসবেন? ইরিন প্রসঙ্গ পাল্টে বললো।
‘হু…আসবো। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছো দেখলাম। তুমি তাহলে রেডি থেকো। আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে তোমাকে।’
‘আচ্ছা।’ বাধ্য মেয়ের মত নক্ষত্রের কথা মেনে নিয়ে বললো ইরিন।
‘হুম। যাই এখন।’ কথাটা বলে ইরিনের দিকে চাইলো নক্ষত্র। ইরিনের কিছু বলবে এই ভেবে। কিন্তু, ইরিন কিছু বললো না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
নক্ষত্র আপেক্ষা করলো না। ইরিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। দরজার কাছে যাওয়ার কিছু পথ আগেই ইরিন পিছু ডাকলো, ‘পুতুলের বাবাই.. ‘
‘কিছু বলবা? ‘পেছন ফিরে বললো নক্ষত্র।
ইরিন চুপ করে গেল। যে কথাটা বলার জন্য পিছু ডেকেছে সেটা বলবে কিনা সেই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। তাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে নক্ষত্র আবারও প্রশ্ন করে, ‘কি সমস্যা তোমার, পুতুলের আম্মু? পিছু ডেকে এভাবে সঙের মত দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘আ…বা…না,কিছু না। এমনি। ‘
নক্ষত্র ভ্রুকুটি কুচকে তাকালো ইরিনের মুখের দিকে। মনোযোগ দিয়ে দেখলো তাকে।কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর আচমকা বলে বসলো,’আজকে কি রান্না করছো? ‘
হঠাৎ নক্ষত্রের এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে চমকালো ইরিন। বোক বোকা চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চিংড়ির মালাইকারী আর মিষ্টি কুমড়োর ভর্তা। সাথে ভাত ছিল।’
‘খাবার গরম করো, ক্ষুধা লেগেছে।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। দুপুরে লাঞ্চ করা হয়নি আজ। ‘ শেষ কথাটা ইচ্ছে করেই মিথ্যা বললো। শুধুমাত্র ইরিনের কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য।
কথাগুলো বলতে বলতেই ফের ভেতর ঘরের দিকে রওনা দিলো নক্ষত্র। ইরিন পুরো বোকা বনে গেছে নক্ষত্রের এমন আচরণে। ইরিনের হুট করে মনে হলো, নক্ষত্র কি তবে খেতে এসেছিল তার বাসায়? কিন্তু, সে তো সচারাচর এভাবে কখনো খেতে আসে না তার বাসায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া ইরিনের মুখদর্শনও করে না, বাসায় আসা তো অনেক পরের ব্যাপার।।গতবার না হয় পুতুলের জন্য বাধ্য হয়ে থেকেছিল। তাছাড়া, নিজের অতবড় বাড়িতে এত আয়োজন থাকতে তার বাসায় খেতে আসবে এটা ভাবাও চরম হাস্যকর। তাই এই ভাবনা বাদ দিল ইরিন।
কিন্তু, দুপুরে খায়নি এ কথা শুনে বেশ অবাক হলো ইরিন। সে তো দেখেছিল জব্বার আলীকে খাবার নিয়ে যেতে। তখনই তো জেনেছিল নক্ষত্র অফিসে এসেছে আজ। তাই আলাদা করে না নেওয়ায় নিজের জন্য নেওয়া তরকারির বাটিটা জব্বার আলীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। জব্বার আলী জানেই এটা ইরিনের প্রায়শ করা কাজ। তাই তিনি কখনো কোন প্রশ্ন করেন না। মুচকি হেসে ইরিনের দেওয়া বাটিটাও নিয়ে নেন নক্ষত্রের জন্য।
কিন্তু, দুপুরে নক্ষত্র খাবার খায়নি শুনে প্রথমে মন খারাপ লাগলেও পরে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। কিছুটা চেঁচিয়েই বললো, ‘খাননি মানে! কেন খাননি? আমি যে নিজেরটা বাদ দিয়ে আপনার জন্য…’ মুখ ফসকে বলতে গিয়েও চুপ করে গেল ইরিন। নক্ষত্র তার অবস্থা বুঝতে পেরে অলক্ষ্যেই মুচকি হাসলো। গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো ইরিনকে।
‘নিজেরটা বাদ দিয়ে আমার জন্য…কি?’
ইরিন ফাঁকা ঢোক গিললো মনে মনে। প্রশ্নটা এড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
‘খাননি কেন?’
‘মিটিং ছিল একটা। তাই খাওয়া হয়নি। ‘
‘কিন্তু, আজ তো অফিসে কোন মিটিং ছিল না। তাহলে?’
‘পার্সোনাল মিটিং ছিল।’
এ কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেও আর কোন প্রশ্ন করলো না ইরিন। ছোট্ট করে বললো, ‘ওহ। ‘
‘হুম।’ নক্ষত্র বললো।
‘আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। চাইলে চেঞ্জ করে নিতে পারেন। বিছানার উপর আপনার জামা কাপড় আর টাওয়াল রেখে এসেছি। ‘ কিছুটা চোরা গলায় বললো ইরিন।
নক্ষত্রের ভ্রু কুচকে গেল ইরিনের এমন কথায়। অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আমার জামা কাপড় কই পেলে তুমি?’
‘সেবার যখন এসে থেকেছিলেন, যাওয়ার সময় ভেজা ছিল বলে নেওয়া হয়নি। পরে আমি গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। ‘
‘অহ…আচ্ছা, ভালো করেছো। আমি যাই ফ্রেশ হয়ে আসি। তুমি ডিনার রেডি করো। কিন্তু, তার আগে এক কাপ চা করো…ফাস্ট। ‘
কথা বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে গেল নক্ষত্র। ইরিন ছোট্ট করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আরেকটু হলেই আজ মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলতো। তারপর,বাকিটা হতো প্রলয়ঙ্করী এক ইতিহাস!
কিছু সময় ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো ইরিন।আজ নক্ষত্রের আচরণগুলো কেমন অচেনা ঠেকছে। ইরিন নিজ থেকে এর কোন কারণ ভেবে পেল না। হতাশ হয়ে আধভেজা চুলগুলোকে হালকা করে হাত খোপা করতে করতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। চুল খুলে রান্না করার ব্যাপারটা যে নক্ষত্রের ভীষণ অপছন্দের।
১৬১.
ফ্রেশ হতে গিয়ে একেবারে গোসল সেরে ফেলেছে নক্ষত্র।বেশ ভালো লাগছে তার এখন। এক কাপ চা চাই শুধু এই মূহুর্তে এ ভালো লাগার মাত্রাকে আরেকটু বাড়িয়ে আরামদায়ক করার জন্য। তাই, চায়ের খোঁজ করতে করতে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে নক্ষত্র। ইরিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে কাজ করছে। চুলার ওপর পাশে দাঁড়িয়ে চপিং বোর্ডে কিছু কাটাকুটি করছে। হালকা নাক টানার শব্দে নক্ষত্র বুঝলো ইরিন পিঁয়াজ কাটছে। পিঁয়াজ কাটতে গেলেই এই মেয়ে নাকের জল চোখের জল এক করে ছাড়ে।
নক্ষত্র খেয়াল করলো, এক চুলায় গরম গরম ভাত রান্না হচ্ছে। আরেক চুলায় কড়াইতে কিছু রান্না বা গরম করা হচ্ছে। খাবারের গন্ধে নক্ষত্র বুঝলো চিংড়ির মাকাইকারী গরম হচ্ছে। অন্য দু’চুলার একটায় চায়ের পানি ফুটছে অন্যটায় ঘন আঠালো টাইপ সাদা সাদা কিছু একটা রান্না হচ্ছে। এলাচি -দারুচিনির সুবাস বলছে মিষ্টি কিছুই হবে ওটা।
নক্ষত্রের বুঝতে বাকি রইলো না,স্বল্প পরিসরে হলেও ইরিন বেশ ভালোই তোড়জোড় শুরু করেছে রাতের খাবার আয়োজনের। নক্ষত্রের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল ইরিনের অবস্থা দেখে। আচমকা মনে হলো, এভাবে খাওয়ার কথা না বললেই হতো। এমনিতেই সারাদিন অফিস করে আবার বাজার করে ফিরেছে মেয়েটা। একলা বাসায় খুব বেশি কিছু রান্নাও করেনি।এখন বোধয় নক্ষত্রের জন্যই এই ক্লান্তি নিয়েও নতুন করে রান্না করতে হচ্ছে তাকে। মনে মনে অপরাধবোধ হলো নক্ষত্রের। সামান্য গলা ঝেড়ে ইরিনকে ডাকলো, ‘পুতুলের আম্মু..’
ইরিন উপরের সেল্ফ থেকে চা পাতার বোয়ম বের করছিল। নক্ষত্রের ডাকে দ্রুত পেছন ফিরে তাকালো। অপ্রস্তত স্বরে বললো, ‘আপনি একটু ওয়েট করুন। জাস্ট পাঁচ মিনিট। আমি চা নিয়ে আসতেছি। ‘
‘এত কি রান্না করতেছো তুমি? তোমার এখানে খেতে চাওয়াটা ভুল হয়ে গেল বোধয়।’
‘এই..না। তেমন কোন আয়োজন নেই। জাস্ট ভাত বসিয়েছে আর খাবার গরম করছি। আপনি ঘরে গিয়ে বসুন। আমি জাস্ট দু মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে আসতেছি।’
‘দু মিনিটই তো। তুমি চা বানাও আমি ওয়েট করি এখানেই।’
ইরিন আর কথা বাড়ালো না। গরম পানিতে ইতোমধ্যে চা পাতা দেওয়া হয়ে গেছে। ইরিন কাপে দুধ চিনি মিশাতে শুরু করলো।
‘আচ্ছা , পুতুলের আম্মু…আমি যদি তোমাকে সত্যিই ডিভোর্সটা দিয়ে দেই, কেমন হবে সেটা?’
অপ্রত্যাশিত এমন কথায় বেশ চমকে গেল ইরিন। বিস্মিত চোখে তাকালো নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্র দেয়ালের কার্নিশের সাথে অনেকটা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার কিঞ্চিৎ রহস্যময় হাসি। ইরিন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো নক্ষত্রকে। তারপর, আলতো হেসে পুনরায় শান্ত গলায় বললো, ‘ভালোই হবে। আমার এতদিনের চাওয়া পূরণ হবে।’
‘ডিভোর্সের পরে কি করবে? বিয়ে করবে আবার?’
‘ইচ্ছে নেই। একবার বিয়ে করেই সাধ মিটেছে। তাছাড়া, নতুন করে অন্য কারও লাইফ স্পয়েল করতে চাইনা।’ শেষ কথাটা মুচকি হেসে নক্ষত্রের মুখপানে চেয়ে বললো ইরিন। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের কাজে।
ইরিনের কথার অর্থ ধরতে পেরে হাসি মিলিয়ে গেল নক্ষত্রের। ইরিন কষ্ট পেয়েছে। অথচ এবার তার উদ্দেশ্য ছিল না এমন কিছু করার। হতাশ হয়ে আবারও প্রশ্ন করলো নক্ষত্র।
‘আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় এই স্পয়েলিং এক্সেপ্ট করতে চায়, তাহলে?’
ইরিন এবার চূড়ান্ত অবাক না হয়ে পারলো না। এই নক্ষত্রকে তার কোনভাবেই পরিচিত লাগছে না। ৫ বছরের মত স্বল্পদৈর্ঘ্য একটা সময় সংসার করা মানুষটা এমন হঠাৎ অচেনা ঠেকলে তা চিন্তায় ফেলার মতই কারণ। ইরিন কিছুটা সময় নিল। নক্ষত্র তাকিয়ে আছে তার দিকে। উত্তরের অপেক্ষায় আবারও তাড়া দিল, ‘কি হলো…বলো?’
‘ইরিন নিজের কাপে দুধ চিনি দিতে দিতে বললো, ‘ভেবে দেখবো অবশ্যই। জীবনের প্রয়োজনে কত কিছুই তো নতুন করে ভাবতে হয়, করতে হয়।’
তারপর নক্ষত্রকে প্রশ্ন করলো, ‘তা আজ হঠাৎ আপনি এসব প্রশ্ন করছেন কেন? ডিভোর্সের পর আমি কি করবো না করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। তখন তো আর এর দায় আপনাকে গ্রহণ করতে হবে না। ‘
‘তোমার ব্যাপারে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। কিন্তু, পুতুলের আম্মু কি করবে না করবে সেটা অবশ্যই আমার দেখার বিষয়।’রাগ চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে বেশ কঠিন গলায় বললো নক্ষত্র। ইরিন নিরবেই হাসলো তার এমন কথায়। কিন্তু, কিছুই বললো না বিপরীতে। মিনিট খানিক নিরবতা চললো। ইরিন চা ঢেলে কাপটা নক্ষত্রের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন…আপনার চা। ‘
সামনে তাকিয়ে ভড়কে গেল ইরিন।নক্ষত্র নেই এখানে।ইরিন যা বোঝার বুঝে গেল। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো একখানা। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই চুলাগুলোর আঁচ কমিয়ে দিল। তারপর, রওনা হলো নিজ ঘরের দিকে।ইরিন জানেই নক্ষত্র এখন ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট পোড়াচ্ছে নির্ঘাৎ।
১৬২.
‘পুতুলের বাবাই..’ ভয়ার্তক মনে কিছুটা মিনমিনে গলায় ডাকলো ইরিন।
‘বলো।’ সিগারেটের ধোঁয়া ব্যালকোনির গ্রিলমুখী ছুঁড়ে দিয়ে বললো নক্ষত্র।
‘আপনার চা..’ শান্ত গলায় বললো ইরিন।
নক্ষত্র পেছন ফিরে একদম স্বাভাবিকভাবেই হাতে নিল কাপটা ইরিনের হাত থেকে। ইরিন মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। যাক..তার মনের আশংকা সত্যি হয়নি শেষমেশ। নক্ষত্র রেগে নেই। আচরণে অন্তত স্বাভাবিকই লাগছে তাকে।
ইরিন চায়ের কাপটা দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আর কিছু লাগবে আপনার?’
‘না।’ নক্ষত্রে গ্রিলের খাঁচভেদ করে অবশিষ্ট সিগারেট বাইরে ফেলে দিয়ে বললো।
‘আচ্ছা।’ কথাটা বলেই ইরিন পেছন ফিরে রান্নাঘরের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। এক পা ফেলার পরেই পেছন থেকে নক্ষত্র ডাকলো, ‘ইরিন…’
‘ইরিন ‘ডাকটা শুনে মূহুর্তেই থমকে গেল ইরিন। তারপর,মনের ভ্রম বলে কয়েকসেকেন্ডের মাঝেই আবার যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই বাঁ হাতের কব্জিতে জোরালো ভাবেই টান পড়লো। ইরিন পিছু ফিরতেই আরও একটা টানে সোজা নক্ষত্রের খুব নিকটে গিয়ে হাজির হলো ইরিন।
ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। নক্ষত্রের একহাতে গরম চায়ের কাপ থাকায় টান দেওয়ার ফলে তা থেকে কিছুটা চা ছলকে নক্ষত্রের হাতে আর ইরিনের জামায় গিয়ে পড়লো। ইরিন সহসা ঠিকমত কিছু ঠাওর করতে পারলো না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারলো, সে এই মূহুর্তে নক্ষত্রের হাতে বন্দী। নক্ষত্র ইরিনের হাতটা ধরে রেখেই চায়ের কাপটা ব্যালকোনির দোলনার পর রাখলো। ইরিনের মন ইতোমধ্যে কু গাইতে শুরু করেছে। নক্ষত্রের হাবভাব তার মনেই ভালো ঠেকছে না।
‘আমার মুখে কি নিজের নামটা এতই অচেনা লাগে তোমার আজকাল যে ডাকলেও উপেক্ষা করে চলে যাও?’ রাগমিশেল শক্ত গলায় বললো নক্ষত্র।
ইরিন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রের দিকে। নক্ষত্রের এমন কন্ঠস্বরে ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও ইরিন একটুও ভয় পেল না। কেবল বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো নক্ষত্রের রক্তচুক্ষুর বিপরীতে। বাচ্চাদের মত অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, ‘আপনিই তাহলে আমার নাম ধরে ডেকেছিলেন?’
‘তো কি ভূতে ডাকবে?’ দাঁত খিঁচে বললো নক্ষত্র।
‘ওহ…আমি তো ভাবছি ভুল শুনেছি।’ ফিক করে হেসে দিয়ে বললো ইরিন।
নক্ষত্র ভড়কে গেল আচমকা তার রাগের বিপরীতে ইরিনের এমন বাচ্চাসুলভ আচরণে। রাগ বাড়লো নক্ষত্রের। ইরিনকে আরও কাছে টেনে নিল সে। রাগে গমগম করা গলায় প্রশ্ন করলো, ‘হাসিতেছিস কেন তুই? আমি তোর নাম ধরে ডাকলে হাসি পায় তোর? জোক (কৌতুক) মনে হয়?’
ইরিন এবারে আলতো হেসে সরাসরি নক্ষত্রের চোখে চোখ রাখলো। শান্ত গলায় বললো, ‘কত বছর পরে ডাকলেন এই নামে? অপ্রত্যাশিত কিছু ভ্রম মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু তো নয়!’
নক্ষত্র আর কোন জবাব দিতে পারলো না ইরিনের এ কথার বিপরীতে। সে নিজেও সঠিক জানে না…ঠিক কতকাল পরে ইরিনের জন্য তার নামখানা উচ্চারণ করেছে। হতাশ হলো নক্ষত্র। রাগ উবে গিয়ে জায়গা করে নিল বিষন্নতা। শান্ত চোখে ইরিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা….আমাকে কি কখনো তোমার বন্ধু মনে হয়েছিল ইরিন?’
ইরিন এবারে একটু নয় পুরোপুরি অবাক হলো।ভ্রু কুচকে নক্ষত্রের মুখপানে চেয়ে চিন্তায় ডুব দিল। কিছু উদ্ধার করতে না পেরে সরাসরি নক্ষত্রকে প্রশ্ন করলো, ‘আজ কি হয়েছে আপনার? এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছেন?’
‘জানি না। তুমি বলো না ইরিন…আমাকে কখনো তোমার নিজের বন্ধু মনে হয়েছিল?’ উতলা গলায় বললো নক্ষত্র।
ইরিন এবার সত্যি সত্যি গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। এ নক্ষত্রকে সে চিনে না। বিয়ের প্রায় সাত বছর হতে চললো তাদের। মাত্র মাস কয়েকের তফাৎ। কিন্তু, এতদিনেও এই মানুষটাকে তার চেনা হয়ে উঠা হলো না যেন। ইরিন নক্ষত্রের অস্থিরতা ঠাওর করতে পেরে মিষ্টি হেসে বললো,
‘আপনি আমার হাজবেন্ড। আমার মৃত জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চারক। বেঁচে থাকার সাহস। আমার ভালোবাসার পুরুষ। কিন্তু, বন্ধু নন।’
নক্ষত্র ব্যাপকভাবে আহত হলো ইরিনের এমন জবাবে।হতাশ হয়ে ফোসঁ করে একটা শ্বাস ফেললো। ইরিনকে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কি তবে একটা বন্ধু চাই? আমার সাথে ডিভোর্স হলে নিজের বন্ধুর জায়গাটা পূরণ করবে তুমি এবার?’
ইরিন বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে নক্ষত্রের প্রশ্নভরা মুখের দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে সে জবাব দিল, ‘বন্ধু হলে মন্দ হবে না। তবে..’
‘তবে? অস্থির গলায় প্রশ্ন করে নক্ষত্র। তার চোখমুখ প্রবল উৎকন্ঠা। ইরিন সেটা দেখে মুচকি হাসলো। রহস্য করে বললো, ‘না…কিছু না।’ অথচ মনে মনে আওড়ায়, ‘তবে সব কিছুর আগে পরে আমার আপনাকে চাই।’
নক্ষত্র সেটা মানলো না। আগের চাইতেও বেশি অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা, বাদ দাও এটা। আমাকে বলো, আমি তোমার বন্ধু হলে কি হতো? আমাকে আরও আগেই ভালোবাসতে? ওয়াসিফকে নিজের জন্য চাইতে না তখন?’
‘ওয়াসিফকে আমি কখনোই নিজের জন্য চাইনি। চেয়েছিল আমার বিভ্রান্ত মনের ভুল বাসনাগুলি। এ কথাটা বিগত কয়েক বছরে বহুবার বলেছি। কিন্তু, আজও আপনি আমাকে ভুল বুঝে যাচ্ছেন। বন্ধু হলে হয় তো অন্তত একবার আমাকে বোঝার চেষ্টা করতেন। স্বামী হিসাবে যেটা করতে পারাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে আপনার জন্য।
আর রইলো আপনাকে ভালোবাসার প্রশ্ন, আপনি আমার বন্ধু হলে আরও আগেই ভালোবাসতাম কিনা জানি না। তবে আপনাকে গ্রহণ করতে সহজ হতো অনেক আগেই। আপনি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। যদিও দোষ আমারই বেশি ছিল। আপনাকে পছন্দ ছিল না এই সত্যিটা স্বামীকে বলতে না পারলেও হয় তো বন্ধুকে বলতে পারতাম।সেও হয় তো বুঝতো আমাকে।
স্বামী নামক যে মানুষটা ভালোবেসে আমার শরীরের গভীরে প্রবেশ করেছে, আমি স্ত্রী হয়ে বাঁধা দেইনি…বন্ধু হলে হয় তো সে আগে মনের গভীরে পা রাখতো। আমার শরীর হতো তার যাত্রা পথের সমাপ্তির ঠিকানা। বন্ধু হলে হয় তো…কত কিছুই তো হতো হয় তো! কিন্তু, স্বামী নামক আমার ওই পুরুষটি বরাবরই অনন্য। ‘ বিষন্ন গলায় শুকনো হেসে বললো ইরিন।
ইরিনের জবাবের প্রতিটা শব্দ বাক্য নক্ষত্রের ভেতরে তোলপাড় শুরু করে। আতংকের ঝড় বইয়ে দেয়। রাফিদের কথার সাথে ইরিনের কথার মিল খুঁজে পায় সে।এই প্রথমবার নক্ষত্রের মনে মনে হিংসাবোধ জাগলো। ভয় হয় ইরিনকে একেবারে হারিয়ে ফেলার। আবার হতাশও হয় নিজের এ ব্যার্থতার উপর। ক্লান্ত গলায় ইরিনকে বললো,
‘ফিরে যাবে ইরিন? এবার না হয় বন্ধু হয়েই থাকবে আমার সাথে।’
‘স্বামীর সাথে বন্ধুর মত মেশা যায়, কিন্তু বন্ধুকে স্বামী ভাবা যায় না এভাবে।একঘরে..এক ছাদের তলায় থাকা তো অসম্ভব ব্যাপার। ‘
‘তাহলে কি চাও তুমি?’ বিক্ষিপ্তভাবে মেজাজে প্রশ্ন করে নক্ষত্র।
‘মুক্তি’। বেশ দৃঢ়তার সাথে বললো ইরিন।
‘দিবো না। মরে গেলেও না।’ জেদি গলায় বললো নক্ষত্র।
ইরিন নিরবে হাসে নক্ষত্রের এমন কথার ধরণে। ঠোঁটের বাঁকে ঠিকরে পড়ে যন্ত্রণা। কন্ঠের মিহি স্বরে অন্ততের নিঃসরিত গভীরতা এসে ভীড় জমায়। তারা নিজ থেকেই আউড়ে যায়…
‘ আমি অর্ধমৃত হয়ে পড়ে রই
দুই আঙিনার মাঝ বরাবর
এক তরফা দহনে পুড়ি
একাই ভিজে হই একাকার
বেঁচে থাকা মৃত্যুসম মনে হয়
তবুও চলে শ্বাসপ্রশ্বাস।
দিন গুণি এই বুঝি মুক্তি মিললো
এই বুঝি আমি পুনঃজীবিত
অথবা সম্পূর্ণ মৃত
তবে রোজ নতুন দিনে
কিংবা দিনশেষে রাত নামলে
আমি টের পাই,
আমার মুক্তি বাঁধা পড়ে আছে
একদা দু পায়ে মাড়ানো
এক নক্ষত্রের একজীবন
ঘৃণার অবসানে
তার অন্তকালের
ভালোবাসার কাছে। ‘
চলবে…
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো]