#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২৪_শেষাংশ
#লেখায়_জারিন
১৩৯.
সময়টা মধ্যরাত্রী। স্বামীর দায়িত্ব পালন শেষে বিছানার এক পাশে পিঠে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে নক্ষত্র। একই চাদরের নীচে থেকেও মাঝে বেশ দূরত্ব ইরিনের সাথে তার অবস্থানের। দুজন দুপাশে। বিমুখ। নক্ষত্রের আঙুলের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট। ইতোমধ্যে আরও দুটো শেষ করেছে সে। মনের ক্লান্তি পোড়ানোর চেষ্টা চলছে তার। ঘরজুড়ে পিন পতন নিরবতা। ঠিক তখনই ইরিনের শান্ত গলার আওয়াজে কিছুটা চমকে উঠলো নক্ষত্র।
‘আপনি যখন প্রথম আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলেন আমি জেনেছিলাম ভালোবাসার স্পর্শ কেমন হয়। কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু যন্ত্রণা হয়নি। কামনার স্পর্শ তখনো আমার অজানা। ওয়াসিফ যেদিন ভোগ করেছিল আমাকে, সেদিন বুঝেছিলাম কামনা জাগলে পুরুষ মানুষ কেমন জানোয়ার হয়ে উঠে। স্পর্শ কতটা হিংস্র আর বেপরোয়া হয়। কামনার তৃপ্তি না হওয়া পর্যন্ত কামসাধনার অবসান ঘটে না। কিন্তু, আজকে প্রথম বুঝলাম ভালোবাসাহীন স্পর্শ কামনার স্পর্শের চাইতেই অনেক বেশি যন্ত্রণা দেয়। ভালোবাসাহীন গভীর স্পর্শ এতটা নির্দয় হয় সত্যিই জানাছিল না আমার। আজ সত্যিই মানুষ বলে মনে হচ্ছে না আপনাকে। ‘
‘তো আগে কি আমাকে ফেরেশতা ভেবেছিলে নাকি তুমি?’ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাঁকা হেসে বললো নক্ষত্র।
‘আপনি একটা অমানুষ হয়ে গেছেন নক্ষত্র।ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে বুঝি এমন অমানুষ হয়ে উঠে মানুষ?’
‘ঠিক তা নয়। তবে দায়িত্ব পালনে বড়জোর নিষ্ঠার প্রয়োগ করা যায়…ভালোবাসা নয়। তুমি চেয়েছিলে আমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করি, করেছি। সেটা আমি কতটা নিষ্ঠা বা অবহেলায় করবো সেটা আমার ব্যাপার।’
‘এতটা ক্ষোভ নিয়ে কি করে বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনি আমাকে? খুন করবেন না, আমাকেও নিজেকে শেষ করতে দিবেননা…তো সেদিন মরার জন্য ছেড়ে দিলেই পারতেন। আমি মরে গেলেই তো এত অশান্তি, ক্ষোভ নিয়ে বাঁচতে হতো না আপনাকে।’ বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো আবারও ইরিন।
‘দায়িত্ব যে! দায়িত্ব পালন করতে আমি আবার কার্পণ্য বা অবহেলা করি না সচারাচর । এই যে দেখো আজও করলাম না। বাই দা ওয়ে…..মন ভরেছে তোমার? চাহিদা মিটেছে নাকি আরও এফোর্ট দিতে হবে আমায়?’
‘ছিঃ……এমন অসভ্যের মত কথা বলছেন কেন আপনি? ‘রাগে..দুঃখে.. লজ্জায় একাকার হয়ে বললো ইরিন।
‘সভ্য থেকে কি উদ্ধার হয়েছে আমার? দায়িত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলে তুমি। জবাবটা ভালো মতই পেয়েছো নিশ্চয়।’ সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো নক্ষত্র। তার এমন অচেনা রূপের মতই ধুয়াশায় ছেয়ে গেল তার বাহ্যিক অবয়বটাও।
কষ্টে..যন্ত্রণায় ইরিন এবার চোখ বুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সমস্ত শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আছে। নিজের সম্পূর্ণ ক্ষোভ ঢেলে দিয়েছে আজ নক্ষত্র তার প্রতিটি স্পর্শে। গভীর ছোঁয়ায় মিশিয়েছে আক্রোশের বিষ। রুক্ষ বিচরণে পিষে গেছে ইরিনের সমগ্র সত্তা। ইরিন পদে পদে টের পেয়েছে নক্ষত্রের ভালোবাসাহীন স্পর্শের তীক্ষ্ণতা। সূক্ষ যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সে। নক্ষত্র রেহায় দেয়নি। ইরিনকে কোন সুযোগ দেয়নি তার রুক্ষ স্পর্শের দাবানল থেকে মুক্তির।
ইরিন সহ্য করতে না পেরেও বাধ্য হয়েই নিজেকে সঁপে দেয় নক্ষত্রের দেওয়া অমানুষিক যন্ত্রণার কাছে। নক্ষত্রও যেন অন্য এক নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিল আজ। ছাড় দেয়নি একবিন্দুও। নিজের অপরাগতার অভিযোগের অবসান ঘটিয়ে ছেড়েছে। ফলাফল ব্যাথাতুর নিস্তেজ শরীর নিয়ে বিছানার সাথে মিশে আছে ইরিন। কিঞ্চিৎ নড়নচড়ন বা স্পর্শও যেন বিষাক্ত ছোবল তার জন্য এখন।
১৪০.
ইরিনের কান্না শুনে পাশ ফিরে তাকালো নক্ষত্র। বিরক্ত হলো সে। ব্যাথায় কাতর ইরিনের এক বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো নক্ষত্র। নক্ষত্রের জোরালো স্পর্শে যন্ত্রণায় সশব্দে আর্তনাদ করে উঠলো ইরিন। নক্ষত্র তাতে পাত্তা দিল না।এক হাতে ইরিনের চোখ মুছে দিয়ে বললো, ‘কান্না থামাও ইরিন। খুশি মনে নিজের দায়িত্ব পালন করো। ‘
নক্ষত্রের কথায় অবাক চোখে তার দিকে তাকালো ইরিন।নক্ষত্রের সাথে চোখাচোখি হতেই তার দৃষ্টির অর্থ বুঝে নিল নক্ষত্র। বাঁকা হেসে বললো, ‘আমরা তো স্বামী স্ত্রী, রাইট? আমি আমার স্ত্রীর চাহিদা মিটিয়ে স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি এবার তো আমার স্ত্রীর পালা। সে তার দায়িত্ব পালন করবে না? এমন হয় নাকি!’
নক্ষত্রের কথার অর্থ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না ইরিনের। অনাগত স্পর্শের কথা ভেবে মনে মনে শিউরে উঠলো সে। নিজের দূর্বল হাতেই নক্ষত্রকে ঠেলে দূরে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু, নক্ষত্রের বাহুবন্ধনের দৃঢ়তা ভেঙে মুক্তি মিললো না তার। নক্ষত্রকে আগাতে দেখেই ইরিন অস্পষ্ট আর্তনাদে চেঁচালো।
‘নক্ষত্র…না…প্লিজ।’
নক্ষত্র সুযোগ দিল না। সত্যিই বুঝি আজ অমানুষ হয়ে উঠেছে সে। ভালোবাসা মরে গেলে কি মানুষ অমানুষ হয়ে উঠে নাকি ঘৃণা ক্ষোভ তা গিলে খেলে? নাকি প্রতিশোধে পিষে যায় অনুভূতি? প্রিয় হয়ে উঠে অপ্রিয়। প্রেম হয়ে উঠে বিষাক্ত।
ভালোবাসা ভুলে গিয়ে বেঁচে থাকে ভুল, ক্ষোভ আর যন্ত্রণা!
১৪১.
সারারাত অমানুষিক স্পর্শের যন্ত্রণায় কাতর ইরিনের ভোর নাগাদ রেহাই মিললো। বিদ্ধস্ত শরীর ও মনের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে গেল সে। নক্ষত্রও পাশেই শুয়ে ছিল তার। ইরিনকে ছাড়ার পর কপালে হাত রেখে চোখ বুজে শুয়ে ছিল সে। ইরিনের কান্না তার সহ্য হয় না, তবুও আজ সে নিজেই তার কান্নার কারণ হয়েছে। স্বেচ্ছায়…নিজ উদ্যোগে। ইরিন কত করে বলেছিল কষ্ট হচ্ছে তার নক্ষত্র মানেনি। বরং কষ্ট বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণে। নিজের মাঝে সুপ্ত অমানুষের রূপটাকে পুরোদমে লাগামহীন করে দিয়ে চড়াও হয়েছিল ইরিনের উপর। ইরিনের প্রশ্নের যোগ্য জবাব দিতেই তার এই রূপ সে ব্যাবহার করেছে বলে মনকে প্রবোধ দিয়ে গেছে প্রতি মূহুর্তে।
ইরিনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে পাশ ফিরে তাকে দেখলো নক্ষত্র। এলোমেলো হয়ে বিদ্ধস্ত এক রমণী ঘুমিয়ে আছে কিছু দূরেই। তার রক্ত জমাট বাঁধা ঠোঁট, ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো রক্তের ধারা, কিংবা ফর্সা শরীরে লালচে হওয়া জায়গাগুলো এ মূহুর্তে যে কোন পুরুষের কামরূপকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম। কিন্তু, নক্ষত্র তাতে আকর্ষিত হলো না। যন্ত্রণাময় হাসি ঠিকরে পড়লো তার ঠোঁটের বাঁকে। মুখ ফিরিয়ে নিল সে ইরিনের থেকে। নিজেকে দেখলো একবার।তার হাতে, কাঁধে এমনকি পিঠেও নিজের যন্ত্রণার ছাপ ফেলেছে ইরিন।
নক্ষত্র একছটাক হাসলো নিজের অবস্থা দেখে। বালিশে মাথা রেখে সিলিং এ দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। আপন মনে মৃদু স্বরে আউড়ালো…
আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন- কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু- একই আলো পৃথিবীর পারে
আমারা দু’জনে আছি; পৃথিবীর পুরোনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,
হয় নাকি?’
(জীবনানন্দ দাশ)
১৪২.
ডাক্তার সুব্রতর চেম্বারে বসে আছে নক্ষত্র। তার হাতে ইরিনের ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট । মিটমিটিয়ে হাসছে সে। ইরিনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং তার নিজেরও। দ্বিতীয়বারের মত গর্ভধারণ করেছে ইরিন। ছাব্বিশতম দিন চলছে। নক্ষত্র আবারও বাবা হতে চলেছে এবং ইরিন তার সন্তানের মা।
‘এত তাড়াহুড়োর কি বিশেষ কোন দরকার ছিল, আদৃত?’ -নারাজ গলায় বললেন ডাক্তার সুব্রত।
‘ইরিনের ইচ্ছেয় হয়েছে এটা।’ নির্বিকার গলায় বললো নক্ষত্র।
‘তার ইচ্ছে ছিল মানলাম, কিন্তু তুমি সব জেনে বুঝে তাতে সায় দিয়েছো কেন? এটা কি তোমার অন্যায় মনে হচ্ছে না?’
‘অন্যায়ের সাথে কি অন্যায় করা যায়, ডক্টর সুব্রত?’
ডাক্তার সুব্রত চমকালেন নক্ষত্রের এমন কথায়। আজ প্রায় ৮ মাস যাবৎ ইরিনের নিয়মিত চেকআপ করছেন তিনি।সেই সূত্রে নক্ষত্রের সাথে সাক্ষাৎ আলাপও হয়েছে বহুবার। শুধু মাত্র ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক ছাড়িয়ে তা স্নেহ ও আন্তরিকতার সম্পর্কে গড়িয়েছে। সম্বোধন বদলেছে।
স্বামী হিসেবে নক্ষত্রের দায়িত্বশীল আচরণ, মানুষ হিসেবে তার অমায়িক মানসিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে বারেবার। কিন্তু, বিগত কয়েক বারের চেক আপে আসা ইরিনকে দেখে তিনি বেশ চিন্তায় পড়ে যান। ইরিন আগের তুলনায় অনেকটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি জমেছে, মুখে বিষাদের ছাপ।বাহ্যিকভাবে দৃষ্টিগত দিক থেকেই ইরিনের শরীরেও কিছু আঘাতের ছাপ তিনি দেখেছেন, যেটা নিয়মিতভাবে স্বামী স্ত্রী তাদের বিশেষ মূহুর্তের সংস্পর্শে এলে তৈরী হয়। কিংবা যখন জোরপূর্বক মিলিত হয় একে অন্যের সাথে। ইরিনকে তিনি মেয়ের মত স্নেহ করেন। তাই এমন অবস্থা দেখে জিজ্ঞেসও করেছিলেন বার কয়েক, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা তার। ইরিন প্রতিবার না সূচক জবাব দিয়ে এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। গত পরশু ইরিনের অবস্থা দেখে সত্যিই বেশ বিচলিত হন তিনি। মনে খটকা লাগে। তাই ব্লাড টেস্ট দেন।
আজ রিপোর্ট দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। তার ধারণাই ঠিক। ইরিন গর্ভবতী। অথচ, তিনি বারবার নক্ষত্রকে বলেছিলেন ইরিনের এমন শারিরীর অবস্থায় অন্তত একবছর যেন বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে না ভাবে তারা। বিশেষ মূহুর্তেও যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। অথচ সাত মাস যেতে না যেতেই কি করলো তারা!
আচ্ছা, আদৃত কি ইচ্ছা করেই করেছে এমন? প্রশ্ন জাগে ডাক্তার সুব্রতর মনে। কিন্তু, তিনি তো ভালোভাবেই বুঝিয়ে বলেছিলেন। নক্ষত্রও বুঝেছিল। ডাক্তারের প্রতিটা কথা পরামর্শ মেনে চলতো সে। তাহলে এমন কেন করলো নক্ষত্র? এই মূহুর্তে ইরিনের শরীর একদমই প্রস্তুত নয় এই বাচ্চাটার জন্য। এই বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে গেলে স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হবে ইরিনকে। এত কষ্ট দেওয়ার কি খুব দরকার ছিল তাকে? এসব ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল ডাক্তার সুব্রতর। হতাশ হয়ে তিনি নক্ষত্রকে বললেন,
‘ইরিনের জীবন ঝুঁকির সম্ভাবনাও আছে এই মূহুর্ত বাচ্চাটাকে জন্ম দিলে। এটা তো জানতে তুমি, তাই না?’
‘জীবন মৃত্যু সবটাই সৃষ্টিকর্তার হাতে। দু-দুবার মরতে মরতে বেঁচে এসেছে, এরপরের হায়াত যতদিন আছে ততোদিনই বাঁচবে সে। কিন্তু, আল্লাহ যখন এই রহমত দান করেছেন আমি খুশি এর জন্য। বাকিটাও আল্লাহ ভরসা।’
‘তুমি তাহলে বুঝে শুনেই এমনটা করেছো!’ অসন্তুষ্ট গলায় বললো ডাক্তার সুব্রত।’
‘স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি। স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করে। বাকি সময়টাও তাকে দেখে রাখার দায়িত্বটাও আমার। এবং আমি তা ভালোভাবে পালন করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ।’
‘দেখো, আদৃত….ইরিনের কেসটা সত্যিই জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন দৃষ্টান্ত আমার জন্য। তোমার মত হাজবেন্ড আমি এই প্রথম দেখেছি। তাই এমন আচরণের আশা তোমার থেকে কখনোই ছিল না আমার। তারপরেও, আমি তো জাস্ট একজন ডাক্তার। পেশেন্টের ভালো মন্দের ব্যাপারে সাজেস্ট করাই আমার কাজ। বাকি মানা না মানা তাদের উপর ডিপেন্ড করে। তবে, সত্যি বলতে তোমাদের এই কাজে আমার একদমই সাপোর্ট নেই।ডাক্তার হলেও একজন মানুষ আমি। দীর্ঘদিন কোন রোগীর সাথে চিকিৎসা সূত্রে জড়িত থাকলে তা আন্তরিকতার সম্পর্কে গড়ায়।তোমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তুমি জানো সবটাই। ইরিন আমার মেয়ের মতন। তার ভালোর জন্যই বলেছিলাম কথাগুলো। তবুও যখন কাজটা তোমরারা করেছোই তখন আমার কি বা বলার আছে আর। ‘
‘আপনি ওর ভালোর জন্য যা করা দরকার সেসব সাজেস্ট করুন। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আমার সন্তান সুস্থ ভাবেই পৃথিবীতে আসবে এবং তার মা-ও ভালো থাকবে ইন শা আল্লাহ।’
নক্ষত্রের এমন একরোখা জবাবের পর আর কিছু বলার থাকে না ডাক্তার সুব্রতর। তিনি ইরিনকে আরেকবার চেক আপে নিয়ে আসার জন্য বলেন।আরও কিছু প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো দরকার। বাচ্চার অবস্থা জানা জরুরি।সেই সাথে ইরিনের মনের খবরও।
১৪৩.
আছরের আযান দিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। কিন্তু নামাযটা এখনো পড়া হয়নি ইরিনের। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না তার একদমই। ইদানীং শরীর প্রচুর দূর্বল লাগে তার। খাওয়া দাওয়া মুখেই তুলতে পারে না বলতে গেলে। নক্ষত্র বকে ধমকে জোর করে খাওয়ায়। আজকাল নক্ষত্রকে বেশ ভয় পেতে শুরু করেছে ইরিন।
সেরাতের অমানুষিক যন্ত্রণার পরে প্রায় রাত একই যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছে তাকে। নক্ষত্রের ভাষায় স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছে সে এভাবে। স্ত্রী হিসেবে ইরিনের দায়িত্ব পালনের দায় মিটিয়ে নিয়েছে নিজের ইচ্ছেমত। লাগাতার দেড় দু মাস এভাবেই কেটেছে তার রাতগুলো। তারপর কোন একটা অজানা কারণে নক্ষত্র নিজ থেকেই দূরত্ব তৈরী করে নিয়েছে তাদের মধ্যে। ছুঁয়েও দেখেনি তাকে। ইরিন ব্যাপারটা খেয়াল করলেও কোন প্রশ্ন করেনি।
গত পরশু হঠাৎ করেই নক্ষত্র ইরিনকে নিয়ে যায় ডাক্তার সুব্রতর কাছে। ইরিন জিজ্ঞেস করলে শুধু এটুকু বলে যে রুটিন চেক আপের জন্য যাচ্ছে। অথচ ইরিন জানতো সেদিন বা কাছেপিঠে তার আগে/পরে কোন চেক আপের তারিখ ছিল না। ইরিন কথা বাড়ায়নি। অসুস্থ মন, ভঙ্গুর শরীর নিয়ে আজকাল তার কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। তাছাড়া নক্ষত্রের প্রতি ভয়টাও একটা বড় কারণ যার জন্য সে নক্ষত্রের কথার উপর কথা বলে না। তার চাওয়ার প্রতি আপত্তি করেনা। যার শ্রেষ্ঠ সাক্ষী নক্ষত্রের কাছে আসার প্রতিটা যন্ত্রণাময় রাত।
‘কংগ্রাচুলেশনস, মিসেস. ইয়াসমিন রাওনাফ। ‘
চোখ বন্ধ করে বিছানাতেই পড়ে ছিল ইরিন। নক্ষত্রের এমন কথায় দ্রুত চোখ মেলে তাকালো। অবাক হলো ভীষণ। নক্ষত্রের হাতে মিষ্টির বাটি।দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে সে। কিন্তু, হঠাৎ মিষ্টি হাতে এমন কথার কোন মানে খুঁজে পেল না ইরিন। অবাক চোখে নক্ষত্রের দিকে তাকাতেই নক্ষত্র এগিয়ে এলো। মিষ্টির বাটিটা পাশের টেবিলের উপর রেখে ইরিনের বাহু ধরে তাকে উঠিয়ে বসালো। ইরিন বালিশে হেলান দিয়ে বসতেই তার পাশে বসে মিষ্টির বাটিটা হাতে নিল নক্ষত্র। খুশি খুশি গলায় ইরিনকে বললো, ‘দেখি…হা করো।’
ইরিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন?’
‘আহা…হা না করলে মিষ্টি খাবে কি করে। দেখি মুখ খুলো। ‘
‘এ সময় মিষ্টি কেন খাবো হঠাৎ? ‘
‘আগে খাও…তারপর বলছিল।’
ইরিন আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হা করে। নক্ষত্র তাকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দেয়। নক্ষত্র মিষ্টির বাটিটা রেখে ইরিনকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে গাঢ় করে চুমু খায় ইরিনের ঠোঁটে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে। ইরিন পুরো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। মন স্মরণ করার চেষ্টা করে…ঠিক কতকাল পরে এতটা কোমলভাবে যন্ত্রণাহীন স্পর্শ করেছে নক্ষত্র তাকে? মনে করতে পারে না ইরিন। মনের ভেতর অভিমান জেগে উঠে। ভিজে আসতে শুরু করে আঁখিপল্লব।
নক্ষত্র তাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই ঘোর কাটে ইরিনের। কানের খুব কাছে নক্ষত্রের ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠে সে। কি হচ্ছে…কেন হচ্ছে এটুকু আন্দাজ করার আগেই নক্ষত্র বলে, ‘কংগ্রাচুলেশনস,ইরিন। ইউ ডিড ইট। তোমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমার সন্তানের মা হতে চলেছো তুমি। ‘
নক্ষত্রের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় ইরিন। বুকের ভেতর অজানা একটা অনুভূতির সূক্ষ চলাচল শুরু হয়। এটা সুখের নাকি কোন অজানা আশংকার বুঝে না ইরিন। তবে নক্ষত্রের কথায় ‘উদ্দেশ্য সফল হওয়ার ‘ ব্যাপারটা সে ধরতে পারলো না। নক্ষত্র তাকে ছেড়ে দিয়ে আলতো হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকায়। ইরিনের শান্ত স্তব্ধ দৃষ্টির অর্থ বুঝে বুক পকেট থেকে প্রেগন্যান্সি রিপোর্টটা বের করে। বাড়িয়ে দেয় ইরিনের দিকে। ইরিন সেটা দেখে। হাত বাড়িয়ে নেওয়ার সাহস হয় না তার।
‘এটা দেখো….তোমার প্রেগন্যান্সির পজেটিভ রিপোর্ট। এটাই তো চেয়েছিলেনা তুমি?নাও…তোমার উদ্দেশ্য সফলের সার্টিফিকেট । ‘ চাপা ক্ষোভ নিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো নক্ষত্র।
‘আপনি খুশি হননি?’ দ্বিধান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ইরিন।
‘খুশি না হওয়ার কি আছে! অবশ্যই আমি খুশি। আল্লাহ আমাকে স্বামীর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার সফলতা দিয়েছেন, আমাকে বাবা হওয়ার রহমত দিয়েছেন…তুমি মা হচ্ছো…আলহামদুলিল্লাহ, আমি অনেক খুশি।’ একদম হাসি হাসি মুখে বললো নক্ষত্র।
কিন্তু, ইরিনের মন মানলনা নক্ষত্রের কথায়। সে আরও বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। চোখে মুখে চিন্তার ভাজ ফেলে কিছু একটা ভাবনাতে থাকলো। তাকে এভাবে দেখে নক্ষত্র বললো,
‘এত চিন্তা করছো কি নিয়ে? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে। তাই তো সেদিন আমার দায়িত্বের প্রতি প্রশ্ন তুলেছিলে।নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তো ছিল তোমার এমন নোংরা প্রচেষ্টা। এটার আংশিক তো সফল হলো। তো এখন সামনের প্ল্যান কি? আর কি করার আছে তোমার?’
‘মানে?’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে ইরিন।
‘মানে…এই যে বাচ্চাটাকে দিয়ে আমাকে বশ করার প্ল্যান করেছিলে! বাচ্চা তো এলো।তুমি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু, অতি দুঃখের সাথে তোমাকে জানাতে হচ্ছে যে….তোমার উদ্দেশ্য পরের ধাপে খুব বাজেভাবে ফ্লপ হয়েছে। এই বাচ্চাটা কখনোই আমার স্ত্রী হিসেবে তোমাকে তোমার জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আজ থেকে আমার জন্য তুমি শুধুমাত্র আমার বৈধ সন্তানের মা। এছাড়া আর কিছুই না। আমার প্রতি তোমার আর কোন ব্যক্তিগত অধিকার রইলো না। আর না আমার প্রতি কোন দায় থাকবে তোমার। তুমি শুধুই আমার সন্তানের মা হয়ে থাকবা আমার জীবনে। সেই হিসেবে তোমার যতটুকু যা প্রয়োজন সেই সবটার দায়িত্ব আমার। স্বামী হিসেবে আমাকে দাবি করার অধিকার তোমার আর রইলো না আজ থেকে। তাই জিজ্ঞেস করছি, এরপরের প্ল্যান কি? কি করবা আমাকে বশ করার জন্য?’
‘ এইসব আপনি কি বলতেছেন? কিসের উদ্দেশ্য… কিসের প্ল্যান করেছি আমি?’ আতংকিত গলায় অস্থির হয়ে বললো ইরিন।
‘ডোন্ট এ্যাক্ট ইনোসেন্ট। আমি সবটাই জানি,ইরিন। সেদিন সবটাই শুনেছিলাম আমি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। তোমরা খেয়াল করোনি আমাকে। কিন্তু, জানো…আমি সেদিনও বোকার মত আশা করেছিলাম যে এই ভুল করার কথা ভুলেও ভাববে না তুমি। কিন্তু, চিরচারিতভাবে তুমি আমার বোকামোটাই নিষ্ঠার সাথে আমাকে প্রমাণ করে দেখালে। আমিও কিন্তু তোমাকে ফেরাইনি আর। তুমি যা চেয়েছো সেটাই করেছি। কিন্তু, এই যাত্রা এখানেই শেষ। ‘
একদম সাবলিলভাবে ঝরঝরে গলায় কথাগুলো বললো নক্ষত্র। ইরিন বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল সম্পূর্ণ ব্যাপারটায়। কিছু বলার মত বোধশক্তিও খুইয়েছে যেন সে। একদম নির্বাক হয়ে হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো সে নক্ষত্রের দিকে।
নক্ষত্র এবারে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ইরিনকে বললো, ‘তোমার মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও সুখবরটা। আমি আম্মুকে বলে মিষ্টি পাঠিয়ে দিয়েছি অলরেডি। পৌঁছালো বলে। কারণটা তুমি নিজে জানিয়ে দিও। সাথে এও বলে দিও……সন্তান শুধুমাত্র বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নয়। সব বাবা-মা স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকে না আজীবন। উনার ধারণা পুরোপুরি ভুল।’
কথা শেষ করে নক্ষত্র জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ইরিন নিজের পেটে হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। তার ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে নক্ষত্র। যে সন্তানকে ঘিরে নতুন করে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করতে চেয়েছি সেই সন্তানই সম্পর্কটা নষ্টের কারণ হয়ে গেল। এই ভুলের শেষ পরিণতি কি? নক্ষত্র কি তবে আর কখনোই ক্ষমা করবে না তাকে? এসব চিন্তায় ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায় ইরিনের। অবাধ্য নোনাজলে ভেসে বেড়ায় অসহনীয় যন্ত্রণারা। এ কেমন জীবন তার…অজস্র ভুলে ভরা!
১৪৪.
‘আমি যদি আজকে মরে যাই….মাফ করে দিবেন তো আমাকে?’ কাতর গলায় ইরিনের এমন কথা শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে নক্ষত্রের। তবুও, নিজেকে ইরিনের সামনে শক্ত রাখতে কঠিন গলায় বললো,
‘তোমাকে হাফ এনেস্থিসিয়া দেওয়া হবে ইরিন। এতে মরার কোন চান্স নাই। এত আজেবাজে চিন্তা করবা না একদম। আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে। ‘
ইরিন দূর্বল শরীরে অনেক কষ্টে হাসে। সামান্য হাসির শক্তিটুকুও নেই ওর। তবুও হাসে নক্ষত্রের কথায়। নক্ষত্র ভেতর ভেতর দূর্বল হয়। কিন্তু বাইরে বিরক্তির ভাব করে। ইরিনকে ধমকায়।
‘এভাবে হাসছো কেন? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?’
‘নিজের জন্য হাসতেছি। জীবনে এমনই কঠিন পাপ করেছি যে মরণ দুয়ারে এসেও ক্ষমা নেই আমার। আপনার ভালোবাসা কি একেবারে গোড়া থেকেই মরে গেছে নওরিনের আব্বু?’
‘যে আসতেছে তার কথা ভাবো ইরিন। পুরোনো কথা মনে করো না। ‘ কঠিন গলায় বলে নক্ষত্র।
‘নক্ষত্র..’ ভীষণ দরদমাখা গলায় ডাকে ইরিন। ইরিনের এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য হয় না নক্ষত্রের। ইরিনের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে সাড়া দেয়।
‘হু? কিছু বলবা? খারাপ লাগছে বেশি? ‘
‘আমাকে শেষবার একটু ভালোবেসে ছুঁয়ে দিবেন প্লিজ? ক্ষমা না পেলাম, আপনার একটুখানি স্পর্শ নিয়ে যাই! ‘
নক্ষত্র ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আলতো করে একবার। ইরিন চোখ বন্ধ করে সে স্পর্শ অনুভব করে। দুচোখ বেয়ে আনন্দধারা ঝরে পড়ে। নক্ষত্র আর দাঁড়ায় না ইরিনের কাছে। ও.টি রেডি কিনা দেখবে বলে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। ইরিন আবারও কাঁদে। এই মানুষটাকে ভালোবাসতে পারার…তার সন্তানকে নিজ গর্ভে ধারণ করার সুখে কাঁদে। আবার কয়েকমুহূর্তের ব্যাবধানে তাকে ছেড়ে যাওয়ার আশংকায়…কষ্টেও কাঁদে সে। মন বলে, জীবন এত জটিল কেন? যার সাধনায় সাধক হওয়া…এ তারে কেমন পাওয়া? কেনই বা এমন ছেড়ে যাওয়া? জীবন কেন একটু সহজ হয় না তার? সুখপাখি ডানা ঝাপটায় অথচ আঙিনায় পা অবধি রাখে না।
হায়…জীবন! জন্মের পর জন্ম ঘটে তবুও বেঁচে থাকা হয়ে উঠে না। প্রতি ধাপে নতুন করে জন্মাতে জন্মাতেই জীবন দুয়ারে মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে। এত জন্ম পার করেও বেঁচে থাকা হয় কি আদৌ?
১৪৫.
‘ইরিনকে ও.টিতে নেওয়া হয়েছে। সি-সেকশনের প্রস্তুতি চলছে তার। নক্ষত্র বাইরের চেয়ারে বসে আছে। সাথে আম্বিয়া খাতুন, শায়লা, কনক আর রিতুও এসেছে। তারাও অপেক্ষা করছে নতুন অতিথির সাথে প্রথম সাক্ষাতের।
নক্ষত্র বাইরে যতই শক্ত থাকুক, ভেতর ভেতর অস্থিরতায়, ভয়ে মরণ দশা তার। সে ভাবে বিগত কয়েকমাসের কথা। কিভাবে এতগুলো দিন পার করেছে ইরিন আর সে। কতটা কষ্ট করেছে ইরিন শুধুমাত্র তার ক্ষোভের শিকার হয়ে। নক্ষত্র অনুতপ্ত হলেও ইরিনের সামনে কোমল হয়নি একবারের জন্যও। নিজের কষ্ট হলেও কষ্ট দিয়ে গেছে সে ইরিনকে।
এ যে পুরুষের মন। বহু বছরের পুরোনো বটবৃক্ষের মতন।বুড়িয়ে যাবে তবু শক্ত শেকড়ের জোরে ঠাই দাঁড়িয়ে রবে বছরের পর বছর।
নক্ষত্রের মনে পড়ে, প্রথম সন্তানের সময় ইরিন রাগ করে বলেছিল…বাচ্চাটা তার রক্ত মাংস খেয়ে তাকে একেবারে শেষ করে তারপর পৃথিবীতে জন্ম নেবে। নওরিন তা করেনি। তার ভাগ্যই হয়নি শরীরে প্রাণ নিয়ে মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে আলোকিত পৃথিবীতে আসার। মাতৃগর্ভের অন্ধকার থেকে দুচোখে অন্ধকার মেখে একেবারে পৃথবীর অতল অন্ধকারে ঠাঁই করে নিয়েছিল সে ।তবে, ইরিনের দ্বিতীয় সন্তান যেন বোনের অসম্পাদিত কাজটাই সম্পন্ন করে ছেড়েছে।
একটা স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায় একজন গর্ভবতী নারী যতটা না কষ্ট করে ইরিনকে তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। নক্ষত্র তার সেবায় কোন ত্রুটি রাখেনি। কোন ভুল হওয়ার সুযোগ দেয়নি। কড়া নজরে রেখেছিল ইরিনকে। কিন্তু, তাও শারিরীকভাবে অনেক বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে ইরিনকে।
সন্তান গর্ভে এলে নাকি একটা আলাদা দ্যুতির আবির্ভাব ঘটে হবু মায়ের চেহারায়। ইরিনের ক্ষেত্রে হয়েছে তার বিপরীতটাই।পুরো গর্ভকালীন সময়টায় শরীর একদম ভেঙে চূড়ে গেছে ইরিনের। রক্ত সল্পতার কারণে বেশ কয়েকবার তাকে রক্ত দিতে হয়েছে। বাচ্চা অপুষ্টিতে যেন না ভুগে সেজন্য জোর করেই খাবার মুখে তুলেছে। কিন্তু, শরীরে ধরে রাখতে পারেনি কিছুই। ঘুম হতো না ঠিকমত। পায়ে পানি এসে পা ফুলে গেছে। হরমোনের পরিবর্তনে মানসিকভাবেও অনেক সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে ইরিন। তারপরও সবই সে সহ্য করেছে নক্ষত্রের সন্তান জন্ম দিবে বলে।
নক্ষত্রের মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো অনেক বেশি। সে এতটা নিয়ন্ত্রণহীন না হলেও পারতো। ইরিনের প্রতি ক্ষোভ তাকে দিশেহারা করে দিয়েছিল। ইরিনের উদ্দেশ্যকেই তার বিপরীতে ব্যবহার করতে চেয়েছিল নক্ষত্র। সে জানতো এখন নতুন করে মা হওয়ার জন্য ইরিনের শরীর মোটেও প্রস্তুত নয়। ইরিন নিজেও জানতো এটা। তবুও সে এই ঝুঁকিটাই নিয়েছে। নক্ষত্রের দোষ শুধু এটুকু সে ইরিনের এই ভুলকে নিজ থেকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ফলাফল ইরিন একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছে অনেকাংশেই।
কি অদ্ভুত জীবন মানুষের। কেউ অবুঝ হয়ে ভুল করে।কেউ আবার ভুলকে প্রশ্রয় দেওয়ার ভুল করে। ভুলে ভুলে ভুক্তভোগী হয় কিছু নির্দোষ জীবন। অনুতাপও সেই ভুলের মাসুল দিতে ব্যার্থ হয়। নক্ষত্রের ভুলটাও ছিল ঠিক এ রকম। ইরিনের প্রতি জমা রাগ অভিমান তার দ্বিতীয় ভুলের কারণে নক্ষত্রের ক্ষোভে পরিণত হয়। সবটা জেনে বুঝে সে ইরিনের সন্তান ধারণের পরিকল্পনায় সহায়ক হয়ে উঠে।পরিণাম হয় ইরিনের অতিমাত্রায় খারাপ শারিরীর অবস্থা এবং অপুষ্ট সন্তান ধারণ।
দেখতে দেখতে ৩৫ সপ্তাহ কেটে যায়। ইরিনের এমন খারাপ অবস্থা দেখে ডক্টর সুব্রত কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। ৩৫ সপ্তাহ পরেই পুনরায় সি- সেকশনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সন্তানের আগমন ঘটতে চলেছে পৃথিবীতে।
১৪৬.
‘পেশেন্ট ইরিনের হাজবেন্ড কে এখানে?’ একজন নার্সের বিরক্তিমিশেল বাঁজখাই গলার আওয়াজে ভাবনাচুত্য হয় নক্ষত্র। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যায় নার্সের দিকে।
‘জ্বী..বলুন। কোন সমস্যা?’
‘আপনি পেশেন্ট ইরিনের হাজবেন্ড?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি রেডি হয়ে ভেতরে চলুন। স্যার যেতে বলেছেন।’
নার্সের এমন কথায় বেশ ভয় পেয়ে যায় নক্ষত্র। আতংকিত গলায় প্রশ্ন করে, ‘ক্যা..ক…কেন? কি হয়েছে? ইরিনের কোন সমস্যা?’
‘আরেএএ আপনার ওয়াইফই তো একটা সমস্যা। বিগত আধা ঘন্টা ধরে এনেস্থিসিয়ার লোককে সে বসিয়ে রেখেছে। বারবার বলছে, আপনাকে ডেকে দিতে। আপনি না গেলে সে এনেস্থিসিয়া নিবে না। সিজারও করবে না। আপনিই বলেন এইটা কোন কথা? আমাদের কি আর পেশেন্ট নাই? সারাদিন তারে নিয়ে ও.টিতে বসে থাকবো? চলেন এখন তাড়াতাড়ি। আরও তো ও.টি আছে স্যারের।’
নার্সের কথায় নক্ষত্র ঠিক কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারলো না। ইরিনের উপর রাগ লাগছে, মেয়েটা এক নাম্বারের ঘাঁড়ত্যাড়া, জেদি মানুষ। আবার হাসিও পাচ্ছে তার ইরিনের এমন পাগলামোতে। মেয়েটা তাকে ভালোবেসেই মরেছে একেবারে। তবুও এ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যায় নক্ষত্র। পুরোনো ক্ষত এ ভালোবাসায় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত জ্বালা ধরায়। নক্ষত্র এ জ্বালা থেকে পরিত্রাণের জন্য উপেক্ষার আশ্রয় নেয়।
১৪৭.
‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই ইরিন। এতগুলা মানুষকে হয়রানি করার কি মানে, হ্যাঁ?’ চাপা স্বরে ইরিনকে ধমকে বললো নক্ষত্র।
ইরিন এ ধমক গায়ে মাখলো না। নিরবে হাসলো নক্ষত্রের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে। নিস্তেজ গলায় বললো,’ যদি মরে যাই এখানেই…..আপনাকে কাছ থেকে না দেখে যেতে পাওয়ার আফসোস রয়ে যাবে।নিজের ভুলের জন্য অনেক আফসোস জমে গেছে আমার।কিন্তু, এই আফসোসটুকু নিয়ে মরতে চাই না আমি। আপনি কি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবেন প্লিজ?’
নক্ষত্র আর কোন কথা পায় না ইরিনের এমন আকুতি মিনতির পরে।তার নিজের ভেতরটাই অবশ অবশ লাগতে শুরু করেছে। ইরিনকে এনেস্থিসিয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। নক্ষত্র শক্ত করে তার হাতটা ধরে রাখে। ইরিন নিরবে সুখজল বিসর্জন দেয়।
প্রায় ১০ মিনিট পর নবজাতকের কান্না আওয়াজে নক্ষত্র পাশ ফিরে তাকায়। ডক্টর সুব্রতর হাতে লম্বা নাড়ি সমেত রক্তে মাখামাখি হওয়া একটা ছোট্ট শরীর।নক্ষত্র অবাক নয়নে তাকিয়ে প্রথম দেখলো তার সদ্যজাত সন্তানকে। ডক্টর সুব্রত নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কংগ্রাচুলেশনস আদৃত। ইটস আ বেবি গার্ল।তোমার মা এসেছে। মিষ্টি কিন্তু ডাবল চাই আমার।’
নক্ষত্র কিছু বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেললো। একদিকে তার নবজাতক কন্যা গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। অন্যদিকে ইরিনও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। নক্ষত্রের হাতের মুঠোয় থাকা ইরিনের হাতের কম্পনে নক্ষত্র নির্বাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো ইরিনের দিকে। তার চোখদুটোও সুখজলে ছলছল করছে। সমস্ত শরীর পুরো অসাড় হয়ে আসছে এক অভাবনীয় সুখের আবেশে। মনে মনে কয়েকদফায় ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ পড়ে ফেললো সে। এমন সুখে রবের শুকরিয়া আদায় না করলে কি আর চলে!!
প্রথমবার বাবা হয়েছে সে। তার পরী ছোট্ট আরেকটা পরীর জন্ম দিয়েছে। পরিপূর্ণ করেছে তার জীবন। তার মনের বাসনা পূরণ করে আল্লাহ তার ঘরে বরকতসরূপ প্রথম সন্তান মেয়ে দিয়েছেন। তার মায়ের জায়গাটা ভরাট করার জন্য তার মেয়ে এসেছে।এত সুখ সে কিভাবে সামলাবে!
হাতে টান পড়তেই হুঁশ হয় নক্ষত্রের। ইরিন তার ধরে রাখা হাতটা ছাড়াতে চাইছে। নক্ষত্র ইরিনকে খেয়াল করতেই দেখলো সে একহাতে তাদের মেয়েকে বুকে আগলে রেখেছে। বাচ্চাটাও এখন আর কাঁদছে না। মায়ের বুকের উষ্ণতা পেয়ে শান্ত হয়ে লেপ্টে আছে মায়ের বুকের মাঝে।সম্ভবত মায়ের প্রথম স্পর্শ অনুভব করছে। ক্যানোলা লাগানো থাকায় ইরিন একহাতে ঠিকমত ধরতে পারছে না বাবুকে।অন্যহাতটাও এই জন্যই ছাড়াতে চাইছে সে।
নক্ষত্র হাত ছেড়ে দিতেই ইরিন তার হাত ধরে নিল আবার। হাতটা টেনে এনে মেয়ের মাথায় স্পর্শ করালো। নক্ষত্রের সমস্ত শরীর জুড়ে হিম শীতল এক শিহরণ বয়ে গেল। সন্তানকে প্রথম স্পর্শ করার স্বাদ বুঝি এতটাই সুখের..এতটাই মধুর?! এ যেন সত্যিকার অর্থেই স্বর্গীয় সুখ।একদম অতুলনীয়।
‘বাচ্চার ওজন কম আদৃত। অপুষ্ট অনেকটাই। তাকে কয়েকদিন এনআইসিইউতে রাখতে চাইছি। তারপর কিছুটা স্টেবেল হলে তোমাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হবে। ‘ ইরিনের সেলাইয়ের কাজ করতে করতে বললেন ডক্টর সুব্রত।
‘আপনার যেটা ভালো মনে হয় করুন ডক্টর। আমার মেয়েটা সুস্থ থাকলেই হলো।’
‘মেয়ের নাম কি রাখবে বলে ভেবেছো?’
‘এখনো ভাবিনি কিছুই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে এটা তো জানতাম না। তাই ভাবা হয়নি কিছু। ‘ কিছুটা লাজুক স্বরে জবাব দেয় নক্ষত্র। নওরিনের বেলায় তো না জেনেই নাম ঠিক করে ফেলেছিল। তার বিশ্বাস ছিল মেয়েই হবে। হয়েছিলোও তাই। কিন্তু, নামটা ধরে তাকে ডাকার ভাগ্যটা আর হয়নি কারও। তাই এবার আগেভাগেই কিছু ঠিক করেনি নক্ষত্র। যা হওয়ার হোক, একটা সুস্থ বাচ্চা হলেই হলো তার।
‘আদৃতা রাওনাফ – বাবুর নাম। ‘ ইরিন বললো আচমকাই।
আদৃত চমকালো মেয়ের নাম শুনে। তার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে ইরিন।
ডক্টর সুব্রত হাসতে হাসতে বললেন, ‘বাহ! আদৃতর মেয়ে আদৃতা। চমৎকার নাম। ‘
‘মাশাল্লাহ।’নক্ষত্র আউড়ালো মনে মনে। ইরিনের প্রতি তার যতই রাগ অভিমান থাকুক….এই সন্তানের জন্য সে ইরিনের কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।
চলবে…