#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_47
ক্যাফেটেরিয়া তে বিশাল সমাবেশ বসেছে। সমাবেশের প্রধান আকর্ষন মির্জা পরিবার আর শিকদার পরিবার। প্রচন্ড অবাকের সহিত দাঁড়িয়ে আছে অভিনব , ঝিল। সকালে প্ল্যান করে এসেছিলো অভিনব আর ঝিল । তবে যেটা হলো সেটার জন্য মোটে ও প্রস্তুত ছিলো না তাঁরা । ক্যাফে তে শিকদার পরিবার আর মির্জা পরিবার আগেই উপস্থিত ছিলো। এখন পিনপিন নিরবতা চলছে। অভিনবর হাত টা চেপে ধরে রেখেছে ঝিল। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।
অভিনবর দৃষ্টি বরাবরে মতোই স্থির। আজব লোক , এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ও কি করে শান্ত আছে ?
_ তোমরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে ?
_ জি !
_ আমাদের কথার কোনো মূল্য নেই ইহান?
_ অবশ্যই আছে বড় মামা। কিন্তু ঝিল ও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন। আমি সবাই কে নিয়েই বাঁচতে চাই।
ইববান ভ্রু কুটি করে তাকালেন। ইকবালের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। দুটো পরিবারের ঝামেলা চলছে তাঁর উপর আরেক ঝামেলা। তাই এক গভীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওনারা। ছেলে মেয়েরা যখন নিজেদের মতামত কে গুরুত্ব দিচ্ছে তাই একটা সুযোগ দেওয়া দরকার।
ইকবাল ঝিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন
_ তোর কোনো ইচ্ছেই অপূর্ন রাখি নি। এটা ও রাখতাম না যদি না যাই হোক, তবে এর জন্য পরীক্ষা দিতে হবে।
_ পরীক্ষা!
কথা টা অবাকের সহিত বললো ঝিল । অভিনবর মুখে একটু চিন্তার ছাপ দেখা গেল। ঝিল ভাইদের দিকে তাকালো। ভাই রা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে । যখন পরিবারের কঠিন সিদ্ধান্ত হয় তখন ছোট রা কথা বলে না। তবে ঝিলের দৃষ্টি দেখে রোহন বলে ফেললো
_ কি পরীক্ষা বড় কাকা ?
_ জানতে পারবে তাঁর জন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে।
আর পরীক্ষায় যদি পাস না হয় তো ওদের আলাদা হতে হবে।
_ কি পরীক্ষা বড় পাপা ?
_ পরীক্ষা টা হলো অভিনব মির্জা পরিবারে আগামী এক বছরের জন্য থাকবে । আর তুমি শিকদার পরিবারে।
_ হোয়াট ! আমি তোমাদের ছেড়ে
ঝিল কে বলতে না দিয়ে জাফর বললেন
_ তুমি তো তোমার সিদ্ধান্তে অটল। আমাদের ছেড়ে থাকার জন্য তুমি প্রশস্ত ওহহ তাহলে সমস্যা কোথায় ? তুমি যেমন পারবে আমরা ও পারবো।
শেষ কথাটা বলার সময় জাফরের গলা ধরে আসলো। চোখে পানি চিক চিক করছে। তবু ও তিনি কঠোর গলায় বললেন
_ ওদের কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হোক।
একে একে সবাই বের হয়ে গেল। অভিনব আর ঝিল কে কথা বলার জন্য কিছু টা সময় দেওয়া হলো। অহেদের দিকে এক পলক তাকালো অভিনব। তিনি আশ্বস্ত করলেন। মুহুর্তেই পরিবেশ থমকে গেল।
আধ ঘন্টা পর দুজন এক মত পোষন করলো। যেহেতু পরিবারের সবাই কে নিয়ে থাকতে চায় তাই এই পরীক্ষা টা দিতেই হবে।
ঝিলের চোখ মুখ ফুলে গেছে। কারন শর্তে উল্লেখ করা আছে আগামী এক বছর কেউ কারো সাথে দেখা করতে পারবে না। অভিনব এতো বোঝানোর পর ও মেয়েটার মস্তিষ্ক মানতে চাইছে না।
দুজনে দু দিক ফিরে বসে রইলো। অভিনব বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল
_ আমরা ফোনে যোগাযোগ রাখতে পারবো তো ।
ঝিল উত্তর দিলো না। অভিনবর মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমে গেল। দু পরিবার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দিশা পাওয়া যাচ্ছে না।
ইসহ আজকে সবাই মিলে প্ল্যান করার কথা ছিলো। কিন্তু এরা সবাই আরো এক ধাপ এগিয়ে।
ঝিলের দু বাহু টেনে ধরতেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠলো ঝিল। মনের ভাঙচুরে ব্যথিত অভিনব। ঝিল কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই অশান্ত হয়ে পরলো।
দু হাতে নিজের চুল খামচে ধরলো। ঝিলের সে দিকে ধ্যান নেই।
হঠাৎ করেই অভিনবর বুকে মাথা রাখলো ঝিল। প্রশান্তি তে চোখ বুঁজে নিলো । অভিনবর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে কয়েকগুন।
_ আমরা পারবো না ঝিল ? আমাদের ভালোবাসা কি এতো টাই ঠুনকো? সামান্য হাওয়া তেই যা ভেঙে যায় তাঁকে কি বলবে তুমি?
_ আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি । আমাদের পারতেই হবে । চেষ্টা করে যাবো বাকি টা আল্লাহর ইচ্ছা।
ঝিলের এমন পরিবর্তনে হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে অভিনব। একটু আগে যে মেয়ে বাচ্চা দের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছিলো সেই মেয়েটা এখন পূর্ন বয়স্ক দের মতো কথা বলছে। আশ্বস্ত করছে সেই মেয়েটাই।
সবাই কে আসতে দেখে অভিনব ঝিলের থেকে দূরে সরে গেল। না জানি কি হতে চলেছে। কি আছে ভাগ্যে কে জানে। একটাই প্রার্থনা শেষ টা যেন সুখময় হয়। না হলে মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। বিচ্ছেদের নীল ব্যাথা অনুভব করার শক্তি যে নেই।
*
ব্যাগ গোছানো শেষ মৌনতার। দুটো ব্যাগ গোছাতে গোছাতে তাঁর অবস্থা নাজেহাল। হাঁটু তে থুতনি গুঁজে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে ঝিল। আজ কেই শিকদার পরিবারে অবস্থান করতে হবে। এতো এতো মানুষের সাথে কি করে থাকবে আদৌ কি মানিয়ে নিতে পারবে সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ নেই।
মৌনতা আরক্ত হয়ে বলল
_ এভাবে বসে থাকলে কোনো কিছু হবে ? জীবন টা তো থেমে থাকবে না !
_ তো ? কি করতে বলছিস ?
_ সঠিক ভাবনা ভাবতে বলছি , মনোবল বাড়া সাহস যোগাড় কর।
গা দুলিয়ে হাসে ঝিল। যার ভবিষ্যত ধোঁয়াশা তাঁর আবার মনোবল। মানুষ না হয়ে পাথর হলে না হয় নির্নিমেষ মনোবল বেড়ে যেতো। এখন কি করে সম্ভব ?
ঝিলের ভাবনার মাঝে উপস্থিত হয় রোহন আর আহনাফ। চোখে মুখে কালি জমেছে। সারা রাত ঘুমায় নি। মোট কথা মির্জা পরিবার কাল সজাগ ছিলেন। সব থেকে প্রিয় সদস্য কে বিদায় জানানো মোটে ও সহজ কার্য নয়।
_ ঝিল বনু এভাবে ভেঙে পরছিস কেন ?
মাথায় আহনাফের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকায়। কোটরে যাওয়া চোখ গুলো পিট পিট করছে। একটু হাসার চেষ্টা করে ভাইয়ের বাহু ধরে উঠে দাঁড়ালো । যেন শরীরে বিন্দু পরিমান শক্তি নেই। নিলাভ আকাশের বুকে যেমন মেঘ জমে ঠিক তেমনি মেঘ জমেছে তাঁর বুকে । অভিমানে কান্না চলে আসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে রোহনের দিকে এগিয়ে যায়। একটু হাসে যেই হাসিতে ছেলেটার বুক ভারী হয়। অতি সাবলীল গলায় ঝিল বলে
_ এমন দিন দেখতে হবে জানলে মির্জা পরিবারে জন্মগ্রহণ করতাম না।
সুখ না থাকলে মানুষ সুখের পেছনে ছুটে। আমি ঠিক কিসের পেছনে ছুটছি বলো তো ?
ধোঁয়াশা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। একটু ভুল হলেই সমস্ত টা শেষ।
_ বোন
হাত উঁচিয়ে আহনাফ কে থামিয়ে দেয় ঝিল। চোখের পানি যেন বাঁধ ভেঙেছে। ভাইয়ের দু বাহু ঝাঁকিয়ে ঝরঝরে কেঁদে উঠে।
হঠাৎ করেই মেঝে তে বসে পরে। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদে । অশরীরী মতো কান্নার আওয়াজের সাথে ভেসে আসে অভিমানের কন্ঠস্বর
_ এতো সুখ কেন দেখালে বলো তো ? আমি তো সুখী ছিলাম। যা চাইতাম তাই পেয়ে যেতাম। একটা ব্যথা ছিলো যে ব্যথা ভোলানোর চেষ্টা তোমরা করেছে। অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম আমি।
তবে এখন কেন ব্যথা ভোলানোর কেউ নেই ? সুখ দেখিয়ে কেন সুখ কেড়ে নিলে তোমরা।
উত্তর আছে তোমাদের ?
কারো মুখে কোনো কথা নেই। এরি মাঝে রোহন বেরিয়ে যায়। চোখ দুটো ব্যর্থ হয়েছে। বোনের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে আরো দূর্বল অনুভব করাতে চায় না।
মৌনতা এক কোনে দাঁড়িয়ে হিচকি তুলে কাদছে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর কষ্ট যেন ওকে নুইয়ে দিয়েছে। ছুটে চলে যায় সে। মিনিটের মাঝে চলে আসেন জাফর মির্জা। অত্যন্ত কঠোর তাঁর কন্ঠস্বর যা ক্ষনে ক্ষনে অবাক করে ঝিল কে।
যেই পাপা মেয়ের প্রতি টা কথা কে কথা হিসেবে নয় বরং কর্তব্য হিসেবে পালন করেছে সে আজ এতোটা পরিবর্তন। ঝিলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো মানুষ বদলায়।
গলায় এক দলা থু থু চলে আসলো। এমন পরিবার তাঁর ?
যে পরিবার নিজের শত্রুতা বহন করার জন্য মেয়ের সুখ কেড়ে নেয়। মুহুর্তেই রাগ অভিমান বিদ্রূপে পরিনত হলো।
নিজের জন্য ই বাঁচতে হয়। জীবনে একাই লড়াই করতে হয়। কেউ শেষ অব্দি পাশে থাকে না।
আহনাফের দিকে তাকিয়ে প্লাস্টিকের হাসি দিয়ে বলল
_ আমাকে গাজীপুর দিয়ে আসো ভাইয়া।
_ কিন্তু এখনো তো
_ কথা বাড়িয়ে ওহ না। চলে যেতেই হবে যখন তো আগে যাওয়াই ভালো।
কায়া দেখলে মায়া বাড়ে আমি চাই না মায়া বাড়াতে ।
সবাই আমাকে দৃরে ঢেলে দিতে পারলে আমি কেন পারবো না ?
কথা গুলো ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের মতো বুকে বিধলো। জাফরের চোখে অশ্রুর ঘন রেখা। ঝিল সে দিকে তাকালো না।
বেড়িয়ে আসলো, করিডোরে বড় পাপা আর মেঝো পাপা কে দেখতে পেল। সামান্য হাসলো , দোয়া নেওয়ার ইচ্ছে হলো না। তবু ওহ সবাই কে সালাম করে গেল। পাঁচ ভাই দাঁড়িয়ে, ঝিলের দিকে হাত বাড়াতেই ঝিল বলল
_ পর কে আপন করার চেষ্টা করো না। আসি, সবাই ভালো থেকো।
রোহন ভাইয়া মৌন কে সেফলি বাসায় পৌছে দাও।
বোনের শেষ ইচ্ছে টা দায়িত্ব নিয়ে না হয় পালন করলে।
রোহনের গলা ধরে আসে। আহনাফের সাথে হাঁটা লাগায়। এক পা দু পা করে শ পা পেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। সা সা করে ছুটে চলে গাড়ি। পেছন ঘুরে না ঝিল। প্রচন্ড মায়া , যে মায়া মানুষ কে অমানুষ করে তুলে। আবার যে মায়া অমানুষ কে মানুষ করে তোলে।
*
আহনাফ আর সাদাদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিল আর অভিনব কে দেখা করার সুযোগ দিয়েছে। ঝিলের নির্লিপ্ত চাহনির সাথে মুখের ঘনঘটা অভিনব কে অবাক করে দিলো।
কেন যেন হাত বাড়াতেই উসখুস করছে তাঁর মন। অভিনবর আড়ষ্ঠতা দেখে ঝিল ই এগিয়ে আসলো। দু জনের চোখাচোখি হলো । ঝিল হাসলো সাথে অভিনব। বেশ সাবলীল গলায় বলল
_ আমি অপেক্ষা করবো অভিনব। জানি না কি হবে । তবে শেষ দিন অব্দি আমি তোমার ই থাকবো।
_ আমি ওহ
কথা টা পরিপূর্ন না করেই ঝিল কে জড়িয়ে নিলো। ঝিলের ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে বলল
_ কি মোহ দিয়েছো তুমি ? আমি যে পাগল হয়ে গেছি।
আমাদের পথ এতো টা দুর্গম না হলে ও তো পারতো। যদি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি ?
_ কখনো ই না। না আমি তোমাকে হারাবো আর না তুমি আমাকে হারাবে। লড়াই করার আগেই হেরে যাবে ?
অভিনব উত্তর দেয় না। ঝিল কে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অভিনবর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরতেই ঝিলের অন্তর কেঁপে উঠে। খামচে ধরে অভিনব কে। হঠাৎ ই অনুভব হয় 365 টি দিন 8760 ঘন্টা 525600 মিনিট 31536000 সেকেন্ড দূরে থাকতে হবে।
বুকের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হলো। ঝিল নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিনবর হাত দুটো মুঠো বন্দী করলো। মুহুর্তেই হেসে ফেললো। অভিনবর হাতের কাছে সে পিচ্ছি। অভিনব ভ্যাগা চাহনি তে ঝিল কে দেখে নিলো। ঝিলের কপালে শুষ্ক ঠোঁট ছুঁইয়ে হাসলো।
হাসি মুখে বিদায় দিতে চাইলে ও কান্না চলে আসলো। দু চোখ যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ঝিল দু হাত দূরে গিয়ে ঘুরে তাকালো । অভিনব কে পেছন থেকে জড়িয়ে বললো
_ ভালোবাসি খুব ভালোবাসি তোমায় !
গ্রুপ
**আমার পরবর্তী গল্প অব্যক্ত প্রিয়তমা। সবাই পড়বেন তো ?
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন । ভালো লেগে থাকলে একটা রিভিউ দিবেন।
চলবে