ধূসর রঙের প্রজাপতি ৪০

0
494

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_40

ভোর হতেই উঠে বসেছে ঝিল। পারছে না এখনি বেরিয়ে যেতে। অভিনব কে নিয়ে প্রচন্ড ইনসিকিউর ফিল করছে। তাই তো ভোর পাঁচ টায় উঠে অভিনব কে খোচাচ্ছে। অভিনব ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালো। আবার ঘুমিয়ে পরলো। ঝিল এবার রাগ করলো। অভিনব বিষয় টা খেয়াল করেছে তাই ঝিল কে বেডের সাথে চেপে ধরে আবার শুইয়ে পরলো।
_ আজব তোমার এতো ঘুম পাচ্ছে তো তুমি ঘুমাও । আমাকে কেন টানছো ?

_ তোমাকেই প্রয়োজন তাই তোমাকেই টানছি।

_ ছাড়ো বলছি।

_ ছাড়বো না।

ঝিল নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অভিনব না পেরে উঠেই গেল । ঝিল কে কাছে টেনে বলল
_ এতো ভয় পাও আমায় নিয়ে ?

_ অনেক বেশি।

_ তাহলে চলো পালিয়ে যাই।

_ পালিয়ে যাবো ?

_ হ্যাঁ বহুদূর। যেখানে আমি আর তুমি থাকবো। সবার উপস্থিতি নট এলাউ।

_ এমন হয় নাকি ?

_ কেন হবে না। তুমি চাইলে চাঁদ কে খন্ড করে দিবো।

_ ধ্যাত।

_ বিশ্বাস হচ্ছে না ?

_ হুমম হয়েছে বিশ্বাস। এখন শোনো আমার না খুব ভয় হচ্ছে। মাহেরা আপু একদম চুপচাপ ছিলো। যদি কিছু করে বসে ?

অভিনব দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল
_ কিছু হবে না। তুমি এতো ভয় পেও না।
আচ্ছা ফ্রেস হয়ে এসো আমরা সবাই কে বলে মংলা থেকেই নেমে যাবো।

_ তাহলে রূপসা সেতুর কি হবে ?

_ সেটায় ওহ ঘোরাবো একদিন। তবে বাইকে চরে, হ্যাপি ?

ঝিল মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। অভিনব ঝিলের কাঁধে নাক ঘষে বলল
_ তাহলে আমি কি পাবো ?

ঝিল লজ্জা হাসলো। অভিনবর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
_ যেটা আমি চাইবো।

_ তুমি কি চাও ?

_ যেটা তুমি চাও।

ঝিলের কথা অভিনব হাসলো। ফ্রেস হয়ে এসে সকলের সাথে নাস্তা সেরে নিলো। সবাই মন খারাপ করে ফেলেছে। অভিনব সবাই কে আশ্বস্ত করে বললো আবার আসবে এক সাথে । ঝিল পাপড়ি কে জড়িয়ে কেঁদেই ফেললো। বড্ড আপন হয়ে গেছে। তবে যেতে তো হবেই । পরিশেষে ঝিল আর অভিনব হাসি মুখে সবাই কে বিদায় জানালো।

মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে সোজা ঢাকা চলে যেতে চাচ্ছে ঝিল। তবে অভিনব বললো এখানেই একদিন রেস্ট নিতে। ঝিল ও সায় জানালো। খুলনার একটা রিসোর্ট এ চলে আসলো দুজনে। রিসোর্ট টা বোধহয় কাপল দের জন্য ই করা।
পুরো রিসোর্ট জুড়ে রয়েছে প্রেমের ভাস্কর্য আর ফলক করা সংলাপ। ঝিল মনোযোগ দিয়ে প্রতি টি সংলাপ পড়ছে। কাউন্টার থেকে চাবি কালেক্ট করে বের হয়ে আসলো অভিনব । ঝিল কে মনোযোগ সহকারে পড়তে দেখে বলল
_ সারাদিন কি এখানেই পার করে দিবে ?

_ দিতেই পারি। বেশ ভালোই তো লাগছে।

_ রুম টা তো দেখে আসবে !

_ ওহহ হ্যাঁ । আচ্ছা চলো , আমাদের কটেজ কোন দিকে ?

অভিনব ঝিল কে দিক দেখিয়ে দিলো। এককদম এগিয়ে আবার পিছিয়ে গেল। অভিনবর হাত ধরে এক সাথেই হাঁটতে লাগলো।

কটেজ এ এসে ঝিল অবাক হলো। কটেজ এর রুম টা ভীষন সুন্দর। এক সাইটে বাঁশের তৈরি ঘরের মতো ডিজাইন করা। একটা ওয়াসরুম সাথে ছোট খাটো কিচেন ওহ রয়েছে। অভিনব ব্যাগ দুটো কাবাডে তুলে রাখলো । ততক্ষণে ঝিল ব্যলকনি তে চলে গেছে । অভিনব ব্যলকনিতে গেল না। ফ্রেস হওয়া দরকার তাই বাথরুমে চলে গেল।
একে বারে সাওয়ার নিয়ে ফিরেছে। ট্রাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে আশে পাশে তাকালো । ঝিল এখনো ব্যলকনিতে আছে। ট্রাওয়াল হাতেই ব্যলকনিতে চলে আসলো।

পেছন ফিরে আছে ঝিল। অভিনব চার পাশে চোখ বুলালো। ব্যলকনি টা নদী বরাবর। এখান থেকে নদীর পানি গুলো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। অপর পাশে বিশাল ফুলের বাগান।
অভিনবর উপস্থিতি অনুভব করে ঝিল তাকালো। অভিনবর হাসি দেখে ঝিলের বুক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।
_ লজ্জা পাচ্ছো কেন ঝিল ? আমি তো কিছু করি নি।

_ তুমি হাসছো কেন ?

_ হাসলে বুঝি লজ্জা পেতে হয় ?

_ হুমম হয়।

_ কফি খাবে ?

ঝিল মাথা হেলালো। অভিনব কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। যাওয়ার পূর্বে বলে গেল ফ্রেস হতে।

কফি বানাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে অভিনব কে। কেটলি টা নষ্ট বোধহয়। ঝিল ফ্রেস হয়ে এসে ভাবলো কফি খাবে। কিন্তু সেটা হলো না। অভিনব অপরাধীর মতো তাকালো। সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঝিল নাক ফুলালো।
_ এই রাগ করো না। বাইরের থেকে খেয়ে আসি ?

_ উহুহহ। তাহলে তো তোমার হাতের স্বাদ পাওয়া যাবে না।

_ বোকা মেয়ে চলো তো।

ঝিল কে টেনে নিয়ে গেল অভিনব। বাইরে এসে ধোঁয়া উঠা কফি খেয়ে নিলো।

*

শীতের প্রকোপে নেতিয়ে উঠেছে গাছ গুলো। কেমন রুক্ষ শুষ্ক দেখাচ্ছে। সূর্য যথাসম্ভব কিরন দিয়ে যাচ্ছে। তবে অভিমানী কুয়াশা সূর্য কে আসতে দিচ্ছে না। লেপ্টে রয়েছে আকাশের বুকে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে ঝিল। পাশেই অভিনব ফোন হাতে গভীর মনোযোগ দিয়েছে। কয়েক ফিট দূরে গুটি কয়েক বাচ্চা খেলছে। গাঁয়ে ওলের জামা কাপড়।
তাঁদের পাশে ই জড়ো করে আছে বাচ্চা দের মা বাবা। সন্তান দের নিয়ে পার্কের এসেছে সুন্দর সময় কাটাতে।

_ একটা কথা কি জানো আমি আমার শৈশব এ সব পেয়ে ও কিছু পাই নি। বন্দী থাকতে হয় নি তবে সঙ্গির অভাব ছিলো। ভাইয়া দের সাথে খেলতাম ঠিক ই তবে মা নামক সঙ্গীর অভাব ছিলো। কখনো কাউকে মা ডাকা হয় নি। আদুরে গলায় কখনো কেউ বলে নি খাবার টা না খেলে খুব মারবো।
পাপা রা আমার প্রতি টা কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। আমি ই যেন তাঁদের রাজ্যের এক মাত্র রাজকন্যা । আমি যা বলেছি সেটাই ঠিক। আমার চাওয়া গুলো ভিন্ন হয়ে গেছে। আমি চাইতাম কেউ আমাকে শাসন করুক।
কথায় আছে না যার যেটা অভাব সে সেটার প্রতি ই আকর্ষিত। আমার অভাব ছিলো মা।

খুব মনোযোগী শ্রোতা অভিনব। মেয়েটার কষ্টের পূর্ন অনুভব না হলে ও কিছু টা বুঝতে পেরেছে সে। ঝিলের আক্ষেপ কখনোই যাবে না। মায়ের স্থান কেউ কি পূরন করতে পারে ? তবু ও ঝিল কে আশ্বস্ত করে বলল
_ তুমি না চাইলে ও তোমার এক মা আছেন সেটা জানো ?

ঝিল একটু হাসলো । অভিনবর কথার মানে সে বুঝতে পেরেছে। অভিনব অভিজ্ঞদের মতো করে বলল
_ জানো ই তো আমি আমার মা বাবার এক মাত্র সন্তান। ছেলে থাকলে ও তাঁদের মেয়ের শখ ছিলো। কিন্তু আল্লাহ সেটা চান নি। কারন আল্লাহ চেয়েছেন তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে। তোমার মায়ের অভাব আর মম এর মেয়ের অভাব পূরন করার জন্য।
সৃষ্টিকর্তার ভাবনা বিশাল। তাঁর ভাবনার পেছনের এক অংশ ও আমরা কল্পনা করতে পারি না।
কে জানতো আমার থেকে 10 বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে হবে আমার বউ?

ঝিল ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অভিনব প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তে তাকিয়ে বলল
_ কি হলো ? ভ্রু যুগল এমন কুঁচকে গেছে কেন ?

_ তোমার বয়স কত ?

_ 29

চোখ পিট পিট করে তাকালো ঝিল । অবিশ্বাসের স্বরে বলল
_ মজা করছো ?

_ মজা কেন করবো ?

_ মাই গড। আমার সামনে বসে থাকা ছেলেটার বয়স 29 হয়ে গেছে। আমি তো 25 26 বছর ভেবেছি।

অভিনব গগন কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। ঝিলের চুল টেনে বলল
_ এখন কি ভাবছো , বুড়ো হয়ে গেছি আমি ?

_ ধ্যাত। সেটা কেন ভাববো ? একটা জিনিস ই মেলাচ্ছি যে, মেয়েরা কুঁড়ি তেই বুড়ি। দশ বছর পর দেখা যাবে আমার কপালে ভাঁজ পরে গেছে। চোখ দুটো স্থির , আর মুখে কোনো উজ্বলতাই নেই। আর তুমি পুরো ই উল্টো।

_ উহুহহ । মেয়েরা মা হয় , আর মা কখনো বুড়ো হয় না। তাঁদের সন্তানের কাছে সব সময় ই সুপার ওম্যান।

ঝিল খিল খিল করে হাসলো। অভিনব বাহু তে মাথা ঠেকিয়ে বলল
_ আইসক্রিম খাবো।

_ এখন ?

_ হ্যাঁ।

_ ঠান্ডা লেগে যাবে ।

_ লাগবে না। দেখো ঐ পিচ্ছি বাচ্চা গুলো ও কেমন আইসক্রিম খাচ্ছে।

_ তুমি কি পিচ্ছি ?

_ কোনো সন্দেহ ?

অভিনব একটু ঝুঁকে নিলো। ঝিলের মুখের দিকে কিছু ক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
_ বোধহয় না।

অভিনবর বাহু তে চাপর মেরে হাসলো মেয়েটা। আকাশ টা একটু একটু করে স্বচ্ছ হচ্ছে । বোধহয় বিকেল হতে চলেছে। কুয়াশা গুলো শিশির হয়ে ঘাস কে রাঙাতে লাগলো।

*

পাঁচ ছয় বছর বয়সী এক পিচ্ছি ঝিলের জামা ধরে টানছে। ঝিল পেছন ফিরে তাকালো। অভিনব আইসক্রিম নিতে আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছে। সময় টা যেন একটু বেশি ই নিচ্ছে। হাঁটু ঘেড়ে পিচ্ছিটার সামনে বসলো। বাচ্চা ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। ঝিল অধর কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল
_ নাম কি তোমার ?

_ শিশির।

_ বাহহ ভারী সুন্দর তো তোমার নাম টা। তুমি দেখতে ও একদম শিশিরের মতো।

বাচ্চা টা খলবিলিয়ে হাসলো। ঝিল সে হাসি উপেক্ষা করতে পারলো না। টুপ করে চুমু দিয়ে দিলো। বাচ্চা টা যেন লজ্জা পেল । মাথা নিচু করে রইলো। অভিনব কে আইসক্রিম পার্লার থেকে বের হতে দেখে উঠে দাঁড়ালো । আবার জামায় টান অনুভব করলো। শিশির তাঁর জামা টেনে ধরছে। ঝিল হাঁটু গেড়ে বসতেই শিশির বলল
_ ক্ষিদে পেয়েছে।

_ তোমার ক্ষিদে পেয়েছে ? সকাল থেকে কিছু খাও নি ?

বাচ্চা টা মাথা ঝাঁকালো । অভিনব ততক্ষণে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চা টাকে দেখতে একটু হাসলো।
_ কি কথা হচ্ছে ঝিল ?

_ ওর ক্ষিদে পেয়েছে।

_ আচ্ছা !

বাচ্চা টা মাথা ঝাকালো। অভিনব নিচু হয়ে হাঁটু মুরে বসলো। শিশিরের দু হাত মুঠো বন্দি করে বলল
_ তোমার মা বাবা কোথায় ?

বাচ্চা টা মাথা নিচু করে ইশারা করলো। অভিনব তাকিয়ে দেখলো বাচ্চাটা মা হিসেবে এক পাগলী কে দেখাচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ঝিল বলল
_ ঐ টাই তোমার মা ?

_ হুমম।

অভিনবর অন্তকর্নে ব্যথা অনুভব হলো। একজন পাগলী ও তাঁর সন্তান কে আগলে রেখেছে। মা বুঝি এমনি হয় ?
অভিনব কাউ কে ফোন করলো। কিছু কথা বার্তা বলে নিলো। ঝিল বাচ্চা টাকে আদর করে যাচ্ছে।
অভিনব বলল
_ ওদের একটা এন জি ও তে পাঠালে কেমন হবে ঝিল ?
বাচ্চা টা তো ইনসিকিউর।

ঝিল ও সম্মতি জানালো। ভাগ্যিস বাচ্চা টা ছেলে । মেয়ে হলে রাস্তার হায়না রা এই ছোট বাচ্চাটা কে ও কলঙ্কিত করে দিতো। শরীরে বসিয়ে দিতো কালো হাতের থাবা। ঝিলের চোখ বন্ধ হয়ে গেল। না জানি কতো শিশু প্রতি দিন অত্যাচারিত হচ্ছে। না জানি কতো মা তাঁদের সন্তান কে হারাচ্ছে কিছু বিষাক্ত হায়নার কাছে।

বাচ্চা টা কে নিয়ে একটা ফুড কোড এ চলে আসলো। ঝাল বিহীন নানা খাবার অর্ডার করে দিলো। কিন্তু শিশির খাবার খাচ্ছে না। ব্যস্ত হয়ে ঝিল বলল
_ এগুলো কি তোমার পছন্দ নয় ?

শিশির উত্তর দিলো না। অভিনব ভাবনায় পরে চকলেট অর্ডার করলো। আশ্চর্যজনক ভাবে চকলেট টা ও নিলো না সে। অভিনব শিশিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
_ কেন খাচ্ছো না তুমি ?

_ আমার মা !

থম মেরে গেল ঝিল আর অভিনব। বিস্ময়ে হতবাক। ছোট এক বাচ্চা সে ও তাঁর মাকে রেখে খাবে না। ছলছল করে উঠলো ঝিলের চোখ। অদ্ভুত শিহরন অনুভব হলো। মা নামক মানুষ টার প্রতি এতো ভালোবাসা সত্যি ই অতুলনীয়। প্রতি টা সন্তানের কাছেই তাঁর মা বাবা সেরা। অথচ আজ ও এ দেশে বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিছু অমানবিক সন্তান দামী ফ্ল্যাটে থাকছে আর আস্তা কুড়ের মাঝে ফেলছে মা বাবা কে।

এই গল্পের শেষে আসবে নতুন গল্প “অব্যক্ত প্রিয়তমা “। আশা করি সেই গল্প টা কে সবাই সাপোর্ট করবেন।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here