#দ্বিপ্রহরের_রাত্রি
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
৪.
আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই-ই শ্রুতিকে পছন্দ করেছে। অবশ্য সে পছন্দ করার মতোই মেয়ে। শান্ত ব্যবহার, মিষ্টি চেহারা, ধীরকণ্ঠে কথা বলা সবই তো পছন্দের লক্ষণ। সবার সব প্রসংশা হজম হলেও শেষের কথাগুলো শ্রুতির ঠিক হজম হয় না। অরিত্রর ফুপু বলছিল,’ছেলে যখন বিয়ে করে বউ এনেছেই তখন ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। শ্রুতির বাবা-মাকেও ডাকো ভাবি। তারপর দুই পরিবার মিলে ছোটোখাটো অনুষ্ঠান করে না হয় আবার বিয়ে দিলাম।’
এই মুহূর্তে শ্রুতির মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলতে,’এ অসম্ভব!’ কিন্তু বলার উপায় নেই। এসব বুদ্ধি, চালাকি তার একান্তই নিজের ছিল। ইতিমধ্যে অরিত্রকেও সবাই ড্রয়িংরুমে এনে বসিয়েছিল। সে কিছুই বলছিল না। শুধু নিরীহর মতো বসে ছিল। তবে ফুপুর শেষ কথাটি শুনে সে প্রফুল্লিত হয়ে ওঠে। সেও দেখতে চায় শ্রুতি এবার কী করে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শেষ হলে সুলায়মান রহমান শ্রুতিকে বলেন,’মা, তোমার বাবার নাম্বারটা দাও।’
বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ আসায় সে বিচলিত যেমন হচ্ছিল তেমনই কষ্টও লাগছিল। আজ যদি বাবা-মা থাকত তাহলে কি এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হতো? শ্রুতি মাথা নত রেখেই বলল,’আমার বাবা-মা কেউ নেই। আমি মামা-মামির কাছে বড়ো হয়েছি। তারা কেউ আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। যদি নিতই তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের পালানোর প্রয়োজন হতো না। তাছাড়া অরিত্রর কোনো চাকরী নেই এখন। সে বেকার। ওর হাত ধরেই বাড়ি থেকে পালিয়েছি। যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সে সবদিক দিয়েই পার্ফেক্ট ছিল। সেখানে মামা-মামিকে ফোন করে আসতে বললে তারা অরিত্রসহ আপনাদেরও অপমান করবে। যেটা আমি চাই না।’
শেষের কথাগুলো বলতে শ্রুতির খারাপ লাগছিল। কারণ তার মামা-মামি মোটেও এরকম নয়। তবে উপস্থিত সবাই তো প্রথম কথাতেই গলে গেছে, যখন জেনেছে শ্রুতির কেউ নেই। সে এতিম। যতই মামারা লালন-পালন করুক না কেন, বাবা-মা তো বাবা-মা-ই হয়। সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন অদিতি বেগম। সে উপরে উপরে যতই রাগ দেখাক না কেন, ভেতরটা তুলার চেয়েও নরম। তার চোখেও অশ্রু চলে এসেছে। খারাপ লাগছিল অরিত্ররও। ফুপু তখন নরমস্বরে বললেন,’তাহলে এখন কী করা যায়?’
উত্তরে শ্রুতি বলে,’কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলি ফুপু?’
ফুপু হাসলেন। শ্রুতির চিবুক ছুঁয়ে বললেন,’বোকা মেয়ে! কিছু মনে করব না। বলো।’
‘আমি চাচ্ছিলাম, অরিত্রর আগে একটা চাকরী হোক। তারপর না হয় আমি ওকে নিয়ে মামা-মামির কাছে যাব। তখন তো আর তারা আমাদের অপমান করতে পারবে না।’ অরিত্র যে বেকার এটা সে অনিক আর বাচ্চাদের সাথে কথা বলে কৌশলে জেনে নিয়েছে। ভাগ্যিস জেনেছিল। অরিত্র বেকার বলেই হঠাৎ বুদ্ধিকে সে কাজে লাগাতে পারল। সকলেই শ্রুতির মতামতকে প্রাধান্য দেয়।
যদিও দুই পরিবার এখন একত্রিত হচ্ছিল না, তবুও অদিতি বেগম এবং সুলায়মান রহমান ছোটোখাটো একটা আয়োজন করেন আত্মীয়-স্বজন এবং নিকট প্রতিবেশীদের জন্য। এদিকে হাফ ছেড়ে বাঁচে শ্রুতি। অরিত্রর মেয়ে কাজিনরা শ্রুতিকে সেখান থেকে নিয়ে অরিত্রর ঘরে আসে। কাজিনগুলা ইচ্চি-পিচ্চি থেকে শুরু করে শ্রুতির সমবয়সীও আছে। পিচ্চিগুলোকে ঘর থেকে বের করে দিল বড়ো কাজিনরা। ওদের মধ্যে একজন শ্রুতিকে পরখ করে হাস্যরসাত্মকভাবে বলল,’অরিত্র ভাইয়ের পেটে পেটে যে এত শয়তানি তা কিন্তু আমরা কেউই বুঝতে পারিনি ভাবি। যখনই জিজ্ঞেস করতাম, ভাইয়ের কেউ আছে কী-না তখন এমন একটা ভান ধরত যেন দুনিয়ার সবচেয়ে ইনোসেন্ট ছেলেটা সে। আর বলত,’বিয়ে-শাদী আমার দ্বারা হবে না বুঝলি? আমি হব সন্ন্যাসী।’ আর এখন দেখেন, প্রেম তো ছিলই এমনকি বিয়ে বাড়ি থেকে আপনাকে তুলেও আনল।’
শ্রুতি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। মনে মনে বলে,’বইন রে, পেটে পেটে শয়তানি তো তোদের ভাইয়ের না। আমার!’
মেয়েটি বলল,’আচ্ছা এসব কথা বাদ দেন। আপনাদের সম্পর্ক হলো কীভাবে?’
‘কফি…কফিশপে। বিল দিতে গিয়ে। মানে ওয়েটার ভুল করে তার বিলের লিস্ট আমায় দিয়েছিল আর আমারটা তাকে।’
‘তারপর?’
শ্রুতি দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে,’বেয়াদব মেয়ে! তারপর আবার কী? তোর জন্য কি এখন আমার মিথ্যে গল্প বলার ঝুলি নিয়ে বসেছি? তুই বলবি তারপর, আর আমি একটা করে মিথ্যা গল্প বলব। তুই আবারও বলবি তারপর, আমিও আবার আরেকটা মিথ্যা গল্প বলব। চুপ কর। নয়তো এখনই থাপ্রে দাঁত ফেলে দেবো বলে দিলাম।’
কিন্তু শ্রুতির আফসোস হচ্ছে কথাগুলো সরাসরি বলতে না পারায়। মিথ্যে বলতেও মন সায় দিচ্ছে না। কেননা মিথ্যে বললেই তো সে তুতলে যায়। আর যদি একবার ধরা খায় তবে? মেয়েটি এখনও তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শ্রুতির কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা গোয়েন্দাগিরি করছে।
‘নাম কী আপনার?’ প্রসঙ্গ পাল্টাতে প্রশ্ন করল শ্রুতি। কিন্তু মেয়েটাও যেন নাছোড়বান্দা। বলল,’সামিনা। আমায় আপনি করে বলার দরকার নেই। তুমিই বলতে পারেন। বললেন না তো, তারপর কী হলো?’
শ্রুতি মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নিয়ে বলল,’অনেক লম্বা কাহিনী। একদিন সময় নিয়ে বলব।’
‘সংক্ষেপেই বলেন তাহলে।’
‘হতচ্ছাড়ি! এত জেনে তোর লাভ কী?’ এবারও সে মনে মনে কথাগুলো বলে নিজেকে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করছিল। মুখে বলল,’তারপর ওয়েটারকে বিষয়টা জানালাম। ওয়েটার স্যরি বলল। তখন অরিত্রর সাথে টুকটাক কথা হয়। এরপর একদিন হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায়। এরপর ফেসবুক আইডি, নাম্বার আদান-প্রদান হলো। তারপর প্রেম আর তারপর বিয়ে।’ শ্রুতি এই মিথ্যা কথাগুলো বলতে একবারও আটকে যায়নি। কারণ এই পুরো ঘটনাটাই হচ্ছে রুমকির প্রেম-কাহিনী। যার দরুণ মুখস্থ বিদ্যার মতো ঝড়ঝর করে বলে ফেলে। সামিনাও যেন এক কাঠি এগিয়ে। সে জিজ্ঞেস করল,’তাহলে পালালেন কেন আপনারা?’
‘বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি তাই।’
এবার সামিনা চুপ হয়ে গেল। তার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়। শ্রুতির গড়গড় করা মিথ্যাগুলি শুনে সে অরিত্র এবং শ্রুতির সম্পর্কের কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
অরিত্র তখন অনিককে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। সামিনার চোখে-মুখে রাগ স্পষ্ট। মূলত সামিনা আপন কাজিন নয় অরিত্রর। সামিনার মা এবং অরিত্রর মা কলেজ জীবনের বান্ধবী ছিল। একদম বোনের মতো। সেই সূত্রেই ওরা কাজিন। সামিনা পিঞ্চ মেরে বলল,’বাব্বাহ্! বউকে দেখি এখন চোখের আড়ালও করতে চাও না।’
এরপর শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলল,’জানেন ভাবি, আপনাদের বিয়ের আগে অরিত্র ভাইয়া কিন্তু আমায় বউ ডাকত। সবাই জানত আমরা জামাই-বউ।’
শ্রুতি বাঁকা হেসে বলল,’ছোটোবেলায় ওরকম জামাই-বউ সবাই-ই খেলে।’
‘মোটেও নয়। কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমাদের মাঝে এমন সম্পর্ক ছিল।’
‘তাহলে জেনে নাও, এখন থেকে তোমাদের ডিভোর্স। সে এখন আমার। কুনজর, বদনজর কোনো নজরই দিও না।’ কথাগুলো হাস্যরসাত্মকভাবে বললেও খানিকটা পিঞ্চ মেরেই বলল শ্রুতি। যেমনটা সামিনা পিঞ্চ মেরেছিল। শ্রুতির এমন কথায় সামিনার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যায় আরও। অরিত্র শ্রুতির কথাবার্তা শুনে মনে মনে বলে,’নাটক!’
সামিনা বাকিদের নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। শ্রুতি এবার চোখমুখ পাকিয়ে বলে,’ব্যাপার কী?’
‘ব্যাপার আবার কী হবে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল অরিত্র।
‘এই মেয়েটার ভাব-গতি তো আমার ঠিক মনে হলো না।’
‘পছন্দ করে আমায়।’
‘শুধু পছন্দ?’
‘কী জানি! ভালোটালো বাসতো নাকি জানিনা।’
‘আপনি বউ কেন ডাকতেন?’
‘মজা করতাম। শুধু ও নয়, আরও অনেকেই আছে।’
‘ঢং দেখলে বাঁচি না! সন্ন্যাসী হওয়ার স্বপ্ন দেখে আবার তার নাকি বউয়ের অভাব নেই।’
‘আজব! সত্যি সত্যি বউ ছিল নাকি? কিন্তু আপনি তো একদম বিনা সার্টিফিকেটে গলায় ঝুলে পড়েছেন।’
‘গলায় ঝুলে পড়ব কেন? আমি তো মুক্তোর মালা নই।’
অরিত্র দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বানর?’
‘উমম! ছোটোবেলায় এমনই তো একটা প্রবাদ শুনতাম,’বানরের গলায় মুক্তোর মালা। আমি যদি মুক্তোর মালা না হই, তবে আপনিও বানর নন। টেনশন নিয়েন না।’
‘আপনাকে কী সহজ-সরলটাই না ভেবেছিলাম আমি! এখন দেখছি ঠিক তার উল্টো।’
‘আপনি কী ভেবে নিয়েছিলেন আমি তো আর সেটা জানিনা।’
‘জানার দরকারও নাই। আমায় জাস্ট এটা বলেন, আপনি সবাইকে এসব মিথ্যে কেন বলেছেন?’
শ্রুতি আশেপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বলল,’আমার থাকার জায়গার প্রয়োজন ছিল। আর এরকম সেফ জায়গা আমি আর পাব নাকি জানা নেই। তাই এই নাটকটা আমায় করতে হয়েছিল।’
‘আশ্চর্য! এজন্য আপনি এত বড়ো মিথ্যে কথা বলবেন? আমার পরিবারের ইমোশোন নিয়ে তো আমি আপনাকে খেলতে দেবো না। এলাকায় আমাদের একটা সম্মান আছে। আপনার খাম-খেয়ালির জন্য সেটাও আমি নষ্ট হতে দেবো না। এখনই আপনি সবার সামনে সত্যিটা স্বীকার করবেন।’
‘আপনি আমার কথাটা শুনুন।’
‘কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না। আসুন আমার সাথে।’
শ্রুতির অপেক্ষা না করে অরিত্র নিজেই শ্রুতির হাত টেনে বাইরে নিয়ে যায়। শ্রুতি জানে, অরিত্রর সাহায্য ব্যতীত এই নাটক এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু সেখানে যদি অরিত্রই সত্যিটা বলার জন্য ফোর্স করে তাহলে শ্রুতির আর কোনো উপায় নেই। কারণ বিয়ের কোনো ডকুমেন্টস তার কাছে নেই। যেখানে বিয়েটাই হয়নি সেখানে ডকুমেন্টস আসবে কোথা থেকে?
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। পর্ব ছোটো হয়েছে জানি। অ্যাসাইনমেন্টের যন্ত্রণায় জীবন শেষ। কলেজ খুললে ভেবেছিলাম অ্যাসাইনমেন্ট হবে না। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট তো এসে হাজির। ১২ তারিখ যদি সত্যিই কলেজ খোলে, তাহলে কী হবে সেটাও বলা যাচ্ছে না। তাহলে পরীক্ষা না হওয়া অব্দি লম্বা বিরতিও নিতে হতে পারে।?]