দেবী পর্ব ৫১

0
539

#দেবী
লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি (ছদ্মনাম)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৫১ঃ

দুলাল সিরাজীর মৃত্যুর খবর শুনে আশেপাশের গ্রাম গঞ্জের সকল মানুষের ভীড় জমেছে সিরাজী মঞ্জিলের বাইরে। রুহুলের আদেশ মতো সিরাজী মঞ্জিলের গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।কেবল কিছু নিকট মানুষ আছে মাঠে তবে অন্দরমহলে ঢুকতে দেওয়া হয় নি।আর সেই সাথে অন্দরমহলের দরজার কাছেও কড়া নিরাপত্তা। সকলের চোখে পানি। নারী পুরুষ সকলেই কেদে গা ভাসাচ্ছে। যখন থেকে শুনেছে রুহুলের স্ত্রী খুন করেছে তখন সকলেই অবাকের সাথে ক্ষীপ্ত ও হয়েছে। আজ যদি দেবী কে তারা হাতের কাছে পায় দেবীর হাড় ও খুজে পাওয়া যাবে না কিনা সন্দেহ।

পিছন গেইট দিয়ে সাজু বের হলো। ওর এখনো কিছু লোক দরকার নিরাপত্তার জন্য। সাজুকে দেখেই কেউ একজন সাজুর সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। হাত জোর করে বললো,”আমারে কাকনের সাথে একবার দেখা করবার দেন।”

সাজু অবাক কারণ রিতা ওর সামনে। সাজু ওকে বললো, “ওঠো, এইভাবে হাত জোর করতাছো কেন?”
–“ফাতিমা আপা কাকনের কথা শুইনা অসুস্থ হইয়া গেছে।আমরা জানি কাকন এই কাম করতেই পারেনা।”
–“হেতি তো কাকন না, হে অন্যকেউ।”
–“না,মিছা কথা। আমাগো কাকন তো রক্ত দেইখাই ভয় পায়। ওর মত সরল মাইয়া এই কাম করতেই পারেনা।
আমরা জানি আপনেরা ওরে ফাসাইতাছেন। আমারে একবার ওর লগে দেখা করবার দেন। হাত জোর কইরা কই। আমি জানি ও খুব ভয় পাইতাছে। ”

–“না ভয় পাইতাছে না। আসলে আমরা যার দ্বারা কোনো কিছু কল্পনা করা তো দূর আন্দাজ ও করি না তারাই সেই সকল কাম অনায়েসে করে। ভাবিমা ও
ঠিক তেমনি একজন। ”
–“আমি বিশ্বাস করি না।আপনেরা মিছা কথা কইতাছেন। কাকন নাকি হিন্দু এগুলা ছড়াইয়া কি লাভ হইতাছে কন। আমারে দেখা করবার দেন। ”

রিতা সাজুর দুপা আকড়ে ধরে মিনতি করলো। সাজু রিতাকে ছাড়িয়ে দু কাধে হাত রেখে বললো, “আমার সাধ্য হইলে অবশ্যই তোমায় নিয়া যাইতাম কিন্তু রুহুল সাব এর নিষেধ অমান্য করার সাহস আমার নাই। তুমি মহিলাশালায় চইলা যাও।”

রিতা সাজুর হাত ঝারি দিয়ে কাদতে কাদতে বললো, “আমারে আইজ ফিরায়া দিলেন আমিও একদিন আপনেরে ফিরাইয়া দিমু দেইখেন।কাকনের লগে দেখা করতে দিলেন না।আপনেরা সব খারাপ। ”
রিতা কাদতে কাদতে হাটা ধরলো। সাজু রিতার যাওয়ার পানে চেয়ে বললো, “ফিরাইয়া দিও না আমারে।দেবী যেমনে সিরাজী সাব রে খু’ন করছে তুমিও সেইরকম ভালোবাসায় খু’ন কইরো রিতা।”
____________________

রুহুল সিরাজী মঞ্জিল থেকে বেরোবে।তবে কানে আসছে স্বজনদের কান্না। আজ রুহুলের ও কষ্ট হচ্ছে একসাথে নিজের রক্তের পুরুষদের জন আর নিজের স্ত্রীর জন্য। একসাথে দুই কষ্ট রুহুলের হৃদয়ে কষ্টের পাহাড় তুলে দিয়েছে। রুহুল কে দেখেই দাদিমা এগিয়ে গেলো রুহুলের দিকে। জড়িয়ে ধরে কাদলো।বললো, “মানিক, মানিক রে ছাড়িস না এই হিন্দু বেজাত মা*রে তুই ছাড়বি না। আমার সুখের সংসার ধ্বংস করছে ওই মা*।ওরে সাজা দিবি তুই মানিক। ”

রুহুল দাদিমার মাথায় হাত রেখে বললো, “যে যা করেছে প্রত্যেকে তার সাজা পাবে দাদিমা।পাপের হাড়ি যখন ভড়ে যায় শাস্তি তখন উগরে পড়ে।দাদাজান তার পাপের সাজা পেয়েছে। আর যারা বাকি আছে তারাও তাদের পাপের সাজা পাবে।”

–“তুই এখুজন তর বউ এর পক্ষ নিতাছা। কেমন মদ্দা তুই যে নিজের বউ এর পক্ষ নেস। ওরে সাজা দিবি। অন্দরমহলের দরজা খুইলা দিয়ে পুলিশ আনতে দে।”

–“সব খুলে দেওয়া হবে দাদিমা। মৃত্যুর দরজা খুলে গেছে, আজ দুনিয়ার কোনো দরজার ক্ষমতা নেই সেই দরজা আটকিয়ে রাখার। কান্না থামান ওযু করে নামাজ পড়ে দুয়া করুন।”

তারপর দাদিমা কে টুলে বসিয়ে দিলো। রানু কে ডেকে বললো,”রানু, রানু, দাদিমা কে নিয়ে যা। আর চাচি আম্মা কেও দেখে রাখিস”
–“আইচ্ছা দাদাভাই। ”
–” আমি চললাম দাদিমা, জানাজায় যাবো।”
_____________________

জোহর বাদে জানাযা পড়ানো হলো। সিরাজপুরে এত বড় জানাজা বোধহয় আজ অব্দি কেউ দেখে নি। কতশত মানুষ গননা করা অসম্ভব। সিরাজপুরের মসজিদে জানাজা পড়ানো হলো। মসজিদের বাইরেও ছালা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে তবুও যেন জায়গার সংকট। রুহুল তার দাদাজানের লাশ কাধে নিয়ে কবরস্থানে গেল। মনে পড়লো, “ছোট বেলায় দুলাল সিরাজী ঘোড়া হয়ে রুহুল কে কাধে চড়াতো। এমনকি কাধে নিয়ে সিরাজপুরের মসজিদে ও যেতো। অথচ আজ দাদাজান এর লাশ তার ই কাধে। আবার জামাল ও কম ভালো বাসতো না। মহীবুল হওয়ার আগ অব্দি রুহুল ই জামালের প্রিয় ছিল। হাটা শেখানো, কোলে নিয়ে ঘোরাঘুরি প্রভৃতি করেছে। অথচ সময়ের ব্যবধানে তারাই রুহুলের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। রুহুল কে কেবল ব্যবহার করে গেছে। আর তার শাস্তি স্বরুপ রুহুলের স্ত্রীর হাতে খুন হতে হলো তাদের। ভাগ্য কতটা নির্মম। রুহুল ধিক্কার জানায় নিজের পুর্বপুরুষের গড়া নীতি কে। যেখানে মানুষের চেয়ে বেশি মানসম্মান কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেখানে মানুষকে মানুষকে মনে করে না। যেখানে ধর্মের অপব্যবহার করা হয়।

আসরের আগেই লাশ দাফন করা হলো। রুহুলের হৃদয়ে চিড়ে কান্না আসছে তাদের রেখে যেতে। বাবার পরে তার দাদাজান ছিল অথচ আজ আর নেই। রুহুল শেষ বারের মত মুখটি চেয়ে চেয়ে দেখলো। তারপর মাটি দেওয়া হলো। আকাশের অবস্থা ভালো না। বোধহয় ঝড় হবে তবে নিশ্চিত রুহুলের হৃদয়ের ঝড়ের সমতুল্য আজ কোনো ঝড় হতে পারবে না।

কবরস্থান থেকে সিরাজী মঞ্জিলের পথে হাটা ধরলো রুহুল। সাজু রুহুলের কাছে এসে বললো, ” খবর পাইলাম মহিলা পুরুষ উভয় অন্দরমহলে ঢুকার জন্য উত্তেজিত হইয়া গেছে। ভাবিমা খুন করছে এইডা শুইনা আরো বেশি ক্ষেইপা রইছে। হয়তো পুলিশের কানেও গেছে। পুলিশ রে থামাইতে পারলেও বিক্ষিপ্ত মানুষ
গো কেমনে থামাইবেন?

রুহুল মাথার টুপি খুলে পকেটে ভড়লো। বললো,
” অন্দরমহলের দরজা শক্ত করে আটকানোই থাকবে। কেউ যেন আজ ঢুকতে না পারে। আবহাওয়া ভালোনা বোধহয় ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে।তারাএকাই চলে যাবে।”

–“আপনে বুঝতাছেন না তারা যাইবো না। তাগো একখান ই কথা হিন্দু মা*রে জন্তুর খাওয়া বানামু। নিজ হাতে খুন করমু। আর তাছাড়াও বাপ-মাও, জাত তুইলা নানা গালিগালাজ করতাছে।”
–” যার যা খুশি বলুক। সবাই সবার দিক দিয়ে ঠিক। ”

রুহুলের সাথে সাজু হাটা ধরলো। বললো, “এখুন কি ভাবিমার কাছে যাইবেন।”
–“হুম যেতে তো হবেই। তার মাকে দেওয়া শেষ ইচ্ছে তাকে পুরণ করতে হবে। আমি তাই নিজে সাহায্য করতে চাই তাকে।”
–“আরেকবার ভাইবা নেন। উনি যদি সত্যিই খুন করে?”
–“তাকে ভালোবেসে তো বহুদিন আগেই খুন হয়েছি এবার নাহয় দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে আরেকবার খুন হলাম।”
–“জগতে বহু প্রেমিক দেখছি কিন্তু আপনের মতো এমন প্রেমিক জীবনে দেখি নাই।”
–“আমি তো প্রেমিক নই, আমি হলাম একজন পুরুষ যে তার স্ত্রীকে মহাকাশ সমান ভালোবেসেও ব্যার্থ।”
–“আপনে ব্যার্থ না আপনেই স্বার্থক।”
–“যার ভালোবাসায় সার্থকতা নেই সে কখনো সার্থক হতে পারে না সাজু।গুড়ি হুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে কবর এর উপর কাগজ দিয়ে দে মাটি যেন ধুয়ে না যায়।আর পুলিশের ব্যবস্থা কর যেন কেউ মঞ্জিলে না যায় ।”
______________________

প্রকৃতি তে ঝড় হবে বোধহয়। কেমন শীতল পরিবেশ। সবে আসর শেষ হলো।কিন্তু যেমন অন্ধকারে ছেয়ে আছে যেন সূর্য ডুবেছে বহুক্ষণ। রুহুল নিজেও সিরাজী মঞ্জিলের পিছন গেইট দিয়ে অন্দরমহলে ঢুকেছে। সামনে সকলের ভিড়।তাদের সামনে দরজা খোলা এখন বিপদ। সিরাজী মঞ্জিলে ঢোকার পর রুহুল কারো সাথেই কথা বলে নি। সরাসরি নিজের কক্ষে চলে গেলো। রুহুল কক্ষে যেয়ে অবাক হলো।পুরো ঘর অন্ধকারে ছেয়ে আছে। দরজা জানালা সব বন্ধ।

হঠাৎ করেই হারিকেন জ্বলে উঠলো। রুহুল মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো সেদিকে। হারিকেন এর আলোর চেয়েও বেশি মুগ্ধতা দেবীর চোখে মুখে।পড়নে লাল পাড় এর সাদা শাড়ি। কোমড় অব্দি চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।কানের পিঠে শুকনো রক্তজবা ফুল। সিথির মাঝবরাবর রুহুলের দেওয়া সেই টিকলি। অদ্ভুত রূপবতী দেবীকে আজ দেখছে রুহুল।

দেবী হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো রুহুলের দিকে। তারপর সালাম করলো রুহুলের পায়ে। রুহুল যেন বাকশক্তি হারয়ে ফেলেছে।নিরব পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো।কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না। দেবী এবার রুহুলের বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুহুল কে। রুহুলের হৃদগতি যেন আরো বেড়ে গেলো মুহুর্তেই। রুহুল দেবীকে জড়িয়ে ধরার আগেই দেবী বললো, “জান্নাতের সুখ কেমন তা আমার জানা নেই, তবে আপনার বুকে আমি সত্যিই জান্নাতের শ্রেষ্ঠ সুখ অনুভব করি সিরাজী সাহেব। ”

রুহুলের দুচোখ ছলছল করছে। দেবীর দুচোখ এ বোধহয় খুব শীঘ্রই সমুদ্রের সাথে বন্ধুত্ব হবে। দেবীর পরনে শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, টিকলী সবকিছু দেখে রুহুল শক্ত হাতে দেবীকে জড়িয়ে ধরলো।রুহুল বললো, “কেন,আজ ই কেন পড়তে হলো, আজ ই কেন এই রুপে আসতে হলো। আর কত সাজা দিতে চান। বলেছিলাম তো আসর পর আমায় হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়ে নেবেন।আমার জীবনের শেষ সময়ে এমন রুপ না দেখালেও পারতেন। আপনাকে এমন রুপে দেখে যে মরতে খুব কষ্ট হবে আমার।”

–“উহু, ভয় নেই আপনার ভালোবাসাই জিতে যাবে। কেননা আমার ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।”

রুহুল দেবীকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি তো বিশ্বাস ঘাতক নই। তাহলে কেন আমার সাথেই বিশ্বাস ঘাতকতা করতে চান বিবিজান?”

–” আমি তো বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি। আমি আমার বাবার সাথে করা অন্যায় কারীদের কেবল শাস্তি দিতে চেয়েছি।আমি যে আমার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

রুহুল দেবীকে ছেড়ে দিলো।উচ্চস্বরে বললো,”তাহলে পুরণ করুন সেই প্রতিজ্ঞা, সেই দেওয়া কথা।”

দেবী রুহুলের হাতে চুমু দিয়ে বললো,” মানুষকে যখন আমরা কোনো কথা দেই তখন সেই কথা রক্ষা করা নিজের জান রক্ষার চেয়ে ও বেশি জরুরি।আমি আমার মায়ের রক্তাক্ত শরীর ছুয়ে কথা দিয়েছিলাম অপরাধী দের শাস্তি দেবো। কিন্তু তখন যদি জানতাম এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যাকে ভালোবাসবো সে ই আমার বাবার হত্যাকারী হবে তাহলে বোধহয় আমি সেই কথা দিতাম না। ”
রুহুল অবাক হয়ে দেবীর দিকে তাকালো বললো, “আবার বলুন কি বললেন। এই পৃথিবীতে আপনি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?”
–“আমার প্রথম ভালোবাসার পুরুষ বাবা ছিল আর শেষ ভালোবাসা আপনি। আপনাকে খুন করা মানে নিজের ভালোবাসা, নিজের সুখ কে হত্যা করা।আমি পারবো না আপনাকে হত্যা করতে।”

রুহুলে দেবীর দুগালে হাত রেখে বললো,”তাহলে কি মেনে নিতে পারবেন আমায়। সংসার করতে পারবেন নিজের বাবার হত্যাকারীর সাথে?”
–“না!”
–“তাহলে কেন এগুলো বলছেন? ”
–“আগে আমার কথা শুনুন।আমি আমার ভালোবাসার কাছে লজ্জিত তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম।আমি এই বিস্তর পৃথিবীতে যাকে নিস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছি তার নাম রুহুল সিরাজী। হ্যা এটা ঠিক আমি হত্যার উদ্দেশ্য এই মঞ্জিলে পা রেখে ছিলাম কিন্তু আমার ভালবাসায় কোনো প্রতারণা ছিল না। যারা বেশি ভালোবাসে তাদের ভালোবাসার প্রকাশ কম এই কথাটি আমি নিজের দ্বারা বিশ্বাস করি। ”

রুহুল উৎসুকভাবে বললো,”ভালবাসেন আমায়? একবার শুধু আপনার মুখে ভালোবাসি শুনতে চাই বিশ্বাস করুন দুনিয়ার সকল ধারালো অস্ত্রেও মাথা ঢেকাতেও রাজি আছি। বলুন না ভালোবাসি?”

–“আমি আপনাকে, আপনাকে এতটা ভালোবাসি যতটা এই মহাজগৎ এর বিশালতা নয়। এই পৃথিবীর বুকে আজ অব্দি যত ফোটা বৃষ্টি নামে নি তার চেয়ে ও বেশি বর্ষণমুখর আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা।আপনার ভালোবাসা আপনি সয়ং আপনার মুখে প্রকাশ করেছেন কিন্তু আমি আপনাকে এতটা ভালোবাসি যে সত্যিই আজ তা মুখে প্রকাশ করতে পারছি না।”

দেবী ঢোক গিললো। রুহুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “আজ মুখে বলতে শরীর কাপছে।আমার শেষ রক্ত দিয়েও যদি আপনার নাম লিখে দি তবুও মনে হবে আমার ভালোবাসা আপনার ভালোবাসার কাছে কম। আমার ভালোবাসাকে আপনার ভালোবাসার কাছে হারতে দেই কি করে। আমি আপনাকে, আপনাকে সকল প্রতিশোধ, ঘৃণার উর্ধে একজন স্বামী হিসেবে ভালোবাসি। একজন সুপুরুষ হিসেবে ভালোবাসি। আপনার ভালোবাসার প্রেমে পড়ে, আপনার ভালোবাসাকে ভালোবেসে আমি আপনাকে আমার হৃদয়জুড়ে ভালোবাসি। আমি আপনাকে সাত আসমানের ওই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে, দুনিয়ার সকল পাপাচার কে ঘৃণা করে, আমাদের পবিত্র বন্ধনের বিরোধিতার কসম করে বলছি ভালোবাসি।”

দেবীর সুমধুর কন্ঠে ভালোবাসার আকুতি শুনে রুহুল বিমোহিত। বহু প্রতিক্ষার পর আজ প্রথম দেবীর মুখে ভালবাসি শুনেছে। রুহুল এখন মরলেও তার কোনো আফসোস নেই কেননা তার বিবিজান আজ তাকে ভালোবাসি বলেছে।

মুহুর্তেই দেবী উটকি দিলো। মুখ দিয়ে পড়লো লাল ঘন তরল। রুহুল চিৎকার করে আকড়ে ধরলো দেবীকে। বললো,”বিবজান, এই বিবিজান মু..মুখে কি এগুলো, র,,রক্ত, আপনার মুখে রক্ত কেন?বিবিজান! ”

দেবী রুহুলের পাঞ্জাবীর কলার ধরে রুহুলের হৃদবক্ষ বরাবর মাথা রাখলো। বললো, আমার প্রতিশোধকে আমি আপনার পবিত্র ভালোবাসার কাছে হারতে দেবো না।”
–“রক্ত কেন বেরোচ্ছ্র?”
–“চুপ, আমার আরো কিছু কথা আছে।যেগুলো আপনাকে শুনতে হবে। আমার মনে হচ্ছে আজ কম হয়ে যাবে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।আমি আপনাকে এত ভালোবাসি যে দুনিয়ায় প্রথম কারো অভিমান করা মুখ আমার হৃদয় পুরিয়ে ছাড়খাড় করে দিয়েছে বারংবার। প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহুর্ত কেবল একটা ভাবনাই ভেবে গেছি যে যদি আপনি জেনে যান আমিই সেই খুনি তখন আপনার বুকের সমস্ত ভালোবাসা,সুখ হারিয়ে ফেলবো আমি। এজন্য ভেবেছিলাম আপনাকে বলবো আমায় হত্যা করে প্রতিশোধ নিন। কিন্তু আপনিই যে সেই হত্যাকারী জানা ছিল না।সত্যিই আমার বাবার হত্যাকারীর সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।কেননা প্রতি মুহুর্তে মনে হবে আপনিই সে, আপনইই সে বংশের যাদের জন্য আমি এতিম হয়েছি। নিজের হাজারো সুখ-স্বপ্ন হারিয়েছি। আমায় ক্ষমা করে দেবেন।তাই না আমি আপনকে নিয়ে বাঁচতে পারবো , আর না আপনাকে শাস্তি দিতে পারবো।”

রুহুল দেবীকে বুকের ভেতর শক্ত করে ধরে বললো, “না কিচ্ছু হবে না আপনার। আপনার কোনো দোষ নেই। দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষকে হত্যা করলেও আমি মানবো আমি নিষ্পাপ। যে অকারণে কারো ক্ষতি করবে না। আপনার মাঝে আমি দুনিয়ার সকল পবিত্রতা খুজে পেয়েছি। আপনি কখনোই পাপি নন। আপনি সারা জীবন আমার কাছে থাকবেন।আপনার কিচ্ছু হবে না।
আপনি কথা বলুন, চোখ খুলুন। ”

রুহুল উচ্চস্বরে সাজুকে ডাকলো।দেবীকে পাজাকোলে তুলতে চাইলে দেবী মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।রুহুল দেবীকে তুলতে চাইলে দেবী বাধা দিলো। দেবী রুহুলের মুখে হাত দিয়ে বললো, “হুশ চুপ কোনো কথা নয়। আমার সময় এই পৃথিবী হতে শেষ। আমি পৃথিবীর বুকে হাজার বছর বাচতে চেয়েছিলাম। ছোট থেকে হাজারো স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু এই পৃথিবী আমায় বাচতে দিলো না, পুরণ করতে দিলো না সেই সকল স্বপ্ন। তাই আমিও আর বাচতে চাই না এই পৃথিবীতে ।”

–“আপনাকে ছাড়া আমি কি করে বাচবো বিবিজান। এই পৃথিবীতে কেবল আপনাকে ভালোবাসার বিনিময়েই ভালোবাসা পেয়েছি।অন্যকেউ তো বাসেনি। আপনি মরে গেলে আপনার রুহের সাথে আমার রুহ টাও নিয়ে যাবেন। তাহলে আমি বাচবো কি করে?”

–“আর আপনাকে হত্যা করে নিজে কি নিয়ে বাঁচতাম বলুন। নিজের ভালোবাসাকে ঘৃণা,প্রতিশোধ এর কাছে খুন হতে দেবো এমন ভালো আমি বাসিনি।”
–“আপনকে ছাড়া কেবল আমার দেহ দুনিয়ায় থাকবে। রুহ তো আপনার সাথেই চলে যাবে।”
–“উহু আপনাকে বাঁচতে হবে। সেদিন রাতের আমায় দেওয়া কথা গুলো আপনার রাখতে হবে। সিরাজপুরের দায়িত্ব আপনার।সকলকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার ।আপনি কিন্তু আমার বলা সকল কথা রাখবেন।”

–“আমায় ছাড়ুন। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আপনার কিছু হতে পারে না।আপনাকে বাচতে হবে বিবিজান। আমার পা ছাড়ুন। ”

–“হাসপাতালে নিলেও আমি বাঁচবো না। আমি জেহের পান করেছি। ভয়াবহ জেহের যা আমি নিজের বাবার হত্যাকারীর জন্য নিয়ে এসেছিলাম দুলাল সিরাজীর সম্মুখে। কিন্তু আপনাকে হত্যা করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিজের জীবন নিজেই দিয়ে দিলাম।”

রুহুল নিজের কোলে দেবীর মাথা রেখে বললো, “নিজের জীবন নিজে দিয়ে নিজে নয় আমায় খু’ন করলেন। আমায় হত্যা করলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না যতটা আপনার এই রক্তমাখা মুখ থেকে বুক অব্দি রক্ত দেখে হচ্ছে। আমাকে বাচিঁয়ে না রেখে খুন করলেই পারতেন। ”

দেবী রুহুলের বুকে মাথা রেখে বললো, একটা শেষ অনুরোধ রাখবেন আমার? ”
–“হুম! ”
–“আমায় দয়া করে আমার বাব-মা আর বাকিদের মতো ওই অন্ধকার কক্ষে রাখবেন না। কোনো খোলা সাদা-নীল আকাশের নিচে দাফন করবেন। যেন আমি মন চাইলেই খোলা আকাশ টা দেখতে পারি। ঝাকে ঝাকে যখন পাখি উড়ে যাবে তখন মনে করবেন আমি আপনাকে মনে করছি। হাজারো ফুলে ঘুরতে থাকা প্রজাপতি রা যখন আপনাকে স্পর্শ করবে মনে করবেন আমার মনে আপনাকে ছোয়ার একটু বাসনা জেগেছে। যখন অনেক বৃষ্টি হবে ওই খোলা বাড়ান্দায় আমাদের প্রথম মিলনের রাতের কথা মনে করবেন।যেরাতে দুজন দুজনার হয়ে ছিলাম। আমার কথা মনে পড়লে ওই খোলা বাড়ান্দায় দাড়িয়ে আমার কথা স্মরণ করবেন। আমি বৃষ্টির ফোটা রুপে আপনার সঙ্গে মিশে থাকবো। বাতাসে যখন বাগানের ওই রক্তজবা ফুলের সুভাস বেরোবে মনে করবেন আমার ঘ্রাণ দিয়ে আপনার মনকে সতেজ করতে এসেছি। আকাশের ওই পূর্নিমার চাদের আলো যখন দেখবেন মনে করবেন সেদিন আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে। আর আকাশের ওই কালো মেঘ যখন ডাকবে বুঝবেন খুব করে অভিমান করেছি আপনার সাথে। আপনি কিন্তু আমার রাগ ভাঙাতে যাবেন।মনে রাখবেন তো আমায়? ”

–“না এগুলো কিছুই হবে না। আপনি মরতে পারেন না। আপনি বাচবেন। হাজার বছর বাচবেন।”

–“আমি আপনার বুকে মাথা রেখে হাজার বছর বাচতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিয়তি আমায় আপনার বুকে ঠাই দিল না। ”

দেবীর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ দিয়ে নাক দিয়ে রক্ত আসছে। দেবী ঢোক গিলে আবারো বললো, “শুনুন না, আমার ডান পাশে আরেকটা কবর খোদাই এর জন্য জায়গা রাখবেন।যেখানে আপনার মৃত্যুর পর আপনাকে দাফন করা হবে।আমি সারাজীবন বাবা-মার সাথে স্বর্গে বাস করার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু জীবনের শেষ সময় এসে আপনার সাথে জান্নাতে বসবাসের ইচ্ছে জেগেছে।আল্লাহ যদি আমায় জান্নাত দান করেন মনে রাখবেন, আমরা জান্নাতেও একসাথে হাটবো। একসাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দেবো। তবে হ্যা সত্তর টি হুরকে আপনার কাছেও আমি ঘেঁষতে দেবো না। একা লড়ে যাবো ওই হুরদের সাথে। এই পৃথিবীতেও আপনার বুক ভড়া জান্নাতের সুখ আমার। মৃত্যুর পরেও আপনার বুকের জান্নাতের সুখ কেবল আমার। ”

–“আমি নিজেই তো আপনার, সেখানে অন্যকেউ কি করে আপনার থেকে আমাকে নেবে,কেউ নেবে না। ”

–“সে আমি জানি না। কিন্তু আমি আল্লাহকে বলেছি যদি আমায় জান্নাতে নেয় তবে যেন আপনার বুকে ওই হুরদের না রাখে। আপনি আর আপনার এই বুক ভরা সুখ,ভালোবাসা শুধুই আমার।”

দেবী বারবার ঢোক গিলছে। রুহুল কাদছে। দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। দেবী রুহুলের বাম গালে হাত রেখে বুকে চুমু খেলো। মিথ্যে হাসি হেসে বললো, “একবার বলুন না ভালোবাসেন আমায়। অনেকদিন হলো আপনার মুখে ভালোবাসি বিবিজান শুনি না।আপনি আজ প্রথম আমায় দেবী নামে ডেকেছেন। কিন্তু জানেন এই নাম শোনার পর থেকেই আমার হৃদয় বার বার ব্যাথিত হচ্ছে। বিবিজান ব্যতীত অন্য নামে আর কোনোদিন ডাকবেন না আমায়। আমি কিন্তু রাগ করবো, আসবো না আর আপনার কাছে। আপনার মুখে বিবিজান ব্যাতিত অন্য কোনো ডাক আমায় শ্বাস আটকে দেয়।একবার আপনার বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকভরা আদর দিয়ে ডাকুন না বিবিজান বলে! ”

রুহুল দেবীকে শক্ত করে আকড়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে কাদতে বললো, ” ভালোবাসি বিবিজান। ভীষণ ভালোবাসি। পুরো জগৎ এর সকল সৃষ্টির মাঝে ভালোবাসা নামক অসুখ নিকৃষ্ট । সেই নিকৃষ্ট সৃষ্টি আমার মনে কেবল আমার দেখা সেরা সৃষ্টি আপনার জন্য। আমি ভীষণ ভালোবাসি, আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি বিবিজান ভীষণ ভালোবাসি। ”

দেবী রুহুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু হাতটা মাটিতে পড়ে গেলো। খুব নিরবেই চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেলো দেবীর। নিমিষেই ডান চোখ বেয়ে একফোঁটা নোনাজল প্রশ্রবণ হল দেবীর। চোখ গুলো ঠিক চেয়ে আছে উপর দিকে যেন এখন রুহুল কে দেখছে। ভালোবাসার মানুষকে দেখার ক্ষুধা মেটাচ্ছে দুচোখে।

রুহুল দেবী কে ডাকছে,”বিবিজান, বিবিজান,
ক..কথা বলুন।”
রুহুল চিৎকার করে ডাকলো, “বিবিজান!”
কিন্তু দেবী আর চোখ খুললো না। হারিয়ে গেছে সে পৃথিবীর বুকে হতে নিমিষেই, দুনিয়ার সকল মায়া-মহব্বত ত্যাগ করে। এই পৃথিবীতে রুহুলের হৃদয়ের সকল ভালোবাসাকে এক নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে রেখে বিদায় নেয় ‘দেবী’।

চলবে….

#দেবী
#Srotoswini_স্রোতস্বীনি

বিদ্রঃ দয়া করে কেউ কপি করবেন না। ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট শেয়ার করে পাশে থাকবেন। আমি প্রথম পর্বেই লিখেছিলাম রুহুলের বিরহের কথা। তাই হ্যাপি এন্ডিং দেওয়া অসম্ভব। কাউকে না কেউকে মরতেই হতো। ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে রাখবেন।ধন্যবাদ।

©️ Srotoswini-স্রোতস্বীনি ✍️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here