#দেবী
লেখিকাঃ #Srotoswini_স্রোতস্বীনি (ছদ্মনাম)
কপি করা সম্পুর্ণ নিষেধ।
৪৮ঃ
ভয়াবহ জন্তুতে ভড়া জঙ্গলে অন্ধকারে ঝোপঝাড় এর আড়ালে হাটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে দেবী। সারা শরীর কাপছে। সেই সাথে কাপছে হৃদপিণ্ড। অন্ধকার এই রাত কে কাল রাত মনে হচ্ছে দেবীর। আকাশে গুরুম গুরুম মেঘের আওয়াজ, সেই সাথে পশুদের হুংকার দেবীর ভয় বারংবার বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেবীর কানে কেবল আসছে মায়ের আর্তবাদ, ঠাম্মার সেই ক্রন্দনরত আবদার, আর বাবার সেই হাস্যজ্বল মুখের দেবীমা ডাক। রাত যত গভীর হচ্ছে ভয় ততোই বাড়ছে। কিছুক্ষণ পরেই ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করলো। জঙ্গলের গাছগাছালির নড়াচড়া শুরু। ঝড়ো বাতাসের সাথে গায়ে লাগলো বৃষ্টির ফোটা। কেপে উঠলো দেবীর লোমকুপ ও।আকাশে বাজ পড়ছে, ঝড়ো বাতাস,মুষলধারে বৃষ্টি ভিজে একাকার। কিন্তু এই বৃষ্টি, ঝড়ো বাতাস কাকনের হৃদয়ের আগ্নেয়গিরি থামাতে পারছিল না।
সেদিন রাতে একসাথে দুই দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছিল দেবীকে। এক দিকে স্বজন হারানোর ঝড় অন্যদিকে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা।সেদিন রাতেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় সিরাজপুর সহ আশেপাশেও। স্বল্প মাত্রার জলোচ্ছ্বাস এ সিরাজপুরের নদীবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে আশেপাশের নিমতলি আর আমলাপাড়া এলাকার ভয়াবহ দশা হয়। দেবী সাতার কাটার চেষ্টা করে,গাছের ডাল আকড়ে ধরে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে সে বাচবে না। এই পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই।এই ভয়াবহ রাতে খুব করে চেয়েছিল সে যেন বেচে না থাকে।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। যখন পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল ভেবেছিল এই সুন্দর সুনীল আকাশ, এই জগৎ আর দেখা হবে না। কিন্তু নিমতলি আর আমলাপাড়ায় ভয়াবহ ক্ষতি হয় অনেকে প্রাণ হারায়। অনেকে এতিম কেউ, কেউ বা নিস্ব আবার কেউ বা সন্তান হারা।নিমতলি গ্রামের পানিতে অনেক মানুষ ভেসে ছিল তাদের মধ্যেই একজন ছিল দেবী। তাদের কে যখন উদ্ধার করা হয় অনেকেই অসুস্থ ছিল। দেবীও গুরুতর অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল।জ্ঞান হীন হাসপাতালে পড়েছিল সাতদিন। তারপর কয়েকজন এতিম মেয়ের সাথে তাকেও আনা হয় মহিলাশালায়। মহিলাশালায় যখন আনা হয় তখনও ওর মধ্যে জ্ঞান ছিল না।প্রায় কিছুদিন পর সকলেই স্বাভাবিক হয়, কিন্তু হয় না কেবল দেবী। সেই ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরটিকেই নিজের সর্বস্ব বানিয়ে বসেছিল। সবচেয়ে সুন্দর হওয়ায় সকলেই খুব সহজে আকৃষ্ট হয়েছিল।
ফাতিমার এমন পাথরের মতো মুর্তিরুপে মেয়েটিকে দেখে খুব মায়া কাজ করে।দেবীর কাছে বসে প্রথমবারের মতো। মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কথা বলে সহজ করার জন্য। কিন্তু দেবী বিষন্নতায় কোনো কিছুই খেয়াল করতো না।একদিন রাতে দেবী ঘুমের ঘোরে নিজের মাকে স্বপ্ন দেখে। মা বলে চিৎকার করে উঠে বসে। ফাতিমা তাহাজ্জুদ পড়ে সবে শুয়েছিল কাকনের ডাকে কাকনের কাছে যায়। কাকন সেদিন প্রথমবারের মতো কথা বলেছিল। জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে মা মা বলে ডেকেছিল ফাতিমাকে। জীবনে প্রথমবার কারো মুখে মা ডাক শুনে ফাতিমা চোখ ভিজে উঠে। সন্তানহীন ফাতিমা সন্তান অনুভব করে দেবীতে। ফাতিমাও আপন করে নেয় দেবীকে। কিন্তু দেবী কিছুই বলতো না। সবাই ভেবে নিয়েছিল দেবী ভয়ে সব ভুলে গিয়েছে। ফাতিমা নিজের পছন্দ মতো দেবীর নাম দেয় কাকন। সিরাজপুরের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। কুরআন পড়তে হবে। কাকন ও বিনা বাক্যে সকল কিছু গ্রহণ করে।ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ কেই মেনে নেয়। তবে দেবী জীবিত থেকেও প্রাণহীন ছিল।কয়েকমাসে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। প্রকৃতির দুর্ভিক্ষের ক্ষত সেরে যায় কিন্তু হৃদয়ের দুর্ভিক্ষের ক্ষত থেকেই গিয়েছিল।
____________________
এতক্ষণ দেবীর মুখে সকল ঘটনা নিরব হয়ে শুনছিল বসার ঘরের প্রতিটি প্রাণি। একটি মাছিও যেন টু শব্দটা করছিল না।কারো কারো চোখেমুখে পানি,আর কারো কারো বিস্ময়। সকলেই হতবাক কতটা কঠিন, নিষ্ঠুরতার সাথে লড়াই করতে হয়েছিল ওইটুকু মেয়েকে।সেদিন রাতে নিজের জীবন ও চলে যেতে পারতো দেবীর।
তারা আরো অবাক হয়েছে সুভার অতীত জেনে। তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারে নি সুভা হিন্দু ছিল। মালেকা আর মহীর মা দুজনেই অবাক এত বছরেও জানতে পারে নি। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক প্রহরী দাসিরা যারা সিরাজীদের এতদিন ফেরেস্তা ভেবে এসেছিল। দেবীর মুখে এগুলো শুনে সুভা আরেকবার ভেঙে পড়লো। দেবীর পা দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমায়, আমায় মাফ করে দে মা। আমার জন্য শুধুমাত্র আমার জন্য তোর জীবনে এত কষ্ট এত ঝুকির সম্মুখীন হয়েছিস। দাদা, বৌদি,বাবা, মা প্রতিটা মানুষ কেবল আমার জন্য জীবনের শেষ মুহুর্তে এসেও কষ্ট ভোগ করেছে।সব কিছুর জন্য আমি দায়ী।”
সুভা দেবীর পায়ের কাছে উপুড় হয়ে কাদতে লাগলো। কাকন ঠিক আগের মতোই জড় পদার্থের মতো বসে রয়েছে। দেবীর এমন ঘটনার বিবরণ শুনে সকলেই দেবীর দিকে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু রুহুল মাথা নিচু করে সকল বিবরণ শুনছিল। তার অগোচরে এত কিছু ঘটে গেছে আর সে জানলোই না। তার দাদাজান একটা মা,একটা সন্তান কেও খুন করেছিল। দেবীর ভয়াবহ রাত, দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করার বিবরণ যেন রুহুল কেও সমান কষ্ট দিচ্ছিল। রউহউলের গায়ের প্রতিটি লোম দাড়িয়ে গিয়েছে এই বিবরণ শুনে। না জানি কতটা ভয়, কতটা কষ্ট হয়েছিল তার বিবিজানের। রুহুলের ইচ্ছে করছে সেই দুর্ভিক্ষ কে ক্ষতবিক্ষত করতে আর সেই সাথে নিজেকেও।কেন সেদিন সে একবার ও দেখে নি সেই অসহায় মা মেয়েকে। রুহুল এবার চোখ তুলে চাইলো তবে সাজুর পানে। সাজুকে উদ্দেশ্য করে বললো, –“সাজু,লাশগুলোর গোসল- কাফনের ব্যবস্থা কর।”
রুহুলের কথা ও চোখের ভাষা বুঝলো সাজু।
বললো, “জি আমি লোক আনতাছি। ”
দাদিমা লাশের কাছে বসেই বললো, “না আমার সিরাজী সাবের লাশ দিমু না।আমার জামাল আমার বাছা আমি দিমু না।” বুক তাপড়িয়ে কাদতে থাকলো।
দেবী দাদিমার দিকে চেয়ে বাকা হেসে বললো, “কাছের মানুষকে হারানোর কষ্ট খুব ভয়াবহ তাই না দাদিমা। কত সুন্দর করে কাদছেন আপনি। কিন্তু আমি, আমি কিন্তু এভাবে কাদতে পারি নি। এই মুখ এই দুহাতে চেপে রেখেছিলাম যেন ওনারা শুনতে না পায়। আমি সেদিন ও প্রাণভড়ে কাদতে পারিনি।আমার এই বুকে কষ্ট টা জমে গেছে। ওনাদের আত্মচিৎকার একটু একটু করে কমিয়ে দিয়েছে সেই জমা কষ্টটা।”
সকলেই দেবীর কথা মন দিয়ে শুনছে রুহুলের ইচ্ছে করছে দেবীকে নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিতে। বলতে ইচ্ছে করছে, “বিবিজান কাদুন আমার বুকে। ভাসিয়ে দিন আপনার জমে থাকা কষ্ট।” কিন্তু রুহুলের সাহস নেই এই মুহুর্তে দেবীর কাছে যাওয়ার।কোন মুখে যাবে সে সে তো নিজেও সিরাজী।
সাজু রুহুলের দিকে চাইলো।সে কিছু বলার আগেই রুহুল বললো, “আমি লাশ সরানোর ব্যবস্থা করতে বলেছি সাজু। আর সিরাজপুরে জানিয়ে দেওয়া হোক দুলাল সিরাজী এবং তার সন্তান জামাল সিরাজী রাতে ইন্তেকাল করেছে। ”
রুহুলের কথায় সাজু প্রহরী দের ইশারা করলেন।তারপর সাজু ঘরের প্রত্যেকটা সদস্য কে দেখলো। একেজন নিজেদের ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত।লাশ গুলোকে ভালো ভাবে দেখে সাজুর মস্তিষ্কে হঠাৎই নতুন প্রশ্ন হানা দিলো।সাজু উৎসুক চোখে দেবীর দিকে প্রশ্ন ছূড়লো,”ভাবিমা আপনেই কি তাইলে হেলাল ভাই রে খুন করছিলেন? ”
সাজুর কথায় আরেকদফা সকলেই দেবীর দিকে তাকালো।সকলেই যেন মনযোগী হলো আবার শুনতে। দেবী ঘরকাপানো হাসি দিলো। দেবী হাসছে কিন্তু চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। রুহুল মনে মনে বললো, “আমি আমার বিবিজান কে চিনি। এ তার মুখের হাসি নয় এ তার বেদনার খোলস যা সে চায় না দেখাতে। এতটা পাথর কেন হলেন বিবিজান। ”
দেবী ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লো। বললো, “শুধু কি হেলাল সিরাজীর কথাই শুনতে চান সাজু ভাই?
সাজু বিশ্মিত হয়ে বললো,”আরো কেউ আছে নাকি?”
–“হ্যাঁ অবশ্যই আছে। হেলাল ,হাবিবুল্লাহ, মহীবুল এদের সকল কেই আমিই হত্যা করেছি। ”
আরেকদফা সকলেই চমকালো।মালেকা দেবীর কাছে যেয়ে দুবাহু ঝাকাতে ঝাকাতে বললো, “তুমি, তুমি আমার হেলাল রেও খুন করছো?”
দেবী নির্বিকার ভাবে বললো, ” শুধু তাদের ই নয় বিলাল সিরাজীর এই দশা ও আমি করেছিলাম। ”
দেবীর মুখে বিলাল সিরাজীর কথা শুনে সকলেই হতভম্ব। কেননা তারা কেউ ই এটা আশা করেনি।রুহুল নিজেও অবিশ্বাস্য ব্যাপার মনে করলেন।তার প্রাণপ্রিয় আব্বাকে তার সহধর্মিণী এমন করেছে।রুহুল এবার এগিয়ে গেলো দেবীকে নিজের দিকে ঘুরালো। প্রশ্ন ছুড়লো,” আব্বার ওই দশা আপনি করেছিলেন?”
দেবী রুহুলের চোখে চোখ রেখে বললো, “আগেই বলেছি আমার রক্তে মিথ্যা বলার সুভাষ নেই। ”
রুহুল দেবীর হাত ছেড়ে দিলো।সে তার স্ত্রীর কে চেনে। আজ এখানে যে রয়েছে সে তার স্ত্রী নয়।রুহুল বুঝে গেছে কেন তার স্ত্রী আজ এতটা কঠোর ভাবে কথা বলছে।রুহুলের ভালোবাসা ঠুনকো ছিল কি।
সকলের মাঝে রানু চোখ মুছলো।বললো,”ভাবিজান, তাইলে আপনে সেবা করতেন কেন তারে?”
–” বিয়ের দিন যেদিন সে আমায় দেখে প্রথম কেদেছিল সেদিনই মনে মনে তৃপ্তি পেয়েছিলাম। সে জীবিত থেকেও মৃত মানব। ভেবেছিলাম তার জন্য শাস্তি এটাই থাক দ্বিতীয় বার আর হত্যার প্রয়াস করব না। জানো এ বাড়িতে সেই আমার কুকর্মের সাক্ষী। এদের মা’রার আগেই মৃত্যুর খবর পৌছে দিতাম আমি বিলাল সিরাজীর কানে।ওনার আঁখি ভড়া জল আমায় অনেক সুখ দেয়। ”
সাজু বললো, “কেমনে মারছিলেন তারে ভাবিমা?”
__________________
মহিলাশালার শেষ মাথায় খাদের পাশে নতুন এক ভবনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।মেয়েদের থাকার জন্য আর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল।সেই কাজের ই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিলাল সিরাজী কে। দেবী সেখানেই প্রথম বিলাল সিরাজী কে দেখে। মনে পড়ে যায় সেই কালরাতের কথা। দেবী রোজ দেখতো বিলাল সেখানে যায়। একদিন হঠাৎ করেই বিলাল সিরাজী দোতলার কাজ দেখিতে আসে। কোনো মজুর ছিল না সেদিন তাই দেবীর কুবুদ্ধি আসে। দেবী বিলাল সিরাজী কে দেখেই পিছু পিছু গিয়েছিল। বিলাল দোতলায় উঠে কিনারায় যায় এবং সেখানেই ছিল হাতুড়িসহ নানা সরঞ্জাম। বিলাল সিরাজী বিপরীত মুখী হয়ে দাড়ালে দেবী হাতুড়ি টি হাতে নেয় এবং ধারালো পাশ দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে। বিলাল সিরাজী পিছনে ফিরে আর্তনাদ করে ওঠে।দেবী আবারো আঘাত করে। দেবী নিজের পরিচয় দিতে ভোলে না। তৃতীয়বার যখন মাথায় আঘাত করেছিল তখনি বলে দিয়েছিল নিজের পরিচয়। অনেক বার আঘাত করে মাথার তালুতে।দেবী জানতো মাথায় এভাবে আগাহত করলে তাড়াতাড়ি মরবে। আর যন্ত্রণা টাও ভয়াবহ ভাবে পাবে। বিলালের অজ্ঞান হওয়াকেই মৃত্যু ভেবে নিয়েছিল দেবী।প্রথমবার কাউকে হত্যা করার প্রয়াস করেছিল। তারপর মাগরিবের আগেই সেই ভবন থেকে বিলাল কে খাদে ফেলে দেয়। খোজাখুজির পর পরেরদিন সকলে দেহ পায়। গ্রামের একদল ছড়ায় খাদের পাশের ভুত প্রেত করেছে।অজ্ঞতা সেই ভবনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে মানুষের যাতায়াত ও বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন সকলেই বিলাল সিরাজীর জন্য কেদেছিল তবে হাসি ছিল কেবল দেবীর মুখে। সে ভেবেছিল মরে গেছে কিন্তু দুদিন পরেই জানতে পায় জীবিত তবে মৃতের চেয়েও বেশি বড় ক্ষতি হয়েছে বিলাল সিরাজীর ।তবুও মনে মনে তৃপ্ত হয় দেবী।
_________________
মালেকা কাদতে কাদতে বললো, “এতডা খারাপ ভাবে মারতে পারলা। তোমার হাত কাপে নাই? ”
–“কাপবে না কেন। অনেক কেপেছিল কিন্তু মস্তিষ্ক কাজ করছিল না। কিন্তু আমি বরাবর ই মস্তিষ্কের কথা শুনি। তাই হাত কাপলেও পিছোপা হয় নি। নিজের স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলাম।”
দাদিমা কাদতে কাদতে বললো, “ওরা একজন কে মারছে তাই বইলা তুই সবাইরে মারলি। ”
দেবী হাসলো কিছু বললো না।
সাজু আবারো জিজ্ঞেস করলো, “আর হাবিবুল্লাহ রে কেমনে খুন করেছিলেন?”
দেবী বললো, “এককটা কথা কি জানেন , হাজার বছর মানুষকে যা না শেখাতে পারে, অভিজ্ঞতা খুব কম মুহুর্তেই তা শিখিয়ে দেয়। এই আমায় দেখুন না সে রাতের পর আর কোনো কিছুই আমায় কষ্ট দেয় না, অন্ধকারকে ভয় করি না এমন কি ভয়াবহ ঝড় তুফান ও না।এ কেমন হয়েছি আমি? ”
–“পাথর হইয়া গেছেন!তা কেমনে মারছিলেন?”
–” আমার বিবাহের আগের দিন মাঝরাতে হাতের মেহেদী তুলতে বেড়িয়েছিলাম আমি। কিন্তু বাড়ান্দায় দাঁড়াতেই কারো ছায়া দেখতে পাই। প্রথমে কেমন যেন লেগেছিল। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই চেনা লাগলো। আমার এই হাতুড়ি আর বাড়ান্দা থেকে বটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তারপর হাবিবুল্লাহ কে দেখেই চিনে ফেলি। পুরনো ক্ষত তাজা হয়। ইচ্ছে করেই এগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সেই বকুলতলার কাছে দাড়াই। আমি বুঝেছিলাম হবিবুল্লাহ আমাকে অনুসরণ করে পিছন পিছন আসছে হয়তো আমাকে খুন করতেই এসেছে। তারপর নদীর কাছে এসে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ি। হাবিবুল্লাহ আমায় খুজতে এসেছিল কিন্তু উল্টো ওকেই মাথায় আঘাত করি। বটি দিয়েও আঘাত করি। বেচারা মৃত্যুর থেকে বাঁচতে চেয়ে কতই না অনুরোধ করছিল। কিন্তু ছাড়িনি। আমার পরিচয় পেয়েই আরো ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।আমি ওকে বলি আমার মাকে কি করেছিলি।আমাকে হাবিবুল্লাহই প্রথম গুপ্ত কক্ষের কথা বলেছিল। হাবিবুল্লাহ বাচার জন্য বলেছিল, “তোর মা-বাপ রে কবর দেয় নাই। মঞ্জিলের গুপ্ত ঘরে ফালাইয়া রাখছে। যাতে কেউ টের না পায় আমরা খুন করছি। সেইখানেই আছে তোর মা-বাপ। হয়তো এতদিনে আড্ডি হইয়া গেছে।সব দুলাল সিরাজীর হুকুমে হইছে। আমারে ছাইড়া দে। আমি তো হুকুমের গোলাম।আমি তোরেও খুন করবার চাই নাই। জামাল সিরাজী হুকুম করছিল তরে খুন করতে। কারণ মহী তরে এক রাইতের জন্য চাইছিল। আর তুই রুহুল এর বউ হবি এইডা ওরা মানবার পারতাছে না। আমাক মাফ কইরা দে। আমি জানতাম না তুই ই দেবী।”
নিজের বাবা-মার মৃত্যুর পর শেষ কাজ টুকু করতে না পারায় আমি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠি। কষ্টে রাগে,ঘৃণায় বার বার ওর দেহে বটি দ্বারা আঘাত করে।তার সাথে মাথায় হাতুড়ি দ্বারা মারতেই থাকি।আমার মায়ের হাত ধরে রেখে ও সেই কালরাতে বলেছিল আমার মাকে খুন করার কথা। ওই হাতে ও বটি দিয়ে আঘাত করেছিলাম আমি।তারপর সিরাজপুরের নদীতে ফেলে আসি লাশ।
তারপর সেই নদিতেই গোসল করে এসেছিলাম আমি। ওর পচা রক্ত সেই নদীতেই পড়ে ছিল। তারপর মহিলা শালায় এসে আবার শুয়ে পড়েছিলাম।অথচ কেউ কিচ্ছু টের ও পায় নি।তারপর হাতুড়ি টি স্বযত্নে রেখে দিয়েছিলাম।কিন্তু মাথায় ঘুরছিল অন্য চিন্তা আর হৃদয়ে কষ্ট যে সেই মঞ্জিলেই আমার বাবা-মা আছে। আর তাদের শেষ কাজ টুকুও করা হয়নি। প্রতিজ্ঞা করি মন থেকেই বিয়ে করবো। মেনে নেবো এই বিবাহ তবে লক্ষ থাকবে আমার বাবা-মাকে খুজে বের করা। এই সিরাজী মঞ্জিলের সকল অপরাধের শাস্তি দেওয়া।”
–“আর হেলাল ভাই?”
–“সামিয়ার বিয়ের আগে মহিলাশালায় যখন গিয়েছিলাম হাতুড়িটা নিয়ে আসি।ভেবেছিলাম জামাল কে খুন করবো কিন্তু কেন যেন হেলাল কে খুন করতে ইচ্ছে করলো। সামিয়ার বিয়ের দিন ওর অজ্ঞান হওয়ার সুবিধা নেই। হেলাল কেও ইচ্ছে করে বলি যে তিনতলায় আমার সাথে যেতে। তার দাদাজানের হুকুম। অজ্ঞতা হেলাল রাজি হয় এবং আমার সাথে তিনতলায় যায়। হেলাল কে ইচ্ছে করেই দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম মেঝেতে। তারপর আচলের নিচ থেকে সেই হাতুড়ি টি বের করি। তারপর হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করি।ও আমার পরিচয় শোনার এক সেকেন্ড পরেই মরে যায়। কিন্তু ওর শরীরে প্রচুর রক্ত ছিল। আমরা পা ওর রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছিল। হাহাহা, হেলাল এই বংশের সবচেয়ে বোকা জানো’য়ার ছিল।
–“আর মহীবুল?”
–“ও একটা নর্দমার কীট ছিল।ওর জন্য আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয়েছিল। প্রথমবার খুন করার আগে দুর্বল হয়েছিলাম আমি। আমার মাঝে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা কাজ করছিল এটা ভেবে যে ও আমায় ধর্ষন করতে এসেছে। সেদিন আমার নিজের নারীত্বের কথা মনে হয়ে কষ্ট হচ্ছিল।আর আমার স্বা..”
দেবী কথাটা শেষ করলো না। থেমে জোরে শ্বাস নিলো। বললো, “অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়াই। তারপর বিছানা থেকে নেমে যাই।দরজার কাছের বাটাম দ্বারাই মাথায় আঘাত করি। আমার পরিচয় শুনে ও দরজা খুলে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি তার আগেই খুন করি ওকে। বারবার মাথায় আঘাত করতেই থাকি। আর তারপরই আম্মা আসে। ওনাকে দেখে ভয় পাই যে যদি উনি কাউকে বলে দেয়। কিন্তু আম্মা ভেবেছিল আমি আত্মরক্ষার জন্য খুন করেছি। অজান্তেই রক্তের টান অনুভব করেছিল বোধহয় সেরাতে আম্মা তাই নিজের ঘাড়ে সব দোষ নেয়। তবে আফসোস ওকে কঠিন মৃত্যু পারি নি। সেদিন প্রথমবারের মতো বাবা-মার জন্য নয় বরং নিজের জন্য হত্যা করেছিলাম । নারী কে অসম্মান করা নরপিশাচদের বাচার অধিকার নেই। আমার ইচ্ছে করছিল ওর শরীর কেটে পোকামাকড় দের আহার করি। কিন্তু সেরাতে সত্যি মতো ভেঙে পড়েছিলাম। নিজেকে খুব অপবিত্র লাগছিল।বুঝেছিলাম একজন নারীর সবচেয়ে দুর্বলতা বোধহয় নিজের ইজ্জত। ”
সাজুসহ সকলেই দেবীর চতুর বুদ্ধির বিবরণ শুনে হতবাক। কতটা সুক্ষ্ম ভাবে এত গুলো হত্যা করেছে।ও যতটা সহজ ভাবে বলেছে আদোও কি এতটা সহজ ছিল।
রুহুল নিজের আম্মার দিকে চাইলো। তার আম্মা এত বড় সত্য লুকিয়েছে তার থেকে। একটা বার অন্তত রুহুল কে জানলে কি এমন হতো। রুহুলের ভীষণ কষ্ট লাগলো এটা ভেবে যে তার ভালোবাসা কি এতটাই মিথ্যে ছিল যে একটা বার বলা যেতো না তাকে। এই জীবনে যে দুটি নারীকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে রুহুল তারা দুজন ই বিনিময়ে কেবল রুহুলকে ভুল বুঝেই গেলো।বিনিময়ে কি এক চিমটি ভালোবাসতে পারলো না রুহুলকে।বোধহয় একই জাতের, একই রক্তের তাই দুজনেই রুহুলকে ভালোবাসতে পারে নি। অথচ রুহুল এক সৌরজগৎ সমান ভালোবেসে গেছে।নারীর ভালবাসা পাওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ বলে মনে হচ্ছে এখন। ”
চলবে,,,
#দেবী
#Srotoswini_স্রোতস্বীনি
বিদ্রঃ দয়া করে কেউ কপি করবেন না। ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট শেয়ার করে পাশে থাকবেন। এটা সম্পুর্ণ আমার কল্পনায় গড়া গল্প বাস্তবতার সাথে তুলনা করবেন না। ধন্যবাদ।
আজ আমি গল্প দিতাম না। শরীর টা ভালো যাচ্ছে না। ফুল ফ্যামিলি জ্বর এ ভুগছি। দোয়া করবেন সকলে।
®️ Srotoswini-স্রোতস্বীনি ✍️