দূর আলাপন
পর্ব-৫
______________________
তিতিক্ষা শব্দহীন পায়ে হেঁটে সোফায় টেলিফোনের কাছে এসে বসল। নাম্বার চেপে টেলিফোন কানে তুলে আরেকবার চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে দেখে নিল কেউ আসছে কিনা! নাহ, কেউ নেই। সে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ওপাশের মানুষটার সারা পাওয়ার জন্য। অনেক ভেবে তবে সে এই প্ল্যান টা বের করেছে। কাজ হওয়া চাই-ই-চাই। নইলে যে কি হবে….নাহ! সে আর ভাবতে চায় না কিছু। রিনরিনে স্বরে তখনই ওপাশ থেকে একটি মেয়ে বলে উঠল,’হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন… ? ‘
তিতিক্ষা উত্তেজিত হয়ে বলল,’ওয়ালাইকুমুস সালাম। চিনতে পারলি না আমায়? আমি তিতিক্ষা। ‘
-‘ওহ তিতি, তুই! অচেনা নাম্বারতো তাই চিনতে পারি নি হঠাৎ। তুই এই অসময়ে কল?’
-‘কারণ আছে। বলছি শোন … ‘
-‘হু। ‘
-‘তুই কি এখনো একাই আছিস? নাকি খালাম্মা ফিরে এসেছে বাড়ি থেকে? ‘
-‘মা ফেরেনি এখনো। কিন্তু কেন?’
-‘বলছি। একটা কাজ করতে হবে তোকে। করবি তো?’
-‘কি কাজ? কোনো সিরিয়াস ব্যাপার? কাউকে পেটাতে হবে নাকি? অতটা হলে কিন্তু আমি এখন পারবো না ভাই। মা বাড়ি নেই। আমি গৃহবন্দী। কামলা খাটছি দিনরাত! এই অসময়ে এসব কাজ ভালো হবে না।’ মিহি নামের মেয়েটির হাসির শব্দ শোনা গেল।
তিতিক্ষা কিন্তু হাসলো না। গম্ভীর হয়েই রইল। তারপর একইসঙ্গে উত্তেজিত ও ইতস্তত কণ্ঠে বলল,’মিহি, পরশু আমি তোর ওখানে আসছি। অসুবিধে হবে না তো কিছু?’
মিহি মেয়েটি ফের মিষ্টি করে হেসে বলল,’ ধুর! কি যে বলিস! তোকে তো আমি সেদিন এখানে আসতেই বলেছিলাম। বরং তুই নিজেই মুখের ওপর না করে দিলি। এখন তবে চলে আয়।’
তিতিক্ষা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,’আসল কথাটা বলিনি এখনো। আমি পরশু তোদের বাড়ি আসব কিন্তু তার আগে আমাকে তোর দাওয়াত দিতে হবে। এখনি একবার দে তো!’
মিহি বিস্মিত হয়ে অস্ফুট স্বরে হাসল, ‘ দাওয়াত দিতে হবে কেন? দাওয়াত ছাড়া কি আসা যায় না। এতদিন তো এভাবেই এলি! আজ আবার নতুন কি ভূত চাপলো মাথায়?’
তিতিক্ষা জেদের স্বরে বলল,’তুই একবার মুখে দাওয়াত দে শুধু। নইলে আমি আসতে পারবো না।’
মিহি আমুদে ভাব নিয়ে বলল,’দাঁড়া দিচ্ছি,
মিস তিতিক্ষা তাবাসসুম, ১৭ই জুন, রোজ শুক্রবার দুপুর ২ ঘটিকায় হাজারিবাগে আমার বাসগৃহে আপনার নিমন্ত্রণ রইল। উক্ত সময়ে অনুগ্রহ করিয়া অধমের গৃহে পদধূলি দিলে এই অধম কৃতার্থ হইবে। আপনি অবশ্য আসিবেন।
ইতি মিহি
হয়েছে এবার? ‘
তিতিক্ষা মুচকি হাসল। বলল,’হু। এইকথা গুলো বুবুকেও একবার বলতে হবে। পারবি তো?’
-‘ব্যাপার না। সেও নাহয় বললাম। কিন্তু কাহিনি কি তা তো কিছু জানলাম না। হঠাৎ আবার এভাবে গা ঢাকা দেয়ার প্রয়োজন পরল কেন তোর? কে আসছে বাসায়? নিনাদ ভাই? তাই বুঝি যেচে দাওয়াত নিয়ে তাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য এসব আয়োজন, সেবার ঈদের মতো? ‘
-‘কেউ আসছে না। এবার আমাকেই যেতে হচ্ছে। নিনাদ ভাইয়ের বাড়িতে। শুক্রবার দাওয়াত সেখানে। বুবু বলেছে যেতেই হবে। আর তাই যেতে যেন না হয় সেজন্য এই আয়োজন।’
মিহি হাসতে লাগলো। -‘বেচারাকে আর কত ফাঁকি দিবি! সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে দেখছি তোদের এসব অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা। জীবনটা তেজপাতা করে দিলি বেচারার।’
তিতিক্ষা হাসিতে যোগ দিতে পারল না। তার হঠাৎ লজ্জা করতে লাগল। সে তো শুধু একটি ছেলেকে দেখা না দেয়ার জন্যই এতকাল ধরে এসব ফন্দি করে আসছে। তার প্রধান কারণ যাকে সে ফাঁকি দিতে চায় ‘সে একটি ছেলে’। এর বেশি কিছু তো না। নিনাদ বলেই সে বিশেষ ভাবে সন্ত্রস্ত হচ্ছে। মিহি কি তবে তাই ভাবছে?’
ঠিক সে সময় বাইরের দরজার কাছে অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল। তিতিক্ষা তটস্থ হয়ে দাঁড়াল। বাড়িতে এখন সে আর মারুফ সাহেব ছাড়া কেউ নেই। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। তিহা ছেলেকে নিয়ে ছাদে গেছে অনেকক্ষণ। এই ভর দুপুরে আর কে আসবে। তবে নিশ্চয়ই বুবুই ছাদ থেকে নেমে আসছে।
‘মিহি, আমি ফোন রাখছি। রাতে তুই বুবুকে কল দিবি আজ। মনে থাকে যেন। আল্লাহ হাফেজ। ‘ বলে টেলিফোন নামিয়ে রেখে তিতিক্ষা দৌড়ে সে জায়গা ছেড়ে পালাল।
সেদিন রাত এবং তার পরদিনও কেটে গেল কোন ঝামেলা ছাড়াই। মিহির এই হঠাৎ দাওয়াত দেয়া নিয়ে তিহা কিছু বলল না। তিতিক্ষা মিহির ওখানে যাবে, না তার সাথে নিনাদের বাড়িতে যাবে সেকথাও জানতে চাইল না। শুক্রবার সকালে তিতিক্ষা তাই নিজেই গেল বুবুর কাছে। ইতস্তত করে বলল, ‘বুবু….তাহলে ছোটন কে সাথে নিয়ে তুমি বরং একাই যেও ওবাড়ি। মিহিটা হঠাৎ দাওয়াত করে বসল। না যাই যদি তবে আবার কষ্ট পাবে খুব । আমি নাহয় ওখানেই যাই। তুমি শিউলি ফুআম্মা কে বুঝিয়ে বোলো একটু।’
তিহা গম্ভীর হয়ে বলল,’ কষ্ট তো পাবেই। লজ্জা শরম বিসর্জন দিয়ে যেচে এভাবে দাওয়াত নিলি। না গেলে কষ্ট পাবে না?’
মুহুর্তে তিতিক্ষার মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল। সে চোখ বড় বড় করে বুবুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
তিহা সেসবের পরোয়া করল না। কঠিন স্বরে বলতে লাগল,’কি মেয়েরে তুই! যাবি না ভালো কথা। সে কথা মুখে বললেই হতো। তা না করে, যাওয়া নিয়ে মিথ্যে যেন বলতে না হয় সেজন্য যেচে দাওয়াত নিলি বন্ধুর কাছে! অথচ পুরো ব্যাপারটা যে মিথ্যার ওপরেই দাঁড়িয়ে সেটা খেয়ালই করলি না?’
তিতিক্ষা চুপ করে আছে দেখে সে আবার বলল,’আমার ওপর ভরসা নেই তোর? আমার বন্ধু নিনাদ এত বাজে ছেলে? যে তার হাত থেকে বাঁচতে বারবার তোকে মিথ্যা নাটক সাজাতে হবে? হা?’
অথচ তোর অস্বস্তি হবে বলে নিনাদ সেদিন নিজেই আমাকে বলছিল আজ সে বাড়িতে থাকবে না, বাইরেই কোথাও খেয়ে নেবে। তোকে ওবাড়ি দাওয়াতও হয়ত সে কোনদিন করত না। শুধু ফুআম্মা জোর করলেন বলে।
এতটা করবি জানলে আমি শুরুতেই ফুআম্মা কে মানা করে দিতাম। যাইহোক, যেখানে খুশি যা তুই। শিউলি ফুআম্মাকে আমি কিছু একটা বলে দেব।’
তিতিক্ষা ম্লান মুখে মাথা নুইয়ে বসে রইল। বাজ ভেঙে পরলেও বোধহয় সে এতটা অবাক হত না যতটা বুবুর কথা শুনে হয়েছে। বুবু প্রথম থেকেই তার সব ফন্দি ফিকির বুঝে ফেলেছিল তাহলে। ছিঃ! কি লজ্জা…
তিহা গটগট করে হেঁটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। তিতিক্ষার মন হঠাৎ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আজকের আগে কখনোই বুবু তার সাথে এমন কঠিন স্বরে কথা বলে নি। সে কি সত্যিই একটু বারাবাড়ি করে ফেলেছে এবার! সর্বনাশ! বুবু যদি এবার বাবাকে বলে দেয় সব!
দুপুরে যাওয়ার আগে ছেলেকে নিয়ে তিহা তিতিক্ষার ঘরে এলো। এসে দেখল তিতিক্ষা বোরকা পড়ে একদম তৈরি হয়ে বসে আছে। সে না দেখার মতই নির্লিপ্ত স্বরে বলল,’ আমরা যাচ্ছি। দেখি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসব। বাবাকে দেখিস।’বলে ছেলেকে নিয়ে ঘুরে পা বাড়াতেই তিতিক্ষা উঠে দাঁড়াল। ব্যাস্ত স্বরে থেমে থেমে বলল,’আমিও তো যাব। আমাকে রেখেই তোমরা চলে যাচ্ছ যে?’বলে হাত কচলাতে লাগল।
সে ভেবে দেখেছে। এখন যাওয়াটাই নিরাপদ। বাবা এখনো কিছু জানেন না। নাহয় বাবা খুব রেগে যাবেন। তার জারিজুরিও ধরে ফেলবেন মুহুর্তে। তাছাড়া বুবু তো বলেই দিয়েছে নিনাদ এবার সিরিয়াস। আর এখানে এসে যাই করুক, সে নিশ্চয়ই নিজের বাড়ি ডেকে অপমান অন্তত তিতিক্ষা কে করবে না। এটুকু ভরসা তো সে করতে পারে! অতএব যাওয়া যায়।
তিহা মনে মনে হাসল। ওপরে আগের সেই গাম্ভীর্য বজায় রেখেই বলল,’চল তাহলে। ‘
বলা মাত্র তিতিক্ষা বোনের পশ্চাদপসরণ করল!
_____________________
মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারের কাছে একটি ছোট ফ্ল্যাটেই নিনাদের আবাস। সেখানে সে একাই থাকে। আগে একটি ছেলেও থাকত সাথে। বছর দুয়েক হল চাকরি পেয়ে ছেলেটি এবাড়ি ছেড়েছে। দুই রুমের সেই ছোট ফ্ল্যাটের সবকিছুই ভারি সুন্দর। হাতিলের খুব সৌখিন গুটিকতক ফার্নিচার, বেতের সোফা আর অসংখ্য গাছ দিয়ে ঘেরা পুরো বাড়ি । কিন্তু ঘর সুন্দর হলে কি হবে, ঘরের মালিক যে বেজায় এলোমেলো। এখানের জিনিস ওখানে-সেখানে পরে আছে। মাসের পর মাস এভাবেই থাকে। এবার শুধু নিজের ফুফুর ভয়ে আর তিহা, তিতিক্ষার কাছে মান-সম্মান বাচাতেই বহুদিন পর তাকে সেসব গোছাতে হয়েছে।
তিহা তিতিক্ষা যখন নিনাদের বাড়ি এসে পৌঁছাল তখন ভর দুপুর। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। ঢাকার ব্যাস্ত সড়কে মানুষের বাড়ি ফেরার তাড়া ভীষণ। আর দিনের মত ছুটির দিনটিও দীর্ঘ জ্যামে বসে থেকে খোয়াতে চায় না তারা।
তিতিক্ষা তিহার পেছনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভেবেছিল দরজা খুলতে নিনাদই আসবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল একটি মেয়ে। একমুখ হাসি দিয়ে চারিদিক পূর্ণ করে দিয়ে মেয়েটি গৃহে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। এরপরই ব্যাস্ত পায়ে হেঁটে সেখানে এসে দাঁড়ালেন শিউলি ফুআম্মা সয়ং! তিহাকে দেখেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিহাও তাই। শিউলি ফুআম্মাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ সে হাউ মাউ করে সে কাঁদতে শুরু করল। মাকে হারিয়েছে সে আজ বহুদিন হল। এরপর শিউলি ফুআম্মা ছাড়া আর কাউকেই মায়ের কাছাকাছি মর্যাদা সে দিতে পারে নি। তাই এতদিন পর দেখা হওয়ায় সে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সেই মেয়েটি পরিবেশ হালকা করতে মিষ্টি করে হেসে তিতিক্ষা, ছোটনকে ভেতরের ঘরে নিয়ে বসাল।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ছোটনের সবার সাথে খুব ভাব হয়ে গেল। এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। নিনাদ জুম্মার নামায পরে ফিরল কিছুক্ষণ পর। তিতিক্ষা একা বসে ছিল ভেতরের ঘরে । বাইরে সবার কথাবার্তা সেখানে বসেই শুনছিল সে। সেই মেয়েটি তখন আবার এলো তার কাছে। তিতিক্ষা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল। মেয়েটিকে দেখে সে বই রেখে দিল। মেয়েটি এসে বিছানায় তার পাশেই কিছুটা দূরত্ব রেখে বসল। হাসি হাসি মুখ করে বলল,’এইখানে নিনাদ ভাই আসব না। আপনি মুখ খুলেন। আপনারে একটু দেহি।’
তিতিক্ষা ইতস্তত হেসে নিকাব খুলল। মেয়েটি সাথে সাথে বলে উঠল,’ও মায়া গো! আপনে তো মেলা সুন্দর! আর কত সাদা! তাই বুঝি সবসময় মুখ ঢাইকা রাখেন?’
তিতিক্ষা লাজুক হাসল। ভালো করে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটির দিকে। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ, পড়নে খয়েরী পাড়ের লাল কালো ফুল আঁকা সুতির শাড়ি। বড় বড় চুলগুলো একপাশে সিথি করে পেছনে বেণী করে রাখা। মুখটা মায়াবী। সবমিলিয়ে ভারি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। তিতিক্ষা হেসে বলল,’ ফরসা হলেই কেউ সুন্দর হয় না। আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। ‘
মেয়েটি সাথে সাথে পুরো শরীর দুলিয়ে হেসে উঠে বলল,’কি যে কন! আমারে বাড়িতে সবাই ডাকে কালি বইলা। আমি আবার সুন্দর! হা হা’
তিতিক্ষা সংকোচ ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মেয়েটির মুখে সবসময় যেন হাসি লেগেই আছে। কি সুন্দর প্রাণবন্ত সে হাসি! কোনো খাদ নেই, দ্বিধা নেই। ‘
-‘আপনার নাম কি?’ তিতিক্ষা মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করল।
-‘আমার না আফরিন। গেরামে সবাই আমারে কি ডাকে জানেন? ‘আপ্পিনি’ নামটা সুন্দর না?’মেয়েটি নিজের কথাকে বিদ্রুপ করে নিজেই হো হো করে হেসে উঠল এবার।
তিতিক্ষাও মৃদু হাসল। বলল,’আফরিন নামটাই বেশি সুন্দর। ‘
-‘সুন্দর হইলে কি হইব। কেউ তো ডাকে না।খালি…..’ হঠাৎ থেমে সে আবার বলল,’আপনের নাম কিন্তু আমি জানি। তবে বেজায় কঠিন নাম। কইতে কষ্ট লাগে।’ আফরিন নামের মেয়েটি শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাতে পেচাতে বলল।
তিতিক্ষার মনে হল এমন সহজ-সরল, মিষ্টি মেয়ে সে আর কখনো দেখে নি। কি সুন্দর করে হেসে হেসে, মুখ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলে মেয়েটি। প্রাণ যেন তার পুরো শরীর জুড়েই বিস্তৃত।
অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনের খুব ভাব হয়ে গেল। তবে মেয়েটি তিতিক্ষার কাছে বেশিক্ষণ বসতে পারল না। খাবার সময় হয়ে গেছে। শিউলি ফুআম্মা তাকে রান্নাঘরে ডাকছেন।
খাবার পর শিউলি ফুআম্মা তার গল্পের ঝুঁলি খুলে বসলেন তিহার সাথে। তিতিক্ষা আর আফরিনও বসল সেখানে। ছোটন তখন বাইরের ঘরে নিনাদের সাথে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। নিনাদ তাকে খানিক পর পর জিগ্যেস করছে,’বাবা জীবন, তোমার হবু শ্বশুর বাড়ি পছন্দ হয়েছে তো? জলদি বল। নইলে আবার নতুন করে বাড়ি খুঁজতে হবে আমাকে!’
ছোটন তখন আর উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই। সে আসবে বলে আগে থেকেই নিনাদ তার জন্য খেলনা, চকলেট , আইসক্রিমের যোগান এনে রেখেছিল। সেসব নিয়ে সে এখন মহা ব্যাস্ত।
ক্রমে ক্রমেই শিউলি ফুআম্মা আর তিহার আলাপ জমে উঠল। তিতিক্ষা সর্বদাই স্বল্পভাষী। সে কেবল গালে হাত রেখে একমনে কথা শুনছিল। সহসা ওড়নায় টান পড়তে পেছন ফিরে তাকাল। পেছন থেকে আফরিন তার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘তারা আলাপ করুক। আসেন আমরা বারান্দায় যাই।’
তিতিক্ষা আফরিনের পিছু পিছু উঠে বারান্দায় চলে এল। এসেই সে অবাক। খোলা বারান্দা জুড়ে উত্তরে হাওয়া, বাতাসের তালে টবে লাগানো গাছগুলোর হেলদোল আর দুটো ছোট্ট লাভবার্ডস পাখির খাঁচার ভেতর অনবরত কিচিরমিচির ডাক। সবকিছু মুগ্ধ করে দিল তাকে। তিতিক্ষা আবিষ্কার করল পুরো বাড়ির মধ্যে এই বারান্দাটাই সবচেয়ে সুন্দর, ভয়ানক সুন্দর। তার হঠাৎ বিশ্বাস করতে কষ্ট হল এই বাড়ি, এই এতো সুন্দর বারান্দা সব নিনাদের। এসব সাজাতে তো একটা সুন্দর মন লাগে। ওই অসভ্য লোকটার যা একদম নেই।
তিতিক্ষা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এল। আফরিন মেয়েটি তার পাশেই বারান্দার কোমড় সমান রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি বহু দূরে। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেছে অনেকক্ষণ। বৃষ্টির আগমনী সংকেত পুরো আকাশ জুড়ে। পশ্চিম থেকে ভেসে আসা কালো মেঘ, প্রবল শীতল বাতাসের ঝাপটা। এবার শুধু ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষা। তিতিক্ষা তাকিয়ে রইল। আফরিন মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। একেবারে প্রকৃতির মতই বিশুদ্ধ সুন্দর। তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেই সে বলল,’আফরিন, তোমার শাড়িটা খুব সুন্দর, একদম তোমার মত।’
আফরিন মেয়েটি সহসা সেই বিস্তৃত খোলা আকাশ থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মাথা নুইয়ে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে লাজুক হেসে বলল,’শিউলি চাচিও কইছে এইকথা। নিনাদ ভাই ঢাকায় আসার পর এই শাড়ীটা আমারে কিইনা দিসে। চাচি বলে নিনাদ ভাই আমারে যা কিইনা দেয় তাই নাকি আমারে খুব সুন্দর মানায়।’
কথা বলে মেয়েটি আর লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারল না। তাকালে হয়তো দেখতে পেত তার কথা শুনে সামনের মানুষটির হাসিমুখ মুহুর্তেই কেমন ভয়ানক বদলে গেছে!
চলবে………
★অদ্রিজা আহসান
দূর আলাপন
পর্ব-৬
__________________
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল মাথা নুইয়ে। তিতিক্ষা একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে তুমি করে বলে ফেললাম। মনে করনি তো কিছু?’ আফরিন হেসে ডানে বামে মাথা নাড়ল। প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় মনে মনে বোধহয় খানিক স্বস্তিও পেল।
মাঝে হঠাৎ যে নিরবতা নেমে এসেছিল, দুজনের কেউই তাতে কিছু মনে করল না। হয়ত দুজনের একজনও ব্যাপার টা ঠিক ধরনেই পারেনি। কিছু মুহুর্তের জন্য দুজনই যেন ভাবুক হয়ে উঠেছিল সেসময়।
আবার সেই নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে দেখে তিতিক্ষা নিজেই কথা শুরু করল এবার। পুরো আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের রাজত্ব। মেঘেদের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে ভীষণ। তিতিক্ষা আকাশের দিকে দৃষ্টি মেলে ওড়না টা আরেকটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল,’তোমার বয়স কত আফরিন?’ খানিক থেমে বলল, ‘কিছু মনে কর না। এভাবে নাম ধরে ডাকছি তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভুল হয়ে থাকলে যেন শুধরে নিতে পারি।’
-‘কিছু মনে করি নাই আমি। আমার বয়স আসলে কত তা আমি নিজেই জানি না ঠিকমতো। তবে চাচি কইছে এই পৌষে আমার বয়স ঊনিশে পরব।’
-‘তাহলে ঠিক আছে। তুমি বয়সে আমার কিছুদিনের ছোটই হবে। শুধু আফরিন বলেই ডাকা যায় তোমায়। ‘বলে তিতিক্ষা ম্লান হাসল।
হাসল আফরিনও। বলল,’আপনি খুব ভালা মানুষ। আর নিনাদ ভাই কি না কিই কইছিল আমারে আপনের কথা……’
তিতিক্ষা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’কি বলেছিল তোমার নিনাদ ভাই? ‘
আফরিন ফের শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে বলে,’কইতো, আমি যেইখানে থাকি ওইখানে একটা নাগিনী আছে বুঝলি। আমারে দেখলেই খালি হিস্ হিস্ কইরা ফণা তুইলা ছোবল দিতে আসে। একেবারে কালনাগিনী সাপ। উউহ….কি ভয়ংকর! দেখলেই ডর লাগে আমার।’ কথার মাঝখানেই হঠাৎ থেমে মেয়েটি দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। ‘ছিঃ! ছিঃ! কিসব কইতাছি আমি! কিছু মনে কইরেন না আপনে। আমার মুখের লাগাম নাই। বড় বেহায়া মুখ আমার।’
দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে তিতিক্ষা বহু কষ্টে একটু হাসল। বলল,’শুধু এসবই? ভালো কথা কি কিছু বলে না আমার নামে?’
আফরিন অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’হু, কয়তো। ভালো কথাও কয়। বাড়িতে গেলে হে সারা দিন-মান আপনাগো কথাই খালি কইতে থাকে ঘুইরা-ফিরা।’
-‘তোমার সাথে বুঝি নিনাদ ভাইয়ের খুব ভাব?’
আফরিন লাজুক হেসে উত্তর দেয়,’হু, বাড়িতে গেলে তো নিনাদ ভাই সারাদিন আমার সাথেই গপ করে। আর কত কিছু নিয়া যায় আমার লাইগা…. ‘
তিতিক্ষা হঠাৎ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যার জানার সব জানা হয়ে গেছে তার। সকলকে দেখিয়ে বেরানো নিনাদের ভালোমানুষির পেছনে আসল রূপ তবে এই!
আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে তিতিক্ষা হঠাৎ ব্যাস্ত কণ্ঠে বলে,’ভেতরে যাই চল। বৃষ্টি নামবে এখনই।’ তারা ঘরে ফিরে আসে। তিহা কিংবা শিউলি ফুআম্মা কেউ তখন আর নেই সেখানে। রান্নাঘর থেকে কথা ভেসে আসছে। আফরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তিতিক্ষাকে আসতে বললে সে বলে, ‘আসরের আযান দিয়েছে। নামায পড়ে তারপর যাই। তুমি নামায পড়বে না?’
আফরিন সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইতস্তত হেসে বলে,’মাঝে মাঝে তো পড়ি। আচ্ছা, খারান ওযু কইরা আসি।’
বাড়িতে প্রতিটা বিকেল তিতিক্ষার কাটে ছোটনের সাথে। হোক ঘুম, খেলা কিংবা ঘুরাঘুরি। বিকেল হলেই তিতিক্ষাকে ছোটনের চাই। তিতিক্ষা নামায শেষ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছোটনের খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়। এবাড়ি আসার পর থেকে ছোটনের দেখা আর পায় নি সে। একঝলক না দেখলে মন এখন শান্ত হবে না আর। তিতিক্ষা সামনের ঘরে উঁকি দেয়। নাহ, আর কেউ নেই। ছোটন একা ঘুমিয়ে আছে বড় সোফাটায়। তিতিক্ষা তার পাশে এসে বসতেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। খুলে যায় দরজা। নিনাদ মাথা থেকে টুপি নামিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে ভেতরে আসে। তিতিক্ষা কে যেন সে দেখেই নি, এমনি ভাবে সে আফরিনকে ডাকতে থাকে। অদূরে বসে তিতিক্ষা সহসা ঘোমটার আড়াল থেকেই আড়চোখে সেদিকে চায়। এই দুজনের ব্যাপার টা কি, আজ সে দেখে তবে ছাড়বে। আফরিন এগিয়ে আসতেই হাতে থাকা ঠোঙা টা সে আফরিনের হাতে দিয়ে ঘুরে দরজা লাগাতে উদ্যত হয়। আফরিন সেখানে দাঁড়িয়েই ঠোঙা খোলে। ভেতরে জিলাপি দেখে ভ্রু কুচকে বলে,’ওমা, এত জিলাপি কেন্ আনছেন?
জিলাপি না আপনের দুই চোক্ষের বিষ। সাপের মত নাকি দেহা যায়? তাইলে আজকে আবার কি হইল?’
নিনাদ এসব কোনো কথার উত্তর না দিয়ে আফরিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে চলে গেল সেখান থেকে। আফরিন দৌড়ে ফুআম্মার কাছে চলে যায়। সেখানে গিয়েও বলে একই কথা ।
জিলাপি দেখে যদিও তিতিক্ষার চোখ চকচক করে উঠেছিল ক্ষনিকের জন্য, তবু সে নিজেকে সামলে নিল। হতাশ হয়ে মুখ ফেরাল সেদিক থেকে। ছোটনের মাথায় এলোমেলো আঙুল চালাতে লাগল। নাহ! তার চাওয়া মতো কিছুই হল না। ভেবেছিল নিনাদ, আফরিনের কথায় অস্বাভাবিক কিছু অবশ্যই থাকবে। আর সে খপ করে হাতেনাতে ধরে ফেলবে তাদেরকে। অথচ নিনাদ তো কথাই বলল না। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল গটাগট হেঁটে। তিতিক্ষা হঠাৎ ভাবে, ব্যাপার টা এমন নয় তো, যে তাকে দেখেই নিনাদ এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততা দেখাল! সে-ই তো ওর স্বভাব। নইলে কি আর ভার্সিটিতে শ’খানেক ললনা সামলাতে পারে একাই?
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। তিতিক্ষা, তিহা দুজনেই চিন্তান্বিত। এই বৃষ্টি না থামলে তারা আজ ফিরবে কি করে! এদিকে সন্ধ্যে হয়ে এল। বাবা বাড়িতে একা আছেন। তিহা, তিতিক্ষা, ছোটন এই তিনটি প্রাণীর চিন্তান্বিত মুখের দিকে চেয়ে খানিক করুণা করেও বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখাল না। তিতিক্ষা ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল। একে তো বাবার চিন্তা তার ওপর বিকেলের সেই ব্যাপার টার পর থেকেই তার মন কেমন বিষিয়ে উঠেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরার কথাও ভাবল দুএকবার! সন্ধ্যার প্রায় এক প্রহর কেটে যাবার পর অর্থাৎ রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি তার গতিতে কিছুটা লাগাম টানল। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর আবার ছুটির দিন। সেজন্যই বোধহয় রাস্তাঘাট অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা ছিল। নিনাদ তাদের একা ছাড়তে পারল না এই অবস্থা দেখে। একটা ক্যাব ডেকে এনে সে নিজেও উঠে গেল তাদের সাথে।
বাড়ির সামনে ক্যাব থামতেই সবার আগে তিতিক্ষা বেরিয়ে বৃষ্টির মাঝেই গটাগট হেঁটে ভেতরে চলে গেল। পেছন ফিরল না একবারও। ঘরে এসেই দ্বোর বন্ধ করল সে।
তিহা একপ্রকার জোর করেই নিনাদ কে নিয়ে এল ভেতরে। সেই ভিজেছে সবচেয়ে বেশি। ক্যাবের খোঁজে তখন রাস্তায় নামতে হয়েছিল তাকে।
তিতিক্ষার ঘরের সামনে এসে বিরক্তি মেশানো স্বরে ব্যাস্ত হয়ে তিহা বলল,’এখন দরজা বন্ধ করলি কেন আবার? ছেলেটা ভেজা গায়ে বাইরের ঘরে বসে আছে। গামছা-টামছা কিছু একটা দে। এদিকে ছোটনের মাথাও ভিজে গেছে। আজই না আবার জ্বরে পড়ে। ওর বাবা আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে জানলে….।আমি যাই ওর মাথা মুছি গিয়ে। ‘
তিতিক্ষা বাধ্য হয়ে পানসে মুখে দরজা খুলল। দেয়ালের এপাশ থেকেই তোয়ালেটা ছুড়ে মারল নিনাদের সামনের সোফায়। সাথে সাথে ঘুরে হাটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলা ধরিয়ে কেতলিতে পানি বসাল চায়ের জন্য।
নিনাদ বসার ঘরে একাই বসে ছিল। তার চুল, দাড়ি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পড়নের সাদা পাঞ্জাবি টাও ভিজতে বাকি নেই। এই ভিজে জবজবে শরীরে অন্যের বাড়িতে, অন্যের সোফায় বসতে খারাপ লাগে। কিন্তু না বসে উপায়ও নেই। নাহয় এ নিয়েও তিহা ঠিক ঝগড়া বাঁধাবে তার সাথে। নিনাদ যখন ভিজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে এসব ভাবছিল তখনই আচমকা তোয়ালেটা তার সামনের সোফায় এসে পড়ে। নিনাদ একমুহূর্তের জন্য ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। তারপর বুঝল এটা ছোট গিন্নির কাজ।
মাথা মুছতে মুছতেই নিনাদের নাকে এসে লাগল দার্জিলিং থেকে আনানো প্রকট সুঘ্রাণ বিশিষ্ট চা পাতার গন্ধ। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ যেন সেই ঘ্রাণকে আরও প্রবল করে তুলছে। এই চা-পাতার ঘ্রাণ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চামচ নাড়ানোর ক্ষীণ আওয়াজ, ঘরের থমকে থাকা আবহাওয়া নিনাদকে বারবার এখানে আসতে বাধ্য করে। তার ওই নির্জন কুটিরে তো এমন সুখ নেই! কিন্তু কিসেরই বা তার অভাব? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ক্ষনে ক্ষনে নিনাদের কানে এসে ঠেকে। সে হল ‘মানুষের অভাব’। তার ঘরে মানুষ নেই। এমন কেউ নেই যে দিনভর হেঁটে বেড়াবে চারিদিক জুরে, রাগ করে রান্নাঘরে ধুপ ধাপ আওয়াজ তুলে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করবে সময়ে অসময়ে, এমন বৃষ্টির দিনে এভাবেই দার্জিলিং টি বানাবে, চামচের টুংটাং শব্দ তুলে বাড়িঘর মুখরিত করবে। নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।
তিতিক্ষাদের ওবাড়ি থেকে আসার দুদিন পর একরাতে মারুফ সাহেব মেয়েকে ডেকে পাঠালেন কথা বলার জন্য। ঘরের মানুষের গোপন বৈঠকও বলা যায়। যতই হোক তিহা এখন বিবাহিত। এবাড়িতে সে মেহমান। তাই সব বিষয়ে তাকে জরানো ঠিক নয়।
রওশানের মতো মারুফ সাহেবও নিনাদে মুগ্ধ ছিলেন। বাবা মা হারা ছেলে বলে খানিক করুণাও এসে মিশেছিল সেই মুগ্ধতার সাথে। তিনি আরামকেদারায় শুয়ে এক হাতের ওপর অন্য হার রেখে গুনগুন করে কিসব ভাবতে ভাবতে মেয়েকে হঠাৎ একটা প্রস্তাব করলেন। ‘তিতি, নিনাদের ফুফু শুনলাম তোমাদের খুব যত্ন করে খাইয়েছেন সেদিন। তিহার সাথে নাকি খুব ভাব। এযুগে আজকাল এতটা কে করে বল?’
তিতিক্ষা বাবার পাশে বিছানায় বসে গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু’
মারুফ সাহেব গুনগুন করে হাত নাড়াতে নাড়াতে ফের বললেন, ‘ নিনাদও চলে যাচ্ছে। ছেলেটাকেও তো একদিন এনে ভালো মন্দ খাওয়ানো দরকার। ওদের বরং দাওয়াত করে দিই আসার জন্য। কি বল?’
তিতিক্ষা সহসা মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। মুখ শক্ত করে মনে মনে বেজায় চটে গিয়ে বলল,’আবার সেই দাওয়াত! আমি মরে যাই, মরে যাই আমি!’
মারুফ সাহেব মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বললেন,’কি হল তিতি! করে দেই দাওয়াত। কি বল?’
-‘হু, করো দাওয়াত। ‘
-‘নিনাদের ফুফু। ভদ্রমহিলা প্রথমবার আসবেন আমাদের বাড়িতে। দেখো যত্ন আত্তির ত্রুটি যেন না হয়। নিনাদও তো চলে যাবে বাইরে। সেখানে কি খায় না খায়। ওর যা যা পছন্দ সব জেনে নিয়ে তারপর রান্না করো। কেমন?’
-‘হু’
-‘আসতে বলি কবে বলত? পরশু? ‘
-‘তোমার যেদিন ইচ্ছে। ‘ হঠাৎ সাদা হয়ে ওঠা মুখ নাড়িয়ে মিনমিনে স্বরে তিতিক্ষা বলে। তারপর আচমকা উঠে পা বাড়ায় রান্নাঘরের দিকে। চাপা স্বরে বলে, ‘তুমি বসো বাবা। আমি চা নিয়ে আসছি।’
চলবে….
★অদ্রিজা আহসান