#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৭|
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে বলা হয় প্রেমের শহর। এ শহরে ল্যালা নামক এক প্রণয়ীর বাস। বয়স বত্রিশ। সুন্দরী, বোকা, স্মার্ট শ্বেতাঙ্গ রমণী সে। বাবা, মা কেউ বেঁচে নেই৷ দু’বার বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। দূর্ভাগ্যবশত সম্পর্কগুলো টেকেনি। বর্তমানে সিঙ্গেল জীবনযাপন করছে৷ বাবা, মায়ের বিজনেস বড়ো ভাই আর বোন দেখে। সে তার ছন্নছাড়া জীবনটুকু নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত৷ নিজেকে একজন ইউটিউব ব্লগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ফ্যানফলোয়ার ছড়িয়ে গেছে লাখের ঘরে। এছাড়া গত এক বছর ধরে খুঁজে চলেছে ‘অ্যা ম্যান উইথ অ্যা বিউটিফুল হার্ট।’ প্রেমের শহরের মেয়ে সে। মনে প্রাণে লালন করে প্রেমানুভূতিকে। তাই একজন যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে চলেছে নিজের সবটুকু প্রণয় ঢেলে দেয়ার জন্য। সে ধারণা করে তার জন্য বিধাতা যাকে ফিক্সড করে রেখেছে এখন পর্যন্ত সেই সুপুরুষের সঙ্গে তার দেখাই হয়নি৷ ইতিপূর্বে যে দুজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল ওরা নেহাতই দু’টো এক্সিডেন্ট। আর এক্সিডেন্ট নয়৷ এবার সে বেশ সচেতন। প্রেম করলে রয়েসয়ে করবে। বিয়েতে জড়ালেও বুঝেশুনে জড়াবে৷ লোকে প্রথম প্রেম নিয়ে আগ্রাসি থাকলেও সে আগ্রাসি তার শেষ প্রেম নিয়ে।
হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যামো রয়েছে ল্যালার। দেড় মাস আগে মায়ের বান্ধবী যাকে সে লিটল মম বলে ডাকে। তার বাসা জেনেভাতে এসেছিল। তখনি পরিচয় হয় নামীর সঙ্গে। অ্যালেনের মা আর ল্যালার মা দু’জন খুব ভালো বন্ধু ছিলেন৷ মায়ের মৃত্যুর পর লিটল মমের কাছে মায়ের মতো শান্তি পায় ল্যালা। সেই সুবাদেই জেনেভায় এসে নামীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।
নামী ল্যালাকে লায়লা নামে ডাকে। ল্যালা যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে লাইফ পার্টনার খুঁজে চলেছে। এ নিয়ে পরিবার, বন্ধু, বান্ধব তার সঙ্গে হাসি, ঠাট্টা করলেও নামী এসব করে না। বরং সে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে, ” আমার দৃঢ় বিশ্বাস লায়লা, তোমার মতো সুন্দর মনের মেয়ের জীবনে একজন পারফেক্ট ম্যান আসবে৷ আর তোমাদের প্রেম লায়লা, মজনুর থেকেও গভীর হবে। ” বাংলা ভাষা জানে না ল্যালা। তাই ওর সঙ্গে ইংরেজিতেই বাক্য বিনিময় করে নামী।
গতরাতে সৌধ, সুহাস ফিরে যাওয়ার পর কিছুতেই নামীর ঘুম আসছিল না। ঘুমুতে ঘুমুতে শেষ রাত৷ চোখটা যখন লেগে এসেছে মাত্র। তক্ষুনি ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ল্যালার নাম। কল রিসিভ করতেই ল্যালা জানায়, সে গতকাল জেনেভাতে এসেছে। এখন আসছে তাদের বাসায়। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। ল্যালার স্বভাব সম্পর্কে মোটামুটি জানে নামী৷ তাই হুট করে কোনোকিছু না জানিয়ে আসাতে অবাক হলো না। অ্যালেন বা তার মা বোধহয় জানেই না৷ ল্যালা আসছে। জানলে খুশিই হবে৷ শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছিল। তবু উঠল সে। গায়ে চাদর জড়িয়ে তাকাল সুহৃদের পানে। ছেলেটার ওঠার সময় হয়ে এসেছে।
উঠে যদি তাকে না পায় তবে কান্নাকাটি করবে৷
সুহৃদের সঙ্গে তার কিছু মিল, অমিল রয়েছে। সে মিষ্টি পছন্দ করে না৷ সুহৃদও মিষ্টি খায় না৷ আবার সে একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে৷ কিন্তু সুহৃদ একা থাকতে মোটেই পছন্দ করে না৷ যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণ একা থাকলেও ঘুম ভাঙার পর তার সঙ্গে একজন না একজন থাকা চাই। খুব বেশি কাঁদে না সুহৃদ। সব সময় মুখে হাসি লেপ্টেই থাকে৷ ঠিক বাবার মতো। কাঁদে শুধু ঘুম থেকে ওঠার পর আশপাশে পরিচিত কোনো মুখ না দেখলে। সুহাসও এরকম। ছোটো থেকেও বন্ধুবৎসল। একা থাকা, চুপচাপ থাকা ওর স্বভাবে নেই৷ মা, বাবা সবসময় কাছে না থাকলেও বোন আর বন্ধু, বান্ধব নিয়ে হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়ে ওঠেছে। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নামী৷ বেঘোরে ঘুমানো বাচ্চাটাকে আর তুলল না৷ নিঃশব্দে পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ি পেরুতে পেরুতেই শুনতে পেল কলিং বেল বাজছে। এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে ল্যালা! মাত্রই তো কথা হলো। বলল, আধঘন্টা লাগবে। সে ভেবেছিল নিচে এসে এক মগ কফি খেতে খেতে অপেক্ষা করবে। ভ্রু যুগল কুঁচকেই সদর দরজার দিকে এগুলো সে।
হাড় কাঁপানো শীত। জেনেভা শহরের শীতার্ত ভোর৷ চারপাশ সাদা তুলোর মতো বরফে ঢেকে গেছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোর রাতে মনকে আর মানাতে পারেনি সুহাস৷ ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখল। বুকে জড়িয়ে আদর করল। কত হাসি, কত খেলার সঙ্গী হলো৷ অথচ ছেলের মা? তার সুহাসিনী। সে দেখা দিল না৷ না চোখের তৃষ্ণা আর না হৃদয়ের। কোনোটিই মিটল না। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এ শহরে এসেও যদি মানুষটার দেখা না পায়৷ তবে মন, মস্তিষ্ক ঠিক থাকে? থাকে না৷ তাই তো উন্মাদগ্রস্ত হয়ে বউ আর ছেলের জন্য নিয়ে আসা দুটো লাগেজ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে। সৌধকে ডেকে আর বিরক্ত করেনি। এমনিতেই সৌধ তার জন্য অনেক সেক্রিফাইস করেছে। এতকিছুর পর শান্তিতে একটু ঘুমাচ্ছে। এটা আর নষ্ট করতে মন সায় দেয়নি৷ তাই একা একাই চলে এসেছে অ্যালেনের বাড়িতে৷ বউ, বাচ্চার কাছে। ছোটো ছোটো বরফে গাড়িটা ঢেকে গেছে প্রায়। ডোর খুলে নেমে দাঁড়াতেই পরনে কালো রঙের হুডি ধবধবে সাদা বরফ বৃষ্টিতে মেখে যায়। ত্বরান্বিত হয়ে লাগেজ দু’টো বের করে৷ এরপর গাড়ি লক করে লাগেজ দু’টো হাতে নিয়ে ছুটে চলে যায় বাড়ির সামনে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে চাপতে থাকে কলিং বেল।
সদ্য ঘুম ভেঙে খোলা, এলোমেলো চুলে সদর দরজা খুলল নামী। দু’হাতে লাগেজ। লম্বাটে দেহে কালো হুডি পরা মানুষটা৷ লাগেজ সহ শরীর জুড়ে বরফে ছেয়ে গেছে৷ ফর্সা মুখটা তীব্র শীতে রক্তশূণ্য, ফ্যাকাসে৷ ধূসর বর্ণীয় দৃষ্টিজোড়া নীল, নীল ঠেকছে৷ নিমেষে বুকের গহীন বনে চিড়িক দিয়ে উঠল নামীর৷ সর্বাঙ্গে বেয়ে গেল এক গুচ্ছ হিম বাতাস। হৃৎস্পন্দনের গতি বুঝিয়ে দিল, সম্মুখের মানুষটার প্রতি তার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। কোমল হৃদয়টিকে ঘিরে রাখা শক্ত খোলস ম্রিয়মাণ হলো। চোখ দু’টি ভরে উঠল নোনাপানিতে। স্তব্ধ চোখ, বাকরুদ্ধ মুখ আর নিশ্চল দেহে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল অভিমানী নারীটি৷
কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শনে হৃৎস্পন্দন থমকে গেছে সুহাসের। সেই চেনা মুখ, অভিমানে ঘেরা পলকহীন, ছলছল দৃষ্টিদ্বয়। ভোমর কালো চুল। আপাদমস্তক নামীতে দৃষ্টি বুলালো সুহাস। যে নামী তাকে ছেড়ে এসেছে সেই নামীর মাঝে আজ এই নামীর অনেক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ভীড়ে চোখ দু’টিই কেবল জানান দিল,
‘সুহাস তোর সুহাসিনী আজো তোকেই ভালোবাসে। ‘
আচমকা ধূসর মণিযুক্ত ছোটো ছোটো চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে উঠল। নিষ্পলক তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস। ওষ্ঠ কোণে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে, কান্নাহাসির দাবানলে চাপা উত্তেজনা নিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল ,
‘ সুহাসিনী, শীতার্ত ভোরে আজ এ অনাকাঙ্ক্ষিত দেখার সুখে যদি মরণও হয় তবে তাই সই। ‘
আকস্মিক কাঁপা ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলা সে বাক্যটি শুনে নামীর মন আকাশে জমে থাকা মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। যা দেখে ত্বরিত নিজের দু’হাতে থাকা লাগেজ দু’টো নিচে রেখে এগিয়ে এলো সুহাস৷ যেন এক্ষুনি বুকে টেনে উষ্ণ আলিঙ্গনে ভরিয়ে তুলবে প্রিয়তমাকে। সুহাসের সেই উদ্দেশ্যকে সফল হতে দিল না নামী। আর না এক মুহুর্ত ওর সম্মুখে দাঁড়াল। সুহাস তার কাছে যাওয়ার পূর্বেই সে এক ছুটে চলে গেল উপরে। নিজের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল, সুহৃদ ওঠে পড়েছে৷ কান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। নামী তাকে কাঁদতে সুযোগ দিল না৷ কারণ এখন সে কাঁদবে, খুব কাঁদবে। যে কান্না কাউকে দেখানো যায় না৷ যে দুর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করা যায় না৷ যে অনুভূতি একান্তই তার, শুধুমাত্র নিজের।
দরজা বন্ধ করে ছুটে এসে ছেলেকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল নামী। ভেতরটা শেষ হয়ে গেল ভেঙেচুরে। ঠিক এ কারণেই সে এতগুলো দিন দূরে সরে আছে৷ দিনশেষে সেও তো নারী৷ তার ভেতরেও একটা নরম মন আছে। ওই মানুষটা যত ভুল করুক। অন্যায় করুক। বেলা শেষে যখন সামনে দাঁড়ায়। ইনোসেন্ট মুখটা নিয়ে ভালোবাসে, নরম সুরে কথা বলে গলে যায় সে৷ নিজেকে কেন যেন আর আটকাতেই পারে না। তাই তো সেদিনের পর আর মুখোমুখি হতে চায়নি৷ ওর করা ভুলের শাস্তি গুলো সামনে থেকে দিতে পারবে না বলেই দূরে চলে এসেছিল৷ ওর ভুলের শাস্তি দিয়েছে। বুঝতে পেরেছে নিজের ভুলটাও। তবু যে প্রগাঢ় অভিমান হৃদয়ে জমেছে তা থেকে বেরুতে পারছে না৷ অনেকটা সময় সুহৃদকে বুকে জড়িয়ে কাঁদল৷ একদম মন খুলে কাঁদল। যখন নিজেকে একটু হালকা অনুভব করল সম্বিৎ ফিরল তক্ষুনি। অকস্মাৎ খেয়াল হলো, সুহাস এসেছে। সুহৃদের বাবা এসেছে। শীতে কেমন কাঁপছিল। রক্তশূন্য হয়েছিল চোখ, মুখ। সে কি এতটাই নিষ্ঠুর? মানুষটার অমন অবস্থা দেখেও অবজ্ঞা করে চলে এলো। অতিরিক্ত শীতে অসুস্থ হয়ে পড়ে সুহাস৷ কোল্ড এলার্জি আছে! ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠল। ত্বরিত সুহৃদকে ফ্রেশ করিয়ে ভাবল নিচে যাবে৷ মুখোমুখি যখন হয়েই গেছে। আর লুকোচুরি করে কী হবে?
.
.
এক টুকরো শীতল স্থিরতা এসেছে সুহাসের মনে। এক ঝলক নামীকে দেখতে পেরেই মন হয়ে গেছে শান্ত, সুস্থির। এই যে নামী অবজ্ঞা করে চলে গেল। এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সুহাস। গতকাল নামীর সাথে হওয়া কথোপকথনের সবটাই সৌধর মুখে শুনেছে সে। এরপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দাঁতে দাঁত পিষে, বুকে তীব্র যন্ত্রণা পুষেই অপেক্ষা করবে। তার সুহাসিনীর অভিমান ভেঙে পড়ার অপেক্ষা। দৃঢ় বিশ্বাস। তার সুহৃদের মা ঠিক ক্ষমা করবে তাকে। কিছু দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়, কিছু দূরত্ব মানুষকে শুধরাতে সাহায্য করে। আবার কিছু দূরত্ব শুষে নেয় আমাদের মনের সকল ভুল, পাপ, বিষপূর্ণ অনুভূতি।
ড্রয়িংরুমের সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে সুহাস৷ গায়ে পরা নরম বরফ টুকরো গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে মাত্রই বসেছে। শীত লাগছে ভীষণ। মিস করছে অতীতের বহু শীতার্ত রাত। যে রাত গুলোয় নামীর নরম দেহের উষ্ণ আলিঙ্গনে কাটিয়েছে সে। কখনো কখনো অতীতের স্মৃতি যেমন সুমধুর হয় তেমনি আবার তিক্ততারও হয়৷ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল সুহাস। সে পারত নামীর পেছনে ছুটে যেতে। জোর করে মেয়েটাকে কাছে টেনে বুকে জড়াতে। নিজের এই জোরটাকে খুব কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। যে মেয়ে এতগুলো মাস একা কাটাল তাকে ছাড়া। তাকে আজো একাই ছেড়ে দিল। শুধু একবার নিজে থেকে কাছে আসুক। ধরা দিক একটিবার৷ এরপর আর কক্ষনো একলা ছাড়বে না। কক্ষনো না।
দু’হাতের তালু ঘষে ঘষে দু’গালে ছোঁয়াচ্ছিল সুহাস। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছিল আর ছাড়ছিল৷ কী করবে না করবে বুঝতে পারছে না৷ এ বাড়িতে আর কাউকেই দেখছে না৷ ঘুম থেকে উঠেনি বোধহয়। সুহৃদ কী উঠেছে? নামী কি আর তার সামনে আসবে? যদি না আসে! সুহৃদকে কাছে পেতে মন মরিয়া হয়ে উঠল। তড়পাতে লাগল পিতৃ সত্তা। এরই মধ্যে বেজে উঠল কলিং বেল। ফলে কিঞ্চিৎ চমকাল সুহাস। এ বাড়িতে এই ভোরবেলা কে এলো আবার? তখন দরজা লাগিয়ে এসেই বসেছিল সে। তাই এখন আবার উঠে গেল দরজা খুলতে। ল্যালা ভেবেছিল দরজাটা নামী খুলবে। এত্ত সকালে আর কারো দরজা খোলার কথা নয়৷ কিন্তু দরজা খুলতে ধারণা পাল্টে গেল। নামী নয়। একজন অচেনা সুদর্শন যুবক দরজা খুলেছে। নিমেষে চোখ দু’টো কপালে উঠে গেল ল্যালার। আচমকা ইংরেজিতে প্রশ্ন করেও বসল,
‘ কে হে যুবক? ‘
সাতসকালে কলা গাছের মতো লম্বা একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর দর্শন পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল সুহাসের। কোনোক্রমে ইংলিশে জবাব দিল,
‘ আমি এ বাড়ির অতিথি। আপনি? ‘
আকস্মিক মনের ভেতর লাড্ডু ফুটল ল্যালার। গতকাল সে জেনেভাতে এসেছে৷ তার মামাত বোন জামাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে মিটও করেছে। দূর্ভাগ্যবশত ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি। অপছন্দের কারণ ছেলেটার বয়স বিয়াল্লিশ। আর ওজন বেশি। ব্লাড গ্রুপও তার সঙ্গে মিলে গেছে। ফলাফল রিজেক্ট করে দিয়েছে। এখন লিটল মমের বাসায় এসে অল্পবয়েসী সুদর্শন এই যুবকটিকে দেখে এক পলকেই মনে ধরে গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে হাত বাড়াল ল্যালা। বলল,
‘ হাই, আমি ল্যালা। ‘
সুহাস হাত বাড়াতে গিয়েও বাড়াল না৷ এমনিতেই রিমান্ডে আছে সে। নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে আর জড়ানো যাবে না৷ দমে গেল মুহুর্তে। এক ঢোক গিলে সরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমি সুহাস খন্দকার। পেশায় একজন ডক্টর। ‘
‘ ওহ মাই গড! ‘
ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে চ্যাঁচিয়ে উঠল ল্যালা। সুহাস দরজা আঁটকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ল্যালার পরনে জিন্সপ্যান্ট আর কালো রঙের লেডিস ব্লেজার৷ ভেতরে সাদা জাতীয় কিছু পরেছে। হতে পারে টিশার্ট বা শার্ট৷ এমনিতেই উচ্চতা বেশি এর ওপর পরেছে চার ইঞ্চি মতোন উঁচু জুতা৷ উঁচু জুতা পরাতে উচ্চতায় প্রায় সুহাসের সমানই লাগছে। সুহাস আপাদমস্তক ল্যালাকে দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল। যেন সে আশা করছে নামী আসবে বা আসতে পারে৷ আকস্মিক ল্যালা বলল,
‘ মিস্টার সুহাস, আসুন বসুন এখানে আমরা পরিচিত হই। ‘
সুহাসকে কথাটা বলেই গলার স্বর আরো উঁচু করে নামীকে দু’বার ডাকল। সহসা নামীর নাম নেয়াতে ঘাড় বাঁকিয়ে ফের ল্যালার দিকে তাকাল সুহাস। মেয়েটা নামীর পরিচিত! সে তাকালে ল্যালাও তাকাল। মুচকি হেসে ডাকল কাছে গিয়ে বসতে৷ সুহাস কাছে গেল। বসল পাশে। টুকটাক পরিচয় হলো দুজনার। সুহাস বাংলাদেশী শুনে ভীষণ খুশি হলো ল্যালা। মুসলিম শুনে একটু দুঃখও পেল। কারণ সে খ্রিস্টান। পরোক্ষণেই ভাবল, ‘ ভালোবাসা, প্রণয়ের সম্পর্কে ধর্ম বাঁধা হতে পারে না৷ ‘ এ ভাবনা থেকেও গড়গড় করে নিজের ব্যাপারে অনেক কিছু বলে ফেলল। বয়স বলতেও ভুল করল না৷ সবশেষে যখন বলল, সে দীর্ঘদিন যাবৎ বিয়ে করার জন্য পাত্র খুঁজছে। তক্ষুনি থতমত খেয়ে গেল সুহাস৷ ভুত দেখার মতো তাকাল ল্যালার পানে৷ আমতা আমতা করে বলল,
‘ আপনি আমার সিনিয়র দিদি। ‘
ল্যালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। দিদি শব্দটা বেদনাদায়ক লাগল খুব৷ আপাদমস্তক সুহাসকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ বয়স কত? ‘
‘ একত্রিশ প্লাস। ‘
হেসে ফেলল ল্যালা৷ বলল,
‘ কয়েক মাসের ব্যাপার তো নো প্রবলেম। ম্যানেজ করে নিব। ‘
সুহাসের এবার গরম লাগতে শুরু করল। কান দিয়ে উষ্ণ হাওয়া বেরুচ্ছে৷ এই মহিলা তো তার থেকেও ফার্স্ট। বিশ মিনিটের আলাপে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল৷ এদিকে তার আমানদস্ত, বাঘিনী একটা বউ আছে। কিউট একটা বেবি আছে৷ রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল সুহাস। ল্যালাকে বলতে উদ্যত হলো,
‘ সরি দিদি। আই এম ম্যারেড, এণ্ড আই হেভ অ্যা বিউটিফুল বেবি। ‘
কিন্তু বলতে পারল না। তার পূর্বেই সুহৃদকে কোলে করে নামী নিচে নেমে এলো। ল্যালা ওকে দেখেই লাফিয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল নামীকে। কুশল বিনিময় করে এরপর সুহৃদকে কোলে তুলে আদর করতে লাগল। নামী এক পলক সুহাসের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ল্যালার আনন্দ, উল্লাস কমে এলে হঠাৎ নামীকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে এক দমে বলল,
‘ নামী ওই ছেলেটা বাংলাদেশী! অ্যালেনের বাবার দিকের আত্মীয় রাইট? ট্রাস্ট মি ক্রাশ খেয়ে গেছি সিস৷ তুমি জানো গতকাল আমি এক পাত্র দেখতে এসেছিলাম। পছন্দ হয়নি রিজেক্ট করে দিয়েছি। ভাগ্যিস ওটা পছন্দ হয়নি৷ নয়তো আজ এতবড় চমক পেতাম না। সো সুইট দেখতে তাই না? বুঝার উপায় নেই সে বাংলাদেশী। আমি অলরেডি প্রপোজ করে দিয়েছি বুঝলে। বাকিটা প্লিজ তুমি বুঝে নাও৷ কথাবার্তা বলে তোমার এই বান্ধবীটির ব্যবস্থা করে দাও৷ বিধাতা যা করে ভালোর জন্যই করে বলো। কে জানত শেষমেশ আমার শশুর বাড়ি হবে বাংলাদেশ। উফফ, কী যে খুশি লাগছে! ‘
খুশি, উত্তেজনায় তাল হারিয়ে ফেলেছে ল্যালা। একদমে কথাগুলো বলে নামীকে কিছু বলার সুযোগ দিল না৷ ত্বরিত সুহৃদকে কোলে নিয়েই সুহাসের কাছে চলে গেল৷ এদিকে নামী বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। স্তব্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সে! কিয়ৎকাল সময় কাগল বিস্ময় কাটাতে। এরপর চোখ বুজে লম্বা একটি নিঃশ্বাস ফেলল। ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিল শুঁকিয়ে উঠা গলাটা। বারকয়েক পলক ফেলে তাকাল ড্রয়িংরুমে। পাশাপাশি বসে আছে ল্যালা, সুহাস৷ মাঝখানে সুহৃদ। দেখা মাত্র চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ল্যালাকে সে বন্ধু মানে। তাই বলে এই নয় সে সীমা লঙ্ঘন করবে। তীব্র ক্ষোভ নিয়েই এক পা বাড়ায় নামী৷ পরপরই আবার থেমে যায়৷ মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে। ভাবে, ল্যালা হয়তো জানে না সুহাস তার হাজব্যন্ড, সুহৃদের বাবা। আর ওই বেআক্কলটাও নিশ্চয়ই এই পরিচয় এখন অব্দি দেয় নি। দেবে কী করে? মেয়েদের সাথে ইটিশপিটিশ করতে তো ভালো লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করল নামী৷ এরপর মুখটা অত্যন্ত গম্ভীর করে উপস্থিত হলো সুহাস, ল্যালার সম্মুখে। সুহাস আশা করেনি নামী এভাবে, এত সহজে, স্বেচ্ছায় তার সামনে আসবে। তাই হকচকিয়ে গেল। ল্যালার চোখ দু’টো চকচক করছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সুহাসের পানে। নামী বুদ্ধি করে মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে ল্যালাকে বলে উঠল,
‘ ল্যালা, উনি সুহৃদের বাবা। ডক্টর সুহাস খন্দকার! ‘
এহেন বাক্য শুনে সহসা চমকে উঠল ল্যালা। হৃদয় গভীরে বজ্রপাত হলো বার কয়েক। থতমত খাওয়া চোখে একবার তাকাল নামীর পানে। আরেকবার তাকাল সুহাসের পানে। সুহাসের চোখ দু’টো নামীর গম্ভীর চোখ আর কৃত্রিম হাসি দেয়া মুখে স্থির৷ কর্ণে বেজে চলেছে একটিই বাক্য,
‘ ল্যালা উনি সুহৃদের বাবা। ডক্টর সুহাস খন্দকার। ‘
নিমেষে ল্যালার সমস্ত উত্তেজনা মিলিয়ে গেল। অপরাধী মুখে তাকাল নামীর পানে। নামী আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘ আমরা সেপারেশনে আছি৷ যদি উনি চায় তাহলে তোমরা সম্পর্কে যেতেই পারো। ‘
ল্যালা কিছু বুঝে ওঠতে পারল না৷ এদিকে কথা শুনে সুহাস সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ নামীর দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ সুহৃদের বাবা সুহৃদের মাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর কথা ভাবতে পারে না। ‘
বাংলায় বলাতে ল্যালা সুহৃদ ছাড়া কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু নামী তাচ্ছিল্য হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে ভেঙাল খুব৷ সুহাস টের পেয়ে দম্ভ ভরে বলল,
‘ আমার জীবনে সুহৃদের মা’ই শেষ নারী। ‘
ল্যালা কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ শেষে কাঁদো কাঁদো মুখ করে সরি বলল নামী, সুহাস উভয়কে৷ অনুভব করল তার অতিরিক্ত পাগলামি, অধৈর্যতার ফলেই অঘটনটা ঘটে গেল ছিঃ!
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
Baki porbo kobe pabo