#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৬৮|
পরিস্থিতি গুমোট। রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে সৌধ৷ ওর দৃঢ় চোয়াল আরো বেশি দৃঢ় হলো। পেশিবহুল দু’টো হাত চনমনে। যা তীব্র কষ্টে মুঠোবন্দি করল৷ ফুলে ফেঁপে ওঠল হাতের প্রতিটি নিল রগ৷ ঝুমায়নার দেহশ্রী কেঁপে ওঠল এ দৃশ্য দেখে। তীব্র ভয়ে সংকীর্ণ হয়ে গেল মুখশ্রী। অনুভব করল কণ্ঠনালী নীরস হয়ে আসছে। সৌধ সম্পর্কে কম ধারণা নেই ঝুমায়নার। তার স্বামী সৌরভ ছোটো ভাইকে প্রচণ্ড স্নেহ করে। বরাবরই ভাইকে নিয়ে গর্ব করতে দেখেছে সৌরভকে। শুনেছিল, খুব ছোটোবেলায় সৌধকে তার এক স্কুল ফ্রেন্ড গালে ঘুষি মেরেছিল। সৌধ বাড়িতে এসে কাউকে জানায়নি৷ কারণ এক টিচার তার বিচার করেছে৷ তবু সৌরভ অন্য একজন থেকে এ খবর পেয়ে সেই ফ্রেন্ডকে যে হাতে ঘুষি দিয়েছিল সে হাতে গোটা, দশেক কঞ্চি আঘাত করে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সুজা চৌধুরীর বড়ো ছেলে বলে সৌরভ ছোটো থেকেই আলাদা দাপট নিয়ে চলে। ভাই, বোনকে ভীষণ ভালোও বাসে। সবচেয়ে বেশি দুর্বল ভাইয়ের প্রতি। কোনো একদিন কথার ছলে শুনেছিল, ভাই যদি তার প্রাণটুকুও আবদার করে সেটুকু দিতেও দ্বিধা করবে না৷ যদিও কথাটা গভীরভাবে ভালোবেসে আবেগান্বিত হয়ে বলে থাকে৷ তবু ক’জন পারে বড়ো মুখ করে এতটুকু বলতে? ঢোক গিলে ঝুমায়না। সৌরভ তাকেও কম ভালোবাসে না৷ কিন্তু এ বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মতো সৌরভও অন্যায় সহ্য করতে পারে না। বাবার আদর্শে, চৌধুরী পরিবারের প্রতিটি নিয়মনীতি বুকে লালন করে বড়ো হয়েছে সৌরভ, সৌধ৷ আজ যা ঘটল এসব যদি সৌরভের কানে যায় তাকে আর আস্ত রাখবে না।
সৌধর বলিষ্ঠ হাত দু’টো কাঁপছে। যা সে সচেতনতার সাথে ধীরে ধীরে পিছনে নিয়ে নিল। এরপর বা হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জিটা প্রচণ্ড শক্ত করে চেপে ধরল। ঝুমায়নার নিঃশ্বাস আঁটকে গেল এটুকু দেখেই৷ সে টের পেল সৌধর তাকে মারতে ইচ্ছে করছে। শুধুমাত্র বাড়ির বউ, বড়ো ভাইয়ের বউ বলে নিজেকে তীব্র কষ্টে সামলে নিল। দু’ভাইয়ের অনেক স্বভাবই মিলে যায়। সৌরভ যখন প্রচণ্ড রেগে যায় দোষী ব্যক্তিকে মারতে হাত নিশপিশ করে৷ অথচ মারতে পারবে না এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে এভাবেই এক হাত দিয়ে অপর বেঁধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কানাডার বাসায় থাকাকালীন তাদের মধ্যে কঠিন ঝগড়া হয়েছিল। তার বড়ো ভাই এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে৷ ঘোষণা দিয়েছিল, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে৷ সেদিন বড়ো ভাইয়ের সামনে সৌরভ ঠিক এভাবে দাঁড়িয়েই তর্ক করেছিল। যাতে শুধু মুখ টুকুই চলে, হাত নয়। সিনিয়র সদস্যদের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম৷ জুনিয়র হলে হাতটাই বেশি চলে দু ভাইয়ের। রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল ঝুমায়না৷ কাঁপা গলায় কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ আকস্মিক পাশে দাঁড়ানো কান্নারত তাহানীর দিকে তাকিয়ে আদেশ করে,
‘ তাহানী, আম্মার কাছে যাও। ঘুমাও গিয়ে। ‘
মাথা নিচু করে চলে গেল তাহানী। ঝুমায়নার বুক ধক করে ওঠল। দু’পায়ের হাঁটু কাঁপতে শুরু করল সমান তালে। সৌধ তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। যে হাতে সিমরানের গালে কষিয়ে থা প্পড় দিয়েছে সে। সহসা গমগমে কণ্ঠে বলল,
‘ এ বাড়ির বউদের হাত এতবেশি লম্বা হতে নেই। কারণ বাড়ির পুরুষরা সে লম্বা হাত খাটো করে দেয়!’
চমকে ওঠল ঝুমায়না। নিজের দোষ স্বীকার করে আরো বড়ো বিপদে পড়ার ভয়ে বলল,
‘ তোমার বউ সুরকে ব্যথা দিয়েছে। আমি ওর কোলে দিতেই চাইনি৷ প্ল্যান করে সুরকে এ ঘরে নিয়ে এসে ব্যথা দিল। ‘
কান্নাধরা গলায় বলল ঝুমায়না। অবিশ্বাস, ক্রোধ মিশ্রিত স্বরে সৌধ বলল,
‘ আপনাকে ভাবি বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। এ বাড়ির কেউ মিথ্যা বলে না, আর না সহ্য করে। তাহানী যতটুকু বলেছে ততটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য।’
কেঁপে ওঠল ঝুমায়না৷ সৌধ কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে ওয়ার্নিং করে বলল,
‘ আমার সামনে থেকে দূর হন। আপনাকে আমার বা সিনুর ত্রিসীমানায়ও যেন না দেখি। ‘
সৌধ বাক্যটির সমাপ্তি দিতেই ঝুমায়না চলে যেতে উদ্যত হয়৷ তৎক্ষনাৎ আবার থেমে যায়। সৌধ তুড়ি বাজিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,
‘ আজ যা ঘটল আপনার থেকে এটা অকল্পনীয় ছিল। তবু যখন ঘটেছে এরজন্য সিনুকে অবশ্যই সরি বলবেন। ‘
বিস্ময় নিয়ে তাকাল ঝুমায়না। সে সিনুকে সরি বলবে? তার মানে বাড়ির সবাই জেনে যাবে এই ঘটনা! আর সৌরভ, তার কানে গেলে কী হবে? ঘামতে শুরু করে সে। ভয়ে ভয়ে সৌধকে বলে,
‘ প্লিজ সৌধ বিষয়টা জানাজানি করো না। ‘
ফিচেল হাসে সৌধ। সে মোটেও চায় না আজকের ঘটনা আর কেউ জানুক। ঝুমায়না এ বাড়ির বড়ো বউ৷ তার বিকৃত রূপ আর সিনুর অসম্মান কোনোটাই প্রকাশ পাক সে চায় না৷ তাই সীনা টান টান করে দাঁড়িয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে বলল,
‘ অকে, তাহলে এক্ষুনি গিয়ে সিনুকে সরি বলে বিদায় হন। ‘
ঝুমায়নার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল সে অসন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে গেল। এর একটুক্ষণ পরই আবার বেরিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। হয়তো দায়সারা ভাবে নিজের অহংবোধে আঘাত করে সরি বলেছে। মন থেকে যে বলেনি এতে কোনো সংশয় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। আকস্মিক স্মরণ হলো, সিমরানের কথা। সে কাকে, কোন বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে তার থেকে ভালো কেউ জানে না৷ ওই মেয়েটা কতটুকু সহ্য করতে পারে, কতটুকু নিতে পারে এ সম্পর্কে তীক্ষ্ণ ধারণা আছে সৌধর। তাই তো বুকের গভীরে মুচড়ে ওঠল আচমকা। তীব্র লজ্জায় দুমড়ে মুচড়ে গেল মন। সিনু তার বউ। যাকে বিয়ের তৃতীয় রাতে সমাজের নিম্নশ্রেণীর কিছু পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো ছিঃ! এই দায় আর কারো নয় সম্পূর্ণ সৌধ চৌধুরীর।
.
.
বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে ভাবতে পারেনি সৌধ। এমনিতেই দুঃশ্চিতার শেষ নেই৷ লম্বা একটি সময় নিজের জীবন নিয়ে ভোগান্তি পোহালো। অন্ধকার শেষে আলোর দেখা পেল, তুখোড় ঝড়, বৃষ্টি শেষে দেখা হলো ঝলমলে রোদের সঙ্গে। নিজের জীবন যখন একটু সুনিশ্চয়তা পেল তক্ষুনি শুরু হলো সুহাসের জীবনের টানাপোড়েন। এতক্ষণ সুহাসের সঙ্গেই ছিল সে। সোহান আংকেল নামীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছে না৷ মেইল করেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুক কোনোটাই বাদ রাখেনি। ভয় হচ্ছে এখন। নামীর মতো সেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিল না তো? সুহাসকে সান্ত্বনা দিয়ে, ভরসা জুগিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরল সে। এসেই আরেক দফা অশান্তির সম্মুখীন হলো৷ তার জীবনে এই অশান্তি টুকু ছিল অত্যন্ত লেইম৷ তপ্ত মেজাজে নিজের ঘরে প্রবেশ করল সৌধ। দেখতে পেল এক পাশে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরালেই চোখ পড়ল ফ্লোরে। সিমরানের ওড়না পড়ে আছে। বিছানার বালিশ দু’টোও পড়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। নিমেষে একবার চোখ বুঁজল সে। ঠিক কী ঘটতে পারে আঁচ করে ফেলল। ঝুমায়না ভাবির থেকে অকারণে, বিনাদোষে থা প্পড় খেয়ে দুঃখের পাশাপাশি নিশ্চয়ই মাথা গরম হয়েছে? তীব্র ক্রোধে জর্জরিত হয়ে সমস্ত ক্ষোভ ঢেলেছে এসবের ওপর। সবকিছুর ওপর রাগ ঝেড়ে বিছানায় বসে কাঁদছে সিমরান। সৌধর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ কিঞ্চিৎ ঠিক হলেও সিমরানকে কাঁদতে দেখে বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু হলো। ত্বরিত কাছে গিয়ে পাশে বসতেই বউ তার ফুঁসতে শুরু করল। কিছু বলবে বলবে ভাব৷ কিন্তু বলতে পারছে না৷ কান্নার হিড়িকে কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। কিয়ৎক্ষণ সময় নিল সৌধ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রক্তিম বর্ণীয় ডান গালটায়। কতখানি জোর খাঁটিয়ে চ ড়টা মে রেছে! ভেবেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল আবারো। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ। শুনতে পেল ফিকড়ে কাঁদতে কাঁদতে সিমরানের কণ্ঠস্বর,
‘ আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। কীভাবে গ্লাস পড়ে ভেঙেছে জানি না আমি। সুর কীভাবে ব্যথা পেল তাও দেখিনি৷ কান্না শুনে ছুটে এসে দেখি এই অবস্থা। আর ভাবি আমাকে মিথ্যা দোষ দিল! আমি সুরকে ভালোবেসেই কাছে এনেছিলাম। ‘
শেষ বাক্য দু’টো প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল সিমরান। কী ভয়ংকর দুঃখ পেয়েছে মেয়েটা! কী ভয়ানক রেগেও গেছে। স্বাভাবিক। ওর জায়গায় যে কেউ থাকলে রেগে যেত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌধ। তার পুরুষালি পোক্ত হাতটা বাড়িয়ে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিল সিনুর ডান গালে। টনটনে ব্যথায় পুরুষালি উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে ঠোঁট ভাঙিয়ে কাঁদতে লাগল সিমরান। সৌধ শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তাহানী বলেছে আমাকে। যদি ও নাও বলত, ঝুমায়না ভাবির কথা আমার বিশ্বাস হতো না। বিকজ, ঝুমায়না ভাবিকে চিনি মাত্র পাঁচ বছর, তোকে চিনি প্রায় পনেরো বছর৷ ডোন্ট অওরি, আই ট্রাস্ট ইউ। ‘
কান্নার বেগ কিছুটা কমলেও কিছুতেই ওই থাপ্প ড়টা ভুলতে পারল না সিমরান। কেন জানি প্রচণ্ড অভিমান হলো৷ কার ওপর হলো সে নিজেও জানে না। তাই নিজের মোবাইল খুঁজল। খুঁজে পেলে সুহাসের নাম্বার ডায়াল করতে উদ্যত হলে সৌধ কেঁড়ে নিল ফোনটা। বলল,
‘ উহুম, সুহাসকে কল করছিস কেন? ‘
দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে সিমরান বলল,
‘ আমি চলে যাব৷ থাকব না এ বাড়িতে। ‘
কথাটা বলেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল৷ চোখ, গাল, নাক, ঠোঁট সর্বত্রই ভয়াবহ লালচে হয়ে আছে। সৌধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। এরপর সিমরানের ফোন অফ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ধৈর্য সহকারে বলল,
‘ বাচ্চাদের মতো করিস না সিনু। সুহাসের মতো ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্তও নিস না। আমার কথা শোন, যা হয়েছে এরজন্য আমি সত্যি দুঃখীত! ‘
‘ ঐ মহিলার এতবড়ো সাহস কী করে হয় সৌধ ভাই?’
আকস্মিক চ্যাঁচিয়ে ওঠে সিমরান। চোখ বেয়ে পড়তে থাকে নোনাপানির ধারা৷ চমকে যায় সৌধ। সিনুর মুখের ভাষায় বিস্মিতও হয়। ফলে তার চোখ গরম হয় কিঞ্চিৎ। দৃঢ়, শীতল কণ্ঠে সতর্ক করে,
‘ মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ সিনু! উনি ভুল করেছে৷ অন্যায় করেছে। আমি এর প্রতিবাদ করেছি। উনার সঙ্গে যা বোঝাপড়া সব আমার হবে৷ তুই কিছু বলবি না৷ না উনার সামনে আর না আড়ালে। কারণ আমার বউকে এসব মানায় না। ‘
সহসা চুপ হয়ে গেল সিমরান। ক্রোধের বশে মাথা বিগড়ে গেছে তার৷ নিজেকে কেন জানি সামলাতে পারছে না৷ সৌধ ভাই এমন উগ্রতা পছন্দ করে না৷ জানে সে৷ তবু করে ফেলল৷ লজ্জায়, দুঃখে মাটির সঙ্গে যেন মিশে গেল মেয়েটা। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
‘ সরি। ‘
সৌধ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এবারে তার দৃষ্টি সহজ হলো। সিমরান কাঁদছে। এবার নীরবে অশ্রু ঝড়ছে তার৷ ঢোক গিলল সৌধ। চোখ বুঁজে নিজেকে শান্ত করে পুনরায় তাকাল সিনুর দিকে। হাত বাড়ালো। মাথায় আলতো বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ আমি নিজেও সরি সিনু৷ যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। কথা দিচ্ছি, এটাই প্রথম এটাই শেষ এ বাড়িতে তোকে আর অসম্মানিত হতে হবে না। যদি হতে হয় তবে সেদিনই এ বাড়িতে তোর আর আমার শেষ দিন৷ ‘
একটু থেমে আবারো বলল,
‘ আমার স্ত্রীর অসম্মান মানে আমারো অসম্মান সিনু৷ আর সৌধ চৌধুরী অপমানিত, অসম্মানিত স্থানে নিজের ছায়াও মাড়ায় না। ‘
শিউরে ওঠল সিমরান। চট করে মাথা তুলতেই ওর গাল বেয়ে পড়া অশ্রু গুলো মুছে দিল সৌধ। বলল,
‘ কাঁদিস না। আমি কেন জানি তোর কান্নাটা সহ্য করতে পারছি না৷ বিলিভ মি, ‘
আকস্মিক গলায় কান্না আঁটকে গেল সিমরানের৷ বিস্ময়াপন্ন দৃষ্টিতে, বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ নিয়ে তাকিয়ে রইল। সৌধ উঠে গিয়ে টিস্যু বক্স নিয়ে এসে বসল সম্মুখে। এরপর সযত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
‘ তুই আমার জীবনের সেই দ্যুতি সিনু। ঘন অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে থাকতে আচমকা যার দেখা পেয়েছি আমি। আমার সানশাইন রূপে ধরা দিয়েছিস তুই। ‘
থামল সৌধ। এরপর চোখের পানি মুছা শেষে মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে থাকা ছোটো-ছোটো চুলগুলো ঠিকঠাক করে কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
‘ আমার জীবনে দীর্ঘ বর্ষণ শেষে এক চিলতে ঝলমলে রোদ তুই। চৈত্রের খরা শেষে বৈশাখের অঝোরে বৃষ্টি তুই। যাই হয়ে যাক না কেন, আর কক্ষণো বলবি না, চলে যাবি৷ তোর শেষ ঠিকানা আমি৷ মহাপ্রলয় ঘটে গেলেও এই কথা যেন মুখ দিয়ে আর না বেরোয়৷ মনে থাকবে? ‘
মৃদু চমকে মাথা নাড়ল সিমরাম। অমোঘ এক ঘোরে চলে গেল যেন৷ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল সৌধর মুখপানে। সৌধ দেখল অশ্রুতে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া পাপড়িতে আবৃত কৃষ্ণকালো হরিণী চোখ দু’টো বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে। যা তার হৃদয়ে শিহরণ জাগালো। মনে মনে হাসল একটু৷ এরপর ওই চোখে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় বলল,
‘ চলে যাবি? ‘
সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলে মাথা নেড়ে না করল, সিমরান। সৌধ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসি ঠোঁটে লেপ্টে দু-হাত বাড়িয়ে বক্ষগহ্বর উন্মুক্ত করে আহ্বান করল,
‘ আয়, বুকে আয়। ‘
বুকের বা’পাশে ইশারা করে বলল,
‘ এখানটায় মাথা রেখে দেখ তো কিছু শুনতে পাস কিনা? ‘
সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠল সিমরানের। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল ভীষণ। সাহস করে ওঠতে পারল না ওই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার। মেয়েটা যে কঠিন পর্যায়ের নাজুক। সৌধই যে তার জীবনের প্রথম প্রণয় পুরুষ। সিমরান সাহস করে ওঠল না বলেই হয়তো সৌধর ইন্দ্রিয়শক্তি আন্দোলন শুরু করল। হৃদয় তৃষ্ণার্ত হলো, একবারটি মেয়েটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়ার। মনটা চনমনে হলো, যে গালে ঝুমায়না ভাবি আঘাত করেছে সে গালে এক টুকরো আদুরে শীতল স্পর্শ দেয়ার। নাজুক মেয়েটা যে নিজে থেকে আগাবে না বুঝে ফেলল সৌধ। বউ একটু বেশি জুনিয়র হলে এটাই সমস্যা। তাদেরকে নিজের অনুভূতি, চাওয়া পাওয়া গুলো পড়াশোনার মতো করে বুঝাতে হয়, মুখস্থ, টুটস্থ করাতে হয়। আপাতত সৌধর কোনো চাওয়া, পাওয়া নেই। আছে এক টুকরো অনুভূতি। যে এক টুকরো অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে সে অনুভূতির সাগরেই ডুব দিতে চায় অল্প পরিসরে।
বউকে কষ্ট পেতে দেখে যে স্বামীর বুকে অশান্তি জাগে না পৃথিবীর বুকে সে স্বামী, সে পুরুষ কলঙ্কিত। সৌধ কলঙ্কিত স্বামী, পুরুষ কোনোটাই নয়। তাই তো নিজ উদ্যেগেই কাছে টেনে নিল সিনুকে। দু-হাতের অঞ্জলিতে কোমল গালদুটো ধরে টকটকে লাল বর্ণীয় গালটায় প্রগাঢ় ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। গভীর সে চুম্বন গালে দিলেও সিমরানের বুকের গহীনে থাকা হৃদয়টুকু স্বর্গীয় সুখে ছটফটিয়ে ওঠল। টের পেয়ে চুম্বন আর দীর্ঘ করল না সৌধ। সযত্নে বউয়ের দেহাশ্রী বুকের ভেতর জড়িয়ে নিল। মৃদুস্বরে বলল,
‘ চলে গেলে এই আদরটা মিস হয়ে যেত না? ‘
.
.
রোজকার নিয়মেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙল সৌধর। তার অনেকটা কাছেই গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সিমরান। ওর সে ঘুমন্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে গতকাল রাতের কথা স্মরণ হয়ে গেল। মৃদু হাসল সে। গতরাতে কত বুঝিয়ে আদর দিয়ে শান্ত করতে হলো মেয়েটাকে। সহসা টের পেল ধীরে ধীরে সিনু তার সর্বস্ব জুড়ে রাজ করে বেড়াবে। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে ডাকতে উদ্যত হলো সিমরানকে। নামাজের সময় শেষ হয়নি৷ ভাবল, দু’জন মিলে নামাজ পড়ে, শরীর চর্চা করবে৷ এমন সময় মনে পড়ে গেল নিধির কথা। আজ তো নিধির সঙ্গে দেখা করতে যাবে সে। এ ব্যাপারে কি সিনুকে বলা উচিত? একবার ভাবল, কী দরকার। মুখে যতই প্রকাশ না করুক মনে মনে ঠিকই কষ্ট পাবে৷ পরোক্ষণেই আবার চিন্তা করল, কষ্ট পাবে ভেবে না জানিয়ে দেখাসাক্ষাৎ করে এলে পরবর্তীতে জেনে আরো বেশি কষ্ট পাবে। ভুলও বুঝতে পারে৷ উন্মাদের মতো ভালোবাসে বলে এই মেয়ে একদমই দুর্বল নয়৷ যেখানে বিয়ের প্রথম রাতে তারা একে অপরকে কথা দিয়েছে। কেউ কারো থেকে কিচ্ছু লুকাবে না। সেখানে আজ এটা লুকালে কথা ভঙ্গ করা হবে। লম্বা একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাই সিদ্ধান্ত নিল, সিমরানকে জানিয়ে তবেই যাবে নিধির সঙ্গে মিট করতে। সুহাস আর নামীকে এক করতে নিধির সাহায্য তার লাগবেই লাগবে। এটাও বোঝাতে হবে সিনুকে৷
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা।