#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৭|
মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে ফোন কেটে দিল সুহাস। তার রাগের মাত্রা দেখে নামীর বুকে ধুকপুক শুরু হলো। এতক্ষণ সুহাস কথা বলছিল আর সে পাশে বসে সমস্ত কথা শোনার এবং বোঝার চেষ্টা করছিল। যতটুকু বুঝল সিমরানকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। এটা নিয়েই অশান্তি করেছে সিমরান। অশান্তির মাত্রা কতখানি টের পেল নামী। কারণ আর কেউ না জানলেও সে জানে। মেয়েটা একগুঁয়ে স্বভাবের। সৌধ ভাইয়ের প্রতি মেয়েটা গভীর প্রণয়ে আসক্ত। সৌধর জীবনে যে ঝড় এসেছে এই ঝড় থামাতে সিমরানের এক বুক ভালোবাসাই যথেষ্ট। যদি সৌধ সুযোগ দেয়। এতদিন ভয় পেলেও এখন নামী মন প্রাণ দিয়ে চায় সৌধের সঙ্গে সিমরানের জুটি মিলুক। এজন্য সুহাসের সাহায্য দরকার। সাহায্যের আগে সুহাসকে জানানো দরকার সিমরান সেই কিশোরী বয়স থেকে এক সৌধতে মত্ত। ভীষণ ভালোবাসে মেয়েটা। যে ভালোবাসা সমুদ্রের অতল গহ্বরের চেয়েও গভীর। নিধি আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। নিয়তি বা পরিস্থিতি যে কারণেই হোক সৌধর জীবনে সিমরানের আগমনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছে নিধি আপু। আর কোনো বাঁধা নেই, দোটানা নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। সুহাসের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ মাথা ঠান্ডা করো সুহাস। ‘
নামী ভেবেছিল এবার সিমরানের সত্যিটা জানাবে৷ কিন্তু তার আগেই সুহাসের রোষানলের শিকার হলো।
‘ শাটআপ! ‘
ধমকে ওঠল সুহাস। নামী কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
‘ আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? আমি কী করেছি? ‘
আকস্মিক সমস্ত ক্রোধ নামীর ওপর ঝেড়ে ফেলল সুহাস। প্রচণ্ড জোরে দেওয়া ধমকটি নামীর দেহ ছাড়িয়ে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল। ফলে আপনাআপনিই জল গড়াল চোখ বেয়ে। সুহাসের সেদিকে হুঁশ নেই। তার একমাত্র আদরের বোন। তার জন্য পাত্র দেখা শুরু হয়েছে। বাবা, মা সিমরানের বিয়ের কথা ভাবছে। অথচ সে জানে না। মেয়েটা বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত কিনা, ওর কাউকে পছন্দ কিনা এসবও জেনে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল সুহাস। তীব্র ক্রোধে নাক, কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করল তার। ধমক খেয়ে স্তব্ধ নামী কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। সুহাসের অবস্থা দেখে পিঠে হাত বুলালো। নিচু আর নরম গলায় শুধাল,
‘ সুহাস, প্লিজ শান্ত হও। ‘
দু’হাতে কপাল থেকে চিবুক অবধি জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিয়ে লম্বা শ্বাস নিল সুহাস৷ বলল,
‘ বাড়িতে প্রচুর অশান্তি হয়েছে। ভাঙচুর করেছে সিনু। আমাদের আজই ফিরতে হবে নামী। ‘
চমকে ওঠল নামী। আজই ফিরতে হবে? তারা তো হানিমুনে এসেছে। এভাবে ভেঙেচুরে হানিমুন বরবাদ করে চলে যাওয়ার মতো সত্যিই কি কিছু ঘটেছে? তাছাড়া আজ তো আইয়াজ ভাই আর ফারাহর বিয়ে হবার কথা। সুহাস কি ভুলে গেছে এসব? গোপনে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নামী বলল,
‘ কিন্তু আজ তো আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে। কীভাবে ফিরে যাব আমরা? ‘
তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। ওরা বসেছিল বীচের কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে। লোক সমাগম কম তবু দু’একজন ছিল। রাগ ওঠলে সুহাসের মাথার ঠিক থাকে না৷ তাই মায়ের রাগ নামীর ওপর খাঁটিয়ে দিল,
‘ তোমার যেতে সমস্যা থাকলে আমি একাই যাব। বোনটা তো আমার। দায়দায়িত্ব, দরদ সবটাও আমার। তুমি বুঝবে কী করে আমার অনুভূতি? ‘
‘ সুহাস, কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ! ‘
রেষ্টুরেন্টের কাছাকাছিই ছিল সৌধ। আইয়াজ, ফারাহর ছবি তুলে দিচ্ছিল সে। হঠাৎ সুহাসের চড়া গলা শুনতে পেয়ে এগিয়ে আসে। সুহাসকে রাগান্বিত দেখে আর নামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে ধমক দেয়,
‘ কী ব্যাপার তোর! ওকে ধমকাচ্ছিস কেন? লোকজন দেখছে সুহাস রাগ কন্ট্রোল কর। শান্ত হয়ে বসে বল সমস্যা কী? ‘
সহসা ওঠে দাঁড়াল নামী। কান্না প্রায় মুখ করে রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে একছুটে রিসোর্টে চলে গেল। পিছন থেকে ফারাহ ডাকল কয়েকবার। নামী শুনল না। দূর থেকে দেখা গেল চোখের পানি মুছতে মুছতে ত্বরিত বেগে হেঁটে চলে যাচ্ছে মেয়েটা।
.
.
বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বেশ মন দিয়ে শুনল সৌধ। প্রচণ্ড অবাক হলো সে। উদয়িনী আন্টি এত তাড়াতাড়ি সিনুর বিয়ের কথা ভাবার মতো মানুষ নন৷ তাহলে হঠাৎ এই ভুত কে চাপালো তার মাথায়? আর সামান্য একটি বিষয় নিয়ে সিনুই বা এমন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাল কেন? বিয়ে না করলে না করবে। তাই বলে ভাঙচুর করে নিজে আহত হবে? এই মেয়েটা যে সত্যি ভাইয়ের ফটোকপি এতে একবিন্দু সন্দেহও নেই। বিস্মিত মুখে সুহাসের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিল সৌধ। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল সুহাসের কথায়,
‘ দোস্ত আমাকে এক্ষুণি ফিরতে হবে৷ এদিকটা তুই ম্যানেজ করে নিস প্লিজ। ‘
হাসফাস চিত্তে ওঠে দাঁড়াল সুহাস। মুহুর্তেই তার হাত টেনে বসিয়ে দিল সৌধ। কঠিন মুখে বলল,
‘ তুই কোত্থাও যাবি না। যাব আমি। ‘
‘ হোয়াট! ‘
‘ ইয়েস ব্রো। হানিমুনে এসেছ হানিমুন করো ওদিকটা আমি সামলে নিব। ‘
‘ আমার বোন হসপিটালে ভর্তি সৌধ! ‘
চ্যাঁচিয়ে ওঠল সুহাস৷ সৌধ নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর কাঁধে হাত রেখে শীতল কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ আমার বোনটা রিসোর্টে গিয়ে চোখের জল ফেলছে সুহাস। ‘
উদ্যমি চিত্ত আকস্মিক নিরুদ্যম হয়ে গেল। চঞ্চল দৃষ্টি হলো অঞ্চল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। বলল,
‘ নামী বুঝদার সৌধ। ওকে আমি ম্যানেজ করে নিব।’
‘ তুই বুঝদার নোস সুহাস৷ তাই অবুঝতা করছিস। ওদিকের খবর নিয়েছি আমি৷ সিনুকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। পায়ে লেগেছে, ব্যান্ডেস করে দিয়েছে দ্যাটস ইট। বাকি যা সমস্যা দেখে নিব আমি। মাত্র ক’টা দিন ছুটি৷ তুই নামীকে সময় দে দোস্ত। ভালোবাসা পেয়ে যাওয়া মানেই ইট’স ওকে নয়। ভালোবাসা পাওয়া মানে যত্নের সঙ্গে তা রক্ষা করা। অবহেলা, অনাদরে ভালোবাসা হারাতে নেই সুহাস৷ যা পেয়েছিস তা আগলে রাখতে শেখ। ‘
‘ কিন্তু সিনু…’
‘ ব্যাপারটাকে তুই একটু বেশিই জটিল করছিস। ‘
‘ ওর কারো সাথে রিলেশনশিপ আছে সৌধ। ‘
‘ না নেই। ‘
‘ হয়তো আছে আমরা জানি না। নয়তো এমন কিছু কেন ঘটাবে? ‘
‘ তোর বোন সম্পর্কে তোর চেয়েও আমি জানি। কার সাথে মিশছে, কখন কোথায় আড্ডা দিচ্ছে সব আপডেটই পাই। এমনভাবে পাই মনে হয় বোনটা তোর না আমার। ‘
এক চিলতে বাঁকা হাসির দেখা মিলল সৌধর অধর কোণে৷ সুহাস পুনঃপুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ কী করব আমি এখন আমি? ‘
‘ তুই বউয়ের সঙ্গে এনজয় করবি। আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিবি। আমি এক্ষুনি রওনা দেব। ‘
কৃতজ্ঞতায় বুক ভার হলো সুহাসের। সৌধর বুকে মৃদু কিল বসিয়ে ওঠে দাঁড়াল। দাঁড়াল সৌধও। এরপর আচমকা সুহাস তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘ তুই শুধু বন্ধু না সৌধ তুই আমার ভাই। ‘
ওদের কথোপকথন শেষে আইয়াজকে ফোন করল সৌধ। বলল,
‘ আমি ব্যাক করছি দোস্ত। ইমিডিয়েটলি ব্যাক করতে হচ্ছে আমাকে। সরি ভাই, তোর বিশেষ দিনটায় পাশে থাকতে পারলাম না। ‘
আকস্মিক সৌধর সিদ্ধান্তটি সুহাসের মনে দানা বেঁধে থাকলেও আইয়াজ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কারণ ভোরবেলা প্রাচীর দেয়া বার্তাটি দেখেছে সে৷ আর সেই থেকেই হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছিল তার। তাই হঠাৎ সৌধকে ব্যাক করতে হবে জেনে মন খারাপের পাশাপাশি একটু খুশিও হলো। উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নয়তো সৌধ থেকে গেলে কোনোভাবে যদি নিধি আর অর্পণ স্যারের মুখোমুখি হয়ে যায়। সেই বীভৎস মুহুর্তটুকু নিয়ে আর ভাবতে চাইল না আইয়াজ। বলল,
‘ সাবধানে যাস। ‘
সৌধ বাঁকা হাসল। যেন টের পেল আইয়াজের মনোভাবনা। বেইমানদের সহ্য করা গেলেও বেইমান তৈরির মেশিনদের সহ্য করা যায় না৷ সৌধর কাছে অর্পণ স্যার বেইমান তৈরির মিশনের মতো৷ যার মুখ দর্শন করতে ভয় হয় তার৷ না জানি তার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় মেশিনটা। খু ন হয়ে যায় অর্পণ স্যার! না জানি বিধবা রূপে ধরা দেয় তার আগুনপোকা নিধি!
.
.
|চলবে…|
®জান্নাতুল নাঈমা
৩৭ পর্বের বর্ধিত অংশ রাতে দিব ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় পাঠক পেজের প্রথম কনটেস্ট পোস্ট হবে আগামীকাল। যারা মিশিবিবি হাতে পাচ্ছেন, পড়ছেন বইয়ের অনুভূতি, পাঠপ্রতিক্রিয়া শেয়ার করবেন।