#তোর_শহরে_মেঘের_আনাগোনা (৮)
#Rawnaf_Anan_Tahiyat
‘কি রে বুড়ি, এতো রাতে এখানে বসে বসে কি বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলিস না কি?’
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার মতো হবে। বাগানের বেঞ্চে তখনও বসে আছে রাত, সন্ধ্যায় সেই যে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো আর যায়নি ফিরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল একা একাই তখন উক্ত কথা টা শুনে মাথা তুলে দেখে সাকিব ভাই মহা বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখ মুখ কুঁচকে ফের একই কথা জিজ্ঞেস করল সাকিব।
‘ন নাহ তো। আমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে না কি যে আমি তার সাথে এতো রাতে কথা বলতে যাবো?’
‘ তাহলে এতো রাতে তুই বাগানে বসে কি করছিস ঠিক করে বলতো? আবার বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্লান করছিস না তো?’
‘না। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি যাচ্ছি আমার রুমে।’
শক্ত গলায় কথা টা বলে গটগট করে বাসায় ঢুকে গেল রাত। রাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সাকিব দুই হাত বুকে ভাঁজ করে বেঞ্চ টাতে বসলো।কিছুক্ষণ আগে তার সাথে করা সিমরানের ব্যবহার টা ঠিক লাগছে না তার,যেই সিমরান তাকে ভালোই বাসে না সেই সিমরান ওকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললো।নাহ কিছু একটা আছে এর আড়ালে, রাতের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবে তার ও উপায় নেই। খোঁচা দেওয়া কথা শুনে মেয়েটা চলে গেল, এদিকে তার সাকিব ভাই বিপদে পড়েছে সেটা খেয়ালই করলো না।
_______________________________
পরদিন সকালে পুরো বাসায় সাজ সাজ রব। সবাই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে আছে বাসার, কারোর কোনো পাত্তা নেই আজকে।যদিও বা সিমরান সাকিবের আপন খালাতো বোন তারপরও ও এই বাসার বউ হতে চলেছে আর কিছুক্ষণ পরেই তাই ও এখন অন্য বাড়ির মেয়ে প্লাস এই বাসার কনে বলতে গেলে।কনের বাসায় যাওয়ার জন্য কে কি পড়বে,কি কি করবে, কিভাবে যাবে এইসব প্লানিং করছে সবাই মিলে। চারদিকে ঘুরে ফিরে এইসবই দেখছে আর উদাস হয়ে যাচ্ছে মোহনা। কোনো কিছুতেই কোনো উৎসাহ খুঁজে পেল না সে , খালামনিরা, নিদ্রা সহ সবাই ডেকেছিল ওকে ওদের প্লানিং এ জয়েন হতে কিন্তু ও গেল না।বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে ঘুরা ঘুরি করে ছাদে এসে এক কোনায় বসে পড়লো।হাতে করে একটা ছবির এলবাম নিয়ে এসেছে, সুন্দর করে বাঁধাই করা এলবাম টা।কিয়ৎক্ষণ ওটার কভার টার দিকে তাকিয়ে রইল, এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে খুললো সেটা। খুলতেই একটা হাসোজ্জ্বল ছবি বেরিয়ে এলো চোখের সামনে , কাঁপা হাত টা ছবির উপর রাখলো মোহনা। একটা ফুটফুটে দুই বছরের বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফর্সা গড়নের ছেলে। মুখে ভুবন ভোলানো হাসি তার, কিন্তু চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কি একটা চাপা কষ্ট মনের মধ্যে লুকিয়ে আছে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো মোহনা, এই ছবির মানুষ গুলো আজকে সত্যিই ছবি হয়ে গেছে। দুই বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গেল মোহনা..………….……..…
‘খুব সুখের একটা সাজানো গোছানো সংসার ছিল মোহনার। একটা দুই বছরের বাচ্চা মেয়ে নাফা আর স্বামী আহমাদ কে নিয়ে দিন গুলো খুব ভালোই যাচ্ছিল তার কিন্তু ঐ যে বলে না অতি সুখ কারো কপালে ঠিক তাই যেন হয়েছে মোহনার সাথে। একদিন বিকেলে আহমাদ আর মোহনা সুপার শপিং মলে গেল শপিং করতে। শপিং শেষ করে দুজনেই হাসাহাসি করতে করতে রাস্তা পার হচ্ছে ঠিক তখনই উল্টো পথগামী একটা বাস এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ওদের দুজনকেই। আহমাদের কোলে ছিল নাফা , ওরা পড়লো ঠিক রাস্তার উপর। মাথায় আঘাত লেগে সঙ্গে সঙ্গে ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল মোহনা তাই এরপরের কোনো ঘটনাই তার মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো, আশপাশে তাকিয়ে দেখে আপনজনদের সবাই আছে কিন্তু নাফা আর আহমাদ কোথাও নেই। জিজ্ঞেস করল যে ওরা দুজন কোথায় কিন্তু সহজে কেউ উত্তর দিলো না তাকে, বারংবার জিজ্ঞেস করতে একজন বললো ওদের স্পট ডেথ হয়েছে।আর মোহনার জ্ঞান ফিরেছে পুরো ছয় মাস পর, এক্সি’ডে’ন্ট এর পর পরই কোমায় চলে গিয়েছিল সে। হঠাৎ যখন আহমাদ আর নাফার মৃ’ত্যু’র খবর টা শুনলো প্রায় পাগলের মত হয়ে গেল। সবসময় পাগলামি করতো, যখনই কোনো বাচ্চা মেয়ে দেখতো তার মাঝেই নাফা কে খুজতো যেন।প্রায় এক বছর ধরে হসপিটালে থেকে মেন্টাল ট্রিটমেন্ট চলার পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও সেই আগের মোহনায় ফিরে যেতে পারে নি সে।একদম চুপ চাপ নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো হয়ে গেছে সে, কোনো কিছুতেই কোনো হেলদোল নেই আগের মত।
ছবির দিকে তাকিয়ে এইসব অতীত ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ছবিটির উপর।
” আপুই তুমি ছাদে বসে কি করছো এই অবেলায়?”
হঠাৎ করে কারো ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে ঘুরে দেখে রাত এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে। মোহনা কে ঘুরতে দেখে রাত এসে তার পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। মোহনা এক হাতে রাত কে জড়িয়ে ধরে হাসলো, এরপর বললো,,,
‘ কিছু ভালো লাগছিল না রে বুড়ি,তাই এখানে চলে আসলাম।তা তুই এখন ওদের সাথে প্লানিং না করে ছাদে এসেছিস কেন? সাকিবের বউ কে আনতে যাবি না তুই?’
‘না।ওই বাসায় ওই মেয়ে কে আনতে আমি যাবো না আর যেতেও চাই না আমি।আর সেটা কেন চাই না তা তুমি খুব ভালো করেই জানো আপুই ,কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে সাকিব ভাইয়ের সাথে আর কোন কথা বলবো না, ওর সামনেও যাবো না আর।ও ভালো থাকুক ওর ভালোবাসার মানুষ কে নিয়ে,নাই বা পেলাম আমি আমার ভালোবাসার পূর্ণতা।’
রাতের কথা শুনে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো মোহনা, কি বলবে তার কথার প্রতিউত্তরে কিছু বুঝতে পারলো না। এলবাম টা বন্ধ করে এক পাশে সরিয়ে রেখে রাত কে মুখোমুখি করলো নিজের। এরপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে, চোখ দুটো বেজায় ফুলে আছে মেয়েটার। চোখ আংশিক লাল ও হয়ে আছে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কেঁদেছে। এখনও চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে, হাত দিয়ে সেটা মুছিয়ে দিতে দিতে কপট রাগ দেখালো রাত কে।
‘ ভালোবাসা ভালোবাসা করে কি নিজেকে খাবি নাকি তুই?কি অবস্থা করেছিস চোখ মুখের, বাসায় এতো মেহমান তোকে দেখলে কি ভাববে বলতো?
শোন না বোন আমার, এইরকম করে না লক্ষ্মী টি।দেখ,যেই সাকিব কে তুই এতো ভালোবাসিস সেই সাকিব কিন্তু তোকে ভালোবাসে না এতো টুকু ও।সে শুধু তোকে বোন ভাবে,স্রেফ খালাতো বোন এর বাইরে কিছু না। সাকিব ভাই সাকিব ভাই বলে অন্ধ তুই,আর আজ যদি তুই তার বিয়েতে না যাস, তার সাথে কথা না বলিস তাহলে ভাব আর সবাই বিষয়টি ঠিক কিভাবে নেবে?বাকি মানুষগুলোর কথা না ভাবিস, একটা বার খালামনির কথা টা অন্তত ভাব?’
‘ তুমি কি পারতে আপুই, নিজের ভালোবাসা কে বলিদান দিতে? চোখের সামনে নিজের ভালোবাসা কে অন্যের হতে দিতে পারতে কি তুমি?’
এইটুকু বলেই রাত নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলো,কি বলতে কি বলে ফেললো সে। নিজের কষ্ট কমাতে গিয়ে যে সে প্রিয় আপুই এর পুরোনো ক্ষত টাকে জীবিত করে তুললো।
রাতের বাক্য গুলো শ্রবণ করে মোহনা নিজেও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট গুলো কাঁপছে তার,মুখ ফুটে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু পারছে না কেন?
চলবে………..
[আসসালামুয়ালাইকুম। আমি গভীর ভাবে দুঃখিত যে আপনাদের এতো অপেক্ষা করিয়েছি। আসলে চোখ টা এখনও ভালো হয়নি তাই কোনোরকমে এইটুকুই লিখলাম।]