তোর শহরে মেঘের_্আনাগোনা পর্ব ৩

0
755

#তোর_শহরে_মেঘের_আনাগোনা (৩)
#Rawnaf_Anan_Tahiyat

‘ আমাদের রাত বুড়ির কি আজকে ব্রেক আপ হয়েছে নাকি যে বাংলার পাঁচের মতো মুখখানি করে রেখেছে?’

সাকিবের কথা শুনে সবাই চোখ বড় বড় করে রাতের দিকে তাকালো, সত্যিই তো এতোক্ষণ ধরে কেউই খেয়াল করেনি রাতের অন্ধকার মুখ খানি।যেই ভাব নিয়ে আছে তাতে মনে হচ্ছে নিশ্চিত ব্রেক আপ হয়েছে নয়তো বর ম’রে’ছে। সবার অমনভাবে তাকানো দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে রাত, কাচুমাচু হয়ে বললো,,,,

আমি আর সবার মতো ডুবে ডুবে জল খাই না, কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই আমার আর না ব্রেক আপ হয়েছে।

রাতের উত্তর শুনে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো,কথার আগা মাথা কিছুই বুঝল না।তাই সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সবাই আবার আড্ডায় যোগ দিলো।বেশ কিছুক্ষণ ধরে আড্ডা চলার পর সবাই একে একে ডিনার সেরে নিজের নিজের রুমে চলে গেল।পুরো সময়টা একেবারে চুপচাপ হয়ে ছিলো রাত, না সবার সাথে হাসাহাসি করেছে আর না ডিনার টেবিলে বসে কোন বিষয় নিয়ে কথা তুলেছে। নিঃশব্দে সবকিছু খেয়াল করলো একজন, এতো চঞ্চল একটা মেয়ে হঠাৎ করেই আজকে এতো চুপচাপ সেটা কেন জানি সেই একজনের সহ্য হচ্ছে না।

বোধ করি রাত এগারোটা বাজতে চললো, সেসময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো সদর দরজার। ডিনার শেষে মা, তিন খালামনি, ফুপি রা, আব্বু খালুজানদের সাথে লন্ডনের পরিবেশ শিক্ষা ব্যবস্থা পড়াশোনা এইসব কিছু নিয়ে গল্প করছিল সাকিব। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটায় সাকিব নিজে গিয়েই দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই চমকিত হলো সে, সিমরান দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। চোখ মুখের অবস্থা বিবর্ণ হয়ে গেছে,তাড়াতাড়ি করে ওকে ভিতরে নিয়ে এলো। কতক্ষণ শুশ্রূষা করার পর সিমরানের মা ওকে প্রশ্ন করলো যে সে এতক্ষন কোথায় ছিল। নাসিমা রহমান বোন কে আটকাতে চাইলে সিমরানের মা রাজিয়া হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল। শক্ত গলায় বললো,

‘বুবু ও তোমার ছেলের বউ হতে চলেছে কিন্তু এখনও হয়নি তাই আমার মেয়ে কে আমাকেই শাসন টা করতে দাও।মা হিসেবে ওর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব টা পালন করতে দাও আমাকে।আসমার ছেলে মেয়ে দের কে তুমি তোমার কুক্ষিগত করে রেখেছো কারণ আসমা মা হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে জানে না। কিন্তু আমার ছেলে মেয়েদের তুমি বেশি শাসন বা আদর করতে এসো না অন্তত আমার সামনে। বিকেল পাঁচটার দিকে ও বাসা থেকে বের হয়েছে এখানে আসবে বলে, তানহা আর নিদ্রা কে ওর সাথে আনতে বলেছিলাম। ওর দেরি হবে বলে ও একা একাই চলে এসেছে, আমি ও ভাবলাম সাকিব এতো দিন পরে আসছে একাই যাক না হয়।অথচ তুমি দেখো আমার গুনধর মেয়ে কে, তার রাত এগারোটায় এখানে আসার সময় হলো। ভালোয় ভালোয় বল সিমরান, তুই এতোক্ষণ কোথায় ছিলি?’

মায়ের এভাবে গোয়েন্দাদের মতো জেরা করা দেখে ঘাবড়ে গেল সিমরান, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।কি জবাব দেবে এখন মা’কে,মা আবার ওর চালবাজি কোনভাবে ধরে ফেলেনি তো? অসহায় চোখ নিয়ে সাকিবের দিকে তাকালো, কিন্তু নাহ সেখানেও আশ্রয় নেই।ওই বেচারা নিজেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর দৃষ্টি জানান দিচ্ছে যে সাকিব এই মুহূর্তে সিমরানের উপর প্রচুর পরিমাণে রেগে আছে প্লাস ওকে নিয়ে কিছুটা কনফিউশন এ আছে। ছোট মাথার মিথ্যার ভান্ডারে মা’কে জবাব দেওয়ার মতো আর কোনো মিথ্যা জমা নেই তাই অগত্যা মুখ বন্ধ করে বসে রইল।বেশ কিছুক্ষণ ধরে মেয়ের নিরবতা সহ্য করে ফের জিজ্ঞেস করলেন একই কথা, কিন্তু সিমরান কোনো রেসপন্স করলো না।আর সহ্য করলেন না রাজিয়া,বসা থেকে উঠে এসে ঠা’স করে মেয়ের গালে দুটো চড় বসিয়ে দিলেন।বড় আদরে মেয়ে কে মানুষ করলেও শাসনের দিকে কোনো ছাড় নেই রাজিয়ার কাছে, এতো গুলো মানুষের সামনেই মেয়ে কে বেধড়ক মারধর করে শান্ত হলেন। নাসিমা,আসমা আর বাকি সবাই মিলে ও আটকাতে পারলো না তাকে, রেগে রণচন্ডী রূপ ধারণ করেছেন। সাকিব কেন জানি খালামনি কে আটকাতে চাইলো না, আজকের ঘটনার জন্য সিমরান নিজেই দোষী সে ওর সাথে দেখা করতে আসছে বলে কোথায় গিয়েছিল সেটা জানা দরকার। কিন্তু চোখের সামনে এভাবে মা’র খাচ্ছে সিমরান এতে ওর কোনো হেলদোল নেই, তখনকার রাগ টা মনের মধ্যে জমে আছে এখনো। লম্বা একটা হাই তুলে নিজের রুমে চলে গেল, বিশেষ ভালো লাগছে না কিছুই।

___________________________________________

সকাল নয়টার দিকে রাত কলেজ যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিল। ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘটে যাওয়া সবকিছুই শুনেছে সাকিব ভাইয়ের ফুপির কাছে, সবকিছু শুনে সিমরান আপুর জন্য খারাপ লাগলো একটু। এতো বড় হয়েছে আপু তারপরেও খালামনি মা’রে আপু কে,যখন আদর করে তো তখন মাথায় তুলে রাখে আর যখন মা’রে তখন…… কলেজ ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে এলো, এসে দেখে মা আপন মনে রুমাল সেলাই করছে। মায়ের পাশে এসে বসল রাত, তারপর জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বললো,,

‘মা আজকে আমার সব বন্ধুরা মিলে পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে যাচ্ছে।সোমা,মেহু, ফারহানা, মিলি এরাও যাচ্ছে।তো ওরা বলছে যে আমি না গেলে নাকি ওরাও যাবে না, আমাকে যেতেই হবে মাস্ট।’

ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে তো দিলো রাত কিন্তু সে জানে মা কখনো রাজি হবেন না। খালামনির উপর রাজি হওয়ার দায়িত্ব টা ছেড়ে দিবেন আর তিনি ও রাজি হবেন না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আসমা রহমান মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করলেন,,

‘ ভালো কথা তো এটা,সব বন্ধু যখন যাচ্ছে তুই ও যা। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চল, ওদের থেকে পিছিয়ে থাকবি কেন?তা কতদিনের ট্রিপে যাচ্ছিস তোরা, পাঁচ ছয় দিন হলে কিন্তু যেতে দিবো না’

‘সত্যি মা, আমি যাবো? মাত্র দুই দিনের ট্রিপ মা। আজকের দিনটা আর কালকের, এরপরই আমরা সবাই চলে আসবো।’

আসমা রহমান হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর তিনি উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন,রাত কিভাবে নিজের খুশি টাকে প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না। মানে মা তাকে কখনো কোথাও যাওয়ার অনুমতি দিবে এটা স্বপ্নাতিত, যেখানে ওদের সব সিদ্ধান্ত আরেক মহিলা নেন।দশ মিনিটের মধ্যেই তিনি ফেরত এলেন হাতে কিছু একটা নিয়ে, রাতের হাতে সেই জিনিস টা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,,

‘এতে কিছু টাকা আছে ঘুরতে যাচ্ছিস, টাকার দরকার আছে খুব। কোনো কিছু কিনতে ইচ্ছে হলে কিনবি, ইচ্ছে টাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখবি না খবরদার।আর হ্যা হাতে কিন্তু মনে করে মলম টা লাগিয়ে নিয়ে তারপর যাস।’

‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে রাতের?’

মায়ের হাত থেকে টাকা টা নেওয়ার সময় খালামনি এসে উপস্থিত হলো। এতোক্ষণ রান্নাঘরেই ছিল,যেই দেখেছে সে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হয়েছে অমনি বাধা দিতে চলে এসেছে। টাকা টা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো, ‘ কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি খালামনি।’

‘তোকে কি আমি একবার ও যেতে বলেছি রাত? আমার অনুমতি ছাড়া তোর কোথাও যাওয়ার সাহস হয় কি করে?’

‘ওর সাহস হয়েছে কারণ আমি ওকে যেতে বলেছি। তুমি এবার তোমার সন্তান, তোমার সংসার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো বুবু। আমি ও একটু মায়ের দায়িত্ব টা পালন করতে শিখি,দেখি সন্তানের কিসে ভালো হয়।’

‘আসমা তুই? তুই আমাকে এতো বড় কথাটা বলতে পারলি?’

‘রাত তুই আয় এখন,তোর দেরি হয়ে যাবে নাহলে।এদিকটা চিন্তা করিস না, আমি সামলে নিবো সবকিছু।’

মায়ের দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল সে। আজকের দিনটা তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন বলে মনে হচ্ছিল।
রাতের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার রুমাল সেলাই এ মন দিলেন আসমা,আর তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল বড় বুবু নাসিমা। আসমা কখনো তার মুখের উপর কথা বলতে পারে এটা কখনো ভাবেনি, তার অনুমতি না নিয়ে রাত কে বাইরে যেতে বললো আসমা।এটাও হওয়ার ছিল তার সাথে?

চলবে……………….

~ ছোট একটি নোট বার্তা। গল্প টা নিয়ে অনেকের অনেক কনফিউশন আছে,যেমন খালামনির চরিত্র আর মায়ের চরিত্রটা নিয়ে। সেজন্য সবাইকে বলতে চাইছি যে এই চরিত্র দুটি সম্পূর্ণ বাস্তব, চোখের সামনে এই চরিত্র দুটি কে দেখেছি আমি আর অবাক হয়েছি। অনেকাংশে এটা বাস্তব সম্মত ভাবে লিখার চেষ্টা করছি আমি, আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের মনমতো করে গল্প টা উপহার দিতে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here