তোর মনের অরন্যে পর্ব-৩৩

0
558

#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩৩.
আমন রুমে বসে আছে তার চোখে মুখে এক উৎকন্ঠা এক অজানা আশংকা যন্ত্রণা ফুটে আছে। এই কয়েক মিনিটের মধ্যে তার পৃথিবী থমকে গেছে। যখন অ্যাস এর থেকে শুনলো যে সোহাকে পাওয়া যাচ্ছে না তখনই তার মনে হয়েছিলো তার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকার পর সোহার খুঁজে না পাওয়ার কথা তার বিপদের চিন্তা মাথায় গ্রাস করতেই সে রুমে দৌড় দেয়। সব যদি ঠিক ঠাক তাহলে সে জানলেও জানতে পারে সোহা ঠিক কোথায় আছে।

আমনকে এখন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে পুরো। রুমে এসেই ল্যাপটপ নিয়েই বসে পড়ে। ট্রাক লোকেশন এর একটা ফোল্ডারে ঢুকেই সেটা কে অ্যাক্টিভ করে দেয়। প্রসেসিং শুরু হতেই আমনের বুকের মধ্যে এক ভয় গ্রাস করে নেয়। অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে প্রসেসিং এর। প্রায় পাঁচ মিনিট পর প্রপার প্রসেসিং অ্যাক্টিভ হতে আমন ট্রাক লোকেশন এর সাথে সাথে ক্যামেরা অ্যাক্টিভ করে। লোকেশন ট্রাক হয়ে গেছে সিগন্যাল পাওয়া গেছে। নর্থ সাইটে লোকেট হয়ে আছে। পুরো লোকেশন প্রসেস হতে ম্যাপ ক্লিয়ার হয়ে যায়। লাদাখ । খারদুং-লা পাস লাদাখ এর লেহ জেলায় অবস্থিত। এখানেই লোকেশন দেখাচ্ছে । ইতি মধ্যে ক্যামেরা অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার তেমন ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না আবছা হয়েছে রুমের মধ্যে বাইরে থেকে হালকা আলোর ছিটে রুমে আসছে। আমন পরিষ্কার বোঝার চেষ্টা করলো কিন্তু ও ভালো করে কিছু দেখতে পেলো না। ক্যামেরা অন রেখেই লোকেট হওয়া জায়গা দ্রুত গতিতে সার্চ করলো। সাথে সাথে আরো বেশি আতঙ্ক গ্রাস করে নেয় আমনকে। যে জায়গায় লোকেশন দেখাচ্ছে সেখানে চারদিকে বরফে আবৃত্ত জায়গা ।

আমনের মনে শুধু এখন একটাই প্রশ্ন সোহা ঠিক আছেতো এমন একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় এমনি কারোর ভয় না থাকলেও আবহাওয়ার জন্য সোহার অবনতি ঘটতে পারে। না আমনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে এখনই। কিন্তু আমনের একটা কথা কিছুতেই আসে না যে সোহা এই জায়গায় গেলো কিভাবে? এই জায়গার একদিকে কাশ্মীর আর অন্য দিকে চীন এর বর্ডার এমন একটা সাংঘাতিক জায়গায় কে নিয়ে গেলো সোহাকে আর কেনো বা নিয়ে যাওয়া হলো। আমন তার প্রশ্ন এখন সাইটে রেখে ঝটপট তার পদক্ষেপ নিতে থাকে। আমন হাই কমিশনের অফিসে কন্ট্রাক্ট করে ওখানে সোহার ব্যাপারে নিয়ে কথা হয়। হাই কমিশন অফিসে ও সব চিন্তায় ছিল সোহাকে নিয়ে এই মুহূর্তে এমন খবর তারা দ্রুত লাদাখ এর অফিসারদের সাথে কথা বলে নেয়।

আমন তার টিম সাজিয়ে নেয় পুরোপুরি ভাবে। তাকে এক মুহূর্ত দেরি করলে চলবে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে লাদাখ পৌঁছাতে আজ তিনদিন হয়ে যাচ্ছে সোহা কি অবস্থায় আছে কেউ জানে না। আমনের কাছে এক একটা সেকেন্ড ও যেনো বছরের ন্যায় লেগে যাচ্ছে। আমন উপর মহলের কথা বলে দ্রুত তার তিন রেডি করে নেয় তবে পুরো ব্যাপারটাই আমন সিক্রেট রাখতে বলে।

-“কোথায় আছিস তোরা? আমন প্রশ্ন করে ওঠে।

-” দিল্লীতে আছি। অ্যাস উত্তর দেয়।

-“ঠিক আছে তোরা দ্রুত নিজেদের তৈরী করে নে আমি দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। আমন বলে ওঠে ।

-” কোথায় যাবো ভাই? অ্যাস প্রশ্ন করে ওঠে।

-“সোহাকে ফিরিয়ে আনতে। আমন নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয়।

আমন ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ট্যাব এর সাথে কানেকশন করিয়ে রেখেছে সে প্রতি মুহূর্তে অ্যাক্টিভ থাকলো ক্যামেরার দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে যদি কিছু পাওয়া যায়। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে থেকে দিল্লিতে যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। তার কাছে এখন এক একটা মিনিট ও খুবই দামী এক মিনিট এর এপার ওপারে যা কিছুই ঘটে যেতে পারে।

————–
প্রায় আড়াই ঘণ্টার সফরে দিল্লী পৌঁছায় আমন। সোজা হাই কমিশনের অফিসে ওখান থেকে তার সমস্ত কাজ কম্পিলিট অর্ডার নিয়ে নেয়। বাইরে আসতে দেখা হয় অ্যাস নীহার আকাশ সানিদের সাথে তারা নিজেদের মধ্যে অপরাধ বোধে ভুগছে। আমন এক পলক তাকিয়ে নেয় তাদের দিকে তবে তেমন গুরুত্ব দেয়না তার এখন একটাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর সেটা হলো সোহাকে উদ্ধার করা।

-“চলো হাতে একদম টাইম নেই। ওদের সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে আমন।

-” ভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি? সোহা কোথায় আছে তুমি জানো? অ্যাস ভাঙা গলায় বলে ওঠে।

আমন এক পলক নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে নেয় কান্না করে গলা ভেঙে গেছে চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। আমন ওদের দিকে দেখে নেয় ।

-” লাদাখ । বলেই আমন এগিয়ে যায়।

অ্যাস নীহার আকাশ সানি একে অপরের দিকে তাকিয়ে আমনের পিছন পিছন এগিয়ে চলে। আমন সামনে কয়েকজন অফিসারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। অ্যাস নীহার আকাশ সানি ওরাও এগিয়ে যাচ্ছে আমনের পিছন পিছন। আমনের প্রত্যেকটা কথায় তাদের কানে আসছে। আমনের প্ল্যান আর অর্ডার শুনেই তারা বোঝে আমন এমনি এমনি সিনিয়র অফিসারের পদে নেই আর হটাৎ করেই এমন একটা ব্যবস্থা ও নিতে পারেনা সে যতো সিনিয়র অফিসার হোক না কেনো সরাসরি হাই কমিশনের সাথে কথা বলার ক্ষমতা সবার থাকে না। সেখানে আমন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কথা বলে সব কিছুর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাহলে তাদের কি এখনও আমনের বিষয়ে আরো কিছু জানার বাকি আছে।

আমন সাথে তার টিম অ্যাস নীহার আকাশ সানি আর কিছু অফিসার ও আছে তারা সবাই একসাথে প্রাইভেট হেলিকপ্টার করে দিল্লী থেকে রওনা দেয় লাদাখ এর উদ্দেশ্য। এখন প্লেন এর ঝামেলা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে অনেক সময় হাত থেকে বেরিয়ে যাবে যেটা এখন তাদের কাছে নেই। তারা সরাসরি হেলিকপ্টার করে স্পটে পৌঁছে যেতে পারবে। ইতি মধ্যে হয়তো সেখানে লাদাখের অফিসাররাও রওনা করেছে। তাই টাইম নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে। আমন তার লোকেশন অনুযায়ী বলে দিয়েছে ঠিক কোথায় আছে সেই অনুযায়ী তাদের বাহন এগিয়ে চলেছে। এর মধ্যে প্রতিটা মিনিট আমন ছটফট করে গেছে। হেলিকপ্টারে ওঠার পর থেকে এক মিনিটের জন্য ও তার নজর ট্যাব থেকে সরেনি সে একভাবে ক্যামেরা দিকে তাকিয়ে ছিল যদি একবার সোহাকে দেখা যায়।

অ্যাস সানি আকাশ নীহার সারাটা রাস্তা আমনের এই অস্থিরতা দেখে গেছে। আমন বাইরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক দেখলেও তার ভিতরে যে তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা অ্যাসের বুঝতে বাকি নেই। তার ভাই যে সোহাকে মারাত্মক ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা বুঝতে পারে। সোহার জন্য তাদের ও আজ তিনদিন খাওয়া ঘুম মাথায় উঠে গেছে সারাদিন এদিকে ওদিকে খুঁজে গেছে কিন্তু কোথাও পাইনি তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমনের সোহাকে খুঁজে পেয়ে যাওয়াটা তাদের কে ভাবিয়েছে তবে এখন তারা এই বিষয় নিয়ে নয় সোহাকে চিন্তিত হয়ে আছে। সবাই এখন একটাই প্রে করে যাচ্ছে যেনো সোহা ঠিক থাকে তার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।

————

প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায় তাদের গন্তব্যে লাদাখ লেহ জেলার খারদুং-লা তে। আমন এবার তার প্রপার লোকেশন দিতেই তারা পৌঁছয়। উপর থেকেই নিচেই দেখা যাচ্ছে চারিদিকে সাদা বরফে আবৃত্ত হয়ে আছে চারিদিকে জঙ্গল আর মাঝে একটা ছোটো কটেজ মত দেখা যাচ্ছে। আমন বাকি অফিসারদের সাথে কথা বলে কিছুটা দূরেই হেলিকপ্টার ল্যান্ড করায়। কটেজের আসে পাশে কত জন লোক আছে তারা জানে না বেশি থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে তাই রিস্ক না নিয়েই তারা কিছুটা দূরেই ল্যান্ড করে।

আমন হেলিকপ্টার থেকে নেমেই ওখানকার অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করে ওরাও তাদের আসে পাশে ছিল ওদের সাথে কথা হওয়ার পর এগিয়ে যায় কটেজের দিকে। যতো এগিয়ে যেতে থাকে। ততই আমনের বুকের মধ্যে এক অদ্ভূত যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। কেমন একটা ভয় গ্রাস করছে। সে জানে না ওখানে গিয়ে সোহাকে কি অবস্থায় পাবে। কটেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে সামনেই অফিসাররাও আছে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আমন চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়েই ভিতরের দিকে ঢুকে যায়। সাথে অ্যাস নীহার আকাশ সানি ।ওদের এমন ভাবে ভিতরে ঢুকতে দেখে ভিতরে থাকা গার্ড দেওয়া লোক গুলো আমনদের দিকে তেড়ে আসে। আমন কয়েকটাকে মেরে শুইয়ে দেয়।

-“ভাই তুমি ভিতরে যাও এগুলোকে আমরা হ্যান্ডেল করে নিচ্ছি। সানি চিৎকার করে বলে ওঠে।

আমন একবার দেখে নিয়ে কোনও কথা না দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়। এদিকে আকাশ সানি অ্যাস নীহার সবাই মিলে গার্ডদের ফাইট করছে ততক্ষণে অফিসাররা ও এসে গেছে আকাশ সানি গার্ড গুলো কে অফিসারদের হাতে ছেড়ে তারাও বাড়ির ভিতরে চলে যায় দৌড়ে।

আমন দৌড়ে প্রত্যেকটা রুম চেক করতে থাকে। কোথাও সোহা নেই তবে ট্যাব এর দিকে তাকাতেই দেখে সিগন্যাল এখানেই দিচ্ছে। আমন দ্রুত এগিয়ে যায় কোনার শেষের রুমের দিকে। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আমন দ্রুত কোমর থেকে গান বের করে তালাতেই শুট করে দেয়। মুহূর্তে তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে রুমের। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আছে আবছা হয়ে আছে চারদিকে। আমন মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে রুমের মধ্যে হাতড়ে সুইচ অন করে। আলো জ্বলে উঠতেই আমন এবার পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নেয় ।সাথে সাথে তার পুরো শরীর জমে যায় সামনের দিকে তাকিয়ে । পা থমকে গেছে বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। আমন পুরো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী থমকে গেছে। কি এক অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুকের মধ্যে রক্তক্ষরন শুরু হয়েছে। আমন এর চোখ দিয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। অ্যাস নীহার আকাশ সানি তারাও দৌড়ে আসে। রুমের ভিতরে ঢুকতে তাদেরও আমনের মত অবস্থা তারাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। অ্যাস এর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অ্যাস এর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে আওয়াজ বেরিয়ে আসে।

-“সোহা….

সামনে পড়ে আছে সোহার নিথর দেহ । রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর। সোহার চোখ মুখ পুরো সাদা ফ্যাকাশে রক্ত শূন্য হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে।

চলবে…… ❣️

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here