তোর মনের অরন্যে পর্ব-৩২

0
595

#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩২.
সোহা ব্যাঙ্গালোর ছেড়েছে আর প্রায় দশ দিনের বেশি হতে চলেছে। এর মধ্যে একবারও আমনের সাথে সোহার কোনো যোগাযোগ হয়নি। এমনিতেও এইরকম ইমার্জেন্সি মিশনে সোহার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। হটাৎ করে ওদের পাঁচ জন কে জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি থেকে চলে যেতেই প্রথমে আভা চৌধুরী ও সম্রাট চৌধুরী একটু চিন্তায় ছিলেন তবে আমন বোঝাতে চিন্তা মুক্ত হন। তারা এইরকম পরিস্থিতির সাথে এই প্রথম পড়েছে। তাই চিন্তিত হয়ে গেছিলো। অ্যাস বাড়িতে দুই তিনেক থাকে তাই তার কাজের কথা জানলেও এই মুহূর্তের সাথে পরিচিত নয়।

তবে এই দশ দিনে আমন সব সময়ে তার কাজে ব্যস্ত ছিল। সোহার এখানকার মিশনে উঠে পড়ে লেগেছিল। যাতে সে সব কাজ গুছিয়ে রাখতে পারে। আর তাছাড়াও এখানে এমন অনেক কিছুই আছে যা সোহা জানে না। আর আমনও এই মুহূর্তে সব কিছুই জানাতে চাইছে না তাই সে সোহার এই অনুপস্থিতির সময়ে তার সব কাজ গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে । তবে এই সময়ে আমন এমন অনেক পরিস্থিতি ও সত্যের মুখোমুখি হয়েছে যে সে কখনও ভাবতেই পারিনি। এখন সব কিছুই তার কন্ট্রোলে আছে শুধুমাত্র সোহার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে আমন তারপরেই শুরু হবে আসল খেলা।

আমন অফিসে এসে নিজের কেবিনে ঢুকতেই দেখতে পায় সামনেই চেয়ারে মণিকা বসে আছে। এটা দেখেই আমনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে কোনো রকম কথা ছাড়াই ভিতরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে মণিকার এর তীক্ষ্ণ মোহিত দৃষ্টিতে তাকায়। এদিকে মণিকা আমনকে আসতে দেখেই খুশি হয়ে যায়। এতদিন পরই যে তার কার্য্য সিদ্ধি হতে চলেছে এতেই সে খুশি।

-“হাই আমন ।

-” হেই মণিকা তুমি যে এখানে এসেছ আমি খুশি হয়েছি। আমন বলে ওঠে ।

-“তুমি ডেকেছ আর আমি না এসে থাকতে পারি আমন। আমি ভাবতেও পারছি না তুমি নিজে থেকে আমাকে এখানে ডেকেছ। সত্যি এটা আমার কাছে অনেক খুশির। মণিকা আনন্দে বলে ওঠে।

-” হ্যাঁ আসলেই তোমার সাথেতো আমার সেই ভাবে কখনো কথা হয়নি তাই ভাবলাম তোমার সাথে কিছু টাইম স্পেন্ট করা যাক। আমন মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

-” আমিতো সবসময়েই তোমার সাথে সময় কাটাতে চাই আমন। মণিকা একটু লজ্জা পাওয়ার মত করে বলে ওঠে।

-“হ্যাঁ আমিও এখন একটু ফ্রি আছি তাই অবশ্যই তোমার সাথে সময় কাটানো যায়। এর আগেও তোমার সাথে বিজনেস ডিল ছাড়া কোনো কথা হয়নি। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে খুব ভালো বন্ডিং আর সেখানে আমরা কেনো বা পিছিয়ে থাকবো। তাই ভাবলাম তোমার সাথেও আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হওয়া উচিত। আমন মণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

-“সম্পর্ক! হ্যাঁ আমন আমাদের মধ্যেতো সম্পর্ক আছে। আমাদের বাড়ি থেকেতো আমাদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। মণিকা লজ্জা ভাব নিয়েই বলে ওঠে।

-” হ্যাঁ আসলেই আমাদের বাড়ি থেকে সব কিছুই ঠিক করে রেখেছে সেখানে আর বাঁধা দিয়ে কি লাভ বলো আমি ভেবে দেখলাম বড়রা যা ঠিক করে আমাদের ভালোর জন্য। তাছাড়া তুমিও আমাকে পছন্দ করো। কি তাইতো পছন্দ করোতো মণিকা? আমন তির্যক চাহনি দিয়েই জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” আমন আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি আর শুধু পছন্দ করিনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি অনেক। এটা তোমাকে আমি অনেকবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছি। মণিকা বলে ওঠে ।

-” তাই তুমি আমাকে ভালোবাসো?

-“হ্যাঁ আমন আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য সব কিছু করতে পারি সব কিছুই। মণিকা বলে ওঠে ।

-“বাহ মণিকা তুমি আমাকে এত ভালোবাসো আর আমি কিনা সেটাই বুঝতে পারিনি। আমন বলে ওঠে ।

-” কোনো ব্যাপার না আমন এখনতো বুঝতে পেরেছ আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তাছাড়া তুমিও আমার সাথে সেই জন্য তো দেখা করেছ আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবতেও চাইছ। মণিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে আমন এর পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে।

আমন শুধু একবার তার আর মনিকার অবস্থানটা দেখে নেয়। মণিকা একদম তার পাশে এসে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমন চোখ বন্ধ করে আবারো চোখ খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মণিকার দিকে। আমনের এই দৃষ্টিতে যে কেউ ঘায়েল হয়ে যেতে পারে। আর সেখানেতো মণিকা আগের থেকেই লাট্টু হয়েছিলো আমনের প্রেমে তাই আমনের এই দৃষ্টি মণিকাকে আরো বেশি করে আকর্ষণ করে আমনের দিকে।

-“হ্যাঁ মণিকা আমিও এখন সেটাই চাই আমাদের সম্পর্কেও একটা নাম হোক। আমন বলে ওঠে ।

-” ওহ আমন আমি আজকে খুব খুশি শেষ মেস তুমিও আমার সাথে সম্পর্ক গড়তে চাও এই দিনের জন্য আমি কতদিন থেকে ওয়েট করে আছি। আজকে আমি খুব খুশি আমন খুব।

মণিকা উত্তেজনার বশে আমনকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই আমন হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় মণিকাকে। মণিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমনের দিকে। আমন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মণিকা বুঝতে পারে সে বেশি তাড়াহুড়ো করছে। এমনিতেও সে জানে আমন এমন পছন্দ করেনা তাই নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। আমন কোনো কথা বলেনা।

-“তুমি একটু বসো আমার কিছু কাজ আছে সেগুলো সেরে নিয়েই আমরা বেরোব আজকে একসাথে লাঞ্চ করবো। আমন হেসে বলে ওঠে।

-” হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি তোমার কাজ সেরে নাও না আমি তোমার জন্য সব সময়ে অপেক্ষা করতে রাজি আছি। মণিকা বলে ওঠে ।

-“ওকে ।

আমন মণিকার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফাইলে মুখ গুঁজে দেয়। কিছুক্ষণ পর সামনে থেকে ল্যাপটপ টেনে নিয়ে আমন ল্যাপটপ অন করতেই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা যুগল বন্দি হাস্যউজ্জ্বল ছবি। আমন আর সোহার একসাথে একটা ছবি। যেটাতে আমনের পিঠের উপরে চেপে সোহা রয়েছে তার হাত দুটো আমনের গলা জড়িয়ে রেখেছে। আর আমন সামনে থেকেই ছবি তুলেছে। এটা কয়েকদিন আগের ছবি যেদিন তারা একসাথে সারা দিন ঘুরেছে আমন এক দৃষ্টিতে ল্যাপটপ এর স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে তার কাজ শুরু করে।

-“আচ্ছা মণিকা তোমার মায়ের নামটা যেনো কি? আমন কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” মম এর নাম তো সোনিয়া মল্লিক । কেনো আমন তুমি জানতে না বুঝি? মণিকা বলে ওঠে।

-“উম! আচ্ছা মণিকা তোমার মামার বাড়ি কেউ নেই? না মানে আমিতো কখনো তোমার মামাদের ব্যাপারে শুনিনি তাই জিজ্ঞেস করছি আর তাছাড়াও আমি তোমার ব্যাপারে কিছুই জানিনা। তাই এখন থেকে জেনে নিচ্ছি। আমন একবার মণিকার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

-” না না আমন আমার মামার বাড়ির তো কেউ নেই আমি শুনেছি মম একাই আর আমার মম এর বাবা মা ও নেই কোনো এক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। তবে শুধু এক আংকেল আছেন উনি মমের অনেক ক্লোজ । মণিকা বলে ওঠে ।

-” আংকেল? আমন ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে।

-“হ্যাঁ ইমরান আংকেল। আংকেল বাপির ও ফ্রেন্ড। আমাদের বাড়িতেও প্রায় আসেন। মণিকা হেসে বলে ওঠে।

-“ইমরান আংকেল আর তোমার মম অনেক ক্লোজ তাইনা?আমন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে ওঠে।

-” হ্যাঁ । আমন কোনো সমস্যা? মণিকা আমনের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-“না আসলেই একটা পাজেল সল্ভ করছিলাম। আমন বাঁকা হেসে বলে ওঠে।

-” কিসের পাজেল আমন? মণিকা জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” এত তাড়া কিসের সময়ে হলে জানতে পারবে। চলো আমরা বের হই। আমন রহস্যময় হেসে বলে ওঠে।

আমনের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে মণিকা আর বেশি কিছু ভাবেনা আমনের কথা নিয়ে সেও আমনের সাথে বেরিয়ে যায়। আমন ও মণিকা একসাথে লাঞ্চ করে মণিকা কে বাড়িতে ড্রপ করে আমন বেরিয়ে যায় তার কাজে।

————-

আমন বাড়িতে ফিরতে দেখে তার মম আর ড্যাড কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী আমনকে দেখতেই তার দিকে দুজনেই তাকিয়ে থাকে। আমন তার মম ড্যাডের তাকানো দেখে বুঝতে পারে তাঁরা কেনো এই ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে । এতক্ষণে যে সবার কাছে আজকের ব্রেকিং নিউজ ছড়িয়ে গেছে সেটা আর তার বুঝতে বাকি নেই এটা ভেবেই মনে মনে বাঁকা হেসে ওঠে। তবে বাইরে থেকে একদম স্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে আছে।

-“আমন বেটা আমরা এটা কি শুনছি? এটা কি ঠিক? সম্রাট চৌধুরী জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” কি শুনেছ ড্যাড? আমন একদম স্বাভাবিক বলে ওঠে যেনো কিছুই জানে না এমন ভাব।

-“সাজিদ ফোন করেছিলো। আজকে নাকি তুমি আর মণিকা একসাথে টাইম কাটিয়েছ নিজেদের মতো করে আর… ।বলেই থেমে যায় সম্রাট চৌধুরী।

-“তুই নাকি মণিকার সাথে রিলেশনে যেতে চাইছিস? আভা চৌধুরী জিজ্ঞেস করে ওঠেন।

-“হ্যাঁ তোমরা ঠিক শুনেছ। আর তোমরাওতো তাই চাইতে যে মণিকা আর আমার সম্পর্ক হোক। সেই জন্যতো আমাকে না জানিয়ে বিয়ের কথা বলে ছিলে। তাহলে এখন এত অবাক হচ্ছো কেনো? আমন তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে।

আমনের কথা শুনে আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী চুপ করে যান। তারা আমনের কথা বলার টোন বুঝতে পারে। আমন যে এখনও তাদের ওই একটা কাজের জন্য তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছে সেটা আর তাদের বুঝতে বাকি নেই। তবে তারা আজকে এই খবর শুনে চমকে গেছে। যেই ছেলে মণিকার সাথে তার বিয়ের কথা শুনে একমাস তাদের সাথেই কথা বলেনি ঠিক করে কত রাগ ছিলো এই নিয়ে আর সেই ছেলে কিনা নিজের থেকে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এমনটা যে কি করে সম্ভব হলো সেটাই বুঝতে পারেনা তারা। আমন বসে বসে তার বাবা মায়ের অবাক দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছে। এর মধ্যেই আমন এর ফোন তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে ওঠে। আমন ফোন বের করতে দেখে অ্যাস কল করছে। এটা দেখেই তার ভ্রু কুঁচকে যায় তবে খুশি ও হয়। আমন ফোন রিসিভ করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ওপার থেকে উত্তেজিত কন্ঠ ভেসে আসে।

-“ভাই ভাই সোহা কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

অ্যাস এর কথা শুনেই আমন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় । সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় কপালে ভাঁজ পড়ে যায়।

-” খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা মানে? কিসব বলে যাচ্ছিস তুই তোর মাথা ঠিক আছেতো? আমন কিছুটা কঠিন ভাবে বলে ওঠে।

-“ভাই আমি ঠিক বলছি সোহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আজ তিন দিন হচ্ছে ওর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আমরাও কোথাও ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। অ্যাস কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে।

-“তিন দিন থেকে ওর খোঁজ নেই আর আজকে তুই আমাকে জানাচ্ছিস। আমন এবার রাগে হুঙ্কার ছেড়ে বলে ওঠে।

-“ভাই সোহা কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। আর ও প্রায় এমন গায়েব হয়ে যায় তবে সেটা কিছুক্ষণ বা একদিনের জন্য। ওকে কেউ আটকে রাখতে পারেনা তাই আমরা অত চিন্তা করেনি কিন্তু দুইদিন হয়ে যাওয়ার পরও ওর কোনও খোঁজ পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই ওর কোনও বিপদ হয়েছে। আমরা ভিতর থেকেও কোনো খোঁজ পাচ্ছিনা ওর। অ্যাস কান্না ভেজা কন্ঠে বলে ওঠে।

অ্যাস এর কথা শুনে আমনের বুকের ভিতর ধক করে ওঠে যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায় এক অজানা শঙ্কা তাকে গ্রাস করতে থাকে। অদ্ভূত এক বাজে অনুভূতি হতে শুরু করে । তার মাথায় যেনো কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তার কানে একটাই কথা বেজে যাচ্ছে সোহাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমন ধাপ করে বসে পড়ে। অ্যাস এর কথাও তার কাছে আর পৌঁছায় না। সোহা নিখোঁজ সোহাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সোহার বিপদ। এটাই শুধু আমনের মাথায় ঘুরছে। এদিকে আভা চৌধুরী আর সম্রাট চৌধুরী আমনের হটাৎ এমন প্রতিক্রিয়া দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। আমন মাথায় হাত চেপে বসে আছে। তার পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ একদম চুপচাপ পুতুলের মতো করে বসে থাকে। তারপরেই হঠাৎ করেই সোহার কথা মাথায় আসতে উঠে দাঁড়িয়ে উপরে তার রুমের দিকে দৌড় দেয়।

চলবে….. ❣️

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here