তোর নামের রোদ্দুর ?বোনাস পর্ব?

0
749

#তোর_নামের_রোদ্দুর
?বোনাস পর্ব?

লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা

খড়ের ছাউনিটার কোনে ঠেস দিয়ে রাখা শেওলা পরা বাশ জরিয়ে তাতেই মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছি।অজান্তেই একরাশ মুগ্ধতা ভর করেছে মনে,যার প্রবাহ হয়তো অজান্তেই হাসি হয়ে বেরিয়ে আসছে।প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বাজ না পরলেও,মেঘের গর্জনটা আছে।সামনে রুপকথার তেপান্তরের মাঠের মতোই ঘাসের আগায় মুক্তোদানা বিছানো সবুজ বিস্তৃত মাঠ।বৃষ্টিতে ভিজে নিজের মনকে খুশি করার উপযুক্ত পরিবেশ।তবুও তা উপভোগের বিন্দুমাত্র খেয়াল আসছে না মনে।এই পরিবেশটা তো নিতান্তই আমার জন্য।কিন্তু আজ সে সবটা ছাপিয়ে মন আর চোখ শুদ্ধতে আটকে আছে।তার হাসিতে,প্রানোচ্ছলতাতে আটকে আছে।

কালো হাফ হাতা গেন্জি,গোড়ালির অনেকটা উপর অবদি ভাজ দিয়ে গুটানো কালো জিন্স,খালি পা,ফর্সা হাতপায়ের কোথাও কোথাও লেগে থাকা কাদা,ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পরতে থাকা পানি আর উপচে পরা খুশি ঠোটজোড়ায় হাসি হিসেবে শোভা পাচ্ছে শুদ্ধের।কখনো ঠোট কামড়ে,কখনো চুল উল্টে পায়ে ফুটবল ঠেলতে ব্যস্ত উনি।চারপাশে সাত আটটা ছেলের দল ছুটছে ফুটবল কেড়ে নেওয়ার জন্য।

বাসার বাইরে বেরোতেই দেখলাম বৃষ্টিটা কমেছে।যাকে বলে ইলশেগুড়ি।গায়ে লাগছে না বললেই চলে।শুদ্ধ আমার হাত ধরে ছুটলেন।আমিও বিস্ময় নিয়ে শুদ্ধের সাথেই দৌড়াচ্ছিলাম।লোকটার চোখেমুখে এতোটা আনন্দ আগে দেখেছি কিনা মনে করতে পারছিলাম না।হলেও প্রকাশ করতেন না হয়তো।একদম শিশুর মতো সবটা বেরিয়ে আসছিলো তার হাসিতে।বাসার সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে একটা সরু গলিতে ঢুকে পরলেন উনি।সামনে তাকিয়েই বললেন,

-এদিক একটু সাবধানে দেখে দৌড়া।

আমি তো তার হাসিতেই মন্ত্রমুদ্ধ হয়ে ছিলাম।সাবধানতা তো সেখানেই করা উচিত ছিলো।যা হয়নি।বৃষ্টিটার বেগ বাড়লো।শুদ্ধ একটু গতি কমিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন আমার।এবার দুহাত আমার মাথার উপর‌ দিয়ে পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে বললেন,

-চল।আর একটু।

তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভরে উঠছে আমার।খেয়াল হলো বেশ অনেকক্ষন হলো পলক ফেলিনি আমি।একবার চোখ বন্ধ করে আবারো তার সাথেই পা মেলাতে লাগলাম।একটু দুর এগোতেই বিশাল একটা ফাকা মাঠ।একদম জনমানবশুন্য।অবশ্য বৃষ্টিতে কেউ বা আসবে?এই অদ্ভুত মানুষটা ছাড়া!সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো সবুজ চাদর পাতা আছে ওখানে।একপাশে খড়ের ছোটখাটো একটা ছাউনি।আমাকে নিয়ে সেখানেই দাড়ালেন শুদ্ধ।ওড়নায় আমার চুলগুলো নেড়েচেড়ে বললেন,

-এখানেই দাড়াবি তুই।একচুলও নড়বি না।

বলেই উনি খড়ের ঝুপড়ি থেকে বাইরে বেরোলেন।ওটার চারপাশে বেড়া নেই।শুধু উপরটাতেই যা।আমি পা বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবো,তার আগেই শুদ্ধ আঙুল উচিয়ে বললেন,

-বললাম না বেরোবি না।

-কিন্তু…

-খবরদার সিয়া!যদি বেরিয়েছি তুই আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

কাচুমাচু হয়ে দাড়ালাম।শুদ্ধ একদৌড়ে ভিজতে ভিজতেই মাঠের ওপাশটায় চলে গেলেন।কয়েকজনের নাম ধরে ডাক লাগালেন মনে হলো।
এবার মাথার চুলগুলো উল্টে মুখে আঙুল দিয়ে জোরেসোড়ে শীষ বাজালেন উনি।তব্দা মেরে দাড়িয়ে তার কান্ডকারখানা দেখছি শুধু।এই লোকটার পাগলামির সীমা দিন দিন এতোটাই পার হচ্ছে যে আমার সন্দেহ হয় আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছে তো?অভারলোডেড হয়ে যাচ্ছে সবটা।তবুও,তার মুখের এ হাসিটার জন্য চুপচাপ সবটা দেখতে লাগলাম।

কিছুটা সময় পর দুচারটে ছেলে দেখলাম মাঠের কোনায় এসে দাড়ালো।বয়স বারো তোরো হবে।শুদ্ধকে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে দৌড়ে গিয়ে ইয়েএএএ বলে এসে সবগুলো জরিয়ে ধরলো শুদ্ধকে।শুদ্ধও ওদেরকে জাপটে ধরলেন।একটা ছেলে পিছনদিক দৌড়ে গিয়ে আরো কয়েকজনকে ডেকে আনলো।সবাই মিলে এমন করছে যেনো হারানো রাজা ফিরে পাওয়া প্রজা ওরা।শুদ্ধ ওদের নিয়ে আমার কাছে এসে মুচকি হেসে বললেন,

-এই হলো সেই রোদ্রময়ী।

রোদ্রময়ী?এমন কোনো শব্দ হয়?ভ্রুকুচকে তাকালাম তার দিকে।একটা ছেলে বললো,

-ওমা?এই তবে রোদুভাবি?তোমার শ্যামাপাখি?

-এই মায়াবী চেহারার ভাবিটা তোমাকে পোড়ায় শুদ্ধ ভাইয়া?একে দেখে তো শীতল ঝর্না মনে হয়।

-ও রোদুভাবী,শুদ্ধ ভাইয়াকে একদম পোড়াবে না তো আর!কতো কষ্ট পায় ভাইয়াটা!

-হ্যাঁ,তাইতো!শোনো রোদুভাবি!তোমার নামে এতোশত নালিশ জমেছে।অন্যদিন আসলে শুনাবো।আজ বরং আমাদের ম্যাচ দেখো।

-শুদ্ধ ভাইয়ার শ্যামাপাখির গান শুনবো না আমরা?

এতোগুলো সম্বোধনে মাথা ঘুরতে লাগলো আমার।শুদ্ধ ছেলেটার দু কাধে হাত রেখে পিছনে দাড়িয়ে‌ বললেন,

-শ্যামাপাখির গান শুধু আমার জন্য রাফি।বাসায় সবাইকে শুনিয়েছিলো,শাস্তি পেয়েছিলো এজন্যে।কান ধরিয়ে রেখেছিলাম।

হিহি করে হেসে দিলো সবগুলো।এক ছেলে বললো,

-রোদুভাবি?তুমি তাহলে আমাদের জন্য আজ দর্শক হও।এ মাঠে শুদ্ধ ভাইয়া বৃষ্টি ছাড়া খেলে না,আর বৃষ্টিতে একটা দর্শকও পাই না আমরা।আর হ্যাঁ!শুদ্ধ ভাইয়ার পক্ষে না বলে,আমাদের হয়ে একটু চিটিং করে দিও।

আমি হা করে ওদের কথা শুনছিলাম।শুদ্ধ থুতনি ধরে মুখ বন্ধ করে দিয়ে বললেন,

-তিনবছর আগে প্রায়ই আসতাম ওদের সাথে খেলতে।এভাবেই বৃষ্টিতে ডাক লাগালে,শীষ বাজালেই বেরিয়ে আসতো সবগুলো।তোর কথা বলেছি ওদের।তাই এভাবে বলছে।এখন এভাবে হা হয়ে না থেকে বি দ্যা রেফারি!পারলে ওদের হয়ে চিটিং করে দেখা!

এটুক বলেই আমাকে চোখ মেরে ছেলেগুলোর সাথে মাঠের মধ্যে চলে গেলেন উনি।ফুটবল খেলতে খেলতে শুদ্ধ হাসছেন।প্রান খুলে হাসছেন।আর চোখ ভরে দেখছি তাকে আমি।কতোটা সময় কেটে গেছে জানি না।উনি বৃষ্টিতে ভিজছেন সেটা খেয়ালই হয়নি আমার।শুধু দেখছিলাম তাকে।বেশ কিছুটা সময় পর ছেলেগুলোকে একসাথে ডেকে কিছু বললেন শুদ্ধ।ওরা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সুচক ই বুঝিয়ে একনাগাড়ে তাকে আলিঙ্গন করে বল গুড়োতে গুড়োতে বাড়ির পথ ধরলো।শুদ্ধ আমার দিকে তাকালেন এতোক্ষনে।স্বাভাবিক বেগে দৌড়ে এসে বললেন,

-তুই বোর হচ্ছিস?আসলে অনেকক্ষন ভিজেছে ওরা।অসুখ করবে।তাই বাসায়‌ চলে‌ যেতে বললাম।

ধ্যান থেকে বেরিয়ে নিজেকে সামলে বললাম,

-আমিও ভিজবো বৃষ্টিতে।

-না।অসুখ করবে।তুই এক কাজ কর,আরেকটু দাড়া।আমি এই বৃষ্টিকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে আসি।

-কিন্তু…..

শুদ্ধ দৌড়ে গিয়ে মাঠের আরেকটু মাঝ বরাবর দাড়ালেন।মাথা উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে দু হাত ছড়িয়ে দাড়ালেন।আমি একটু অবাক হয়ে দেখছি এবার তাকে।কি করবেন উনি?কি বলবেন বৃষ্টিকে?

-এই বর্ষন???শুনতে পাচ্ছিস?আজ তোর ধারার এতোটুকো প্রয়োজন নেই আমার।শুদ্ধর লাগবে না তোকে।ও তো সিয়া নামের রোদ্দুরের তপ্ততাই ভালোবাসে।আর সে সিয়া কাছে আছে ওর।পাশে আছে ওর।যেটুকো দেখলি আমাকে,সবটা ওর পাশে থাকার ফল।তুই তো শুধু উপলক্ষ্য মাত্র।এই বিস্তৃত মাঠের প্রতিটা ঘাসের ডগায় লেগে থাকা পানিকনা সাক্ষ্যি,শুদ্ধ সিয়াতে পুড়তে ভালোবাসে,তোর বর্ষনে নয়!তুই আমার জীবনে কি এনে দিয়েছিস?আজ অবদি শুধু একাকিত্বকে মনে করিয়ে দিয়েছিস।আজ আমি তোকে দেখাচ্ছি।ওই দেখ!ওইতো আমার সিয়া।আমার সিয়া।ও আমার কাছে।দেখেছিস তুই?দেখেছিস?আজ আর তুই আমাকে কষ্ট দিতে পারবি না।আমার যন্ত্রনাকে মনে করিয়ে দিতে পারবি না।আজ শুধুই ভাসবো আমি খুশির ধারাতে।সিয়াকে পাশে পাওয়ার খুশির ধারাতে!

জানি না কি হলো আমার,একছুটে গিয়ে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলাম তাকে।কিছুটা থমকে গেছেন উনি এটা আমি জানি।তার বুকের গেন্জি খামচে ধরে পিঠে গাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছি।শুদ্ধ আমার হাতের উপর হাত রাখলেন।ছাড়িয়ে নিয়ে হয়তো পিছন ফিরবেন উনি।ওনাকে সুযোগ না দিয়ে আরো ভালোমতোন গেন্জি খামচে ধরলাম তার।গরগর করে বলতে লাগলাম,

-একটু সময় দিন শুদ্ধ।প্লিজ ঘুরবেন না আপনি।এভাবেই থাকতে দিন কিছুটা সময় আমাকে।প্লিজ!

শুদ্ধ থেমে গেলেন।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে ওভাবেই জরিয়ে ছিলাম তাকে।উনি শান্ত গলায় বললেন,

-এভাবে ভিজলে জ্বর হবে তোর সিয়া।

-হবে না।যদি হয়,সেটা নিতান্তই আপনার নামের রোদ্দুরে পোড়ার ফল।আপনার কাছে থেকেও দুরে থাকার তীব্র যন্ত্রনার আগুনে দাহ হওয়ার পরিনাম।বৃষ্টিতে ভিজে কিছু হবে না আমার।

বাজ পরেছে কোথাও!কিন্তু আজ তো কেউ‌ আমাকে দমাতে পারবে না।আজকে শুদ্ধর সিয়া শুধুই তার।প্রকৃতি নিজে বাধ্য করেছে আমাকে।নইলে এসময় এভাবে বৃষ্টি হতো না।পরপর আরো দুটো বাজপরা শব্দ!গোড়ালি উচিয়ে পায়ের পাতায় ভর করে আরো জাপটে ধরলাম শুদ্ধকে।একদম মিশে গেছি তার পিঠে।বৃষ্টি এবার তীরের মতো বিধছে গায়ে।ঠান্ডা হাওয়াও গায়ে লাগছে।পিছনেই সে বাতাসে আমার সাদা ভেজা ওড়নাটা শব্দ করে উড়ছে।সন্ধ্যার আগমুহুর্তটা এটা।ঘরে ফেরার সময়।কিন্তু আমি কোথাও ফিরবো না আজ।আমার গন্তব্য তো আমি পেয়ে গেছি।কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলাম,

-ভালোবাসি শুদ্ধ।খুব ভালোবাসি আপনাকে।আপনার মতো করে হয়তো নয়,হয়তো অতি সাধারনভাবেই,তবে আমার মতো করেই আপনাকে ভালোবাসি আমি।আপনার শ্যামাপাখি আপনাকে ভালোবাসে।শুনতে পাচ্ছেন শুদ্ধ?আপনার সিয়া আপনাকেই ভালোবাসে।আপনাকেই।এই উন্মুক্ত মাঠে চিৎকার করে যেমন বলছি,তেমনটা পুরো পৃথিবীকেও জানিয়ে দিতে চাই আমি।আপনাকে ভালোবাসি।ভালোবাসি শুদ্ধ।ভালোবাসি আপনাকে আমি।ভালোবাসি!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here