#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ৩২
ব্যালকনির রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়িয়ে রয়েছি।পথ দেখে চলেছি সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার।শুদ্ধর!ভর সন্ধ্যের আধারে ঘর নিমজ্জিত।নিভু নিভু দুটো মোম টেবিলে।ব্যালকনির গাছে আজই ফোটা টকটকে একটা লাল গোলাপ তার পাশেই রাখা।শুদ্ধর আসার সময় হয়েছে দেখেই মোমদুটো জ্বালিয়েছিলাম।কিন্তু মোম ফুরিয়ে আসছে,ওনার দেখা নেই।সময় যেনো কাটতেই চাইছে না।অস্থির লাগছে আমার।কখন শুদ্ধ আসবেন?কখন তাকে বলবো?ভালোবাসি তাকে!কখন ফুরোবে এই অপেক্ষার রোদ্দুরের উত্তাপ?কখন?
মোম নিভে গেলো।আরো অন্ধকার হয়ে আসলো ঘর।লাইট জ্বালাইনি বলে তাকাতেও পারছি না সেদিক।মোবাইলটা ঘরেই রাখা।ওটা এনে শুদ্ধকে ফোন লাগাবো,এক পা এগোনোর সাহস হচ্ছে না আমার।বাগানের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো একে একে।ব্যালকনিটা আলোকিত হলো খানিকটা।গুটিগুটি পায়ে পা বাড়াতে লাগলাম রুমের দিকে।পানিতে ভরে উঠতে লাগলো আমার চোখ।
একটু এগোতেই কেউ দরজা খুলে রুমে ঢুকলো।সুইচ অন করে আলো ছড়িয়ে দিলো ঘরজুড়ে।উজ্জ্বল আলোয় সেই চেনা মুখ।শুদ্ধ!একছুটে গিয়ে জাপটে জরিয়ে ধরলাম তাকে।হাতের ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে মেরে উনি চুল মুঠো করে নিলেন আমার।শান্ত গলায় বললেন,
-কি হয়েছে সিয়া?ঘর অন্ধকার ছিলো কেনো এভাবে?আর ভয় পাচ্ছিস কেনো তুই?এইতো আমি এসে গেছি!
পিঠের শার্ট আরো জোরে খামচে ধরলাম তার।উনি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখার চেষ্টা করলেন খানিকটা।তারপর আমার চুলে চুমো দিয়ে বললেন,
-এমন করছিস কেনো সিয়া?কি হয়েছে?
হুশে ফিরলাম আমি।সত্যিই তো!এমনটা কেনো করছি আমি?তাকে ভালোবাসি বলার কথা,কাছে আসার কথা আমাদের।তাহলে এভাবে ভয় পাচ্ছি কেনো?এমন অজানা আশংকা কেনো?ওনাকে ছেড়ে চোখ তুলে তাকালাম আমি।শুদ্ধ আমার গালে হাত বললেন,
-একটু লেইট করেছি বলে এই অবস্থা?
….
-ওকে।আর হবে না এমন!পাক্কা!
তাকে ছেড়ে সরে দাড়ালাম।উনি পুরোঘরে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন,
-টেবিলে ক্যান্ডেলস্ কেনো?
এবার গুটিয়ে দাড়ালাম।শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে শেষ হওয়া মোমদুটো ছুইয়ে দিলেন।পাশের গোলাপ ধরতে গিয়েও থেমে গেলেন।মুচকি হেসে কিছু না বলে টাইটা টেনে খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন উনি।নিজেকে শক্ত করে নিলাম আমি।সরিয়ে রাখা বাকি মোমদুটো জ্বেলে রুমের লাইটস্ অফ করে দিলাম।ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিক তাকালাম।আবছা আলোয় দেখলাম,শুদ্ধ শুধু একটা ট্রাউজার পরে একদম খালি গায়ে বেরিয়ে এসেছেন ওয়াশরুম থেকে।কপালের হালকা ভেজা চুল,সিক্ত মুখ ছেড়ে আজও তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছতে ব্যস্ত উনি।ঘর আবারো অন্ধকার দেখেই আমার দিক তাকালেন।
চোখ পরতেই তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম আমি।ওড়না আঙুলে প্যাচাতে লাগলাম।ঘাম ঝরতে শুরু করে দিয়েছে এবার।জর্জেটের ওড়নায় ঘাম মোছার বৃথা চেষ্টাও করলাম।শুদ্ধ মুচকি হেসে তোয়ালেটা বিছানায় ছুড়ে মারলেন।আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।কিন্তু সে লোক সোজা সুইচের কাছে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো আবারো।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল নাড়তে নাড়তে “বোল দো না জারা”গানের হুইস্টলিং করতে লাগলেন শুদ্ধ।
কিছুটা রাগে কপাল কুচকে আসলো।কিন্তু গানের কথা ভেবে,হ্যাঁ,বলে দেবো!সত্যিই বলে দেবো!ভেবে নিজেকে সামলে নিলাম আবারো।গটগট করে গিয়ে লাইট অফ করে দিলাম রুমের।
শুদ্ধ আটকে গেছেন।ধীর পায়ে এগোলেন আমার দিকে।আমি নিচদিক তাকিয়ে দু পা পেছোলাম।উনি এগোচ্ছেনই।এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার।শুদ্ধ আমার একদম কাছে চলে এসে কাধের পাশ দিয়ে দেয়ালে হাত রাখলেন।লোকটা একদম খালি গায়ে।চোখ যতোদুর যায়,ফর্সা হাত,বুক নজরে আসছেই।উনি আমার দিকে অনেকটা ঝুকে বললেন,
-এসব কি ম্যাডাম?
-ও্ ওই,আসলে….
-কিছু বলবি?
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বোঝালাম।উনি বাকা হেসেই বললেন,
-ওকে বল।
-শুদ্ধ,আসলে….
-হুম,আমি?আসলে?
-না মানে আমি…আসলে…
-হুম,তুই?আসলে?
নাহ্!এভাবে বলতে পারবো না আমি।একটা জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বুজে বলে দিলাম,
-আপনি এভাবে উদোম গায়ে ঘুরছেন কেনো?
-তো?বউয়ের সামনেই তো!
-সরে দাড়ান!আ্ আর শার্টটাও….
-পরছি।
উনি সরে গিয়ে টিশার্ট পরলেন।হাফ ছাড়লাম আমি।বুকে হাত দিয়ে হৃদপিন্ডের নড়াচড়া কয়েকশগুন বেশি জোরে অনুভব করলাম।কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুদ্ধ অনেকটা দ্রুত এগিয়ে এসে আমার কোমড়ে দুহাত দিয়ে দেয়ালে আটকে দিলেন।চোখ তুলে তাকানোর আগেই বললেন,
-শার্ট পরেছি,সরে দাড়াতে পারবো না!এবার বল?
গলা শুকিয়ে গেছে আমার।কথা দলা বেধে আটকে যাচ্ছে শুধু।শুকনো ঢোক গিলে বলতে লাগলাম,
-শুদ্ধ!আমি….
উনি আচমকাই আমার গলায় নাক ডুবিয়েছেন।দেয়ালে মিশে গেলাম আরো।এমনিতেও বলতে পারছি না।উনি আরো এমন করলে পাগল হয়ে এখানেই আটকে থাকবো আমি।উনি কি বোঝেন না সেটা?কেনো করছেন তবে এমন?শুদ্ধ নেশালো কন্ঠে বললেন,
-বলনা সিয়া!সবটা বল?একবার বল?
-আ্ আমার একটু সময় লাগবে!
ফোন বেজে উঠলো শুদ্ধর।একপলক তাকালেন উনি ফোনের দিকে।তারপর আমার কোমড় ছেড়ে উনি বললেন,
-একটু সময়?ফাইন।
মুচকি হেসে সরে গিয়ে কল রিসিভ করলেন উনি।ফোনে কিছু না বলে শুনছিলেন শুধু।ততক্ষনে আমি গোলাপটা হাতে নিয়ে দাড়িয়েছি।শুদ্ধ চুপচাপ ওপাশের বলা কথাগুলো শুনে শক্ত গলায় বললেন,
-এসব কথা যেনো আর কেউ না জানে!
কিছুটা অবাক হয়েছি।কে এমন ফোন করেছিলো?কি এমন বললো ওনাকে যে একমুহুর্তেই গলার স্বর পাল্টে গেলো ওনার?কি এমন কথা যা অন্যকেউ জানলে তার সমস্যা?ধ্যাৎ!হবে হয়তো অফিসিয়াল কিছু!আমি এতোটা অভারথিংক কেনো করছি?কিন্তু শুদ্ধর চেহারায় অসহায়তা।গোলাপটা আবারো টেবিলে রেখে এগোলাম তারদিক।শুদ্ধ ফোন রেখে চুলগুলো উল্টে ধরে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে।কিছুটা এগিয়ে দাড়াতেই উনি আমার দিক না ফিরে বললেন,
-টায়ার্ড লাগছে সিয়া!প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে।
এই পরিবেশটা একদমই চাইনি আমি আজ।তবুও ওনার সামনে দাড়িয়ে হাসিমুখে বললাম,
-বেশ।আপনি শুয়ে পরুন।আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
বিছানায় এসে বাচ্চাদের মতো আমার কোলে মাথা রেখে কোমড় জরিয়ে ধরে শুয়ে পরলেন উনি।আমি তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।আবারো এই মানুষটা কোনোভাবে কষ্ট পেয়েছে আজ।দুটো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
-এখনো কষ্ট হচ্ছে আপনার শুদ্ধ?
-তুই কাছে থাকলে কষ্ট থাকে না আমার সিয়া।
….
-আচ্ছা সিয়া?তোর জানতে ইচ্ছে করে না?মাঝমধ্যে শুদ্ধ এতোটা অচেনা কেনো হয়ে যায়?কেনো তোর চেনাজানা শুদ্ধ হঠাৎ করেই অন্য শুদ্ধ হয়ে যায়?কেনো…
জানতাম।না বললেও সবটা বুঝে যান উনি।মৃদ্যু হেসে বললাম,
-জানতে ইচ্ছে করে শুদ্ধ।কোনো কোনো সময় আপনার এই গম্ভীরতা এতোটাই যন্ত্রনাদায়ক হয়ে ওঠে,বড্ড জানতে ইচ্ছে করে আমার।কিন্তু আমি এটাও জানি শুদ্ধ,আপনি আমার যতই অচেনা হয়ে যান না কেনো,আমাকে ঘিরে আপনার অনুভুতিগুলো কোনোদিন অচেনা হবে না আমার।তাছাড়া এই কথাগুলো তো আপনি বুঝেই যান।যখন এই কেনোর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করবেন,অবশ্যই জানাবেন আমাকে।আমি জানি।তাই আর আলাদাভাবে আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না।
শুদ্ধ আরো শক্ত করে কোমড় জরিয়ে ধরলেন আমার।কিছুটা সময় পর বললেন,
-একটা কথা বলবো?
-ক্লান্তি কেটে গেলে বলুন।
-পৃথিবীতে সম্পর্কগুলো ঠিক কি দিয়ে বিবেচনা করা উচিত সিয়া?
একটু বিস্ময়।প্রকাশ না করে বললাম,
-মন দিয়ে।
-তাহলে পৃথিবী রক্তের সম্পর্ককেই কেনো প্রাধান্য দেয়?হৃদয় দিয়ে গড়া সম্পর্কগুলো কি এতোটাই ঠুনকো?মুল্যহীন?
হুট করেই আয়ান ভাইয়ার কথা মনে পরলো আমার।কোনোভাবে শুদ্ধ কি আয়ান ভাইয়ার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন?বললাম,
-না শুদ্ধ!সম্পর্ক মানেই তো ভালোবাসা।আর ভালোবাসা মানেই তো আত্মিক বাধন।একজন ভাবলো,কেউ তার খুব কাছের,খুব আপন।কিন্তু তাকে ভালো না বাসতে পারলে,সে কোনোদিনও তার কাছের নয়,কোনোদিনও আপন নয় তার।আবার কারো সাথে কোনোদিন সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিলোই না একজনের,তবুও যদি কেউ সেই মানুষটাকেই ভালোবেসে আপন করে নেয়,তার থেকে সার্থক সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না।আমি তো এটুকোই জানি।
বেশ অনেকটা সময় চুপ রইলেন শুদ্ধ।আবারো বললেন,
-আচ্ছা সিয়া?যদি কখনো আমি তোর থেকে দুরে চলে যাই?কি করবি তুই?
দুরে যাওয়ার কথা শুনেই কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার।হাত থেমে গেলো।টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো আমার।শুদ্ধ তাড়াতাড়ি উঠে বসে আমার চোখ মুছিয়ে গাল ধরে বললেন,
-আরে?বোকা মেয়ে!কাদছিস কেনো তুই?কাদিস না প্লিজ!
আমি কাদছিই।উনি জরিয়ে ধরলেন আমাকে।বললেন,
-আচ্ছা শোন,একটা সিক্রেট শেয়ার করি তোর সাথে!যদি কোনোদিন আমি হার্….
-শুদ্ধ!
-লেট মি ফিনিশ?না শুনলে পস্তাবি!শোন!যদি কোনোদিন তোর থেকে এতোটুকো দুর্….
-শুদ্ধ প্লিজ!
ফুপিয়ে আরো জোরে কেদে দিলাম আমি।উনি গাল ধরে চোখেমুখে অনেকবার ঠোট ছোয়ালেন আমার।বললেন,
-কাদছিস কেনো তুই শ্যামাপাখি?প্লিজ কাদিস না!তোর কান্না সহ্য হয়না কিন্তু আমার!তবে কি জানিস তো?জীবন বরই বিচিত্র!আমরা যা চাই,সবটা তেমনভাবে হয় না।সমাপ্তিটাতে কোনো না কোনোভাবে অসমাপ্তি রয়ে যায়।অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বদলে যায় সবটা।তাই যদি কোনোদিন,কোনোভাবে মনে হয়,আমাকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছিস বা তোর থেকে দুরে সরে গেছি আমি,তোর স্বপ্নের আশেপাশে খুজে নিস আমাকে।পেয়ে যাবি।এটা শুদ্ধের প্রমিস তোর কাছে!তোর থেকে দুরে যাওয়া আমি কল্পনাও করতে পারি না।তোর বিশ্বাসে নিজেকে বিশ্বাস করি আমি।কিন্তু যদি কোনোভাবে,কোনোদিন তাতে ফাটল ধরে,তার জন্য পুরোপুরিভাবে তুই দায়ী থাকবি সিয়া!তুই!আর এজন্যই আমাকে কাছে টানার দায়িত্বও তোকে নিতে হবে সিয়া!পারবি না?সব সিচুয়েশনে আমাকে নিজের করে নিতে?পারবি না?এভাবেই আমার সব ক্লান্তিতে আমার আশ্রয় হতে?তোর গল্পের পরিশিষ্টে যে শুদ্ধ তোরই সিয়া!শুধুই তোর!এটুকো মানিস,দেখবি,কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের।কেউ না!
আমার গল্পের পরিশিষ্টে সে আমার।কতোটা শান্তির ছিলো এই কথাটা তা আমিই জানি।কিন্তু তার আগের কথাগুলো?তার দুরে সরে যাওয়া,তা যে মৃত্যুসম আমার কাছে।তাহলে আমিই কেনো তার কারন হতে যাবো?আমি কেনো দায়ী হবো?কেনো বললেন উনি এরকম?কেনো বললেন?
#চলবে….
[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন ]