তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 29

0
1040

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২৯

রুমে আবছা অন্ধকার জেকে বসেছে।ড্রিম লাইটের টিমটিমে আলোটা সে অন্ধকারকে আটকাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।তবুও যেনো আজ পেরে উঠছে না কিছুতেই।চারপাশ আরো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসছে আমার।কিচ্ছু ভালো লাগছে না শুদ্ধর ওমন ব্যবহারের পর থেকে।বিছানায় হাটু জরিয়ে গুটিশুটি মেরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন শুদ্ধ।লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে বললেন,

-মনে হচ্ছিলো খাবার খাওয়া নিয়ে রেস লাগিয়েছিস কারো সাথে।একদম নাকেমুখে ডিনার শেষ করলি যে?

…..

-বইগুলো এনে দিলাম,কোথায় পড়তে বসবি।তা না এভাবে বসে আছে!

…..

উনি এগিয়ে এসে সামনে বসলেন আমার।কিঞ্চিত ঝুকে বললেন,

-রৌদ্রময়ীর চেহারায় আজ অমাবশ্যা কেনো?

একপলক তাকালাম তার দিকে।ঠোট টিপে হাসছেন উনি।বললেন,

-পড়তে বসবি না?

-কাল থেকে পড়তে বসবো।

-এই কালটা হলো তোর কাল!ফিউচার ইম্পসিবল টেন্স!কোনোদিন আসবে না,তোর পড়াও হবে না।আমি জানি!সো,নো কাল!সব আজ থেকেই!

-ইচ্ছে করছে না পড়তে।

-কেনো?

-ভালো লাগছে না।

-কেনো?

-এমনি।

-এমনি কেনো?

-বললাম তো এমনি!

কথাটা বলতে বলতে হাটু ছেড়ে পাশে ফিরে শুতে যাচ্ছিলাম।শুদ্ধ একটানে তার বুকে ফেললেন আমাকে।মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

-এমন করিস কেনো তুই শ্যামাপাখি?সময়ের টেনে দেওয়া দুরুত্ব সইবে,তোর দুরে সরে যাওয়া না।পুরো পৃথিবীর অপমান সইবে,তোর গম্ভীরতা না।সবার রাগ সয়ে নেবে শুদ্ধ,কিন্তু তোর সামান্যতম অভিমানও‌ সহ্য হবে না ওর বিশ্বাস কর।সহ্য হবে না!

এই কথাগুলো শুনলে কার না ইচ্ছে করবে কথাগুলোর মাঝেই হারাতে?সন্ধ্যেবেলার সবটা ভুলে গিয়ে চুপচাপ তার বুকের মধ্যেই মিশে রইলাম।মাথা তুলেছিলাম একবার।উনি মুচকি হেসে কপালে চুমো দিয়ে আমাকে বুকে জরিয়ে শুয়ে পরলেন।কখন ঘুমিয়েছি জানিই না।তবে ঘুম ভাঙ্গলো কপালে শুদ্ধের ঠোটের স্পর্শে।আমাকে চোখ মেলতে দেখে উনি একটা বড়সর হাসি দিয়ে বললেন,

-গুড মর্নিং শ্যামাপাখি!

একটু হেসে ঠিকমতো উঠে বসলাম।সত্যিই সকালে তার মুখ দেখলে রাতের অন্ধকারের মতো সব মন খারাপ কেটে যায় আমার।শুদ্ধ দুহাত তার মাথার নিচে দিয়ে বললেন,

-আজ হাত লেগে গেছে।সারারাত জরিয়ে ধরে রাখা!কম কথা না!তাইনা বউ?

তারদিক ফিরলাম।ওনার ঠোটে সেই মোহনীয় হাসি।একরাশ মুগ্ধতা,ভালোলাগা,লজ্জা নিয়ে ফ্রেশ হলাম।ডাইনিংয়ে এসে দেখি যীনাত আপু কাটা চামুচ দিয়ে ব্রেড খোচাচ্ছে আর পাশে বসা তামিম ভাইয়ার দিকে তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে আছে।তামিম ভাইয়ার চেহারায় বিরক্তি।আবহাওয়া ঠান্ডা করতে একগাল হেসে বললাম,

-গুড মর্নিং!

মাহি আর সেজোমা জবাব দিলো।চুপচাপ বসে গিয়ে মাহিকে ফিসফিসিয়ে বললাম,

-কি হয়েছে?সেই ঝগড়াই?নাকি আবার লেগেছে?

-এবার তো আরো ইন্টারেস্টিং!

-মানে?

-যীনাত আপুর আম্মু ফোন করেছিলো।ওর কিছু টিউশন মিস যাচ্ছে,বাচ্চাগুলোর গার্ডিয়ান নাকি ক্ষেপেছে।আজই ওকে সোজা তোমাদের বাসায় যেতে বলেছে।আন্টি নাকি ওখানেই।তারপর নাকি দুজন একসাথে তাদের বাসায় যাবে।

-কি?আপু আজই….

-আরে মজার কথাটা তো শোনো!

-এখানে মজার কি আছে মাহি?যীন্…

-ধুরু!পরে ডাকিও ওকে।শোনো!ফুপা অফিস যাওয়ার সময় বলে দিয়ে গেছে,তামিম ভাইয়াকে ওকে নিয়ে যেতে।তামিম ভাইয়া তো ওকে নিয়ে যাবেই না।বলেছে কাজ নাকি হয়নি ওর,পরে যাবে।আমি ফট বলে দিয়েছি ফুপাকে,কাল তামিম ভাইয়া কাজ সেরেই বাসায় ঢুকেছিলো,ও নিজে বলেছে শুদ্ধ ভাইয়াকে আজই যাওয়ার কথা।অগ্নিদৃষ্টি ছুড়েছিলো ভাইয়া এটা শুনে জানোতো ইনসিয়া ভাবি?আবার বলে কি,গাড়ি নিয়ে আসেনি ও,ভাড়া বাচাতে লোকাল বাসে যাবে।এদিকে যীনাত আপুও যাবে না ওর সাথে।অনেকক্ষন কথা কাটাকাটির পর ফাইনালাইজ হয়েছে,ওরা দুজন এক সাথেই যাবে।ফুপা এ বাসার গাড়িই নিয়ে বেরোতে বলেছে তামিম ভাইয়াকে।

কপালে হাত চলে গেলো আমার।শুদ্ধ এসে ভ্রু নাচিয়ে বোঝালেন কি হয়েছে।কিছুই বলিনি।সেজোমাই বললো আপু ভাইয়া চলে যাবে।যীনাত আপুর যাওয়ার কারন শুনে উনিও আর কিছুই বলেন নি।খাওয়া শেষে অনেক বুঝিয়ে আপুকে রাজি করালাম ভাইয়ার সাথেই যেতে।বেশ অনেকটা সময় আমার সাথে কাটিয়ে শেহনাজ মন্জিলের জন্য বেরিয়ে গেলো যীনাত আপু।

_____________

শুদ্ধ অফিস গিয়েছেন আজ।দিনটা কেটেছে বইয়ে মুখ গুজে।এতোএতো পড়া দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।এইতো,শুরু হয়ে গেলো আমার লাইফের আরেক অধ্যায়!বর যখন টিউটর!রাতে পড়িস নি,আজ সারাদিনে এগুলো কমপ্লিট না হলে শাস্তি আছে।শুদ্ধর এটুক কথাই যথেষ্ট ছিলো ওই সাদাকালো বইয়ে চোখ আটকে রাখার জন্য।একদিনে আইনস্টাইন হবো আজ আমি,এই ভাব নিয়ে হাই তুলতে তুলতে পড়েছি কিছুটা।বিকেলের দিকে চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলাম মাহি,মামী,সেজোমার সাথে।সেজোকাকুর সাথে শুদ্ধ একটা ব্রিফকেস নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।সেজোমা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-ইনসু?তুই রুমে যা।

-কাকুর খাবারটা….

-কাকু?

আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সেজোকাকু দাড়িয়ে গেছেন।শুদ্ধ একপলক তারদিক,একপলক আমার দিক তাকিয়ে নিশব্দে হেসে টাইটা টানতে টানতে উপরে চলে গেলেন।কিছু না বুঝে আমি কাকুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-কাকু,আপনার খাব্….

-কে তোর কাকু?

-ম্ মানে?

-শশুড় হই না?আব্বু বলে ডাকবি!নাকি ইয়াদের মতো আব্বু ডাক শোনার যোগ্যতা আমার নেই?আমাকে ডাকা যাবে না আব্বু বলে?আমি কি…

-না কাকু,এসব আপনি…

-আবার কাকু?

-ও তো আমাকেও এখনো সেজোমা বলেই ডাকে!

সেজোমাও গাল ফুলিয়ে বসে।ঠোটে জোর করে হাসি টেনে বললাম,

-বেশ!আব্বু আম্মু!

ওনারা হাসলেন।সেজোমা বললো,

-যা ইনসু!শুদ্ধকে ডেকে‌ নিয়ে আয়।একসাথে খেয়ে নিক বাপ ছেলেতে।

মাথা নেড়ে রুমে চলে আসলাম।শুদ্ধ ওয়াশরুম থেকে সবে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছেন।একটা কালো টিশার্ট,ট্রাউজার পরেছেন।কপালের সামনের চুলগুলো হালকা ভেজা,ভেজা মুখে বিন্দুবিন্দু পানি।ওসব ছেড়ে ঘাড়ে লেগে থাকা অদৃশ্য পানি মুছতে ব্যস্ত উনি।হাটতে হাটতেই টেবিল থেকে কিছু কাগজ বিছানায়,বিছানার ব্যাগ থেকে কিছু টেবিলে রাখছেন।এগিয়ে গিয়ে টেবিলের পাশেই দাড়িয়ে মাথা নিচু রেখে বললাম,

-টায়ার্ড?

উনি থেমে গেলেন।তোয়ালেটা চেয়ারে রেখে সামনে দাড়ালেন আমার।দুহাত পিছনে নিজের পিছনে দিয়ে কিছুটা ঝুকে দাড়ালেন।আমি একটু পেছোতেই উনি আরো ঝুকে কপালে ঠোট ছুইয়ে বললেন,

-ছিলাম।এখন নেই।

নাকে নাক ঘষে দিলেন উনি।চুল কানে গুজে দিয়ে সরে দাড়িয়ে বললাম,

-আপনাকে খাওয়ার জন্য ডাক্….

ফোন বেজে উঠলো ওনার।নাম্বারটা দেখে শুদ্ধ তাড়াতাড়ো রিসিভ করলেন কলটা।ব্যস্ত হয়ে বললেন,

-কোথায় তুই?কেমন আছিস?এভাবে এতোগুলো দিন…

….

-তোকে‌ কতোবার কল করেছি।একটাবার তো রিসিভ করবি কলটা!

….

-আজই?আই মিন এখনই?

শুদ্ধ তাকালেন আমার দিক।কিছু একটা ভেবে বললেন,

-আচ্ছা বেশ।আসছি।

কল কেটে আবারো কাউকে ফোন করলেন উনি।বললেন,

-দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে একদম গেইটের কাছে গিয়ে দাড়া।বেরোবো।

এটুক বলেই ফোন রাখলেন শুদ্ধ।কাবার্ডের কাছে গিয়ে কফি কালারের একটা শার্ট বের করলেন উনি।ওটা বেডে রেখে আরো কিছু খুজতে লাগলেন।আমি একটু বিব্রত হলাম।কে এমন কল করেছিলো?সবে ফিরলেন,আবার এখনই বেরোবেন?এগিয়ে গিয়ে বললাম,

-এখনই বেরোবেন?

-হুম।

….

-কোথায় জিজ্ঞাসা করবি না?

-না।সাবধানে যাবেন আর তাড়াতাড়ি ফিরবেন।

-বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।

কপালে ভাজ পরলো আমার।টের পাচ্ছি।তবুও শুদ্ধকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।আড়চোখে বেডে রাখা শার্টটার দিকে তাকালাম।ওটা পরলে হাজার মাইল দুরে থেকেও হাজারটা মেয়ের চোখে পরবেন উনি।মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা বলে হালকা রঙের শার্টটা পরে যেখানেই দাড়াবেন,মাঝরাস্তার হেডলাইটের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকবেন একদম।অনেককিছু করতে ইচ্ছে করছে শার্টটার সাথে।শুদ্ধ বললেন,

-তোর এই কালারের কোনো জামা নেই সিয়া?

একটু চমকে উঠলাম আমি।বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার দিকে।উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-কিছু জিজ্ঞাসা করেছি!

-আ্ আমার জামা কেনো?

-দান করে দেবো কাউকে!যেমন আমিও যাচ্ছি,হাজারটা মেয়ের চোখে পরতে!তেমন জামাটাও বিসর্জন দে!

তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দুটো জামা বের করলাম।একটা পুরোপুরি কফি কালার,একটা কফি আর ব্লাক মিক্সড।শুদ্ধর সামনে ধরে বললাম,

-দুটোই দিয়ে দেবো।আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।যাকে বলবেন তাকে।আপনার বেরোনো লাগবে না!

উনি দু আঙুলে কপাল ধরে হেসে দিলেন।হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।কথাটা বলে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে।এভাবে বলার দরকার ছিলো না মোটেও।শুদ্ধ এগিয়ে এসে বললেন,

-জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড!একসাথে বেরোবো আমরা।ফ্রেন্ডসার্কেলের সবাই শুদ্ধর বউ দেখবে বলে অস্থির হয়ে আছে।শুনেছে রিসেপশন দেরিতে করবো,তাই আর ওয়েট করতে নারাজ সবাই।একটা রেস্ট্রুরেন্টে একসাথে হয়েছে।ফোন করে তোকে নিয়ে পৌছাতে বললো।রেডি হয়ে নে!এজ সুন,এজ পসিবল!

হাসি ফুটলো আমার মুখে।তাড়াতাড়ি চেন্জ করে নিলাম।কফি কালারের গাউনটাই পরলাম।সাজ বলতে ঠোটে লিপস্টিক দিয়েছি শুধু।সামনের ছোট চুলগুলো ছেড়ে বাকিসব ব্যান্ড দিয়ে বাধা।সাইডব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে দাড়ালাম শুদ্ধর সামনে।উনি ফোনটা পকেটে পুরে তাকালেন আমার দিকে।চোখ নামিয়ে নিলাম।হুট করেই কোমড় জরিয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেন উনি আমাকে।চুলের ব্যান্ড খুলে দিয়ে এলোমেলো করে দিলেন চুলগুলো।তারপর আলতোভাবে ঠোটে আঙুল ছুইয়ে দিলেন।কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-একটু বেশিই বোল্ড লাগছিলো!

-ইনসিয়া ভাবিইইইই!

মাহির ডাক শুনে লাফিয়ে শুদ্ধর কাছ থেকে সরে দাড়ালাম আমি।শুদ্ধ দাতে দাত চেপে দরজা খুললেন।মাহির সেই ইনোসেন্ট হাসি।শুদ্ধ কড়া গলায় বললেন,

-তোকে একদম গেইটে দাড়াতে বললাম না?

-ইয়ে ভাবলাম দশ মিনিটের আগেই রেডি হয়ে গেছি,ইনসিয়া ভাবি রেডি হলো কি না দেখে আসি।তাই….

-তোর এই বাহানার তো….

আবারো ফোন বেজে উঠলো শুদ্ধর।বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে মাহির দিকে তাকিয়েই বললেন,

-আসছি আসছি!

ফোন রেখে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-যাওয়া যাক?

মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলাম।আমি জানি,তার বন্ধুমহলে আমি যেনো কোনোরকম অস্বস্তিতে না পরি এজন্যই মাহিকেও নিয়ে যাচ্ছেন উনি।আজ প্রথম শুদ্ধর সাথে ওনার বউয়ের পরিচয়ে বেরোচ্ছি।কিছুটা ভয়,কিছুটা লজ্জা,কিছুটা অস্বস্তি সব মিলিয়ে এক অচেনা অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে ভেতরটায়।তবে সবটার মধ্যেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি খুজে পাচ্ছি।শুদ্ধর কিছুটা স্বাভাবিকতা।আর আমার চাওয়া তো এটাই।এভাবে যেনো আস্তেআস্তে ঠিক হয়ে যায় সবকিছু।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here