তোর নামের রোদ্দুর২ পর্ব 20

0
1392

#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ২০

-বিয়ে!এক পবিত্র বাধনের নাম।দুটো মনের ভালোবাসার পুর্নতা।দুটো আত্মার মিলনের স্বীকারোক্তি।দুটো পরিবারের নতুন এক সম্পর্কের সেতুবন্ধন।অনেকগুলো মানুষের দোয়ার সম্মেলন।কাছের মানুষটাকে আরো কাছে পেয়ে তার ভালোবাসা,যত্ম,পাশে থাকার এক অনন্য প্রতিফলন নিয়ে নতুন সম্পর্কের সুচনা।বিয়ে!এই দু অক্ষরের সম্পর্কের মাঝেই লুকিয়ে সেই আপন মানুষটির প্রতি অর্পিত সমস্ত বিশ্বাস,ভরসা,ভালোবাসা,স্বচ্ছতা,দায়িত্ব,মান-অভিমান,বুঝতে শেখা,বুঝাতে শেখা,মানিয়ে নেওয়া সবকিছু!এগুলোতেই তো জীবনের সার্থকতা।ভালোবাসা।আর বিয়ে।

নানুভাই কথা শেষ করতেই তালি বাজিয়ে উঠলো সবাই।ধ্যান ভাঙলো আমার।আজও আকাশে বড়সড় একদম গোল চাদ উঠেছে।এজন্য আর কুপি জ্বালিয়ে বসিনি আমরা।এতো আলো,এতোবড় চাদ।পুর্নিমাই হবে হয়তো।পুর্নিমা সম্পর্কে ধারনা আমার এটুকোই।উঠোনে বসে নানুমনি নানুভাইকে সাথে নিয়ে আড্ডা বসেছে আজও।কেন্দ্রবিন্দু সীমা ভাবি আর সিফাত ভাইয়া।একথা সেকথায় ওদের উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলছিলো নানুভাই।তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তার কথাগুলো।সে কথাতেই এখনো হারিয়ে আছি যেনো।রিফাত ভাইয়া বললো,

-ওয়াহ্ নানুভাই।কি দিলে!তোমার কাছে বিয়ের সঙ্গা শুনে আমারই খুব বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে বিশ্বাস করো!

ইমরোজ ভাইয়া বললো,

-ভুল বলিস নি রিফাত।আমারো সেইম ফিলিংস্ হচ্ছে।

এবার ইশান ভাইয়া বললো,

-ওমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুষিও না শ্যালকগন।এই বিয়ে যে করেছে সেই বুঝেছে এর কি ফল!

তাপসী আপু বললো,

-তা ঠিক কি ফল পেয়েছো তুমি ইশান?আমিও একটু শুনি!

ইশান ভাইয়া উশখুশ করতে লাগলো।সিফাত ভাইয়া বলে উঠলো,

-এইতো,ডেমো পেয়ে গেছো গাইস?এই বিয়ের সঙ্গাটঙ্গা বাদ দিয়ে নানুভাইকে এটা তো জিজ্ঞাসা করো বিয়ের পরে বউয়ের টর্চার কেমন ছিলো।তাহলেই বুঝবে!

নানুভাই হেসে বললেন,

-হাহ!শোনো নানুভাইয়েরা।বিয়েটা হলো তোমাদের যুগের ভাষায় দিল্লি কা লাড্ডু।যো খায়া,য়ো পাস্তায়া।যো নেহি খায়া,য়ো ভি পাস্তায়া।তাই খেয়ে পস্তানোটাই বেশি চালাকির কাজ বলে আমি মনে করি।

-আমি কিন্তু নানুভাইয়ের কথায় একমত!

সবাই শুদ্ধর কথায় তারদিক তাকালো।আমিও তাকালাম।কিন্তু আমার দিক তাকিয়ে থেকে তার ওই বাকা হাসি দেখে চোখ‌ নামিয়ে নিলাম।সিফাত ভাইয়া বললো,

-ভাই!তোর এখনো ফুললি বিয়ে হয় নি।তুই সিঙ্গেল সমাজের সাথে একমত হবি সেটাই স্বাভাবিক।

-ফুললি বিয়ে?আমার তো….

চোখ বন্ধ করে নিলাম।কানে আঙুল দেওয়ারও তীব্র ইচ্ছা ছিলো।কিন্তু যীনাত আপু শুদ্ধকে শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলো,

-গাইস?শুদ্ধর ইনসুকে আংটি পরানোর সেরেমনি কিন্তু আমরা মিস করেছি।সে খেয়াল আছে তোদের?

সবাই জোরে জোরে সুর তুলে হ্যাঁ বলে সায় দিলো।ওদের ওই সুরেলী আওয়াজ একদম সুবিধের লাগেনি আমার।একটু শক্তভাবেই বললাম,

-আ্ আমার ঘুম পাচ্ছে।যাচ্ছি আমি।

সীমা ভাবি হাত ধরে ধীর গলায় বললো,

-যেও না।এভাবে নানুভাইদের সামনে থেকে গেলে খারাপ দেখাবে ব্যাপারটা।

ওরদিক তাকিয়ে বসেই রইলাম।নানুমনি বললো,

-তাহলে আজ হয়েই যাক‌ দ্বিতীয়বারের মতো?সবার সামনে?

হয়ে যাক মানে?কি হয়ে যাক?বিস্ময়ে তাকালাম নানুমনির দিকে।নানুভাই বললেন,

-হ্যাঁ।শুদ্ধ নানুভাই?আজ সবার সামনে ইনসিয়াকে আংটি পরাও তবে?সে সাহস রাখো তো?

শুদ্ধর দিকে তাকালাম।সে তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে।ডানহাতে বা হাতের সাদা শার্টের হাতাটা টান মেরে বললেন,

-অলওয়েজ।

ইয়ে বলে শব্দ করে তালি বাজালো সবাই।আমার কপালের ভাজ যেনো চোখে পরছে না কারোরই।ছোটমামী বললো,

-ইনসিয়া?আংটিটা খুলে শুদ্ধর হাতে দাও।ওটা আজ ও সবার সামনে পরিয়ে দিক তোমাকে।

আমি জামা মুঠো করে ধরলাম।শুদ্ধ শান্তভাবে বললেন,

-ওটা খুলতে হবে না।আমি আসছি।

এটুক বলেই উনি উঠে গেলেন।অবাক হয়েছি কিছুটা।বড়মামী বললেন,

-কোথায় গেলো ও?

ইমরোজ ভাইয়া বিরবিরিয়ে বললো,

-দেখো গ্রামের স্যাকড়াবাড়িতে হয়তো।মাঝরাতে স্বর্নকারকে ঘুম থেকে তুলে আংটি বানিয়ে নিয়ে আসবে।

কয়েকসেকেন্ড পরেই শুদ্ধ হাজির।সবাইকে পাশ কাটিয়ে আমার সামনে এসে এক হাটুতে ভর করে বসলেন উনি।আমি আরো কিছুটা গুটিসুটি হয়ে বসলাম।শুদ্ধ বললেন,

-আংটি রেডি আছে।আর আমিও।হাতের মালিকের অনুমতি চাচ্ছি।

সবাই মিলে হাত উঠানোর জন্য বলছে আমাকে।এদিকে অদ্ভুত শিহরন হচ্ছে শরীরজুড়ে।হাত পা কাপছে।ভয় হচ্ছে কেমন যেনো।চোখ বন্ধ রেখে কাপতে কাপতে বা হাত তুললাম আমি।পাশ থেকে তাপসী আপু বলে উঠলো,

-এতো সহজে হাত পাচ্ছিস না তুই শুদ্ধ!

আমি চোখ মেললাম।আমার হাতের উপরে,পাশে আরো সাত আটটে হাত।তাপসী আপু,যীনাত আপু,সীমা ভাবি,যুথি,নানুমনিও বাদ যায়নি।দুহাত তুলে সবগুলো ঢেকে দিয়েছে আমার হাত।যীনাত আপু বললো,

-পারলে ইনসুর দিকে তাকিয়েই ওর হাত বের করে আংটি পরিয়ে দে শুদ্ধ!

আমি শুদ্ধর দিকে তাকালাম।তার সেই‌ টেডিস্মাইল।আমার দিকে তাকিয়েই আমার হাতটা উপরে তুলে ধরলেন উনি।ওভাবে শব্দহীন হেসেই বললেন,

-এ বিষয়ে চ্যালেন্জ না করলেও পারো যীনাত আপু!

ভাইয়ারা আরেকদফা তালি বাজালো।আমি আবারো চোখ নামিয়ে নিলাম।নানুভাই বললেন,

-বেশ!এবার আংটি তো দেখাও শুদ্ধ! দেখি কেমন আংটি নিয়ে এসেছো?

উনি বা হাত সামনে তুলে ধরে মুঠো খুললেন।ঘাস পেচিয়ে বানানো একটা রিং।ওর উপর একটা জোনাকি পোকা বসে মিটমিটে জ্বলছে।তামিম ভাইয়া বললো,

-এ শুদ্ধ?এটা কি হলো?ভাবলাম কতো না স্পেশাল কোনো আংটি হবে হয় তো!আর তুই কি আনলি?ঘাসের প্যাঁচ?

তাপসী আপু ওর মাথায় চাটি মেরে বললো,

-গর্দভ!এজন্যই আজও তোরা সিঙ্গেল!রোমান্টিকতার র টাও বুঝিস না।দেখেছিস কতো সুন্দর লাগছে জিনিসটা!

ইশান ভাইয়া বললো,

-আরে,তোমরা মারামারি পরে করিও।শুদ্ধ?তুমি তাড়াতাড়ি পরিয়ে দাও ওটা!জোনাকিটা আবার উড়ে না যায়!

শুদ্ধ মুচকি হেসেই বললেন,

-জোনাকি জানে,ঠিক কখন ওর ওড়ার অনুমতি আছে।

উনি আমার মধ্যমা আঙুলে আংটিটা পড়িয়ে দিলেন।অনামিকা আঙুলে থাকা হীরের আংটিটার চেয়ে জোনাকির আলোটা আরো বেশি সুন্দর,বেশি উজ্জল।হাতটা একটু এগিয়ে চোখের সামনে ধরলাম।জোনাকিটা উড়ে গেলো।তবে শুদ্ধর হাত দিয়ে আলোকিত করে দিয়ে গেলো আমার চারপাশ।তার নামের উজ্জলতায়!

____________

মাঝরাতে ফোনের রিংটোনের শব্দটা যেনো শত হাজার হার্টজ কম্পাঙ্কে কানের কাছে বেজে উঠলো।এমনিতেও দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম,তার উপর কাচা ঘুমটা নষ্ট হওয়ার পথে।ইচ্ছা করছিলো ফোনটা ছুড়ে মারি।নিজেকে অতিকষ্টে সামলে ঘুমঘুম চোখে চরম বিরক্তিতে রিসিভ করলাম কলটা।ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

-জলদি বাইরে আয়!

ধরফরিয়ে উঠে বসলাম।চোখ কপালে আমার।এটা তো শুদ্ধের গলা!মোবাইল কান থেকে সরিয়ে দেখি সাইকো নামে সেইভ করা নাম্বার।উনি ঘুমোন নি এখনো?আর কি বলে কি লোকটা?পাগল হয়ে গেছে নাকি?

-আ্….

-হুশ!জেগে যাবে সবাই।তুই কথা বলিস না।কল কাটছি আমি।ম্যাসেজ চেইক কর!

কলটা কেটে দিলেন উনি।একটুপরই ম্যাসেজ,

“তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আয়।কেউ যেনো টের না পায়।আজ যীনাত আপুকেও বলি নি”

কোথায় যাবো?কি বলেননি উনি যীনাত আপুকে?রিপ্লাই লিখতে যাবো,আরেকটা ম্যাসেজ!

“একটা প্রশ্নেরও উত্তর পাবি না ঘরে বসে।বেরিয়ে আয় চুপচাপ!”

হুহ!বললো,আর হলো!এতো রাতে সে পাগল হয়েছে বলে আমিও পাগলের মতো বেরোবো রুম থেকে?যাবো না!ম্যাসেজ টাইপ করাও শেষ।সেন্ড করার সময়ই আরেকটা ম্যাসেজ!

“দেখ সিয়া! ভালোয় ভালোয় বাইরে না আসলে এই টিনের ঘরের বেড়ায় এমন বারি লাগাবো,সারা গ্রাম জেগে যাবে।তারপর ঘরে ঢুকে সোজা তোকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসবো।ভাল্লাগবে?”

আর কোনো উপায় নেই।যেতেই হবে।একটা শ্বাস ফেলে নিজের দিকে তাকালাম।আবারো ম্যাসেজ!

” কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে।এজ পার আই নো,এই ঘর থেকে বেরোতে পনেরো সেকেন্ডের বেশি সময় লাগার কথা না!”

তব্দা মেরে তখনও বসে আমি।এবার মোবাইলটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে দিলাম।রাগ উঠলো।তবুও “রাগ করে‌ লাভ নেই,রওনা হ!” কথাটা কেউ যেনো বলে দিয়ে গেলো আমার কানে।উকিঝুকি দিয়ে তাকালাম যীনাত আপুর দিকে।কে জানে ও জেগে আছে কি না!ইরাম,যুই ঘুমিয়েছে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ফিসফিসিয়ে ডাক লাগালাম,

-য্ যীনাত আপু?

….

-আপু?

….

-যীনাত আপু!

শেষবার জোরেই চেচালাম।জাগে নি ও এখনো।যাক।ঘুমিয়েছে তার মানে।ম্যাসেজ আসলো,

“অলরেডি আট সেকেন্ড!”

একটা জোরে‌ শ্বাস ফেলে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে ইয়া বড় ঘোমটা টেনে নিলাম।চোরের মতো পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসলাম ঘর থেকে।দরজাটা লাগিয়ে সবে পিছন ফিরতে যাবো,কেউ হাত ধরে টান লাগালো আমার।চেচানো আগেই সে মানুষটার পেছনের অবয়ব দেখে থেমে গেলাম।সেই সাদা শার্ট।শুদ্ধ!মোটামুটি দৌড় লাগিয়েছেন উনি আমাকে নিয়ে।কোনোদিক না তাকিয়ে পা চালালাম তার সাথেই।

#চলবে….

[রিভিউ,রেসপন্স দেখে রাতে আরেকটা স্পেশাল পার্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো?
হ্যাপি রিডিং?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here