#তোর_নামের_রোদ্দুর-২
#লেখনিতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্বঃ১৬
ব্যালকনিতে দাড়িয়ে তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে আছি শুদ্ধর দিকে।আর সে লোকটা রেলিংয়ে ঠেকানো মইটাতে কাচুমাচু মুখ করে দাড়িয়ে।ব্যালকনিতে গ্রিল নেই,শুধু উচু করে রেলিং দেওয়া।তার সাথে এটাচড্ করে ফুলের টব রাখার জন্য কিছুটা গ্রিল লাগানো।ইরাম কয়েকটা ফুলগাছ লাগিয়েছে ওতে।সেই গাছের ফুলগুলো ধরছেন আর এদিকওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করছেন শুদ্ধ।বেশ কিছুটা সময় পর উনি মুখ খুললেন।আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন,
-ইয়ে,মানে,সকাল সকাল ওমন লুক দিচ্ছিস কেনো?
-ঠিক কি লুক দেবো?দেওয়ার মতো কি মুখটা রেখেছেন আপনি আমার?
-অব্ আ্ আমি কি দেখেছিলাম তখন শশ্,আইমিন ছোটকাকু ওখানে ছিলো?আমি তো…
আমি মুখ ভেঙচিয়েই বললাম,
-তা দেখবেন কেনো?জাহাপনা তখন তার বিখ্যাত ঘড়ি পরতে আর হুইস্টলিং করতে ব্যস্ত ছিলেন যে!
উনি তাকালেন আমার দিকে।গাল ফুলিয়ে বললেন,
-ভুল হয়ে গেছে।আর হবে না।
ওই চেহারায় বাচ্চামো দেখে হাসি সংবরন করলাম অতিকষ্টে।বিরক্তি দেখিয়ে অন্যদিক তাকালাম।কাল রাতে আব্বুকে দেখে কেস খেয়েছে এমন একটা লুক দিলো।পরক্ষনেই মোবাইলটা কানে ধরে ” আসছি ইমরোজ ” বলেই সে ভো দৌড়।পাশেররুম থেকে ইমরোজ ভাইয়া নাকি কল করেছে তাকে।ঝুলে রইলাম বেচারী আমি।আব্বুর দিকে তাকাইনি আর।পাথর হয়ে নিচদিক তাকিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম।আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে ” অনেক রাত হয়েছে,ঘুমোও ” বলে চলে গেলেন।দরজা লক করে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম কতোক্ষন।যেনো কেউ গলা টিপে ধরে রেখেছিলো আমাকে।
ঘুমিয়ে গেছি কখন জানিই না।সকালে উঠে নামাজটা সেরে সবে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছি,ভুতের মতো কোথথেকে মই পরলো সামনের রেলিংয়ে।আবছা আলোতে দেখলাম শুদ্ধ উঠে আসছেন মই বেয়ে।ব্যস!হয়ে গেলো!রাতে আব্বু শুনায়নি তো,সকাল সকাল মই বেয়ে এসেছে আমার ঝাড়ি শুনতে।শুদ্ধ আদুরে গলাতে বললেন,
-এখন তো তাকা আমার দিকে ভালো করে?
তারদিক ঘুরে বুকে হাত গুজে বললাম,
-কথা বলার সময় চারপাশে তাকিয়ে দেখে কথা বলা যায় না?একবার বলতে শুরু করলে হুশ থাকে না?
-বললাম তো ভুল হয়ে গেছে!
-তখন আপনি আমাকে ওই নামে ডাকলেন কেনো?
-কোন নামে?
-ও্ ওই যে,ওই নামে।
-কোন নামের কথা বলছিস তুই সিয়া?
-কিছু না।নেমে যান।রুমে যান।কেউ দেখলে ঝামেলা হবে।
উনি বড়সড় হাসি দিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন।যেনো আসার অনুমতি দিলাম তাকে আরো।
-আরে আরে!কর্…
-চুপ!ওরা উঠে যাবে!
-হোয়াট?এখানে কেনো?কাল রাতে আমার নাককান কেটে শান্তি হয়নি?এখন ইরাম,যীনাত আপু দেখলে কি হবে?
-এখন সেইইইই কালকের অতীত টেনে বর্তমানটাকে নষ্ট করছিস কেনো বলতো সিয়া?দেখ না!এখনই সূর্য উঠবে।পুব আকাশে…
-সেই কালকের অতীত?আপনার কোনো ধারনা আছে তখন….
-উফ্!তোরা বাপ মেয়েতে মিলে আমার মুড খারাপ করার পিএইচডি করে রেখেছিস মনে হয়।রাতে ভাবলাম একটু কথা বলবো,শশুড় হাজির।এখন একটু কথা বলবো,শশুড়ের মেয়ের মুখ থেকে শশুড়ের নামই সরছেই না।কপালই খারাপ আমার!
-দেখুন আপনি আমার আব্বুকে ওভাবে বলতে পারেন না!
-জানি তো!লাগে তোর!যাই হোক।শশুড়টা রাগ করেছে সিয়া।চায় নি এতো তাড়াতাড়ি তোকে আংটি পরানোর বিষয়টা সবার সামনে আসুক,চায়নি এতো তাড়াতাড়ি তোর বিয়েটা হোক।
-বুঝেছেন তবে?তাহলে এতো তাড়াহুড়োই বা কেনো করছেন?আমি তো আর মর্…
উনি হুট করেই আমার ঘাড়ের চুল মুঠো করে ধরলেন।চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি।উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে দাতে দাত চেপে বললেন,
-আজ যা বলতে যাচ্ছিলি,তা আরেকদিন বললে আই সোয়ার আমি কি করবো জানি না!
এটুক বলেই উনি ছেড়ে দিলেন চুলগুলো।চোখ মেলে তাকালাম তারদিক।অন্যদিকে তাকিয়ে উনি।নিজের উপরই রাগ হলো।সকাল সকাল রাগিয়ে দিলাম লোকটাকে।একপা এগিয়ে বললাম,
-স্ সরাসরি বউ বলে ডেকেছিলেন কেনো রাতে?
উনি আমারদিক ঘুরলেন।মাথা নিচু করে রইলাম।শুদ্ধ বললেন,
-বউ হস তুই আমার।আর কি বলবো?
-সবাই তো….
-হুম?সবাই তো?
-আব্বু যদি কিছু বলতো?
-বললে বলতো।আমিও রেজেস্ট্রি পেপার দেখিয়ে দিতাম।
-তখন তো পালিয়েই গেলেন।
-ইট ওয়াজ আ ফর্মালিটি।শশুড়মশাইকে দেখালাম,লজ্জা পেয়েছি।আদারওয়াইজ,বলে দিতে পারবো,তুই সত্যিই আমার বউ।ওইটুক সাহস রাখে এই শুদ্ধ!
-বেশি সাহস দেখাতে গেলে বের করে দেবে আপনাকে শেহনাজ মন্জিল থেকে।
-বউ নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যাবো।
-যদি রাগ করে বউটাকে না দেয়?
-তুলে নিয়ে যাবো!কোনো কথা হবে না!
মাথা তুলে তাকালাম তার দিকে আমি।সূর্য উঠেছে।রোদ্দুর গাছের ডালপালাগুলোর ফাক ফোকর দিয়ে উকি দিচ্ছে।শুদ্ধর মুখের কিছু অংশে পরেছে।আর সে বাকা হাসছে।উনি আমার কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে বললেন,
-তোর জন্য সব করতে পারি!সব!
চোখ নামিয়ে নিলাম আবারো।শুদ্ধ চিন্তার ভাব নিয়ে বললেন,
-আচ্ছা সিয়া?তোর আব্বুটার রাগ কমাই কি করে বলতো?তুইই তো বেশি চিনিস তাকে।বলনা?
-তার রাগ নিয়ে পরলেন যে?
-ওইটাই তো!তোর আব্বু একটু রেগে আমার উপর।মনে হলো এ নিয়ে তুইই কিছুটা ডিসটার্বড।তাই ভাবছি,দেখি একটু ট্রাই মেরে।কি হয়!
-ঠিক বলেছেন।আব্বুর রাগ না মিটলে আমিও কিন্তু আপনার উপর র্….
উনি ঠোটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিলেন আমাকে।ফিসফিসিয়ে বললেন,
-হুশশশ্!দু বছর তোর যে অভিমানটা ছিলো তাই কুড়ে কুড়ে খেয়েছে আমাকে।রাগের এতোটুকো জায়গা রাখবো না আমি সিয়া!আর বলেছি তো!তুই আমার!সাময়িক অভিমান করলেও,তুই তো আমাকেই ভালোবাসিস।আর তাই তোকে আমারই হতে হবে।আমি ঠিক নিজের করে নেবো তোকে।বাই হুক,অর বাই ক্রুক।
ওনার হাত সরিয়ে পিছিয়ে দাড়িয়ে বললাম,
-থ্রেট দিচ্ছেন?
উনি একটু এগিয়ে বললেন,
-উম্?থ্রেট?না।একদমই না।কজ অলরেডি তুই আমার।আলাদাভাবে ধমকি?নট নিডেড!
-উহুম উহুম!
লাফিয়ে সরে দাড়ালাম।যীনাত আপু দাড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।আমি ওড়না আঙুলে পেচাতে লাগলাম।আপু এগিয়ে এসে বললো,
-শুদ্ধ?ইনসু তো বরাবরই বোকা।তুই এমনটা করলি কেনো?রুমের দরজাটা দিয়েই আসতি প্রতিদিনের মতো।আমি তো তোর সাইডেই।আচ্ছা মই বেয়ে এলি তো এলি,রুমের দিকে তো তাকাবি একবার?আমি তো দরজা লাগাই নি বাইরে যাওয়ার সময়।যদি অন্য কেউ ঢুকে পরতো?আর তো আর ইরুটা বেডেই বসে।
আমি বড়বড় চোখ করে বেডের দিকে তাকালাম।ইরাম তৎক্ষনাৎ “আমি কিছু দেখি নি” বলে মাথার উপর অবদি চাদর টেনে টান হয়ে শুয়ে পরলো।চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম আমার।শুদ্ধকে দেখলাম ভাবলেশহীনভাবে হাসছেন।যীনাত আপু বললো,
-কোনদিক দিয়ে বেরোবি শুদ্ধ?
উনি লাফিয়ে মইয়ে নেমে যেতে যেতে বললেন,
-মই বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে প্রেম করার মজাটাই আলাদা যীনাত আপু।আসছি।
তব্দা মেরে দাড়িয়ে রইলাম।যীনাত আপু চুল টেনে দিয়ে বললো,
-বেকুবের মতো দাড়িয়ে কি ভাবছিস?তোর সব কথার একটাই কথা।তুই অনেক লাকি ইনসু।যদিও জন্মান্তর বিশ্বাস করি না।কিন্তু লোকে বলে না?জীবনের কিছু কিছু প্রাপ্তি কয়েক জন্ম তপস্যার ফল।তোর জীবনের সেরকম প্রাপ্তি হলো শুদ্ধ নামক ভালোবাসা।ওর মতোন একজন প্রেমিক পুরুষ।ওর মতো উডবি।যা সবার কপালে জোটে না।অনেক সৌভাগ্যবতী তুই।অনেক।
আপু চলে গেলো।কানে বাজতে লাগলো ওর বলা কথাগুলো।শুদ্ধর মতো ভালোবাসা।শুদ্ধর ভালোবাসা।সবটাও আমার।হ্যাঁ।লাকি আমি!সত্যিই তাকে পেয়ে ধন্য আমার জীবন।
_____________
ডাইনিংয়ে সবাই খেতে বসেছে।লেইট লতিফ হিসেবে সিফাত ভাইয়া আর ইরাম শাস্তিভোগ করছে।ইরাম কিচেন থেকে খাবার টেবিলে সার্ভ করছে,সিফাত ভাইয়া গাল ফুলিয়ে কি লাগবে,আরেকটু দেই বলে সবাইকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।সবাই যার যার মতো ওদেরকে নিয়ে মজা নিচ্ছে আর সীমা ভাবি মুখ লুকিয়ে হাসছে।দীদুন বলে উঠলো,
-সিফাত সীমার একটু বাইরে বেরোনো প্রয়োজন।কি বলো সবাই?
আমরা সবাই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ বলে সায় দিলাম।আম্মু বললো,
-কিন্তু মা,মাঝখানে আর মাত্র তিনদিনই তো আছে।এরমধ্যে ওরা বেরোবে?
মেজোমাও বললো,
-হ্যাঁ তাইতো মা।বাড়ির ছেলে,ছেলেবউকে ছাড়া ওদের দাদুভাইয়ের….
দীদুন মেজোমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-তা কখন বললাম ওদের ছাড়া?ওরাও থাকবে তো।
মেজোকাকু বললেন,
-মা?এখন বেরোনোর দরকার নেই ওদের।সবটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক,তারপর না হয়…
এবার সেজোকাকু বললেন,
-তার পরপরই শেহনাজ মন্জিলে আরেকটা বিয়ে।আজাদ ম্যানশনের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান।সেটা কেনো ভুলে যাচ্ছেন ভাই?আপনাদের সবাইকেই তো দুদিকটাই সামলাতে হবে তাইনা?
খাওয়া বাদ আমার।ডানহাত টেবিলের উপরই,বা হাতে জামা খামচে ধরেছি।আড়চোখে একবার শুদ্ধর দিকে তাকাতে যাবো,পাশে বসা তাপসী আপুর হাসিটা দেখে আর হলো না।চোখ আব্বুর দিকে আমার।সে শক্তভাবে বসে।তবে স্বাভাবিক গলায় সিফাত ভাইয়াকে ডাল না দিতে মানা করছেন।দীদুন বললো,
-ওদের বেরোনো বলতে একটা ফ্যামিলি ট্রিপ বুঝিয়েছি আমি।সিফাতের নানুবাড়ি তো কাছেই,দু ঘন্টার পথ।একটু গ্রাম এলাকা আছে।বাচ্চারা সবাই মিলে ওখান থেকেই ঘুরে আসুক দুটো দিনের জন্য।সাথে তোমরা বড়রাও চলে যাও কেউ কেউ।
ইয়েএএএ বলে আপু ভাইয়ারা উল্লাস শুরু করে দিলো।আমিও স্বাভাবিক হলাম কিছুটা।সিফাত ভাইয়ার নানুবাড়ি গিয়েছিলাম একবার।গ্রামবাংলার মধ্যেই পরে জায়গাটা।অনেক সুন্দর।ওখানকার সবাই বেশ ভালোবাসেও আমাকে।আব্বু খেতে খেতে গম্ভীরভাবে বললেন,
-সবাই চলে যাক,ইনসিয়া যাবে না।
সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে তারদিক তাকালো।আমিও কিঞ্চিত অবাক হলাম।যীনাত আপু বললো,
-কি বলছেন ছোটমামা?সবাই যাবে আর…
বড়কাকু এতোক্ষনে কথা বললেন,
-কেনো ইয়াদ?যাবে না কেনো?বাচ্চা মেয়ে,সবাই একসাথে মজা করবে,ও কেনো যাবে না তবে?
আব্বু চুপই ছিলেন।দীদুন ভারী গলায় বললো,
-ইনসু গেলে কি সমস্যা ইয়াদ?
আব্বু তার দিকে তাকালেন।স্বাভাবিকভাবে বললেন,
-মা,ওর পড়াশোনার কথাটাও তো ভাবতে হবে তাইনা?এমনিতেও সিফাতের বিয়েটা নিয়ে ওর স্টাডি অনেকটাই হ্যাম্পার হয়েছে।এতোগুলো দিন পড়াশোনা একদমই ঠিকমতো হয়নি ওর।এখন দুটো দিন বাসায় থেকে কিছুটা পড়াশোনা করুক।
জানতাম।অবশ্যই কোনো কারন আছে তার আমাকে যেতে দিতে না চাওয়ার।মুচকি হেসে খেতে লাগলাম আমি।সে বলে দিয়েছে,যাবোনা।শুদ্ধের কথা মনে পরতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো হঠাৎই।হয়তো সে চেয়েছিলো,আমিও যাই তাদের সাথে,তার সাথে।তবুও খারাপ লাগাটা প্রকাশ করলাম না।দীদুন আবারো বললো,
-পড়াশোনা তো বাদ দিতে বলছি না।যেখানে সবাই…
দীদুনকে শেষ করতে না দিয়ে শুদ্ধ বলে উঠলেন,
-সিয়া থাকুক।যেতে হবে না ওর।
সবাই বিস্ময়ে তারদিক তাকালো এবার।আমিও।সে খাওয়ায় পুর্ন মনোযোগ রেখে স্বাভাবিক গলায় বললো,
-ছোটকাকু ঠিকই বলেছে।সিয়া বাসার বাইরে নাই যাক।ওর এখন পড়ায় কনসেনট্রেট করাটাই বেশি দরকার।
হাসি ফুটলো মুখে।আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মানুষদুটোর মতের এতোটা মিল,এর থেকে বড় কিছু আর কি হতে পারে?তকদির তার ভালো ভালো দিকগুলোর সবটা আমার জীবনে বর্ষিত করেছে।নিজের উপর নিজেরই হিংসে হচ্ছে এখন আমার।
#চলবে…
[কাল শেষের কথাগুলো সিয়ার বাবার ছিলো না।ওটা মনে মনে সিয়া নিজেই নিজেকে কটাক্ষ করে বলেছিলো?
অনেকেই ভুল বুঝেছেন,হয়তো বুঝাতে না পারার ভুলটা আমারই।তাই ক্লিয়ার করার প্রয়োজনবোধ হলো।হ্যাপি রিডিং?]