#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৩৩
জানালা দিয়ে পুরো আকাশটা দেখা যাচ্ছে। আজ আকাশে চাঁদ তারা কিছুই নেই। কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। দূর আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি চোখে পড়ছে। বিছানায় বসে সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে ঈশা। অনেক রাত হয়েছে। এখনো ইভান হসপিটালেই। এখন মেঘলার অবস্থা একটু স্থিতিশীল। কিন্তু গত কয়েকদিনে ইভানের ঘুম খাওয়া সব হারাম হয়ে গেছে। টেনশন স্ট্রেচ সব মিলে বাজে অবস্থা। ঈশার সাথে দুই মিনিট বসে কথা বলার সময়ও হয়নি তার। ঈশারও রাতে ঘুম হয়না। ইভান রাতে হসপিটালেই থাকে কয়েকদিন থেকে। পরিক্ষার জন্য পড়ালেখা করে সময়টা পার হয়ে গেছে। কিন্তু আজ পরিক্ষা শেষ। পড়ালেখাও নেই। সময়টা যেন বিষাদময় হয়ে উঠেছে। একাকিত্তের জালে জড়িয়ে থমকে আছে সময়। আজ মন না চাইলেও পরিস্থিতির কাছে বিশ্বাসটাও হার মেনে দমে যেতে চাইছে। ঈশা উঠে কফি বানানোর জন্য রান্না ঘরে গেলো। চুলা অন করে দিতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। ঈশা একটু অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল। এই সময় কে আসবে। তারপর মনে হল ইফতি হসপিটালেই আছে। হয়তো সে এসেছে। চুলা বন্ধ করে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলেই ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। ইভানের এই সময় কোনভাবেই আসার কথা না। আর আসলেও ঈশার জানার কথা ছিল। ইভান ঈশাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–আমি কি এখানেই দাড়িয়ে থাকবো?
ঈশা সরে দাঁড়ালো। ইভান ভিতরে ঢুকে টেবিলে গিয়ে বসে পড়ল। পানি ঢেলে খেয়ে গ্লাসটা রেখে দিলো। ঈশা দরজা লাগিয়ে দিয়ে ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। সাভাবিকভাবেই বলল
–তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার রেডি করছি।
ইভান ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–আমি খেয়েছি।
বলেই উঠে যেতে যেতে বলল
–ঘরে আয়।
ঈশা দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে ঘরে গেলো। ঘরে গিয়ে দেখে ইভান বিছানায় বসে ফোনে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে। ঈশা সামনে বসে কাপটা এগিয়ে দিলো। ইভান চোখ তুলে কাপটা নিয়ে নিলো। ঈশার দিকে একবার তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কাপটা পাশে রেখে ঈশার হাত ধরল। ঈশা তখনও নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঈশার গালে হাত রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ক্লান্তি আর অসহায়ত্ব চেহারায় স্পষ্ট দৃশ্যমান। ঈশা গালে রাখা ইভানের হাতটা ধরে বলল
–টায়ার্ড লাগছে?
ইভান করুন চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–উহু! কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ মিস করছি আমার জান টাকে।
ঈশা কথা বলল না কিন্তু শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সেই দৃষ্টি দেখে ঈশার মনের কথা বুঝতে পারছে। নাবলেও অনেক কিছুই বলে দিলো সে। ইভান চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–বিশ্বাস ছাড়া ভালবাসা অর্থহীন। যেই মানুষটা তোকে নিজের জীবনের থেকেও বেশী ভালোবাসে সেই মানুষটাকে বিশ্বাস করা কি খুব কঠিন কাজ? কখনও যে মানুষটা তোকে কোন কষ্ট পেতে দেয়নি সেই মানুষটাই যখন তোর অভিমানের কারন হয়! তোর সব থেকে বড় কষ্টের কারন হয় তখন সেই মানুষটার কতটা কষ্ট হয় সেটা আন্দাজ করাও তোর পক্ষে সম্ভব না।
ঈশা খুব শান্ত ভাবে বলল
–আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। অনেক বেশী বিশ্বাস করি।
ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়েই বলল
–হয়তো।
ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–এখন কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না।
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। খুব শান্ত ভাবে বলল
–আমি বোধ হয় তোকে একটু বেশিই বুঝি তাই না? এরকম না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। অনেক কিছু গোপন থেকে যেত। প্রতিটা মানুষের জিবনে কিছু গোপন থাকা উচিৎ যা তার একান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে পুরোটাই ব্যতিক্রম।
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–সবই বোঝ তাহলে এরকম ব্যাবহার কেন করছ?
ইভান ঈশার দিকে তাকাল। তার হাত থেকে কাপটা নিয়ে পাশে রেখে দিলো। দুই হাতে গাল ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
–সরি জান। আই এম রিয়েলি সরি। আমি সত্যিই অসহায় ছিলাম। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে। আর……।
ইভানের কথা শেষ হল না। ঈশা তার আগেই কাপা কাপা গলায় বলল
–আমাকে এসব কেন বলছ? আমি সব জানি। তুমি তো ইচ্ছা করে কষ্ট দাওনি।
ঈশা আর কিছু বলতে পারলো না। ইভান তার ঠোট দুটো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো। প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল। ঈশা খানিকটা কেঁপে উঠলো আচমকা শব্দে। ইভানের পিঠের শার্ট খামচে ধরল। ইভান ঈশাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে তুমুল শব্দে একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছে। মুষল ধারে বৃষ্টি আছড়ে পড়ল পৃথিবীর বুকে। জানালার এক পাশে কাঁচ সামান্য খোলা আছে। দমকা বাতাসে জানালার পর্দা ফড়ফড়িয়ে উড়ছে। এলোমেলো ভাবে বৃষ্টির ফোটা আছড়ে পড়ছে সাদা মেঝেতে। ঘরের উষ্ণ পরিবেশটাও সেই বৃষ্টির তোড়ে কিছুটা শীতল হল।
————–
কপালে হালকা স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঈশার। সকাল সকাল চোখ খুলেই ইভানের হাস্যজ্জল চেহারাটা দেখেই ঈশার দিন শুরু হল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ঈশা চোখ খুলে তাকাতেই বলল
–গুড মর্নিং জান!
ঈশা একটু হেসে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–গুড মর্নিং!
ইভান কফির কাপটা সামনে এগিয়ে দিলো। ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান খুব শান্ত ভাবে বলল
–কাল রাতে আমার বউটা খুব যত্ন করে কফি বানিয়েছিল। কিন্তু আফসোস! খাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম সকাল সকাল নিজে হাত কফি বানিয়ে বউকে খাওয়াই।
ঈশা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একটু হেসে গালে হাত দিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে আয়। একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো।
ঈশা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল
–কয়টা বাজে?
ইভান উঠে দাড়িয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–বেশী না মাত্র ৯ টা।
ঈশা চমকে উঠলো। এতক্ষন ঘুমিয়েছে সে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–টায়ার্ড থাকলে এতো সময় ঘুমানোটা অস্বাভাবিক না।
ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। কাপটা পাশে রেখে উঠে গেলো। কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে যেতেই ইভান বলল
–তাড়াতাড়ি কিন্তু! হসপিটালে যেতে হবে।
ঈশা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখে ইভান ঘরে নেই। ভালো করে চুল মুছে তোয়ালেটা মেলে দিয়ে চলে গেলো বাইরে। ইভান টেবিলে বসে ঈশার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশা ইভানের পাশে বসলো। ইমতিয়াজ রহমান বলল
–মেঘলা এখন কেমন আছে?
ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ভালো আছে। কাল লন্ডনে চলে যাবে। ওর বাবা মা ওখানেই ওর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেছে। মেঘলাও রাজি হয়েছে যেতে।
সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ইভানের কথা শুনে। কয়েক দিনের শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সবাই অস্থির হয়ে উঠেছিল। আজ অনেকটাই হালকা মনে হচ্ছে সেই পরিবেশটা। ইভানের মা আমতা আমতা করে বলল
–বলছিলাম কি বিয়ের পর তো এতো ঝামেলার মাঝে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। এখন তো আর তেমন কোন ঝামেলা নেই। তাই দুজনে যদি কোথাও থেকে ঘুরে আসতে।
ঈশা একটু অসস্তিতে পড়ে গেলো। ইমতিয়াজ রহমান তাল মিলিয়ে বলল
–কোথায় যেতে চাও ঈশার সাথে কথা বলে ঠিক করে নাও। আমি ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি।
ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ঈশার ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হোক তারপর ভাবা যাবে।
আর কেউ কোন কথা বাড়াল না। খাওয়া শেষ করে ইভান ঘরে গিয়ে রেডি হচ্ছিল। ঈশা ঘরে ঢুকে দেখল ইভান চুলের ভাজে হাত দিয়ে ঠিক করছে। ঈশা পাশে দাড়াতেই ইভান তার দিকে তাকাল। স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কিছু বলবি না?
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কি বলবো?
ইভান থেমে গেলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আজ একটু বেশিই বিশ্বাস করছিস মনে হচ্ছে।
ঈশা ইভানের শার্টের উপরের বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল
–যেখানেই যাও দিন শেষে আমার কাছেই ফিরতে হবে। তুমি বাধ্য।
কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে এনে ইভান কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
–সব ব্যবস্থা করে রেখেছিস তাহলে!
————–
সময় খুব দ্রুত পেরিয়ে যায়। সুখের সময় হলে সেটা মনে হয় আরও দ্রুত চলে যায়। বর্ষা থেকে শুরু করে একে একে ঋতু পেরিয়ে শীত চলে এসেছে। প্রায় শেষের দিকে। দিনের বেলা তেমন ঠাণ্ডা নাহলেও রাতের দিকে ঠাণ্ডাটা বেশ জেঁকে বসে। এই ঠাণ্ডার মাঝে এখন এক কাপ গরম চা বা কফি কিছু একটা হলে বেশ হতো। ঈশা ঘাড়ে ব্যাথা অনুভব করতেই হাত দিলো। ঘাড় এদিক সেদিক ফিরিয়ে ঠিক করে নিয়ে আবার বইটা তুলে চোখের সামনে ধরল। তার ফাইনাল পরিক্ষা চলছে। ভীষণ চাপের মধ্যে আছে সে। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়তেই কারও উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে ফেলল। ইভান তাকে এক হাতে জড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বইটা হাত থেকে নিয়ে বলল
–অনেক রাত হয়েছে। এখন ঘুমাতে হবে তো।
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–এখনো পড়া শেষ করতেই পারিনি।
ইভান তার দিকে তাকাল। চোখের নিচে কালো হয়ে আছে। চেহারার উজ্জ্যলতা কমে যাচ্ছে। দুর্বল দেখাচ্ছে তাকে। ঈশাকে এই অবস্থায় দেখে ইভানের কষ্ট হল। ঈশার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। কম্বলটা টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে বলল
–আর না। এখন ঘুমাবি। এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বি। তুই মোটেও নিজের খেয়াল রাখিস না।
ঈশা সত্যিই অনেক ক্লান্ত। উষ্ণতা আর আরামে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। খুব শান্তি লাগছে। মুখ দিয়ে কথাও উচ্চারণ করতে ইচ্ছা করছে না। চুপ করে শুয়ে থাকলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। ইভান বুঝতে পারলো ঈশার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইভানের কিছু কাজ আছে। তাই ঈশাকে ঠিক করে শুয়ে দিয়ে উঠে পড়ল। ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে চুল গুলো ঠিক করে দিলো। মুখটা কেমন মলিন লাগছে। পরিক্ষার কারনে প্রচুর স্ট্রেচ নিচ্ছে। নিজের দিকে খেয়ালও করছে না। ইভানও কয়েকদিন ব্যস্ত থাকায় খুব একটা খেয়াল রাখতে পারেনি। পরিবেশটা একটু চেঞ্জ করা দরকার। আর কয়েকটা পরিক্ষা বাকি আছে ঈশার। তারপরেই শেষ। শেষ হলেই কোথাও থেকে ঘুরে আসবে দুজনে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় ঘুরতে যাবে সেটা নিয়েই ভাবতে লাগলো ইভান। ঈশার পাহাড় পছন্দ। পাহাড় অথবা সমুদ্র কোথাও একটা যেতে পারে। ঈশাকেই জিজ্ঞেস করবে সেটা। তারপর পরিক্ষা শেষ হলেই চলে যাবে বেড়াতে। ঈশাকে আগে থেকে কিছুই জানাবে না। সারপ্রাইজ দিবে সে। ইভানের ভাবনার মাঝেই ঈশা নড়েচড়ে উঠলো। ইভান সেদিকে একবার তাকাল। ঈশাকে আবার থেমে যেতে দেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ঈশা চট করে উঠে বসলো। এভাবে উঠে বসাতে ইভান একটু অবাক হল। তার কাছে গিয়ে বলল
–কি হয়েছে জান? স্বপ্ন দেখেছিস?
ঈশা কোন কথা বলতে পারলো না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। তীব্র শিতেও ঘেমে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ইভান ঘাম মুছে দিয়ে শান্ত ভাবে ডাকল
–ঈশা খারাপ লাগছে? কি হয়েছে আমাকে বল?
ঈশার কথা বলার ক্ষমতা নেই। খুব কষ্ট করে ইভানের এক হাত শক্ত করে ধরে অস্পষ্ট সরে বলল
–কষ্ট হচ্ছে!
চলবে………
(এই গল্পটা শেষ হয়ে গেলে আপাতত কোন গল্প আসবে না হয়তো। একটু ব্যস্ত থাকবো। গল্পটা শেষ হলে কে কে মিস করবেন একটু দেখতে চাই।)